somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামের সমালোচনা ও তার জবাব ১

২৯ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইসলামের সমালোচনা ও তার জবাব
ড. সাঈদ ইসমাঈল চীনী
অনুবাদ: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সূচীপত্র

ক্র শিরোনাম পৃষ্ঠা
১ ভূমিকা
২ আকীদা, ইবাদাত ও আইনের সমষ্টির নাম ইসলাম
৩ মৌলিক আকীদা ও ইবাদাতগুলো কী কী
৪ চৌদ্দশ বছর আগের শরী‘আত কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব
৫ একজন মুসলিম কর্তৃক এমন প্রশ্ন উত্থাপনের বিধান কী
৬ ইসলামী শরী‘আহ ও বাস্তবতার সম্পর্ক
৭ ইসলামী শরী‘আর স্থায়ীত্বের প্রধান কারণ কী কী
৮ ইসলামে মানবাধিকার
৯ ইসলামে ইনসাফ ও সমতার অর্থ
১০ ইসলামে স্বাধীনতার অর্থ
১১ নাগরিকের বাক-স্বাধীনতা
১২ ইসলামে দাসত্ব বলতে কী বুঝায়
১৩ রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে ইসলাম
১৪ জাতীয়তা ও ধর্মে বিভিন্নতা সম্পর্কে ইসলাম কী বলে
১৫ ইসলামে মানবিক সম্পর্ক
১৬ আন্তধর্ম সংলাপ বিষয়ে ইসলামের অবস্থান
১৭ মানবাধিকার সংগঠনগুলো সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান
১৮ কল্যাণ প্রচারে আগ্রহ
১৯ মুসলিমরা ইসলাম প্রচারে আগ্রহী কেন
২০ ইসলামী রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের তৎপরতা নিষিদ্ধ কেন
২১ সৌদি আরবে অন্য ধর্মের প্রকাশ্য চর্চা নিষিদ্ধ কেন
২২ ইসলাম সন্ত্রাস ও উগ্রতাকে প্রত্যাখ্যান করে
২৩ আত্মরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক ভীতিপ্রদর্শনের মধ্যে পার্থক্য করবো কীভাবে
২৪ ইসলাম কীভাবে সন্ত্রাস প্রতিরোধ করে
২৫ কুরআন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কি সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ ডেকে আনে
২৬ ইসলামে নারী
২৭ পুরুষের তুলনায় নারীর মর্যাদা
২৮ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অবস্থান
২৯ কিছু বিচারে নারীর সাক্ষ্য পুরুষের অর্ধেক কেন
৩০ নারীর উত্তরাধিকার কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের অর্ধেক কেন
৩১ নারীর বিয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবক লাগে কেন আর তালাক কেন পুরুষের হাতে
৩২ মুসলিম নারীর জন্য অমুসলিম পুরুষকে বিবাহ করা অবৈধ কেন
৩৩ ইসলাম কেন একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়
৩৪ মহিলাদের জন্য গাড়ি ড্রাইভ করার অনুমতি নেই কেন
৩৫ হিজাব কেন নারীর জন্য
৩৬ বাড়াবাড়ি ও ইসলামী শাসন কায়েম
৩৭ কিছু দেশের শরী‘আহ বিধান বাস্তবায়নকে উগ্রতা বলে আখ্যায়িত করা হয় কেন
৩৮ ইসলামী রাষ্ট্র কি মৃত্যুদণ্ড বাতিল করতে পারে
৩৯ ইসলামী রাষ্ট্র কি চোরের হাত কাটার শাস্তি বাতিল করতে পারে
৪০ ইসলামী রাষ্ট্র কি ব্যাভিচারীর বেত্রাঘাত দণ্ড বাতিল করতে পারে
৪১ বিবাহিত ব্যাভিচারিণীর প্রস্তরাঘাত দণ্ডের বাস্তবতা কী
৪২ ইসলাম ত্যাগকারী কি হত্যার যোগ্য
৪৩ পরিশিষ্ট


ভূমিকা

প্রশংসা ও স্তুতি সব মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্রতে প্রেরিত আল্লাহর সকল নবী-রাসূলের ওপর। আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হোন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৌভাগ্যবান প্রত্যেক সাহাবী, সকল নবী-রাসূলের প্রত্যেক একনিষ্ঠ সঙ্গী-সাথী এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাদের অনুসরণকারী প্রতিটি মানুষের ওপর।
উদ্দেশ্যপূর্ণ ও উদ্দেশ্যহীন প্রচলিত নিরেট ভ্রান্তিবিলাসের অন্যতম হলো, মানুষের সসীম ও সীমিত বোধশক্তিতে নির্ভর করে অসীম জ্ঞানী আল্লাহর প্রণীত আইন ও বিচারের প্রামাণ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। অথচ মানুষের শ্রবণ, দর্শন ও ঘ্রাণেন্দ্রিয় সর্বাধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্র ব্যবহারের পরও আমাদের আনুষঙ্গিক ও পারিপার্শ্বিক জীবনের অনেক কিছুই বুঝতে অক্ষম।
বস্তুতঃ আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি তা প্রামাণ্যকরণের দু’টি পদ্ধতি রয়েছে: আল-মানহাজুন নাকলী বা বর্ণিত পদ্ধতি এবং আল-মানহাজুল আকলী বা অর্জিত পদ্ধতি। বর্ণিত পদ্ধতি নির্ভর করে বর্ণনাকারীর প্রামাণিকতার ওপর। চাই তিনি একজন হন বা বহুজন, চাই এ বর্ণনার পরম্পরায় ব্যক্তি থাকুন বা দল। পক্ষান্তরে অর্জিত পদ্ধতি নির্ভর করে প্রধানত আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার ওপর।
তবে বিশেষত প্রামাণ্যতার বিষয়টি যখন সামনে আসে প্রত্যক্ষভাবে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পৃক্ত তথ্য যেমন, পবিত্র গ্রন্থাবলি নিয়ে, তখন সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গ্রন্থের প্রচারক ঐ নবী-রাসূলের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বর্ণিত পদ্ধতির প্রমাণ থাকলে তাকে প্রাধান্য দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অর্জিত পদ্ধতির কথা আসে এরপরে। কারণ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের ইতিহাস সামনে রাখলে আমরা দেখতে পাই, মানুষ প্রকৃতিতে অনাদিকাল থেকে বিরাজমান অনেক কিছুই বুঝতে পারে নি। যুগ-যুগান্তরের সাধনা আর বিরামহীন প্রচেষ্টার পরই কেবল তার সম্পর্কে ক্রমান্বয়ে ধারণা লাভ করেছে। এরপরও স্রষ্টার গড়া মহাবিশ্বের অনেক কিছুই দুর্বোধ্য ও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে, মানুষের সীমিত জ্ঞান সেসব চিনতে পারে নি। সক্ষম হয় নি সেগুলোকে বুঝতে বা তার প্রকৃতি আবিষ্কার করতে।
অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও কিন্তু আমাদের ভেতরে সংশয় ও বিস্ময়ের জন্ম দেয়। তারপরও যে সূত্র মারফত তা আমাদের কাছে পৌঁছেছে তার ওপর আস্থার কারণে আমরা তাতে আস্থাবান হই। অর্থাৎ আমরা এ জন্য সেটাকে গ্রহণ করি না যে সাধারণ অর্জিত জ্ঞান তার অস্তিত্ব প্রমাণ করছে, বরং আমরা তা মেনে নেই বর্ণিত জ্ঞান ঐ বস্তুটির অস্তিত্ব প্রমাণ করার কারণে।
আরেকটি নগ্ন ভুল এই যে, মানুষ তার মহান স্রষ্টার ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ বিধানের একটি সীমিত অংশ সম্পর্কে জানার পর নিজের অপর্যাপ্ত তথ্য ও অসম্পূর্ণ বোধশক্তির ওপর নির্ভর করে এই ক্ষুদে অংশের সমালোচনার স্পর্ধা দেখায়। এ ভুলের ঝুঁকি আরো বেড়ে যায় যখন এটি হয় কোনো পবিত্র উদ্ধৃতি, স্রষ্টার সঙ্গে যার সম্পৃক্ততা অকাট্য বা প্রায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত। আর মানুষ এই ভুল তথা একটি পবিত্র উদ্ধৃতিকে তার পূর্বাপর বা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে সমালোচনা কিন্তু অজ্ঞতা হেতু করে না। এটি করে বরং তার প্রতি অবজ্ঞা বা ভিন্নমতের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে গিয়ে।
এমন ভুলের একটি উদাহরণ হলো, কোনো গবেষকের কোনো আসমানী আইন নিয়ে কেবল পার্থিব জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া ও চিরস্থায়ী আখিরাতের মধ্যে সম্পর্ক মাথায় না রেখে আলোচনা করা। কেননা, পার্থিব জীবন আখিরাত জীবনের ক্ষেত ছাড়া কিছুই নয়। দুনিয়াতে আমরা যা চাষ করবো, সে সামান্যরই ফসল উঠাবো আখিরাতে। আর আখিরাতে যে ফসল উঠাবো তা দিয়েই আমরা পার পাবো।
এর আরেক উদাহরণ জীবনের অন্য ক্ষেত্রের আইনের সঙ্গে এবং আখিরাতের সঙ্গে একটি আইনের সম্পর্ক বিবেচনায় না নিয়ে গবেষকের পার্থিব জীবন সংক্রান্ত কোনো ইসলামী আইনের সমালোচনা করা। যে ব্যক্তি অজ্ঞতা বা অবজ্ঞাবশত কোনো ইসলামী আইনের প্রকৃতি ও পূর্বাপর সম্পর্কে না জেনে আলোচনা করেন তিনি ঐ ব্যক্তির ন্যায় যিনি একটি পূর্ণাঙ্গ বিধানের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অংশগুলোর একটির মূল্যায়ন করেন তার সম্পূরক অংশ সম্পর্কে না জেনেই। এ ব্যক্তি আসলে ঐ ব্যক্তির মতো যে বলে রাত বা রাতের আধাঁরের কী দরকার? এটি আমাদের মধ্যে ভীতি ও ত্রাস জাগিয়ে দেয়। আমাদেরকে কষ্ট করে আলোর ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ সে এ কথা ভুলে যায়, যদি রাত ও অন্ধকার না থাকতো তাহলে আমরা দিন ও আলো চিনতাম না। দিন ও আলোর মূল্যও বুঝতে পারতাম না।
এসব ভুলের যোগফলে এ ধরনের গবেষকগণ এমন বক্তব্য উদ্ধার করেন, যা ঐ উদ্ধৃতি বা বাণীর উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই জ্ঞানী ব্যক্তি যখন পবিত্র কোনো উদ্ধৃতির সমালোচনা বা মূল্যায়ন করেন, তখন তাকে প্রথমে অবশ্যই জেনে নিতে হবে বিধানটিতে এর ভূমিকা কী। তারপরই কেবল তিনি এর প্রশংসা বা সমালোচনা করবেন।
গ্রন্থটি প্রণীত হয়েছে দু’টি লক্ষ্যকে সামনে রেখে:
1. আকীদা, ইবাদাত, আইন, মানবাধিকার, ইসলাম-প্রচার, উগ্রবাদ-চরমপন্থা ও নারীর মর্যাদা-অধিকার বিষয়ে ইসলামের অবস্থান এবং উগ্রবাদের অর্থ ও ইসলামী শরী‘আকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত ইসলামের নানা উষ্ণ সমালোচনার জবাব প্রদান।
2. যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ইসলামের সামষ্টিক বিষয়সমূহের পরিচয় উপস্থাপন এবং কিছু ভাইয়ের কতিপয় জোরালো প্রস্তাবে সাড়া দান।
লেখক এতে নিম্নোক্ত পদ্ধতি ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন:
1. শুধু অমুসলিম নয়, মুসলিমদের মুখেও অধিক উচ্চারিত প্রশ্নগুলোকে বাছাই করা হয়েছে।
2. আলোচনার জন্য উত্থাপিত বিষয়ের ব্যাখ্যায় অতি সংক্ষেপে বাস্তব কিছু দৃষ্টান্তেরও সাহায্য নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নকলী দলীলাদি বা বর্ণিত প্রমাণসমূহ তুলে ধরায় যথাসম্ভব মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।
3. সুস্পষ্ট বিরোধ ছাড়া মতবিরোধপূর্ণ বিষয়গুলোতে কেবল অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতই উল্লেখ করা হয়েছে।
4. যেসব বিষয়ে বিরোধ সুস্পষ্ট সেসবে পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ এবং তার যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
5. ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন অনির্ভরযোগ্য তথ্য থেকে বিরত থাকা হয়েছে।
বক্ষমান গ্রন্থটি আমি মূলতঃ নিজের পঠন-অধ্যয়ন ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি। যেসব গ্রন্থ থেকে আমি উপকৃত হয়েছি, তার লেখকদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর শুরু ও শেষের সব প্রশংসাই আল্লাহর জন্য। তাঁর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এ গ্রন্থটি প্রকাশের পথে নানাভাবে যারা সাহায্য করেছেন, তাদেরকে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করেন এবং এর দ্বারা তাঁর বান্দাদের উপকৃত করেন।
ড. সাঈদ ইসমাঈল চীনী
মদীনা মুনাওয়ারা ০১/০৬/১৪৩০ হিজরী
আকীদা, ইবাদাত ও আইনের সমষ্টির নাম ইসলাম
আকীদা, ইবাদাত, আইন ও চারিত্রিক আদর্শাবলির সমষ্টির নাম ইসলাম। এটিই সে আসমানী রিসালত ঐশী বার্তার সর্বশেষ রূপ যা সর্বপ্রথম এনেছিলেন আদম আলাইহিহিস সালাম। যুগে যুগে যার সংস্কার সাধন করেছেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল নবী-রাসূল। সব রিসালাত বা প্রত্যাদেশই মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে তার ক্ষণস্থায়ী ও চিরস্থায়ী সৌভাগ্য বাস্তবায়নের পথে। তবে এসব রিসালতের সবই ছিল যে যুগের নবী বা যে স্থানের নবী কেবল তার উপযোগী। একমাত্র ইসলামই এসেছে সমগ্র মানবের জন্য রহমত ও শান্তি স্বরূপ এবং আসমানী সকল রিসালাতকে রহিত করতে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে সম্বোধন করে বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الانبياء: ١٠٧]
“আর আমরা তো তোমাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَآ أَحَدٖ مِّن رِّجَالِكُمۡ وَلَٰكِن رَّسُولَ ٱللَّهِ وَخَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٤٠﴾ [الاحزاب: ٤٠]
“মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নয়, তবে আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪০]
মৌলিক আকীদা ও ইবাদাতগুলো কী কী?
ইসলামের মৌলিক আকীদা এ বাস্তবতাকে ঘিরে আবর্তিত যে দুনিয়ার জীবনই পূর্ণ গল্প নয়। দেখবেন কিছু মানুষ জন্ম নেয় তার মেধা অথবা পৈতৃকসূত্রে পাওয়া সম্পত্তিকে কাজে লাগিয়ে জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য। কিছু লোক জন্ম গ্রহণ করে তার বোকামী ও নির্বুদ্ধিতা অথবা দারিদ্রের সঙ্গে যুঝবার জন্য। আবার কেউ শত্রুদের শত্রুতার বলী হয়, যেকোনো মতে এ জগতের শাস্তির হাত থেকে কোনোমতে পালিয়ে যায়। তেমনি আবার কেউ জীবন তার সৌভাগ্যের বদৌলতে সুখ ভোগ করে পক্ষান্তরে অন্যজন দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে কষ্ট ও বঞ্চনাভরা জীবনের ঘানি টেনে বেড়ায়। এখন যদি জীবনের গল্প দুনিয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয় তাহলে ইনসাফ থাকে কীভাবে? এ কারণেই ইসলাম আরেকটি শাশ্বত জীবনের কথা বলে। সেখানেই হবে চূড়ান্ত হিসাব। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ণ ইনসাফ।
প্রকৃত মৌলিক আকীদাগুলো অতীতের সব আসমানী গ্রন্থ কর্তৃকই প্রমাণিত। আর ইসলামের দৃষ্টিতে তা দৃশ্যায়িত হয় স্রষ্টার একত্ব, তাঁর নির্দেশ পালনের অত্যাবশ্যকতা এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদাত তথা দাসত্বের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ﴾ [النساء: ٤٨]
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ, যার জন্য তিনি চান”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮, ১১৬]
ইসলামের মৌলিক আকীদাগুলো বাস্তবায়িত হয় এক আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, শেষ দিবস এবং ভালো-মন্দে তকদীর তথা ভাগ্যের ওপর ঈমান ও বিশ্বাসের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে মৌলিক ইবাদাত হয় ইসলামের পঞ্চভিত্তির মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল এ কথা স্বীকার করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমযানে সিয়াম পালন করা এবং যার সাধ্য আছে তার বাইতুল্লাহর হজ করা।
এসব ইবাদাত মানুষের নিত্য জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন, নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্রতা ও অযুর শর্তে পাঁচবার সালাত আদায় করা। এটি মানুষকে সময়, শূচিতা ও শৃঙ্খলায় যত্নবান হবার প্রশিক্ষণ দেয়। একইসঙ্গে তা মানুষকে নিজের কাজে এবং তার স্রষ্টার হক সম্পর্কে আন্তরিক ও সচেতন হতে শিক্ষা দেয়। তেমনি যাকাত মানুষকে তার অভিন্ন জাতি তথা মানুষের হকের কথা, সিয়াম ক্ষতি করে না এমন সব সৃষ্টির প্রতি দয়ার্দ্র হবার প্রয়োজনীয়তার কথা এবং হজ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহযোগিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এটা ঠিক যে ইসলামের ইবাদাতে কোনো কোনো আমল বাহ্যিকভাবে পৌত্তলিক ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। যেমন, কাবামুখী হয়ে সালাত আদায় এবং তাকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ করা ইত্যাদি; কিন্তু বাস্তবে এতদুভয়ের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রীতি কোনো যুক্তির আলোকে নয়। এটি সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে সম্পাদ্য। তাই তা পালনের অর্থ কেবল আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন। পক্ষান্তরে মানুষ যেসব আচার ও রীতির কথা বলে- চাই তা যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তিক- তা আল্লাহ তা‘আলার মূল শিক্ষার বিকৃত রূপ।
লক্ষণীয়, আকীদার মতো মৌলিক ইবাদাতগুলো ও তার মৌলিক উপাদানসমূহ ইসলাম আগমনের দিন থেকে বর্তমান পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে। নিত্যপরিবর্তশীল জীবনের প্রয়োজন ও জীবনোপকরণের পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সহজের জন্য অল্প কিছু ক্ষেত্র ছাড়া (যেমন, সফরকালে সালাতে কসর এবং সিয়াম পালন না করে অন্য দিন করা) ইবাদাত খুব একটা প্রভাবিত হয় না।
তবে মানুষের সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট কিছু আইন আছে যা জীবনোপকরণ ও জীবনের নিত্য নতুন ও পরিবর্তনশীল উপকরণের দ্বারা প্রভাবিত হবে। কিন্তু ইসলাম যেহেতু আসমানী রিসালাতসমূহ ও সমগ্র বিশ্বাসীর জন্য সর্বশেষ দীন তাই বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা এর এমন কিছু গুণের দায়িত্ব নিয়েছেন, যা একে সর্বযুগে সর্বস্থানে প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের যোগ্য করবে।
চৌদ্দশ বছর আগের শরী‘আত কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব
হ্যাঁ, অনেকেই এ বিয়ষটায় বিস্ময় বোধ করেন যে চৌদ্দশ বছর আগে আবির্ভাব হলেও ইসলাম কীভাবে তার আইনগুলোকে এই যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক ভাবে। আশ্চর্য, এরা কীভাবে ভুলে যায় যে, মানুষ যদি এমন নিয়ম ও আইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হয় যা যুগযুগান্তরের জন্য চলনসই হয়, তাহলে এই মহাবিশ্বের নিপুণ কারিগর ও খোদ এই মানুষেরও একক স্রষ্টা, যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবই জানেন, তার পক্ষে এমন জীবন বিধান রচনা কি অসম্ভব হতে পারে?
একজন মুসলিম কর্তৃক এমন প্রশ্ন উত্থাপনের বিধান কী
জিজ্ঞাসু মুসলিম ভুলে যান তার ইসলামের আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা কিন্তু অকাট্য বা প্রায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত আল্লাহর সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধানে প্রশ্নাতীতভাবে ঈমান রাখার দাবী রাখে। ভুলে গেলে চলবে না, শুধু তার সন্দেহই তাকে কুফুরী ও কঠিন শাস্তির মুখে ঠেলে দিতে পারে। অনাদিকাল থেকে মহা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণকারী আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র এমন বিধান রচনা করতে সক্ষম, কিয়ামত পর্যন্ত যার আবেদন ফুরাবে না। তাই মানুষের জন্য তাঁর এবং সর্বস্রষ্টা আল্লাহর বিধানের সমালোচনা করা সমীচীন নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥﴾ [النساء: ٦٥]
“অতএব, তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৬৫]
আল্লাহ তা‘আলার বিধান নিয়ে সমালোচনা করার সময় একজন মুসলিম কীভাবে ভুলে যায় যে সে আল্লাহর নির্দেশাবলির মধ্যে কোনো কিছু নির্বাচন-বর্জনের অধিকার রাখে না। তার অধিকার নেই কোনোটাকে গ্রহণ আর কোনোটাকে বর্জন করার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥﴾ [البقرة: ٨٥]
“তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮৫]
এখানে ইসলাম গ্রহণ তথা নিজেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সমর্পনের তিনটি প্রকারের অবশ্যিকতার দিকে ইঙ্গিত দেওয়া সমীচীন মনে করছি:
1. সাধারণ মূলনীতি হিসেবে আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ। এতে আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব বিধানই অন্তর্ভুক্ত। চাই সে বিধান সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক প্রমাণিত হোক, চাই ইস্তিমবাত বা কিয়াসের মাধ্যমে প্রমাণিত। এতে পুরোপুরিভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
2. অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিধানগুলোতে আত্মসমর্পণ। এতে আত্মসমর্পণ করতে হবে প্রশ্নাতীতভাবে।
3. কিছু কিছু ফিকহী সমাধান বা ইসলামী আইনশাস্ত্রের অভিমতের কাছে আত্মসমর্পণ। আর এতে আত্মসমর্পিত হতে হবে একজন মুসলিমের জ্ঞান (ইল্ম) অনুযায়ী অগ্রাধিকার দানের ভিত্তিতে; নিশ্চিতভাবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়। কারণ, সুন্নাহ দ্বারা মতামতের ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য প্রমাণিত।
অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে বলা রাখা দরকার যে, একটি রাষ্ট্রে সরকারি আদালত থেকে প্রকাশিত বিধানগুলোর মধ্যে যথাসাধ্য স্ববিরোধিতা এড়ানোর পাশাপাশি ঐ রাষ্ট্রে প্রচলিত ইজতেহাদী উদ্ধৃতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনেরও অনুমতি রয়েছে। চাই তা নির্ভরযোগ্য প্রসিদ্ধ মাযহাব হিসেবে হোক বা উদ্ধৃতির নির্ভরযোগ্যতার ভিত্তিতে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সকল বিচারক সব বিচারে একই ফয়সালায় উপনীত হবেন। কেননা এখানে রায় বিভিন্ন হওয়ার মতো অনেক রয়েছে।
একজন প্রকৃত মুসলিম দৃঢভাবে বিশ্বাস করেন, এসব বিধানই ‘মুকাল্লাফ’ সৃষ্টির পার্থিব শান্তি ও সাফল্য নিশ্চিত করে যখন তাদের অধিকাংশই তা পালন করেন। আর তা ব্যক্তির দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য বয়ে আনে যখন সে এর অধিকাংশই মেনে চলে। অন্যকথায়, শরী‘আতে ইসলামীর প্রভাব শুধু পৃথিবীর সাময়িক জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা চিরকালীন জীবন পর্যন্ত পরিব্যপ্ত। একজন খাঁটি মুসলিমের পক্ষে এসব বিশ্বাসের কোনোটিকেই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। সুতরাং মুসলিমের কাছে যখন প্রমাণিত হয়, এসব আইন-কানূন আল্লাহর পক্ষ থেকে, তখন অবশ্যই তাকে তা মানবরচিত সকল আইন-কানূন থেকে শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করতে হয়। কারণ, আল্লাহ তা‘আলাই মানুষের স্রষ্টা। তিনিই ভালো জানেন কীসের তিনি তাদেরকে নশ্বর জীবনে ও শাশ্বত জীবনে সৌভাগ্যের অধিকারী বানাবেন।
ইসলাম মানুষের পার্থিব জীবনের নানা পর্যায়ের বিস্তারিত ও মৌলিক সব দিক পর্যন্ত বিস্তৃত। এতে রয়েছে আকীদা, ইবাদাত, মোয়ামালা তথা লেনদেন ও সাধারণ আদব কায়দা থেকে নিয়ে সব কিছু। এটিই একমাত্র আসমানী জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষের সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। এটিই একমাত্র ধর্ম যা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে এবং সৃষ্টিজীবের পরস্পরের মাঝে সম্পর্কের ধরণ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইসলাম মানব জীবনের এমন কোনো পর্যায় বাদ রাখেনি যার জন্য বিধানদাতা স্রষ্টার একত্ববাদের প্রতি ইঙ্গিতবাহী অন্যান্য প্রধান বিধানসমষ্টির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আবশ্যক বিধান প্রণয়ন করেনি। আর প্রধান বিধানটি থাকবে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে যেখান থেকে যাবতীয় শাখাগত ও ব্যতিক্রম নিয়ম উদ্ভাবিত হবে।
অচিরেই বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনার দ্বারা সুস্পষ্ট হবে যে কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে, ব্যক্তি অধিকার ও সামষ্টিক অধিকারের মধ্যে এবং সাময়িক জীবনের চাহিদা ও চিরস্থায়ী জীবনের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় ইসলামই সবচে সফল। তেমনি অচিরে আমাদের সামনে সুস্পষ্ট প্রতিভাত হবে, ইসলামী আইন চৌদ্দ শতাব্দী আগে যেসব অধিকারের কথা বলেছে মানব রচিত আইনগুলো সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতেই কেবল তার কথা বলছে। উপরন্তু এর অনেকগুলোই আবার বাস্তব ক্ষেত্রে এখনো প্রয়োগ হয় নি।

ইসলামী শরী‘আ ও বাস্তবতার সম্পর্ক
এটা ঠিক মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা যে সুস্থ প্রকৃতি ও অর্জিত জ্ঞান দান করেছেন তা তাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের গুটিকয়ের রহস্য অনুধাবন করতে সমর্থ করে। তাই বলে তারা আল্লাহর সব বিধানের রহস্য উদ্ধার বা পরিপূর্ণ জ্ঞানের দাবী করতে পারে না। অন্য কথায় বলতে গেলে, আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের গুটিকয়ের রহস্য অনুধাবন না করতে পারা পরিবর্তিত বাস্তবতায় তার অগ্রহণযোগ্যতা বা অকার্যকারিতার প্রমাণ নয়।
যিনি গভীর দৃষ্টিতে ইসলামের বিধান এমনকি ইবাদাতের দিকে তাকাবেন, তিনি লক্ষ্য করবেন ইসলামের বক্তব্য এবং বাস্তবতার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব খুব স্পষ্ট। যেমন, পানির দুষ্প্রাপ্যতায় অযু-গোসলের জন্য তায়াম্মুমই যথেষ্ট। তেমনি মুকীম ব্যক্তিকে যোহর, আসর ও এশা চার রাকাত আদায় করতে হয়, অথচ মূসাফিরের জন্য এ ওয়াক্তগুলোতে শুধু দু’রাকাত আদায়ই যথেষ্ট।
যিনি ধারাবাহিকভাবে অহী নাযিলের দিকে এবং শরী‘আতের অনেকগুলো বিধানের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন, তিনিও ইসলামের বক্তব্য ও বাস্তবতার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাব সুস্পষ্ট দেখতে পাবেন। ইসলামের বিধানগুলো আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়েছে ২৩ বছর সময়কালে এবং মদকে হারাম করা হয়েছে কয়েকটি পর্যায়ে। একইভাবে এ প্রবণতা প্রতিভাত হয় অনেক বিষয়ে সঙ্গত কারণে মুসলিম আইন বিশারদদের মাঝে সঙ্গত বিরোধের মধ্য দিয়ে।
ইসলামের বক্তব্য ও বাস্তবতার মধ্যে পারস্পরিক প্রভাবকে যুক্ত করা হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের ‘নাসেখ’ ও ‘মানসুখ’-এর সঙ্গে, যেখানে একই বাস্তবতায় নতুন বিধান পুরাতন বিধানকে রহিত করে দেয়।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুস্পষ্ট বক্তব্যধারী নির্দিষ্ট কোনো বিধান বাতিল করা আর বাস্তবায়নের শর্ত পূরণ না হওয়ায় কোনো বিধান বাস্তবায়ন স্থগিত করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রসিদ্ধ যেসব অবস্থায় বিধান রহিত না হওয়া সত্ত্বেও তার প্রয়োগ স্থগিত করা হয়েছিল তার অন্যতম হলো আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর যুগে যাকাতের অংশের মধ্য থেকে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর ‘মুআল্লাফাতু কুলুব’ বা যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয় তাদের অংশ প্রদান স্থগিত করা। কারণ কিছু কিছু কাফের ইসলামকে প্রত্যাখ্যান অব্যাহত রাখা সত্ত্বেও ‘যাদের অন্তর আকৃষ্ট করতে হয়’ অংশের সুযোগ গ্রহণ করে আসছিল। অথচ ততদিনে সত্যের বিজয় সুনিশ্চিত এবং ইসলাম তার অনুসারীদের নিয়ে শক্তিশালী হয়েছিল। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ঠিক একইভাবে দুর্ভিক্ষ ও মন্বান্তরের বছর চোরের হাত কাটার বিধান স্থগিত করেছিলেন।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এক্ষেত্রে বিধান বাতিল করেন নি, যেমন বুঝতে ভালোবাসেন অনেকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। তিনি যখন একটি অরহিত বিধানের বাস্তবায়নের শর্ত অনুপস্থিত দেখেন তখন তার প্রয়োগ স্থগিত করেন মাত্র। এ থেকে জানা গেল কোনো বিধান বাতিল হওয়া আর কিছু শর্ত না পাওয়ায় তার প্রয়োগ স্থগিত করার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান।
এখানে আরেকটি সন্দেহের অপনোদন জরুরি। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু যে বনী তাগলাব গোত্রের খ্রিস্টানদের ‘জিযয়া’ নামক কর অবকাশে সম্মতি দিয়েছিলেন তার মাধ্যমে কিন্তু তিনি আরোপিত কর (ফরয জিযিয়া) বাতিল করেন নি, বরং তা করেছিলেন এর নাম বদলে পরিমাণ সংশোধনের অভিপ্রায়ে। কারণ, তিনি তাদের থেকে যাকাতের দ্বিগুণ উসুল করেছিলেন। সুতরাং বিধান বাতিল করা আর জনস্বার্থে বিধানে ঈষৎ পরিবর্তন আনা এক নয়।
বর্তমানে ইসলামী দেশগুলো মুসলিম নাগরিকের ওপর যে কর আরোপ করে তা অনেক সময় তার এক বছর অতিবাহিত হওয়া সঞ্চিত পুরো অর্থের সমান হয়। এ ক্ষেত্রে তাকে যাকাত দিতে হবে না। আবার কখনো তা তার কিছু সম্পদের ওপর আরোপ হয়। এ ক্ষেত্রে তার যাকাতের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হবে। যেমন অমুসলিম নাগরিকদের ওপর আরোপিত জিযয়া নামক কর কখনো তার বার্ষিক কর বা অন্য কোনো করের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর এটি কদাচিতই জিযয়ার অনুরূপ হয়।
ইসলামী শরী‘আর স্থায়িত্বের প্রধান কারণ কী কী?
এটা ঠিক যে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধানসমূহ অনেক সময় জীবন যাপন পদ্ধতি ও এর নিত্য পরিবর্তনশীল উপকরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়; কিন্তু ইসলাম যেহেতু আসমানী সব রিসালাতের পরিসমাপ্তকারী এবং এটি সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য প্রেরিত তাই বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা এর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের দায়িত্ব নিয়েছেন যা একে সর্বযুগে সর্বস্থানে প্রয়োগ উপযোগী রাখবে। এসব বৈশিষ্ট্যের কিছু নিম্নরূপ:
প্রথমত: অকাট্যভাবে প্রমাণিত আইন সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে সাধারণ নীতিমালার ওপর কেন্দ্রীভূত রাখা। বিশেষত শরী‘আতের প্রধান উৎস তথা আল-কুরআনে এবং কিছু কিছু হাদীসে। যেমন, আল্লাহর নির্দেশিত বিষয় পালন ও নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বিরত থাকার গুরুত্ব, ন্যায়ানুগতা, যুলুম হারাম হওয়া, ব্যবসা হালাল হওয়া আর সুদ হারাম হওয়া এবং বিবাহকে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার পূর্ণতম উপায় বানানো ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত: এসব আইন সংক্রান্ত পয়েন্ট ও মৌলিক নীতিমালা মুকাল্লাফ মাখলুকের প্রকৃতিজাত মৌলিক উপাদান নির্ভর হওয়া। যেমন, রূহগত, জ্ঞানগত, অন্তরগত ও অঙ্গসংশ্লিষ্ট উপাদান, তার মূল প্রকৃতি ও প্রমাণিত মৌলিক প্রয়োজনাদি।
তৃতীয়ত: ইসলাম কিছু বিষয় বিস্তারিত বলে দিয়েছে, বিশেষত সুন্নতে নববীতে। তদুপরি এসবকে এমন প্রমাণিত বিষয় হিসেবে গণ্য করেছে যা পরিবর্তন হবার নয়। যেমন, মুকাল্লাফ দুই সৃষ্টি তথা জীন ও ইনসান অর্থাৎ মানব ও দানবের দুনিয়া-আখিরাতের সৌভাগ্য বয়ে আনার মৌলিক প্রয়োজনাদি। অথবা এমন যা পরিবর্তন হওয়া উচিৎ নয়। যেমন, অকাট্যভাবে প্রমাণিত ওয়াজিব ও হারামসমূহ। যেগুলোকে পরিবর্তনের আওতায় আনা যায় সেদিকে লক্ষ্য করে আমরা এর নামকরণ করতে পারি ‘ছাওয়াবেত’ বা অপরিবর্তনীয় হিসেবে।
পরিবর্তন যদিও কেবল জীবন প্রণালী ও এর উপকরণকেই স্পর্শ করে কিন্তু তা প্রকৃতির বাইরে না যাওয়া উচিৎ, যা দুনিয়ার কল্যাণ ও আখিরাতের সৌভাগ্যের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। আর আল্লাহ প্রদত্ত আইনই নির্ধারণ করবে কোনোটি বৈধ, প্রকৃতি বিরুদ্ধ নয় এবং কোনোটি মানুষের জন্য ক্ষতিকারক এবং তার প্রকৃতি-বিরোধী। কারণ, এ মহাবিশ্বের স্রষ্টাই বিশ্ব চরাচরের সবার প্রকৃতি বান্ধব উপায়-উপকরণ এবং প্রকৃতির সুরক্ষা ও তার সমস্যা দূরিকরণের উপায় সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন।
পক্ষান্তরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞানগত পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি না দিয়েই বলা যায় যে মানব মনন ও তার অভিরুচিতে সে যোগ্যতাই রাখা হয় নি যদ্বারা সে অজ্ঞাত রহস্য বা কারণ বিচার করতে পারে। সুতরাং মানুষের জ্ঞান, জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা এবং আশপাশের অনুধাবনযোগ্য বিষয় সম্পর্কে তার ধারণা সীমিত। আর অননুধাবনযোগ্য বিষয়ের জ্ঞান তথা যেসব বিষয় পঞ্চেন্দ্রীয়ের মাধ্যমে জানা যায় না, সে ব্যাপারে মানুষ আরও দুর্বল। এ জন্যই সে এর অনেক কিছুই জানে না এমনকি বিস্ময়কর এই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের যুগেও, অথচ সে তা ব্যবহারে বাধ্য।
চতুর্থত: মহান স্রষ্টা আইনের প্রধান উৎস হিসেবে নিচের উৎসগুলোকেও স্বীকৃতি দিয়েছেন:
1. আল-কুরআন। এটি তার বক্তব্য ও কাঠামোসহ আল্লাহ তা‘আলার বাণী। একে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে বর্ণনাক্রমে অর্থাৎ একজন হাফেয আরেকজন হাফেয থেকে। এভাবে একাধিক সূত্রে ধারাবাহিক বর্ণনাক্রমে তা গিয়ে পৌঁছেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত। তাছাড়া তা লিখিতভাবেও সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
2. সুন্নাতে নববী। তা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি, কর্ম ও সমর্থন। অর্থাৎ কুরআনে যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং সারা জীবনে তাঁর ওপর পরোক্ষভাবে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার বাস্তবায়ন হিসেবে তিনি যা করেছেন এবং যাতে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন, তার সমষ্টি। আর সুন্নাতে নববীকে সংরক্ষণ করা হয়েছে মুখস্থকরণ ও সুনির্দিষ্ট নিয়মের আলোকে সংকলনের মাধ্যমে। সংকলক তাঁর নিজস্ব নিয়মের আলোকে তা এমনভাবে সংকলন করেছেন যে তা নির্ভুল ও বিচ্ছিন্ন হাদীছের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশে যথেষ্ট। উল্লেখ্য, অধিকাংশ সুন্নাহই দৃঢ় নিয়মের আলোকে সংকলিত হয়েছে।
3. ইজতিহাদ। এটি মূলত বাস্তব জীবনে মানুষের নানা সমস্যার সমাধানে কুরআনুল কারীম ও সুন্নতে নববীর যেসব বক্তব্য ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে তার ব্যাখ্যা এবং এতদুভয় থেকে উদ্ভাবনকে অন্তর্ভুক্ত করে। অনুরূপ কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান কেন্দ্রীক কিয়াসও এর অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু তা যেসব বিষয়ে কুরআন বা সুন্নাহর কোনো নিকট বা দূরতম ইঙ্গিতও নেই সেসব বিষয়ে জ্ঞান ও বুদ্ধি ব্যবহার করে জীবনের নিত্য পরিবর্তশীল সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় বিধানের প্রতি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। তবে তা এসব বিধান কুরআনুল কারীম বা সুন্নাতে নববীর কোনো নির্ভরযোগ্য বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হওয়ার শর্তে।
অন্য কথায়, এই ইজতিহাদে নিচের উৎসগুলোও অন্তর্ভুক্ত যাকে আমরা কিয়াস , ইসতিহসান , উরফ , মাসালেহ মুরসালা , সাদ্দে যারায়ে‘ ও ইসতিসহাব বলে থাকি। এসব উৎসের মূলে আক্বল বা জ্ঞানই প্রধান ভূমিকা রাখে। তেমনি ইসলামী আইনকে স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করতে ‘উরফ’ ভূমিকা রাখে।
এসব উৎস গ্রহণযোগ্য মতামতসমূহ এবং জীবন প্রণালী ও এর উপকরণসমূহের নিত্যপরিবর্তনের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে বক্তব্য কার্যকরণে বিভিন্নতা ও স্থিতিস্থাপকতার ব্যাপক অবকাশ রাখে।
এটি কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিপরীত যা সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিপূর্ণ মানব জ্ঞান, মানব প্রকৃতির মূল্যবোধের বিকৃতি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের রুচি ও পছন্দমত বিধান রূপদান নির্ভর। যে রুচি ও পছন্দ কখনো আংশিক কখনো পুরোটাই আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যে প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতএব ইসলামে গ্রহণযোগ্য ও পরিতাজ্য ইজতিহাদের মধ্যে পার্থক্যের মানদণ্ড মানুষের স্বভাব বা অভিরুচি নয়; বরং আসমানী অহী এবং তার আলোকে রচিত ইজতিহাদ।
এখানে আমরা লক্ষ্য করি যে শরী‘আতে ইজতিহাদের জন্য মুজতাহিদকে কিছু মাধ্যমের ওপর পারদর্শী হতে হয়। কিছু মাধ্যম কেন জানা দরকার তা আমরা বুঝতে পারি নিচের দৃষ্টান্ত থেকে:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِي شَرَابِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ فَإِنَّ فِي إِحْدَى جَنَاحَيْهِ دَاءً وَفِي الأُخْرَى شِفَاءً».
“তোমাদের কারও পানীয়তে যদি মাছি বসে তবে সে যেন তা ডুবিয়ে নেয়। কারণ তার এক পাখায় রোগ আছে এবং আরেক পাখায় প্রতিষেধক আছে।” এই হাদীসে ‘আমর’ তথা নির্দেশবাচক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ থেকে ইসলামী আইনের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায় কেউ মনে করেন, এমন করা বোধ হয় জরুরি। কেউ আবার আরও দূরে চলে গেছেন। তার মতে, হাদীসটি আসলে বাজারে উপস্থাপিত খাদ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ছেড়ে দেবার বৈধতার প্রমাণ। এ ব্যক্তি হয়তো এ কথা বলেছেন হাদীসটিকে অপমান করার জন্য, ফলে হাদীস নয় কেবল তিনিই হয়েছেন অপমানিত। নয়তো তিনি হয়তো সদুদ্দেশ্যেই বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তাকে ইসলামী বিধান বুঝার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যা শিখতে হবে। বস্তুত এ হাদীস একটি তাত্ত্বিক রহস্য উন্মোচন করেছে। যদি ঐ পানীয় মানুষ পান করতে চায় তাহলে তা থেকে উপকৃত হবার পন্থা বাতলে দিয়েছে। হাদীসের উদ্দেশ্য বাছবিচারহীন সব খাদ্যেই এমন করা নয়, যা মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
অনেক মুসলিমও আছেন যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস এবং উটের মূত্র পান করলে কিছু রোগ ভালো হবার হাদীসটিকে অদ্ভুত মনে করেন। অথচ হাদীস দু’টি বিশুদ্ধ। এই এরাই আবার উপকারী মানব আবিষ্কারগুলোয় আস্থাবান হন। যেমন, তারা অজগরের বিষকে প্রতিষেধক ও প্রতিরোধমূলক স্বভাবসম্পন্ন টিকা হিসেবে গণ্য করেন।
এ ধরনের মুসলিমদের দেখা যায়, তারা পশ্চিমা আইন-কানূন সম্পর্কে খুব ভালো জানেন; কিন্তু ইসলামী আইন বিষয়ে তাদের জ্ঞান একেবারে সীমিত। ফলে তারা অপর আইন সম্পর্কে অজ্ঞ, যার জ্ঞান ছাড়া এটিকে বিচার করা সম্ভব নয়। যেমন, «النَّظَافَةُ مِنَ الإِيمان» ‘পবিত্রতা ঈমানের অংশ’ এবং ‘«لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ» (ইসলামে) ঠকানো বা ঠকা- কোনোটারই অবকাশ নেই’ ইত্যাদি হাদীস। এমন অনভিপ্রেত জটিলতা প্রায়ই তখন সৃষ্টি হয় যখন কোনো মুসলিম ইসলামী বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন সেক্যুলার আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে। ফলে তার কাছে বিষয়টি ঘোলাটে বলে প্রতিপন্ন হয়। অথচ সে যদি বিষয়টি যথাযথভাবে ভেবে দেখে তাহলে খুব কমই ঐ বিষয়টিকে অস্বীকার করতে পারবে।
4. ইজমা। এটি ইজতিহাদের মতোই। তবে এটি এমন ইজতিহাদ কোনো যুগে যেমন সাহাবী বা তাবেঈদের যুগে যে বিষয়ে আলিমগণ একমত হওয়ার ফলে তা আরও জোরালো ও শক্তিশালী হয়েছে। শক্তির দিক থেকে কুরআনুল কারীম এবং সুন্নতে নববীর পরই এর স্থান। উসূলবিদগণ সাধারণত একে কুরআন-সুন্নাহর পরই স্থান দেন। সুতরাং ধারাবাহিক বিন্যাস নয়; শক্তির স্তরই প্রচলিত ধারাবাহিকতার ভিত্তি।
এ কারণেই ইসলামী আইনে জীবনের নিত্য নতুন সমস্যা মোকাবেলায় যথেষ্ট নম্রতা ও উদারতার অবকাশ থাকায় বিস্ময়ের কিছু নেই। ইসলামী আইন-কানূন যদিও কয়েক শতাব্দী প্রাচীন বিধি-বিধান নির্ভর; কিন্তু তাতে এমন কিছু সুযোগ বা অবকাশ রাখা হয়েছে যা সাম্প্রতিকতম বাস্তবতাতেও প্রয়োগযোগ্য। এই অবকাশ ও প্রশস্ততা বুঝা যায় নিচের ধারাগুলো থেকে:
1. কিছু বক্তব্য সমর্থন ও প্রত্যাখ্যান কিংবা দুই বক্তব্যের মধ্যে অগ্রাধিকার দানের বেলায় মতের স্বীকৃত বিভিন্নতা। আর বক্তব্য যাচাইয়ের জন্য ত্রুটিপূর্ণ মানবিক জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকা যথেষ্ট নয়। নতুবা অনেক কিছুকেই অস্বীকার করতে হবে। এমনকি গবেষণামূলক আবিষ্কারগুলোকেও। যেমন, মারণব্যাধি মোকাবেলায় প্রাণবিনাশী অজগরের বিষ ব্যবহার ইত্যাদি। অতএব নির্ভরযোগ্য বর্ণনা বা প্রচলিত কথাতেও আস্থা রাখার বিকল্প নেই।
2. বক্তব্য ব্যাখ্যা এবং তা থেকে উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত বিভিন্নতা। কারণ, পদ্ধতি কখনো বিভিন্ন হয়, যদিও তা অল্পই হয়। তেমনি তথ্য ও মতামতে ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট ও প্রবেশপথ বিভিন্ন হয়। বিভিন্ন হয় বক্তব্যের পূর্বাপর সম্পর্কে অবগতি এবং যে ভাষায় বক্তব্য প্রদত্ত হয়েছে তা অনুধাবনের যোগ্যতা।
3. প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ে স্বীকৃত বিভিন্নতা। বহু মানুষ পর্যাপ্ত সূক্ষ্ম মাধ্যম ব্যবহার করে এমনকি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুতে পর্যন্ত প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ে মত ভিন্নতার জন্ম দেয়।
4. বক্তব্য ও বাস্তবে প্রয়োগে স্বীকৃত বিভিন্নতা। এর উদাহরণ: ‘কিস্তিতে বিক্রির ক্ষেত্রে কি সুদের হুকুম প্রযোজ্য’? কারণ বস্তুত বিক্রেতা এখানে একটি ব্যাংকের মতো সম্পদ লেনদেন করে। অথচ তা বাইয়ে ‘ঈ‘না’য় সুদ হবে না। তেমনি ‘সব ধরনের প্রতিযোগিতাই কি নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত’? ইত্যাদি।
5. মাধ্যমিক উৎস নির্বাচনে স্বীকৃত বিভিন্নতা। যেমন, ইসতিহসান, মদীনাবাসীদের আমল, সাহাবীদের উক্তি ও পূর্ববর্তীদের শরী‘আত।


ইসলামে মানবাধিকার
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন,
﴿وَلَقَدۡ كَرَّمۡنَا بَنِيٓ ءَادَمَ وَحَمَلۡنَٰهُمۡ فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِ وَرَزَقۡنَٰهُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَفَضَّلۡنَٰهُمۡ عَلَىٰ كَثِيرٖ مِّمَّنۡ خَلَقۡنَا تَفۡضِيلٗا ٧٠﴾ [الاسراء: ٧٠]
“আর আমরা তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমরা তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিয্ক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৭০]
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পৃথিবীতে তাঁর খলীফা বানিয়েছেন। তাদেরকে পৃথিবীর উত্তম বস্তু থেকে উপকৃত হবার এবং তা ব্যবহার করে পার্থিব ও চিরস্থায়ী জীবনের কল্যাণ অর্জনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি তাদেরকে এ পৃথিবী আবাদ করা এবং এতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও দিয়েছেন।
তিনি সকল মানবকে একই উপাদান তথা মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অতপর এক পিতা ও এক মাতা থেকে তাদের সংখ্যা ক্রমে বাড়াতে লাগলেন। তাইতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلَا لَا فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلَا لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلَا لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلَا أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلَّا بِالتَّقْوَى».
“হে লোকসকল, তোমাদের রব এক। তোমাদের পিতা এক। মনে রেখো, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আরবের ওপর অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কালোর ওপর লালের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আবার লালের ওপর কালোরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে।”
হাদীসে উল্লিখিত এই সাম্যের আহ্বান কিন্তু বহুল উচ্চারিত সাধারণ মানবাধিকারের শ্লোগানের মতো নয়। এর তাৎপর্য ও বৈশিষ্ট্য হলো তা কথার নয়, কাজের।
মানুষকে সম্মানিত করার অংশ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে সর্বোত্তম অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তার পিতামাতার ওপর তার একটি সুন্দর নাম রাখা ওয়াজিব করে দিয়েছেন। সুন্নত করেছেন সন্তানের শুভাগমনের আনন্দ উদযাপন করা এবং এজন্য তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করা। অতঃপর তাদের ওপর তাকে সুন্দরভাবে লালন-পালন অপরিহার্য করেছেন যাতে সে দুনিয়া ও আখিরাতে সফল লোকদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। পাশাপাশি তিনি তার জন্য নানা সামাজিক অধিকারও সংরক্ষণ করেছেন।
ইসলামে ইনসাফ ও সমতার অর্থ
ইসলামে ইনসাফ ও সমতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ইনসাফ ব্যাপক আর সমতা বা সাম্য আপেক্ষিক। আবার সাম্য তখনই ইনসাফ হবে যখন তা হবে আপেক্ষিক।
আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের দিয়েছেন জন্মগত দান (যেমন জ্ঞান) ও অর্জনীয় দান (যেমন উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পদ) অর্জনের বিশেষ সুযোগ। যাতে একটি আরেকটির সম্পূরক হয়। এটি কিন্তু ইনসাফ পরিপন্থী নয়। সাধারণ সমতা ইনসাফ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জিনিস, বরং সমতার কিছু প্রকার আছে সম্পূর্ণ ইনসাফ পরিপন্থী। যেমন অলস ও কর্মঠের মধ্যে সমতা, মেধাবী ও মেধাহীনের মধ্যে সমতা, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সমতা, পিতা ও পুত্রের মধ্যে সমতা, পরিবারের সদস্য ও পরিবার বহির্ভুত লোকের মধ্যে সমতা এবং স্বদেশি ও বিদেশির মধ্যে সমতা। এ জন্যই পরীক্ষা আর এ জন্যই পার্থক্য নির্ণায়ক সুস্থ প্রতিযোগিতা সবার দৃষ্টিতে বৈধ। এ জন্যই কারো প্রতি কাউকে আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়। যাতে বজায় থাকে সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর শৃঙ্খলা। মুসলিম ও অমুসলিম সমাজে এ ব্যাপারে কোনো পার্থক্য নেই।
উত্তম-অনুত্তম নির্ণয়ের বেলায় যদিও অর্জনীয় গুণাবলির ক্ষেত্রে উন্নতির দরজা খোলা আর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত গুণাবলির ক্ষেত্রে দ্বার বন্ধ তথাপি উভয় গুণের পরিমাণ অনুপাতে তার দায়িত্বও বেশি হয়ে থাকে। যেমন, ধরুন, যার মেধা ও জ্ঞান বেশি নিজ ও সমাজের প্রতি তার দায়িত্বও বেশি। অনুরূপ যার বিত্ত ও সম্পদ অধিক তার দায়িত্বও বড়।
সুতরাং কেবল তুলনামূলক সমতাই পারে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে। অতএব প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য বা তার প্রকৃতির যোগ্য বিষয় দেওয়ার নামই ইনসাফ। প্রাকৃতিকভাবে ভিন্ন মানুষগুলোর মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার নাম ইনসাফ নয়। (যেমন, নারী-পুরুষ, পিতা-পুত্রের মধ্যে কালগত অগ্রাধিকার বা অর্জিত গুণ যথা অলস ও পরিশ্রমী)
অতএব, বিচারে ইনসাফপূর্ণ সমতার ভিত্তি চূড়ান্ত অর্জন নয়; বরং প্রাপ্ত যোগ্যতার সঙ্গে তুলনামূলক লব্ধ চেষ্টা। অন্যভাবে বললে, প্রদত্ত যোগ্যতার চেয়ে ব্যয়িত প্রচেষ্টা নির্ভর বিচারের নামই ইনসাফ।
অনুরূপভাবে ইসলামে ইনসাফেরও দাবী সৃষ্টিজীবের অধিকারগুলোর কোনো পূর্ণ প্রতিদান, চূড়ান্ত পরিণাম বা ইনসাফপূর্ণ দায়মুক্তির ব্যবস্থা থাকা। তাইতো ইসলামের ইনসাফ ইহকালীন জীবনকে পূর্ণ গল্প মনে করে না। বরং পরকালীন জীবনকে বিকল্পহীন পরিপূরক অংশ গণ্য করে। দেখবেন ইহকালে ভাগ্যবান ব্যক্তি উল্লেখযোগ্য কোনো কষ্ট-চেষ্টা ছাড়া পার্থিব সব সুখে ডুবে থাকে। অথচ কোনো প্রাণপণ চেষ্টাকারী ব্যক্তি তার চেষ্টার উপযুক্ত প্রতিদান লাভের আগেই মরে যায়। দুনিয়ায় কখনো নিপীড়ক তার নিপীড়নের মাধ্যমে সুখী হয়। বেঁচে যায় তার উচিৎ সাজা থেকে। অথচ নিপীড়িত ব্যক্তি তার পাওনা বুঝে পাবার আগেই বিষণ্ণ বদনে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
এ থেকেই চূড়ান্ত জীবনে ব্যাপক ইনসাফপূর্ণ হিসাবের প্রয়োজন অনুভূত হয়। যেখানে ত্রুটিকারী তার উচিৎ শাস্তি ভোগ করবে। (অবশ্য আল্লাহ যদি ক্ষমা করেন, তবে তা ভিন্ন কথা।) আর পরিশ্রমকারী তার প্রতিদান লাভ করবে হিসাব ছাড়া। অতএব, আখিরাতেই হবে সৃষ্টিজীবের প্রাপ্যের ব্যাপক, পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত বণ্টন।
ইসলামে স্বাধীনতার অর্থ
ইসলামে স্বাধীনতা বলতে নাস্তিক্যবাদী শ্লোগানগুলোর মতো অনিয়ন্ত্রিত বা নামমাত্র নিয়ন্ত্রিত স্বাধিকার বুঝায় না। ইসলাম একটি বাস্তববাদী ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গির ধর্ম। এতে তাই স্বাধীনতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। কেননা মানুষ আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় নিয়মের এক বিশাল জালের ভেতর আবদ্ধ, যা এ মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। আল্লাহ তা‘আলাই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। এতে যা কিছু হচ্ছে তা সরাসরি তাঁর নির্দেশ কিংবা তাঁর সৃষ্ট স্বয়ংক্রিয় নিয়মের মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে। এ মহাবিশ্বে কোনো কিছুই তাঁর নির্দেশ বা ইঙ্গিত ছাড়া হয় না। আর তিনি তাঁর সৃষ্টির ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।
তবে এর অর্থ এই নয় যে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষের জীবন প্রণালী কেমন হবে সে রায় দিয়ে দিয়েছেন। অনেকে যেমন তাকদীরের ইসলামী আকীদাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। বস্তুত তাকদীর হলো, বান্দার যাবতীয় কাজ-কর্মের পূর্ব লিখন। যা কেবল স্রষ্টার নিরংকুশ জ্ঞান নির্ভর। এটি এমন এক জ্ঞান যা কোনো স্থান, কাল বা সসীম ইন্দ্রীয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এমন জ্ঞান, যা সর্বস্থান ও সর্বকালের সব বস্তুকে পূর্ণভাবে বেষ্টন করে রেখেছে।
মানুষের স্বাধীনতা দায়বদ্ধ তার স্রষ্টার প্রতি, যিনি তাদেরকে বানিয়েছেন পৃথিবীতে তাঁর বান্দারূপে, যিনি সকল সৃষ্টিকে করেছেন তাদের অনুগত। অগণিত সৃষ্টিকে তিনি মানুষের বশীভূত বানিয়েছেন যাতে তারা সাময়িক জীবনে এসবকে নি‘আমত হিসেবে গ্রহণ করে। এসবকে বশে এনে যাতে অর্জন করতে পারে পরকালীন জীবনের শাশ্বত সুখ। মৌলিকভাবে এ দায়িত্ব বর্তায় তার আকল-বুদ্ধি, হেদায়াত-সুপথ (আসমানী শিক্ষা) এবং অনিবার্য পরিণামধারী উপকরণ নির্বাচনের স্বাধীনতার ওপর। একইভাবে সে নিজের প্রতি এবং অন্যান্য সৃষ্টির প্রতিও দায়বদ্ধ।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সাধারণ অবস্থায় মানুষের পক্ষে মহাজাগতিক নিয়মের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সে আসমানী শিক্ষাকে উপেক্ষা করতে পারে। যদিও তা হবে বিশেষভাবে চিরস্থায়ী জীবনে তার প্রত্যাবর্তনস্থলের হিসাবে। সুতরাং স্বাধীনতা মুফতে আসবে না, আর মুফতে তা সংরক্ষণ করা সম্ভবও নয়।
এক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, মানুষের স্বাধীনতা যে জনসমষ্টির মধ্যে সে বাস করে তার বিশ্বাস ও চেতনার সঙ্গে জড়িত। চাই সে জনসমষ্টি পরিবার হোক কিংবা সেই কর্মস্থল সংগঠন হোক। আর যা ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাধারণ ব্যাপারগুলোতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতের অনুসারী। একটি দেশে একটি জনসমষ্টির ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য বিশ্ব-সমাজ বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য।
চুক্তির নিয়ম হলো, মানুষ যখন সদস্য হিসেবে সুবিধাদি ভোগ করার জন্য স্বেচ্ছায় কোনো কিছু নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেয় কিংবা কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তখন তাকে চুক্তির সময়সীমা অতিক্রম কিংবা দ্বিতীয় পক্ষের চুক্তি প্রত্যাহার পর্যন্ত এর ধারাগুলো মেনে চলতে হয়। অন্যথায় তাকে ভোগ করতে হয় শাস্তি।
এসব চুক্তি সত্ত্বেও মানুষের অনেক বিষয়ে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা রয়েছে। নশ্বর ইহকালের বিচারে কিংবা শাশ্বত পরকালের মানদণ্ডে ভালো-মন্দ গ্রহণের স্বাধীনতা ছাড়াও মানুষ বহুবিধ স্বাধীনতার অধিকারী। এসবই গ্রহণীয় বা অগ্রহণীয় বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের পরিচায়ক।
সুতরাং বৈষম্য ও বিভিন্নতা মানব সমাজের কল্যাণ সাধনে অন্যতম অপরিহার্য প্রাকৃতিক গুণ। অন্যথায় মানুষের জরুরি প্রয়োজনাদি ও সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনে সহজাত সম্পদগুলোকে কাজে লাগাতে প্রেরণদায়ী প্রতিযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাছাড়া মানুষের পরিচয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যও এই বিভিন্নতা অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣﴾ [الحجرات: ١٣]
“হে মানুষ, আমরা তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
নাগরিকের বাক স্বাধীনতা
অনেক মুসলিমই মনে করেন তার পরিপার্শ্বের সবিশেষ পশ্চিমা সমাজের সফল সংগঠনগুলোই কেবল মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি বাস্তবায়ন করতে পারে। কেননা এসব সংগঠন ব্যক্তির চিন্তা ও মতামতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমরা যদি এসব মুসলিমকে জিজ্ঞেস করি, সত্যি করে বলুন তো, আপনারা কি এসব সমাজে বিদ্যমান বল্গাহীন সেই স্বাধীনতা পছন্দ করেন যা পরকালের অনন্ত জীবন বরবাদ করার মতো কাজেরও সুযোগ দেয়? স্বভাবতই তাদের উত্তর হবে, না।
আর যদি বাক স্বাধীনতার উদ্দেশ্য হয় (কথা ও কৌশলের মাধ্যমে) সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধের অধিকার, তবে মুসলিমদের তো কোনো বিদেশি সমাধান আমদানী করার প্রয়োজন নেই। এ অঙ্গনে তারাই বরং অগ্রগামী। বিশেষত ক্ষমতাসীনদের ইষ্ট কামনায়। হ্যা, এখন মুসলিমদের দরকার কেবল এ ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসা। এ অর্থে বাক স্বাধীনতা কোনো মুসলিমের শুধু অধিকার নয় যাকে সে উপেক্ষা করতে পারে; বরং তা তার ধর্মীয় কর্তব্য। তার বিশ্বাস ও ঈমানই তাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
তবে এ দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত মূলনীতির আলোকে। এ মূলনীতির সবচে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তা কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর আলিমদের সর্বসম্মত মত বা তাদের ‘ইসতিমবাত’ তথা ইসলাম বিষয়ক মাসআলা উদ্ভাবন নীতির পরিপন্থী না হতে হবে। পরন্তু তা এমন পদ্ধতিতে সম্পাদিত হতে হবে, যা কোনো মানব সমাজের কল্যাণ সাধন বা তা রক্ষার স্বয়ংক্রিয় প্রয়োজনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে। এ পদ্ধতির সবচে গুরুত্বপূর্ণটি হলো, তা হতে হবে উত্তম ও সুন্দর উপদেশমূলক এবং সমাজের সামর্থ্যবানরা এ দায়িত্ব পালনে কোনো গাফিলতি করতে পারবে না; যদিও তাদের হতে হয় কষ্টের সম্মুখীন। এদিকে সমাজের দায়িত্ব তাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান এবং এর উৎকর্ষ সাধনে প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাকে উৎসাহিত করা। এ পরিবেশের দাবি, একটি সীমিত গোষ্ঠীকে নিষ্পাপ মনে করে কিংবা কেবল তাদেরই দায়িত্ব; অন্যের নয় ভেবে এ কাজকে পুরোপুরি সীমিত না রাখা। কারণ তারাও মুখাপেক্ষী অন্যের উপদেশের।
পরিবারের ক্ষেত্রে যেমন, এতে এমন কেউ নেই যে তার সদস্যবর্গকে পিতার অজ্ঞাতে চুপিসারে অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে। যেমন, তাদেরকে সমগ্র পরিবারের কল্যাণে দমন বা পীড়নের ভয় ছাড়া পরামর্শ, নিজস্ব চিন্তা বা মতামত দানের অনুমতি প্রদান করা। এতে দেখা যাবে তার কিছু মতামত অপক্ক, কিছু ভাষা শিষ্টাচার পরিপন্থী। তথাপি তা পরিবার ও পরিবার প্রধানের জন্য ‘সব কিছু মনের মতো’ নামের কল্পনার রাজ্যে বাস করার চেয়ে শ্রেয়। যা মূলত অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার নামান্তর। কারণ, উন্মুক্ত আচরণের মধ্য দিয়ে গুরুতর হয়ে ওঠার আগে অপরিণত বয়সেই তার ভুলচুক সম্পর্কে জানা যায়। ফলে অবকাশ থাকে তা শুধরে দেওয়ার। পক্ষান্তরে যা অজ্ঞাতে-অগোচরে চলছে তা তো নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের যথাযথ পূর্ব প্রস্ত্ততি ছাড়া বেড়ে ওঠা ক্যান্সারের মতো।
অন্যকথায়, ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনা গুপ্ত দোষ পুষে রাখার চেয়ে ঢের ভালো ব্যক্ত হলেই বাতাসে মিলিয়ে যাবে এমন ঈষৎ ক্ষতি মেনে নেয়া। সুতরাং কোনো কল্যাণ অর্জন হয় না নিছক মোকাবেলা ছাড়া। এ দৃষ্টান্ত যেকোনো মানবগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সঠিক চাই তা ছোট হোক বা বড়।
ইসলামে দাসত্ব বলতে কী বুঝায়?
ইসলামের আবির্ভাবকালে বিশ্বসমাজে যুদ্ধবন্দিদের দাস বানিয়ে নেয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। ইসলামের আগমনের পরও কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ রেওয়াজ অব্যাহত ছিল। সুতরাং ইসলাম যখন শত্রুদের সঙ্গে তাদেরই অনুরূপ আচরণ করতে গিয়ে যুদ্ধবন্দিকে দাস বানানোর অনুমতি প্রদান করে যাতে মুসলিমরা তাদের শত্রুদের মোকাবেলায় কোনোঠাসা না হয়ে পড়ে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এ দাবির সপক্ষে লক্ষণীয় যে, সে যুগে তৎকালে দাস বানানোর বৈধ নানা উৎস ছিল, সেসবের মধ্য থেকে ইসলাম শুধু যুদ্ধবন্দিকেই গোলাম বানানোর অনুমতি দিয়েছে। তবু এ উৎসকে জায়িয বা বৈধ বলেছে; ওয়াজিব বা জরুরী বলেনি। অর্থাৎ যুদ্ধবন্দিকে দাস বানানো আবশ্যক করা হয় নি। বরং মুসলিম বিচারক বা মুসলিম সরকারকে অবকাশ দেওয়া হয়েছে তাদেরকে গোলাম বানিয়ে নেওয়া, মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া কিংবা মুক্তিপণ ছাড়াই তাদের স্বাধীন করে দেওয়ার মধ্যে যেকোনো সুযোগ গ্রহণের। ফলে যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে আচরণের আন্তর্জাতিক রীতিনীতি পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামের ভ্রাতৃত্বের মূলনীতিতে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ এসেছে।
ইসলামের প্রকৃত মর্ম হলো, দাসত্ব কেবল আল্লাহর জন্য সংরক্ষিত। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই সবার মালিক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দাসত্বের নয়, ভ্রাতৃত্বের। মানুষের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য নিরূপিত তাকওয়ার মানদণ্ডে। আর তাকওয়া একটি ব্যক্তিগত অর্জন। মানুষ বা সৃষ্টিজীবের পক্ষে পার্থিব জীবনের কোনো নিশ্চিত গুণ দেখে তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় কাউকে তাকওয়া দান করা বা এর উত্তরাধিকার বানানো। এ জন্যই ইসলাম দাস-দাসীর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাদেরকে আখ্যায়িত করেছে আপন মুনিবের ভাই হিসেবে। শুধু তাই নয়। বরং তাদের বংশকে ‘ওয়ালা’ পদ্ধতির মাধ্যমে মুনিবের বংশের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। সম্পর্কের মর্যাদার দিক দিয়ে যা প্রায় স্বংশীয়ের মতো। এমনকি তাদের অনেকে মাত্র কয়েক যুগের ব্যবধানে নিজ মুনিব সম্প্রদায়ের শাসক ও পরিচালকে পরিণত হয়েছে।
তাছাড়া ইসলাম দাসপ্রথাকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলে স্বীকার করে না। বরং একে ব্যতিক্রমী অবস্থা বলে গণ্য করে। এ অবস্থা বদলাতে ইসলাম প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজ করেছে। যাতে লোকসমাজে সম্পর্কের প্রচলিত নিয়ম ও বিদ্যমান বাস্তবতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকে। এ কারণেই ইসলাম স্থায়ীভাবে দাসপ্রথা নির্মূলে প্রয়োজনীয় বিধি ও আইন প্রণয়ন করেছে। দাসত্বের একমাত্র বৈধ উপায় বন্ধ হবার পর ইসলাম নানা উপায়-উপলক্ষে দাসত্বের নিয়ম তুলে দিয়েছে। এসব উপায়ের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পাপের কাফফারা (ক্ষতিপূরণ) স্বরূপ প্রদেয় তিনটি সুযোগের প্রথমটি করা হয়েছে গোলাম আযাদ করা। তেমনি যে দাস তার দাসত্বের মূল্য পরিশোধ করে স্বাধীন হতে চায় তাকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, এমনকি বাইতুল মাল বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তা পরিশোধের অবকাশ পর্যন্ত দিয়েছে। গোলাম আযাদ করাকে বড় নেকির কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ঘোষণা করেও দাসত্ব নির্মূলের পথ সুগম করেছে। শুধু তাই নয়, যে বাদী তার মুনিবের সন্তান জন্ম দিয়েছে মুনিবের মৃত্যুর পর তার মুক্তিপ্রাপ্তিও নিশ্চিত করেছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, পাপের দায়মুক্তির ক্ষেত্রে দাস মুক্তিই কিন্তু একমাত্র বিকল্প নয়, বরং এ ক্ষেত্রে গোলাম আযাদ করা, মিসকীনকে আহার করানো অথবা সাওম পালন করার সুযোগও রাখা হয়েছে। কারণ, দাস-দাসী কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। কেননা এমন দিন আসবে যখন কাফফারা ওয়াজিব-ব্যক্তি মুক্ত করার মতো কোনো দাসই খুঁজে পাবে না।
রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে ইসলাম
যেকোনো ব্যবস্থাই গড়ে ওঠে দু’টি উপাদান সহযোগে: আদর্শ বা মূলনীতি এবং কর্মপন্থা বা কর্মসূচি। ইসলাম সামাজিক সংগঠন (বিশেষ সংস্থা ও ফাউন্ডেশন) এবং রাজনৈতিক সংগঠনের (দল ও সাধারণ সংগঠন) পালনীয় মূলনীতি প্রণয়ের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো আচার বা কর্মসূচি দেয় নি। এটিকে সংশ্লিষ্ট যুগ ও স্থানের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। যাতে তারা নিজেদের প্রয়োজন ও বাস্তবতার আলোকে তাদের কর্মসূচি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে।
এ মূলনীতি প্রত্যেক স্থান ও কালের উপযোগী। কারণ তা মানুষের সহজাত ও মৌলিক সকল উপাদানের প্রতি লক্ষ্য রাখে। আসলে প্রায় ক্ষেত্রে সেটিই উত্তম কর্মপন্থা বিবেচিত হয় যা বিদ্যমান নীতি ও নিত্য পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের পারস্পরিক প্রভাবের সমন্বয়ে গঠিত হয়। পারস্পরিক এই প্রভাবের হার জীবনের পর্বের বিভিন্নতা ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। আর রাজনৈতিক সংগঠনের বেলায় কথাটি অন্যসব ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি প্রযোজ্য।
ইসলাম সংঘবদ্ধতা ও সংগঠনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। তেমনি গুরুত্ব প্রদান করে দলের প্রধান নির্বাচনে। যদিও তা অন্যুন দুই সদস্যের দল হয়। ইসলামের এ গুরুত্ব ফুটে ওঠে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় এবং দু’জন সফর করলেও তাদের মধ্যে একজনকে নেতা নির্বাচনে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। অনুরূপ মুসলিমদের জামা‘আতে সম্পৃক্ত হতে এবং এক কালেমায় সমবেত হতে উৎসাহিত করার মাধ্যমে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا وَلَا تَفَرَّقُواْۚ﴾ [ال عمران: ١٠٣]
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩]
সর্বসাধারণকে কল্যাণ-কাজে পরস্পরের সহযোগী হতে অনুপ্রাণিত করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡبِرِّ وَٱلتَّقۡوَىٰۖ وَلَا تَعَاوَنُواْ عَلَى ٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ﴾ [المائ‍دة: ٢]
“সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর। মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর।” [সূরা আল-মায়েদাহ, আয়াত: ২]
ইসলাম ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও পরস্পর কল্যাণকর্মে সহযোগিতার শিক্ষা দেয়। এর সবচে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মদীনায় ইয়াহূদী ও মুশরিকদের সঙ্গে সম্পাদিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধি চুক্তি। অমুসলিমদের সঙ্গে সদাচারের প্রতি তাগিদ দিতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَّا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ أَن تَبَرُّوهُمۡ وَتُقۡسِطُوٓاْ إِلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٨﴾ [الممتحنة: ٨]
“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।” [সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত: ৮]
মূলনীতির দিক থেকে ইসলাম ও অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে সাদৃশ্য ও সাযুজ্যপূর্ণ অনেক দিক রয়েছে। তবে ইসলামী ব্যবস্থায় খ্রিস্টধমীর্য় ব্যবস্থার সঙ্গে কিছু দিকের এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্য কিছু দিকের পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্যের প্রধান দিকগুলো নিম্নরূপ:
1. মধ্যযুগে খ্রিস্টধর্মের নামে চালু থাকা রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি ছিল মূলত মানুষ-সম্বন্ধীয়। তবে তা ঐশী গুণের পূর্ণ ধারকও ছিল। বিচারকই ছিলেন সেখানে বিধান প্রণেতা ও চূড়ান্ত বিধাতা। পক্ষান্তরে ইসলামী ব্যবস্থায় বিচারক ও বিচারপ্রার্থী উভয়ই যথোচিত পন্থায় স্বতন্ত্রভাবে আল্লাহর আইনের প্রতি বিনীত। অর্থাৎ ইসলামে এরা উভয়ে মৌলিকভাবে শরী‘আতে রব্বানী বা আল্লাহর বিধানের কাছে দায়বদ্ধ। হ্যা, মানুষকে সালিশ নিযুক্ত করার অবকাশ দেওয়া হয়েছে সীমিত পর্যায়ে আইনের বিস্তারিত প্রয়োগ অথবা স্রষ্টার সঙ্গে বক্তব্যের সম্পৃক্ততা নিয়ে মতবিরোধ কিংবা বক্তব্যের মর্ম অনুধাবন, ঘটনা নির্ণয় বা ফয়সালা প্রয়োগ নিয়ে মতানৈক্যের ক্ষেত্রে।
2. নাস্তিক্যবাদী গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে আইন প্রণয়নের ভার ছেড়ে দেয় হয়েছে। চাই তা সত্য, কৃত্রিম বা প্রবঞ্চনাপূর্ণ হোক না কেন। এতে ধর্মকে শুধু আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত-বন্দেগী পর্যন্ত সীমিত রাখা হয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলামী ব্যবস্থায় আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত-বন্দেগী ও বিচার-আইন (যেমনটি পূর্বে বলা হয়েছে) সবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মহাবিশ্বের স্রষ্টার প্রতি বিনীত। প্রতিটিই পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এসে সমর্পিত। কুরআন-সুন্নাহে প্রাজ্ঞ এবং মানব-জীবনের প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞ হক্কানী আলিমগণ এসবের বিধি-বিধান প্রণয়ন করেন।
পাশাপাশি এও বলা যায়, বিন্যস্ত গঠনমূলক সমালোচনা (যা আসলে ‘সৎ কাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ’-এর অন্তর্ভুক্ত) একটি ধর্মীয় দায়িত্ব। সম্মিলিতভাবে এ কাজ পরিহারের কোনো অবকাশ নেই। অপরদিকে গণতন্ত্রে অবিন্যস্ত সমালোচনা ব্যক্তির এমন অধিকার, যা সে ছেড়ে দিতে পারে।
তেমনি ইসলামী ব্যবস্থায় শূরা (মতামত দিয়ে অংশগ্রহণ) যোগ্যতা তথা শরী‘আত বা বিচার সংক্রান্ত জ্ঞানে গভীর ব্যুৎপত্তিনির্ভর। এ দুই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেই কেউ শূরার সদস্য হতে পারেন, চাই তিনি পুরুষ হোন বা নারী আর ছোট হোন বা বড়। এক কথায় এখানে মানদণ্ড হলো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পারদর্শিতা। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কর্তৃত্ববানরা । অতপর তাতে যোগ্য-অযোগ্যের পার্থক্য ছাড়া আপামর সাবালক ব্যক্তি ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। এই মুষ্টিমেয় লোক কখনো অধিকাংশ ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেন, কখনো করেন না। এদিকে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন শক্তিশালী ধনিক শ্রেণি। কখনো আড়াল থেকে কখনো প্রকাশ্যে।
তবে ইসলাম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনেক নীতির প্রশংসাও করে। যেমন এর চিন্তা-মতামত-অনুভূতি প্রকাশ তথা বাকস্বাধীনতা; কিন্তু এর শর্ত হলো তা ইসলামের শিষ্টাচার নীতির পরিপন্থি না হতে হবে। এর মাধ্যমে কেউ আহত বা অপমানিত না হতে হবে। ফলে এ স্বাধীনতা সে বাস্তব অবস্থা শনাক্তকরণে কাজে আসবে যা আমরা করি বা যার সঙ্গে আমরা পরিচিত। আর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বা সুনির্দিষ্টকরণ ছাড়া তো কোনো সিদ্ধান্ত বা সুষ্ঠু সমাধানেই পৌঁছানো যায় না।
ইসলাম তেমনি গণতন্ত্রের কিছু পদ্ধতিকেও মূল্যায়ন-সমর্থন করে। যেমন গণতন্ত্রের নির্বাচন পদ্ধতি; যদি তা হয় চূড়ান্তভাবে বা পদ্ধতিগত দিক থেকে বৈধ। যাবৎ না তা শরী‘আতের ‘সাওয়াবেত’ তথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে। যেমন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত শরী‘আতের বক্তব্যের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে কিংবা ওয়াজিব বা হারাম কোনো বিষয় নিয়ে ভোটাভুটি করা। অনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আইন প্রণয়নের প্রাক্কালে ‘পরামর্শে’র আওতার ব্যাপকায়নে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবলম্বিত বৈধ সকল উপায় কাজে লাগাতেও উৎসাহিত করে ইসলাম।
অন্য দৃষ্টিকোণে, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা প্রধানত শক্তি ও দরাদরির লড়াই-নীতিনির্ভর। যে বেশি শক্তিমান, দর কষাকষিতে যে অধিক পারদর্শি, সে-ই এতে লাভবান হয়। এ ব্যবস্থার ছত্রছায়ায় তদুপরি বাইরের কোনো পর্যবেক্ষণের অবিদ্যমানতায় রাজনৈতিক সংঘাতের ময়দানে চাতুর্যপূর্ণ অবৈধ পন্থা ব্যবহার করে অনায়াসে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করা যায়। অবশ্য যেসব মানুষ কপট সিদ্ধান্ত নিতে পারে অথবা তাদের প্রতারিত করতে পারে তাদের কথা ভিন্ন। আর এ স্বার্থের বিজয় কিন্তু জাতির বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বার্থের নাম ভাঙ্গিয়েই কামানো সম্ভব। যদিও তা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সম্মতির ভিত্তিতে; হোক সে সম্মতি কৃত্রিম বা প্রবঞ্চনাপূর্ণ।
পক্ষান্তরে ইসলামী ব্যবস্থায় বিচার ব্যবস্থাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য হাসিলের একটি মাধ্যম বলে গণ্য করা হয়। এতে জবাবদিহিতা কেবল জনগণ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং আল্লাহ তা‘আলাও থাকেন তাদের সঙ্গে পর্যবেক্ষক হিসেবে। তেমনি এখানে হিসাব শুধু পার্থিব জীবন এবং মানুষ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। মানুষের সামনে অপরাধী ব্যক্তি কখনো নির্দোষ সাব্যস্ত হলেও আল্লাহ তা‘আলা তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকেন। গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের জবাবহিদিতা কখনো ঐশী আইন থেকেও শক্তি সঞ্চয় করে এবং তা দর কষাকষি ও পরিতুষ্ট করতে শুধু মানুষের পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণকেও ছাড়িয়ে যায়।
জাতীয়তা ও ধর্মে বিভিন্নতা সম্পর্কে ইসলাম কী বলে?
ইসলাম তো সেই মদীনায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্র থেকেই বিভিন্নতাকে রাজনৈতিক ঐক্যের অন্যতম উপাদান মনে করে এসেছে। তাইতো তাতে নানা জাতি (আনসার, মুহাজির ও ইয়াহূদী) এবং নানা ধর্মের (মুসলিম, খ্রিস্টান, ইয়াহূদী ও মূর্তিপূজক) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল।
ইসলাম মানুষের ব্যক্তি-অধিকার ও সামষ্টিক অধিকার সংরক্ষণ করে, তারা সংখ্যাগুরু হোক চাই সংখ্যালঘু। এদের সবার সঙ্গে ইসলাম ভারসাম্য রক্ষা করে। তবে তাদের প্রত্যেকের যোগ্য পার্থক্যানুসারে। তাই দলকে যা দেয় ব্যক্তিকে তা দেয় না। যৌথ ব্যাপারলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠকে যেসব অধিকার দেওয়া হয় সংখ্যলঘিষ্ঠকে তা দেওয়া হয় না। কেননা সাধারণ ব্যাপারসমূহ যেখানে বিভিন্নতার প্রতি লক্ষ্য রাখা অসম্ভব অথচ সেখানে একতা বজায় রাখাও অবশ্যক, তাতে সংখ্যাগুরুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। দ্বিতীয়তঃ ইসলাম একান্ত প্রয়োজন না পড়লে দলের প্রয়োজনের চেয়ে ব্যক্তির প্রয়োজনকেই অগ্রাধিকার দেয়।
বস্তুত ইসলামের প্রাথমিক যুগগুলোতে ব্যবহৃত পরিভাষা ‘যিম্মী’ শব্দটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে আধুনিক যুগে বহুল প্রচলিত পরিভাষা ‘সংখ্যালঘু’র প্রায় সমার্থ বুঝায়। শব্দদ্বয়ের মধ্যে একমাত্র তফাত হলো, যিম্মী পরিভাষাটি ধর্মীয় পার্থক্য নির্দেশ করে। পক্ষান্তরে সংখ্যালঘুর অর্থ আরও ব্যাপক। কখনো জন্মসূত্রে গুণ যেমন রক্ত-বংশের প্রতি আবার কখনো অর্জিত গুণ যেমন ভাষা ও ধর্মের বিভিন্নতার প্রতি নির্দেশ করে।
ব্যক্তি পর্যায়ে (যেমন, ইবাদাত) ও নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে (যেমন, বিবাহ ও উত্তরাধিকার) ইসলাম সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরু বিরচিত সংবিধানে প্রদত্ত সাধারণ নীতির আলোকে যোগ্য অধিকার প্রদান করে।
তেমনি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের প্রদেয় ‘জিযিয়া’কে বর্তমানের রাষ্ট্রীয় করগুলোর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। অথচ ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের যে তাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ৫% প্রদান করতে হয়, তা গণতান্ত্রিক দেশে প্রদেয় করের কিয়দাংশ মাত্র। উপরন্তু ইসলামী রাষ্ট্রে নারী, শিশু, পাগল, দরিদ্র, বয়োবৃদ্ধ ও দুরারোগ্য ব্যধিগ্রস্ত ব্যক্তিরা এ জিযিয়ার আওতামুক্ত।
ইসলাম সংখ্যাগুরুদের বিশেষত্ব মেনে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণেও বদ্ধপরিকর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَلاَ مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ، أَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ».
“জেনে রাখো, যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিতে থাকা ব্যক্তির ওপর যুলুম করবে, তার অধিকার হরণ করবে, তার ওপর সাধ্যাতীত বোঝা চাপাবে বা তার অমতে কিছু নেবে, কিয়ামতের দিন আমিই তার বিবাদী হবো।” এখানে মু‘আহিদ বা চুক্তিতে থাকা ব্যক্তির অর্থ ব্যাপক। এতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিরাপত্তায় থাকা সব ব্যক্তিই অন্তর্ভুক্ত। চাই তিনি অমুসলিম নাগরিক হোন অথবা সে দেশেরই নাগরিক।
মুসলিম শাসকদের এসব নীতি অবলম্বনের ফলেই মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুগযুগ ধরে অমুসলিমরা বসবাস করেছে বরং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে আবাস গেড়েছে অথচ সেসব দেশের শাসনদণ্ড ছিল মুসলিমদের বাদশাদের হাতে। এরই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিন্দুস্তান বা ভারতবর্ষ, যেখানে প্রায় সাত শতাব্দী রাজ্য পরিচালনা করেছে মুসলিরা অথচ তার কোনো নাগরিককেই ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয় নি। এ জন্যই এতে অবাক হবার কিছু নেই যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা তাদের হিন্দু ধর্ম নিয়েই সংখ্যগরিষ্ঠ থেকে গেছে। আবার অন্যদিকে দেখা যায় দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেমন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় কোনো মুসলিম সৈন্যদল অভিযান পরিচালনা করেনি অথচ এর অধিকাংশ বাসিন্দাই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, একসময় উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোই খ্রিস্টানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ পলায়নপর ইহুদীদের সর্বোত্তম আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেছিল।

ইসলামে মানবিক সম্পর্ক
ইসলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত (মানব ও দানব) সবাইকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের প্রতি আহ্বান করে। এমনকি ইসলামকে যে আখিরাতের মুক্তির পথ হিসেবে স্বীকার করে না তাকেও। যাবৎ না সে ইসলামের অনিষ্ট সাধনায় লিপ্ত হয় কিংবা মুসলিমদের ওপর যুলুম করে বা যুলুমকারীকে সাহায্য করে। কারণ, ইসলাম তার সঙ্গেও সদাচারের মূলনীতিতে অটল থাকে। ইসলাম পৃথিবীর নশ্বর জীবনে সম্মিলিত কল্যাণ বাস্তবায়নে অমুসলিমদের প্রতিও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে উৎসাহিত করে। যাবৎ না এ সহযোগিতা মুসলিমের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য নেতিবাচক কিছু বয়ে আনে। আল্লাহ তা‘আলা জন্মগতভাবেই মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব প্রোথিত করেছেন। তিনি বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣﴾ [الحجرات: ١٣]
“হে মানুষ, আমরা তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।” [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১৩]
আর মুসলিম-অমুসলিমের সাধারণ সম্পর্কের সীমা নির্ধারণ করে আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী,
﴿لَّا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ لَمۡ يُقَٰتِلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ أَن تَبَرُّوهُمۡ وَتُقۡسِطُوٓاْ إِلَيۡهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ يُحِبُّ ٱلۡمُقۡسِطِينَ ٨ إِنَّمَا يَنۡهَىٰكُمُ ٱللَّهُ عَنِ ٱلَّذِينَ قَٰتَلُوكُمۡ فِي ٱلدِّينِ وَأَخۡرَجُوكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ وَظَٰهَرُواْ عَلَىٰٓ إِخۡرَاجِكُمۡ أَن تَوَلَّوۡهُمۡۚ وَمَن يَتَوَلَّهُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٩﴾ [الممتحنة: ٨، ٩]
“দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায় পরায়ণদের ভালোবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ী-ঘর থেকে বের করে দিয়েছে ও তোমাদেরকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। আর যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারাই তো যালিম।” [সূরা আল-মুমতাহিনা, আয়াত: ৮-৯]
অন্যভাষায়, ইসলাম (জিন্ন ও ইনসান তথা মানব ও দানব) সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত মাখলুককে দুনিয়া-আখিরাতের শান্তি অর্জনে একে অপরের সহযোগি হতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা যেমন জানি শান্তি মানে প্রতিটি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকে অন্যের জবরদস্তি ছাড়া নিজেকে সুখী বানাতে কাজ করার সুযোগ দেওয়া। হ্যাঁ, কেউ তার কাঙ্ক্ষিত শান্তি বা তার চেয়েও উত্তম শান্তি অর্জনে সহযোগিতা করলে সেটা ভিন্ন কথা। কারণ, তা জবরদস্তির অন্তর্ভুক্ত নয়।
এ থেকে আমরা দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা বুঝতে পারি:
1. প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের পার্থক্য বিদ্যমান। এমনটি করা হয়েছে যাতে একে অপরকে চিনতে পারে এবং পরস্পর সহযোগিতা-প্রতিযোগিতা করতে পারে। তবে ‘প্রকৃত অর্জনে’র মানদণ্ড তাকওয়া, অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার প্রচেষ্টা করা। আর তা করতে হবে তাঁর নির্দেশিত কাজ সম্পাদন এবং নিষেধকৃত কাজ বর্জন করার মাধ্যমে।
2. যৌথ ক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশতেই মানুষের মধ্যে কিছু ভিন্নতার উপস্থিতি পারস্পরিক সহযোগিতার পরিপন্থি নয়। বরং যৌথ ক্ষেত্রগুলোতে তারা পরস্পরে সহযোগিতা করবে। এভাবে তারা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া ও চিরস্থায়ী আখিরাত জীবনের সৌভাগ্য বাস্তবায়নে যথাসম্ভব একজনের চেষ্টায় অন্যজন পরিপূরকের ভূমিকা রাখবে।
ইনসাফের জায়গা থেকেই ইসলাম নিরপেক্ষ বা সমর্থক অমুসলিম এবং শত্রু ও বিদ্বেষী অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করে। প্রথম দল নিজেদের দেশকে শান্তিরাষ্ট্র আর অপরদল নিজেদের দেশকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করে। তবে জাতিসংঘের মতো একটি অভিভাবক সংস্থা থাকতে উচিৎ ছিল তার সদস্য রাষ্ট্রের সবগুলিই শান্তিরাষ্ট্র হওয়া। যদিও কিছু ব্যতিক্রম থাকাও অসম্ভব নয়, কখনো বাস্তবতা যাকে আংশিক বা সাময়িকভাবে হলেও অস্বীকার করে।
সাধারণত এই নির্ধারণের প্রশ্নটি পারিপার্শ্বিকতা ও আন্তর্জাতিক প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদিকে ইসলামে এই শ্রেণীকরণের যোগ্যতা রাখেন ব্যক্তি বা বিচ্ছিন্ন দল নয়; বরং (ওলিয়ে আমর বা) কর্তৃপক্ষ তথা সমগ্ররাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবকপক্ষ। কারণ ব্যক্তি ও দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়তো আন্তরিকতার অভাব থাকে না; কিন্তু তাতে ব্যাপকতার অভাব থাকে ঠিকই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হয় আবেগাশ্রিত এবং সমস্যার প্রতি আংশিক নজরনির্ভর। তাই প্রায়শই তা ইসলামের বিশুদ্ধ মতামত থেকে হয় বিচ্যুত। তা কখনো সমগ্র উম্মাহ বা এর কোনো বিশাল অংশকে ইসলাম ও মুসলিমের অকল্যাণের দিকে টেনে নিয়ে যায়। বরং তাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পরবর্তীতে এই আবেগাশ্রয়ীদের অনেকেই অনুশোচনায় দগ্ধ হন। আর এমনটাই স্বাভাবিক। কেননা প্রায়োগিক ফিকহী সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়ার জন্য শুধু শরী‘আতের বাণীসমগ্রের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট নয়; এর জন্য আরও প্রয়োজন বাস্তবতা অনুধাবনের মতো যথেষ্ট প্রজ্ঞা।
বিষয়টি পরিষ্কারের জন্য গাযওয়ায়ে উহুদ হতে পারে আদর্শ উপমা। এ যুদ্ধে যুবক শ্রেণি তাদের ধর্মীয় আবেগ আর ইসলামের জন্য প্রাণদানের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে শত্রুদের অবস্থান অভিমুখে বেরিয়ে আসাকেই মুসলিমদের জন্য শ্রেয় মনে করেছিলেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টি ছিল আরও ব্যাপক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। দীর্ঘমেয়াদে কাজের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং মুসলিম ও শত্রু সৈন্যের কথা বিবেচনা সেটিই ছিল বাস্তব ও যথার্থ সিদ্ধান্ত। লক্ষণীয়, যুবশ্রেণীর সিদ্ধান্ত ছিল কেবল দীনের আত্মনিবেদনের আবেগ ও প্রেরণা থেকে উদ্ভুত। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সিদ্ধান্ত ছিল ইসলামের প্রতি তাঁর দায়িত্ব এবং ইসলাম ও মুসলিমের ভবিষ্যৎ ও তাদের নিরাপত্তার চেতনায় পুষ্ট। আর বলাবাহুল্য যে এ দুই সিদ্ধান্তের মাঝে বিদ্যমান বিশাল পার্থক্য।
তবে এর অর্থ কিন্তু এ নয় যে রাষ্ট্রের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত কেবল ক্ষমতাবানদের ব্যক্তি স্বার্থের পদলেহনই করে, হোক না তা ইসলাম ও মুসলিমের হিসেবে। বরং এসব সিদ্ধান্তের সিংহভাগই অধিক দূরদর্শিতা, অধিক সতর্কতা ও অশুভ পরিণামের প্রতি লক্ষ্য রেখে গৃহীত হয়।
আন্তধর্ম সংলাপ বিষয়ে ইসলামের অবস্থান
কিছু ধর্মের লোক আছে যারা অন্যধর্মের লোকদের সঙ্গে আলোচনা করতে ভয় পায়। বর্তমানে যাকে ‘আন্তধর্ম সংলাপ’ বলা হয় একে তারা এক ধরনের পরাজয় বলে মনে করে। এটি ঠিক নয়। সাধারণত আন্তধর্ম সংলাপ অথবা সঠিক শব্দে বললে ধর্মীয় প্রতিনিধিদের পারস্পরিক আলোচনা চার ধরনের হতে পারে :
1. সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ধর্মের শুদ্ধতার স্বীকৃতি সংক্রান্ত পারস্পরিক আলোচনা। এটি প্রচারধর্মী সকল ধর্মেই যেমন ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। এর মধ্যে সরাসরি উভয় ধর্মকে প্রচলনের সবধরণের যৌথ প্রচেষ্টাই অন্তর্ভুক্ত। যদিও তা হয় উভয় পক্ষের অনিচ্ছায়।
2. বাস্তবে এসব ধর্মের অস্তিত্ব সম্পর্কে, ধর্মীয় বিরোধ থেকে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে, এসব মতবিরোধ নিরসনের উপায়ে পৌঁছার জন্য যদ্বারা সবপক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং যৌথ ব্যাপারগুলোতে ফলপ্রসূ সহযোগিতা বাস্তবায়িত হবে- সে বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা। ইসলাম এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। এর কারণ পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
3. প্রত্যেক ধর্মের লোকের অন্যকে নিজ ধর্ম সম্পর্কে তা দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণ বাস্তবায়নে সক্ষম সে বিষয়ে নিশ্চিত করার চেষ্টা। আমরা যদি সকল নবী-রাসূলের দাওয়াতী চেষ্টা সম্পর্কে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাই দাওয়াতের উদ্যোগ ছিল মূলত এ ধরনের আলোচনার প্রথম পদক্ষেপ। আর এটি সকল নবী-রাসূল এবং সত্যের প্রতি আহ্বানকারী সবার দায়িত্ব। সুতরাং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নানা ধর্মের প্রতিনিধি ও অনুসারীর সঙ্গে সংলাপ-আলোচনা মূলত প্রত্যেকের বিশ্বাসকে সত্য প্রমাণ করার এক দারুণ উপলক্ষ। এটি সংলাপে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে অন্যের ধর্মের সত্যতা নিয়ে ভাবার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করে।
4. বিভিন্ন ধর্মের লোকদের সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনে চলমান বিভিন্ন লেনদেনের মাধ্যমে পারস্পরিক স্বতস্ফূর্ত আলোচনা। এতে উভয় পক্ষ ঐচ্ছিক বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাচনিক বা শারীরিক ভাষা ব্যবহার করেন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো সম্পর্কে ইসলামের অবস্থান
বর্তমানে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসংঘের নানা অঙ্গসংস্থা ও সংগঠন আয়োজিত বিচিত্র সম্মেলন অধিকারহারা বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় নানামুখী প্রশংসনীয় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে এসব কখনো কখনো এমন কিছু আইনী ও রাজনৈতিক ইস্যু উস্কে দেয় যা জাতিসংঘের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন এসব সংগঠন নিজেকে স্থানীয় আইনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে যা কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। অথচ এরা বা এদের অধিকাংশই আইনটি প্রণয়ন করেছে।
এসব সংগঠনে কর্মরত অধিকাংশ ব্যক্তির আন্তরিকতার ব্যাপারে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেখা যায় তাদের অনেক উদ্যমীর নিষ্ঠাপূর্ণ আবেগ কখনো এমন নসীহতও পেশ করে যা ঐ জাতির দুনিয়া-আখিরাতের পথচলার সিদ্ধান্তের অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলা যায়। তাতে ঐ জাতির স্বাধীনতার ওপর সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপ করা হয় যারা স্বতস্ফূর্তভাবে জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করেছে। এর সঙ্গে আরও যোগ করা যায়, কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এসব সংগঠনেও অবৈধ অনুপ্রবেশ করে। তাদের চেষ্টা থাকে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক নষ্ট করা এবং বক্রপথে জাতিসংঘের মূলনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। শেষাবধি যাতে এর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থাকে তাদের হাতে। বিষয়টি আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে:
1. এসব সংস্থা ও সম্মেলনের শক্তির উৎস কোথায় যারা জাতির ওপর ছুড়ি ঘোরাবার প্রয়াস পায়? জাতি কি তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে নাকি কমপক্ষে অধিকাংশ জনগণ তাদের নির্বাচিত করেছে?
2. সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশের সিদ্ধান্তের বৈধতা কী? তারা যখন নির্দিষ্ট কোনো জাতির বৈধ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করবেন তখন তাদের সিদ্ধান্ত কি প্রতিনিধি নিযুক্তকারী জাতির অধিকাংশের সিদ্ধান্তের উর্ধ্বে হবে?
3. যদি তারা নির্বাচন বা ভারার্পণের মাধ্যমে জাতির প্রতিনিধিত্ব না করেন, তাহলে কোনো আইনের ভিত্তিতে তারা জাতির আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলান?
 তারা কি জাতিসংঘের নীতির ভিত্তিতে নাক গলান? সদস্য রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের নাক গলানো তো জাতিসংঘের প্রধান মূলনীতিরই লঙ্ঘন যা সদস্যদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করে।
 তারা কি গণতন্ত্রের নীতির ভিত্তিতে নাক গলান? তাদের এ কাজ তো গণতন্ত্রের মূলনীতিরও পরিপন্থী। কেননা গণতন্ত্র একটি জাতির সর্বোচ্চ ক্ষমতা সেদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ন্যস্ত করে।
 নাকি তারা মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নাক গলান? তাদের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই তো মানবাধিকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনার ওপর বড় আঘাত।
এসব সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নীতিগতভাবে কোনো জাতিই বাধ্য নয়, যাবৎ তার সদস্যবৃন্দ আইনী পন্থায় কোনো জাতির প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যথায় এটি শুধু সুপারিশ ও কিছু ব্যক্তির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বলেই গণ্য হবে।
ইসলাম সাধারণভাবে ‘কে করলো’ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মজলুমদের সমর্থনে ব্যয়িত সকল প্রচেষ্টার প্রতিই শ্রদ্ধা ও সমর্থন ব্যক্ত করে। উপরন্তু এ ধরনের কাজে অংশ নিতে সর্বাত্মক উৎসাহ যোগায়। যদিও সে নিগৃহীত গোষ্ঠীটি হয় অমুসলিম। তাই যেসব ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হয় সেখানে এসব সংগঠনকে খবরদারি করতে ইসলাম নৈতিকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। এসব ক্ষেত্র নিম্নরূপ:
1. যখন কোনো দেশ অন্য দেশের ওপর উৎপীড়ন চালায়। বিশেষত জাতিসংঘের উদ্ভবের পর।
2. যখন কোনো দেশ অন্য দেশের জাতি-গোষ্ঠী অথবা তার কিছু নাগরিককে স্থানীয় বা আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে নিগৃহীত করে। অন্যকথায়, যখন আইন প্রয়োগে নাগরিক ও অনাগরিকের মধ্যে কিংবা নাগরিকদের মধ্যে বংশ বা পৈতৃক গুণাবলির কারণে বৈষম্য করা হয়। বিশেষতঃ জাতিসংঘের উদ্ভবের পর।
3. যখন কোনো দখলদার গোষ্ঠী নির্দিষ্ট কোনো ভৌগলিক এলাকার আদিবাসীদের সম্পদ বা ভূমি জবরদখল করতে উদ্যত হয়।
4. যখন রাষ্ট্র কিছু নাগরিককে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। যেমন, তাদের ভূসম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সামর্থ্যমতো নিজ কর্ম বাছাইয়ের অধিকার, পছন্দমত স্থানে বসবাসের অধিকার ইত্যাদি। হ্যাঁ, তবে তা হতে হবে এসব অধিকার অর্জনের গ্রহণযোগ্য নিয়মানুসারে।

কল্যাণ প্রচারে আগ্রহ
চিন্তা, আকীদা ও মাযহাবগত নানা দল-উপদল রয়েছে যারা কেবল নিজেদের আদর্শকেই দুনিয়া-আখিরাতের কল্যাণের জামিন মনে করে। তবে তারা তাদের কল্যাণের পথে অন্যকে শামিল করার ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব অনুভব করে না। তারা কাউকে আহ্বান করে না নিজেদের পথে। আবার কিছু দল রয়েছে, যারা বিশ্বাস করে তাদের অবলম্বিত পদ্ধতিই পার্থিব জগতে বিশ্ব মানবতাকে রক্ষা করতে পারে। পারে আন্তর্জাতিকভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। এরা নিজেদের আদর্শ অন্যদের কাছে প্রচার এবং তাদের জন্য তা আবশ্যক মনে করে। এদিকে আরেক দল আছে যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, তারা যে আদর্শ লালন করে একমাত্র তা-ই মানুষের ক্ষণস্থায়ী ও চিরস্থায়ী জীবনের অফুরান মঙ্গল বয়ে আনতে পারে। আর যেহেতু তারা সমগ্র মানবতার কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করে তাই তারা তাদের চেতনা ও আদর্শ প্রচারে উদ্যমের সঙ্গে কাজ করে। তবে তারা কাউকে বাধ্য করে না। মুসলিমরা এ দলেরই অন্তর্ভুক্ত। তারা চায় মুকাল্লাফ বা আল্লাহর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি জীবই (জিন ও ইনসান) কল্যাণ পথে তাদের সহযাত্রী হোক। কিন্তু এ পথে তারা কাউকে বাধ্য করায় বিশ্বাসী নয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে ইসলামের দিকে ডাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥﴾ [النحل: ١٢٥]
“তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৫]
মুসলিমরা ইসলাম প্রচারে আগ্রহী কেন?
মুসলিমরা একান্তভাবেই কামনা করে, মুকাল্লাফ বা আল্লাহর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি জীবই (জিন ও ইনসান) ক্ষণস্থায়ী ও চিরস্থায়ী জীবনের অনন্ত সুখের ঠিকানা খুঁজে পাক। শাশ্বত জীবন ও নশ্বর জীবনের মুক্তির বার্তা নিয়ে আগমনকারী হিদায়াতে রব্বানীকে একচেটিয়াভাবে নিজেদের করে নেয়াকে মুসলিমদের জন্য বিশেষভাবে হারাম ঘোষণা করেছে ইসলাম। বরং এ বার্তাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া অত্যাবশ্যক করেছে। কেউ যাতে ইসলাম থেকে, ইসলামের আলোকিত পথ থেকে বঞ্চিত না হয়।
একইসঙ্গে ইসলাম মনে করে প্রতিটি জ্ঞানসম্পন্ন বা সাবালক নারী-পুরুষই পৃথিবীতে স্বাধীন। সে যা ইচ্ছে তা গ্রহণ করতে পারে। যে চেতনা পছন্দ লালন করতে পারে। কিন্তু আখিরাতে এর ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ قَد تَّبَيَّنَ ٱلرُّشۡدُ مِنَ ٱلۡغَيِّۚ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
“দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৫৬]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿كُلُّ نَفۡسِۢ بِمَا كَسَبَتۡ رَهِينَةٌ ٣٨﴾ [المدثر: ٣٨]
“প্রতিটি প্রাণ নিজ অর্জনের কারণে দায়বদ্ধ।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৩৮]
তবে কেউ যখন স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করে, তখন তার ওপর সেসব বাধ্যবাধকতা মেনে চলা আবশ্যক হয়ে পড়ে, যা তার ওপর ইসলাম ফরজ করেছে। যাতে সে এসব না মানার শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। যোগ্য বিবেচিত হয় আলাদা বৈশিষ্ট্য ও অফুরান প্রতিদানের।
ইসলামকে যিনি দীন হিসেবে গ্রহণ করবেন, তার জন্য জরুরি এর যাবতীয় শিক্ষা ও আদর্শকে বাস্তবে রূপ দান করা। কিছুকে ধারণ করা আর কিছুকে উপেক্ষা করার কোনো অবকাশ নেই ইসলামে। যতক্ষণ তা হয় অকাট্য বা প্রায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং তার মর্ম হয় উপলব্ধ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ﴾ [البقرة: ٨٥]
“তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮৫]
বিষয়টি আসলে এমন, যেমন কেউ স্বেচ্ছায় একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হলো। এখন কিন্তু সে ঐ দেশের নাগরিক হবার যাবতীয় শর্ত পূরণে বাধ্য। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে দেশের যাবতীয় অধিকার ও সুবিধাদি ভোগ করার জন্য প্রযোজ্য শর্ত পূরণ করা। সে কিছুতেই এসব দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। কোনো দেশের নাগরিক হওয়া আর ইসলামের দীক্ষিত হওয়ার মধ্যে একমাত্র পার্থক্য এই যে, নাগরিককে তার সম্পর্কের দেশ কখনো বিতাড়ন করে; কিন্তু মুসলিমকে তার একান্ত ইচ্ছে ছাড়া কেউ কখনো ইসলাম থেকে খারিজ করতে পারে না।
সংশ্লিষ্ট আরেকটি কর্তব্য হলো, মুসলিম নাগরিককে সমাজের কল্যাণে নিজের সম্পদ থেকে যাকাত প্রদান করতে হয়। যে সমাজের সে অংশ এবং তার বিবিধ সেবা সে গ্রহণ করে। তেমনি অমুসলিম নাগরিককে ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যও কিছু দিতে হয়। অন্যদের বেলায় আমরা বর্তমানে যাকে কর বা ট্যাক্স বলি এটি তার শামিল। যেমন, অমুসলিম দেশের মুসলিম নাগরিকদের নির্ধারিত ট্যাক্স বা কর পরিশোধ করতে হয়। যেমন, ভূমিকর, আয়কর ও বাণিজ্যিক কর ইত্যাদি। এসবের পাশাপাশি তাদেরকে সকল খরচ বাদ দেওয়ার পর (যার মধ্যে করও রয়েছে) যাকাতও দিতে হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রে অন্য ধর্মের তৎপরতা নিষিদ্ধ কেন?
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট কিছু দেশ নিজ ভূখন্ডে অন্য ধর্ম ও মতবাদ প্রচার নিষিদ্ধ করেছে দু’টি প্রধান কারণে:
প্রথম. এসব দেশের সব বা অধিকাংশ নাগরিকই ধর্ম হিসেবে ইসলামকে বেছে নিয়েছে। আর ইসলাম এমন একটি ধর্মবিশ্বাস যার পূর্ণ আনুগত্য অত্যন্ত জরুরী। এটি এমন শরী‘আত যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অন্যদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও নির্ধারণ করে। ইসলামের কয়েকটি মৌলিক বিশ্বাস এমন:
1. মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা রয়েছেন। তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা। তিনিই শুরু এবং তিনিই শেষ।
2. স্রষ্টা কেবল একজন আর তিনি ছাড়া কেউই ইবাদাত বা উপাসনার যোগ্য নয়।
3. সৃষ্টিজীবের প্রয়োজন ও সমস্যা জানার জন্য তাঁর কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না।
4. আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিনকে কিছু গুণে ঋব্ধ করেছেন। যেমন, বিবেক-বুদ্ধি এবং ভালো-মন্দ পছন্দের একরকম স্বাধীনতা। উপরন্তু তিনি তাদেরকে সুস্থ প্রকৃতিতে এবং রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন, তাতে হিদায়াতে সুসজ্জিত করেছেন। ফলে তারা তাদের সাময়িক জীবনের যাবতীয় কর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতপর তারা চিরস্থায়ী জীবনে তথা জান্নাত বা জাহান্নামে সেসব কর্মের ফলাফল ভোগ করবে।
5. মুকাল্লাফ বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি মাখলুক তথা জিন ও মানুষ যথাসাধ্য সর্বশেষ নবী মহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর প্রেরিত আল্লাহর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মানতে বাধ্য।
ইসলামের এসব মৌলিক বিশ্বাস জানার পাশাপাশি আমরা এও জানি যে বর্তমানের ধর্ম ও মতবাদগুলো ইসলামের এসব মৌলিক চেতনার কোনো না কোনোটি কিংবা একাধিক ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর এটা তো অনস্বীকার্য যে, বিরুদ্ধ চিন্তার প্রসার নাগরিকদের নিরাপত্তাকে শুধু সাময়িক জীবনে নয়; চিরস্থায়ী জীবনেও হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
দ্বিতীয়. সাধারণত কোনো দেশের সব নাগরিক সাবালক হয় না। একটি দেশে অনেক নাগরিকই এমন থাকে যারা এখনো সাবালক হয় নি বা যাদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটে নি। এরা নিজেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের আদর্শ ও চেতনা বিনাশী চিন্তা ও মতাদর্শ থেকে রক্ষা করতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন তাদের অপরের সহযোগিতা। মূলত তাদের সাহায্যার্থেই রাষ্ট্র এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। যেমন আমরা দেখি এদেশের যেসব নাগরিক সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অন্য দেশে বসবাস করছে, তাদেরকে সে দেশের নিয়ম মেনে চলতে হয়। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে যে ব্যক্তি গবেষণার জন্য অনৈসলামি চিন্তা ও মতাদর্শ সম্পর্কে জানতে চায় তার জন্য তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্রই সে ব্যবস্থা করে দেয়।
এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। কেননা আন্তর্জাতিক সনদসমূহও মানুষের শিক্ষার অধিকারের মধ্যে পিতা বা বৈধ অভিভাবকের জন্য সন্তানের শিক্ষার বিষয় পছন্দ করার অধিকার সংরক্ষণ করে।
তেমনি এও স্বাভাবিক যে অনেক রাষ্ট্রই তার রাজনৈতিক সীমানার মধ্যে এমন সব তৎপরতা নিষিদ্ধ করে যাকে সে দেশ তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোয় অশুভ এবং তার আভ্যন্তরীণ শান্তি ও নাগরিকের নিরাপত্তায় প্রভাব সৃষ্টিকারী মনে করে। যদিও এসব কার্যক্রমের প্রভাব কেবল সাময়িক পার্থিব জীবন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। সব দেশই এমনটি করে থাকে। এমনকি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোও। অতএব যেসব চিন্তা ও কর্মের প্রভাব শুধু দুনিয়ার সাময়িক জীবন পর্যন্ত সীমিত নয়; বরং আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবন পর্যন্ত প্রলম্বিত তার ব্যাপারে কেন এমন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে না? আর যেহেতু এর ক্ষতিকারিতা আখিরাতের অবশ্যম্ভাবী জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত ফলে তা জাতিসংঘের নীতিরও সমার্থক। কেননা জাতিসংঘ তার সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর।
যদিও অনৈসলামি ধর্মীয় মতবাদ প্রচার-তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকে তথাপি সকল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তার অমুসলিম নাগরিকদের নিজেদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং তাদের ধর্মীয় বিধিবিধান পালন ও বাস্তবায়নের পূর্ণ অনুমতি দিয়ে থাকে। যাবৎ তা সংখ্যাগরিষ্ঠের বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। একমাত্র মক্কা নগরীই এর ব্যতিক্রম। ইসলামের বিশেষ পবিত্র স্থান হিসেবে এর প্রবেশাধিকার কেবল মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত।


সৌদি আরবে অন্য ধর্মের প্রকাশ্য চর্চা নিষিদ্ধ কেন?
এ বিষয়ে কথা বলার আগে আমাদেরকে মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে একমত হতে হবে:
1. জাতিসংঘের সদস্য হওয়া কিংবা এর কোনো কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অর্থ কি এই যে, একটি জাতি তার নিজস্ব ভূখন্ডের ভেতর সে বা তার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য যে মূল্যবোধ বা চেতনা লালন করে, তাকে পরিহার করতে হবে?
অবশ্যই এর উত্তর হবে: না। ধর্মনিরপেক্ষসহ সব দেশই এ অধিকার সংরক্ষণ করে। কেননা জাতিসংঘ সনদ তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলছে:
‘পারস্পরিক সমানাধিকার ও প্রত্যেকের নিজস্ব চলার পথ পছন্দের অধিকারের ভিত্তিতে জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা।’
এই সনদে এমন কিছু নেই যা জাতিসংঘকে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবার অনুমোদন দেয়। তাতে এমন কিছুও নেই যা তার সদস্য দেশগুলোকে সপ্তম অধ্যায়ে উল্লেখিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকরে এ নীতি অন্তরায় নয় বলে এ সনদের কার্যকারিতা স্থগিত করার জন্য এ ধরনের সমস্যা উদ্ভাবনের অনুমতি প্রদান করে।
2. কোনো ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্টেও কি সংখ্যালঘু নাগরিকদের তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বা বিশ্বাস-আদর্শ সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করার অধিকার রয়েছে? অবশ্যই এর উত্তর হবে: না।
3. কোনো সাধারণ গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক দেশে কি বিদেশিদের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে- যারা সেখানে শিক্ষা, চাকরি বা রাজনৈতিক আশ্রয়ের সুবাদে অবস্থান করছে? নিশ্চয় তারা সে দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ যে দেশ তাকে ভিসা প্রদান করেছে। তেমনি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর তার মেয়াদ শেষ বা চুক্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কি উভয়পক্ষের সম্মতি ছাড়া কোনো শর্ত যুক্ত করার অনুমতি আছে কি?
অবশ্যই এর উত্তর হবে: বিদেশি ব্যক্তি স্বেচ্ছায় চুক্তি সম্পাদনপূর্বক একটি দেশে প্রবেশের পর কেবল সেদেশের আইন-কানূন মেনেই সেখানে অবস্থানের অধিকার রাখে। এ ব্যক্তি ও দেশটি কেবল চুক্তি সম্পাদনের আগ পর্যন্তই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শর্তাবলিতে সম্মতি বা অসম্মতি দেওয়ার অধিকার রাখে। আর স্থানীয় সব আইন পরোক্ষ শর্তের অন্তর্ভুক্ত। হ্যা, চুক্তিপত্রে যদি কোনোটাকে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হয় তাহলে ভিন্ন কথা।
সোজা কথায় বললে, একজন বিদেশি নাগরিক চাই তার বিশ্বাস ও মূল্যবোধ অবস্থানরত দেশের মূল্যবোধের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হোক বা না হোক, স্বেচ্ছায় চুক্তি সম্পাদনের পর তার জন্য জরুরী চুক্তির মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেদেশের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়। গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষসহ সব দেশই এমনটি করে থাকে। এর দৃষ্টান্ত অনেক। যেমন,
1) কোনো বিদেশি শিশু যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করে, তার জন্য আমেরিকান পাসপোর্ট ছাড়া সেদেশে প্রবেশের অধিকার থাকে না। যদিও এ পাসপোর্ট বহন করার ফলে মানুষকে তার দেশের নিয়মে শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। তবে বিদেশির জন্য শুরু থেকেই আমেরিকায় প্রবেশ না করার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে যাতে তিনি আমেরিকান পাসপোর্ট বহনে বাধ্য না হন।
2) গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো সব দেশেরই নানা রকমের ভিসা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সুতরাং যিনি যে ধরনের ভিসা নিয়ে দেশে প্রবেশ করবেন তাকে তার যাবতীয় নিয়ম ও শর্তাদি মেনে চলতে হবে। যেমন, তিনি এ দেশে কেবল লেখাপড়া করবেন, কাজ করবেন না এবং কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন না। একজন ভিনদেশি লোক এসব শর্তে সম্মতি প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে নিজের ভালো-মন্দ বিবেচনা করেন। তারপর সেসব তিনি মেনে নেওয়া বা না মানার ভিত্তিতে ভিসা গ্রহণ করেন বা তা থেকে বিরত থাকেন। কোনো পর দেশই তাকে ভিসা নিতে বাধ্য করে না।
3) অনেক মুসলিম ব্যক্তি অমুসলিম রাষ্ট্রে (তাদের ভাষায়) সে দেশের জাতীয়তা নিয়ে বসবাস করেন। তথাপি তারা সেখানে তাদের ধর্মীয় অনেক বিধি-বিধান সেখানে পালন করতে পারেন না। যেমন, স্বপ্রণোদিত হত্যাকারীর ওপর কিসাসদণ্ড প্রয়োগ, ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর বেত্রাঘাতদণ্ড প্রয়োগ ইত্যাদি। কেননা এসব বিধান সেসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক কর্তৃক গৃহীত আইনের পরিপন্থী। এদিকে ইসলামের দৃষ্টিতে এসব বিধান যদিও মৌলিক ও অবশ্য পালনীয়; কিন্তু একটি উদারনৈতিক ও বাস্তবমুখী ধর্ম হিসেবে ইসলাম এসব মুসলিমের বিধানগুলো বাস্তবায়ন না করাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে। বরং তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সংশ্লিষ্ট দেশের আদর্শ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক হতে। অনুপ্রাণিত করে তাদেরকে অন্যের জন্য অনুকরণীয় হতে।
স্বদেশী হিসেবে অমুসলিম দেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু মুসলিমকে যখন এমন নির্দেশনা হয়েছে, তখন বলাইবাহুল্য যে, বিদেশে অবস্থানকারী ব্যক্তির জন্য সেদেশের নিয়ম-কানূন মেনে চলা আরও বেশি আবশ্যক। নিয়ম মানতে না পারলে তো চুক্তি বাতিলের অবকাশ নিয়ে ঐ দেশে বসবাস ত্যাগ করতে পারে। সে হিসেবে নিয়ম পছন্দ না হলে শুরু থেকেই কেউ সৌদি আরবে প্রবেশ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। সৌদি সরকার তো কাউকে এখানে আসতে বা বসবাস করতে কাউকে বাধ্য করে না।
আর কূটনৈতিক মিশনগুলোর ক্ষেত্রে এ নিয়ম এজন্য যে, তারা এখানে স্থায়ী নন। তাদের অবস্থান বারবার পরিবর্তন হয়। তাছাড়া তাদের ধর্ম ও ধর্মের প্রতি নিষ্ঠাও ব্যক্তিবিশেষে বিভিন্ন রকম হয়। সুতরাং তাদের ইবাদতের জন্য সুরম্য স্থাপনা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া কূটনৈতিক নিয়মেও যুক্তিসঙ্গত নয়। কূটনীতির দাবি হলো, তারা তাদের সংরক্ষিত স্থানে নিজস্ব ধর্মীয় আচার-নিয়ম চর্চা করবেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের দাবি উভয় রাষ্ট্র পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখবে। আর এরই অংশ হিসেবে স্থানীয় নিয়ম-নীতির প্রতিও শ্রদ্ধা রাখতে হবে।
সৌদি আরবের জনগণ ইসলামকে তাদের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছে। নিজেদের জন্য তারা ইসলামের যাবতীয় আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদাত-বন্দেগী, আচার-আখলাক ও বিধি-বিধানকে পছন্দ করেছে। এদিকে সৌদি আরবের ভৌগলিক অবস্থানকে ইসলাম বিশেষ সুরক্ষিত স্থান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আরব উপদ্বীপ যেখানে বিশ্বমুসলিমের প্রিয়তম ভূমিদ্বয় তথা মক্কা ও মদীনা অবস্থিত- তাতে দুই ধর্ম একত্রিত হতে পারবে না মর্মে নির্দেশ জারি করেছে। অর্থাৎ সেখানে সরকারি ও প্রকাশ্যভাবে দুই ধর্মের ইবাদাত করা যাবে না। তাই সৌদি সরকার যা সেদেশের মুসলিম জাতির প্রতিনিধিত্ব করছে তারও দায়িত্ব এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। এ ব্যাপারে সৌদি সরকারের কোনো বিকল্পের এখতিয়ার নেই।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×