somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামের সমালোচনা ও তার জবাব ২

২৯ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ
হজ্জ ও ওমরার রুকন সম্পর্কে আলোচনায় এসেছে যে, ইহরাম হচ্ছে, হজ্জ বা উমরার কার্যাবলী শুরু করার নিয়্যত করা। আর এ দু’টোতে প্রবেশের নিয়্যতকে ইহরাম বলার কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমে এমন কতিপয় জিনিস নিষিদ্ধ হয়, যেগুলি এই নিয়্যতের পূর্বে হালাল ছিল। ছালাতের তাকবীরে তাহ্‌রীমার ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটি হয়। কেননা এর মাধ্যমে এমন কিছু বিষয় হারাম হয়ে, যেগুলি এর পূর্বে হালাল ছিল। হজ্জের ইহরাম বাঁধার পর যে বিষয়গুলি হারাম হয়ে যায়, সেগুলিকে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ বলে। আর সেগুলি হচ্ছে ৯টি: পশম উঠানো/কাট-চাট করা, নখ কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, পুরুষ কর্তৃক মাথা ঢেকে রাখা, পুরুষের জন্য সেলাইকৃত পোষাক পোষাকের স্বীয় আকৃতিতে পরিধান করা, স্থলের পশু-পাখি শিকার করা, বিবাহ সম্পন্ন করা, স্ত্রী সহবাস করা এবং যৌন উত্তেজনার সহিত স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা।
এক. পশম উঠানো: মাথার চুল, গোঁফ, নাভীর নীচের লোম, বগলের লোম বা শরীরের যে কোনো স্থানের পশম যে কোনো উপায়ে উঠানো। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَلَا تَحۡلِقُواْ رُءُوسَكُمۡ حَتَّىٰ يَبۡلُغَ ٱلۡهَدۡيُ مَحِلَّهُۥۚ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ بِهِۦٓ أَذٗى مِّن رَّأۡسِهِۦ فَفِدۡيَةٞ مِّن صِيَامٍ أَوۡ صَدَقَةٍ أَوۡ نُسُكٖۚ﴾ [البقرة: ١٩٦]
‘আর তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা মুণ্ডন করবে না, যতক্ষণ না কুরবানীর পশু যথাস্থানে পৌঁছে যায়। তোমাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা মাথায় যদি কোন কষ্ট থাকে, তাহলে তার পরিবর্তে ছওম পালন করবে কিংবা ছাদাক্বা করবে অথবা কুরবানী করবে’ (বাক্বারাহ ১৯৬)। মাথার চুলের মত সমস্ত শরীরের যে কোনো স্থানের পশমও এই বিধানের আওতায় পড়বে। কেননা এগুলির সবই শৌখিনতার অন্তর্ভুক্ত ।
তবে দাড়ি চাঁছা বা ছাটা ইহরাম এবং হালাল উভয় অবস্থায় হারাম। ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«خَالِفُوا الْمُشْرِكِينَ أَحْفُوا الشَّوَارِبَ وَأَوْفُوا اللِّحَى»
‘তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা কর; গোঁফ ছাঁটো এবং দাড়ি ছেড়ে দাও’ (বুখারী, হা/৫৮৯২; মুসলিম, হা/৬০২)। বুখারীতে ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছের শব্দ এসেছে এভাবে, «وَوَفِّرُوا اللِّحَى» ‘দাড়ি বেশী কর’। একই ছাহাবী বর্ণিত মুত্তাফাক্ব আলাইহ্‌-এর হাদীছে শব্দ এসেছে এভাবে, «وَأَعْفُوا» ‘দাড়ি বড় হতে দাও’ (বুখারী, হা/৫৮৯৩; মুসলিম, হা/৬০০)। আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«جُزُّوا الشَّوَارِبَ وَأَرْخُوا اللِّحَى خَالِفُوا الْمَجُوسَ»
‘তোমরা গোঁফ ছাঁটো, দাড়ি ছেড়ে দাও; (এর মাধ্যমে) তোমরা অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা কর’ (মুসলিম, হা/৬০৩)। উক্ত হাদীছ দু’টিতে দাড়ি ছাড়ার আদেশ জ্ঞাপক চারটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি হচ্ছে: الإعفاء, الإيفاء, الإرخاء এবং التوفير । আমাদের শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বর্তমান যুগে মুছীবত প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারণ বহু মানুষ আজ এই সুন্নাতের বিরোধিতা করে এবং দাড়ির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালায়। তারা কাফের এবং মহিলাদের সাতে সাদৃশ্য বজায় রেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজেঊন’। আমাদের শায়খ মুহাম্মাদ আমীন শানক্বীত্বী (রহেমাহুল্লাহ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘আযওয়াউল বায়ান (৪/৬৩০)’-এ সূরা ত্ব-হা-এর তাফসীর করতে গিয়ে হারূন এবং মূসা (‘আলাইহিস্‌সালাম)-এর আলোচনার সময় বলেন, ‘পবিত্র কুরআন দাড়ি ছাড়ার প্রমাণ বহন করে এবং দাড়ি ছিল রাসূলগণের বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ঘন দাড়ি বিশিষ্ট; অথচ তিনি ছিলেন সুন্দরতম মানুষ। যেসব মহা পুরুষ কিসরা এবং কায়ছারের ধন-ভাণ্ডার গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সারা পৃথিবী যাঁদের করতলগত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে কেউ দাড়ি ছাটা বা চাঁছা ছিলেন না’।
দুই. নখ কাটা: ইবনুল মুনযির (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, মুহরিম ব্যক্তির জন্য নখ কাটা নিষিদ্ধ’ (আল-ইজমা/৫৭)। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ ثُمَّ لۡيَقۡضُواْ تَفَثَهُمۡ ﴾ [الحج: ٢٩]
‘এরপর তারা যেন দৈহিক ময়লা দূর করে দেয়’ (হজ্জ ২৯)। হাফেয ইবনে কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) উক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, ‘আলী ইবনু আবী ত্বলহা ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণনা করেন, ‘(এর অর্থ হচ্ছে), মাথা মুণ্ডন করা, সাধারণ পোষাক পরা এবং নখ কাটা । আত্বা এবং মুজাহিদ (রহেমাহুল্লা-হ) ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে এমনটিই বর্ণনা করেছেন। ইকরিমা এবং মুহাম্মাদ ইবনে কা‘ব (রহেমাহুল্লাহ)ও এমনটি বলেছেন’। উম্মে সালামাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বর্ণিত হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِى الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّىَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وأظفارهِ»
‘যখন তোমরা যুল-হিজ্জাহ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ যদি কুরবানী করার ইচ্ছা করে, তাহলে সে যেন তার চুল এবং নখ না কাটে’ (মুসলিম, হা/৫১১৯)। কুরবানী করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির তুলনায় মুহরিম ব্যক্তি এই নিষেধাজ্ঞার অধীনে পড়ার অধিক উপযুক্ত।
তিন. সুগন্ধি ব্যবহার করা: মুহরিম ব্যক্তি শরীরে অথবা কাপড়ে কোনো প্রকার সুগন্ধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকবে। ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছে এসেছে,
«وَلاَ تَلْبَسُوا مِنَ الثِّيَابِ شَيْئًا مَسَّهُ الزَّعْفَرَانُ وَلاَ الْوَرْسُ»
‘তোমরা যাফরান এবং ওয়ার্‌স (এক প্রকার উদ্ভিদ, যাতে সুগন্ধি রয়েছে) রঞ্জিত কাপড় পরবে না’ (বুখারী, হা/১৫৪২; মুসলিম, হা/২৭৯১)। ইয়া‘লা ইবনে উমাইয়া (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, জে‘রানাতে সুগন্ধি মিশ্রিত জুব্বা পরিহিত অবস্থায় এক বেদুঈন ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে বললেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! কেউ সুগন্ধি মিশ্রিত জুব্বা পরে ওমরার ইহরাম বাঁধলে, তার সম্পর্কে আপনার মতামত কি? তিনি বললেন,
«أَمَّا الطِّيبُ الَّذِى بِكَ فَاغْسِلْهُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ وَأَمَّا الْجُبَّةُ فَانْزِعْهَا ثُمَّ اصْنَعْ فِى عُمْرَتِكَ كَمَا تَصْنَعُ فِى حَجِّكَ»
‘তোমার গায়ের সুগন্ধি তুমি তিনবার ধুয়ে ফেলো এবং তোমার জুব্বা খুলে ফেলো। অতঃপর তোমার ওমরার জন্য তদ্রূপ কর, যেরূপ তুমি তোমার হজ্জের জন্য করে থাক’ (বুখারী, হা/৪৩২৯; মুসলিম, হা/২৭৯৮)। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, ‘এক ব্যক্তি মুহরিম অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলেন; এমতাবস্থায় তার উট তার ঘাড় ভেঙ্গে দিলে তিনি মারা গেলেন। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«اغْسِلُوهُ بِمَاءٍ وَسِدْرٍ، وَكَفِّنُوهُ فِى ثَوْبَيْهِ، وَلاَ تَمَسُّوهُ بِطِيبٍ، وَلاَ تُخَمِّرُوا رَأْسَهُ، فَإِنَّهُ يُبْعَثُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مُلَبِّيًا»
‘তোমরা পানি এবং বরই পাতা দিয়ে তাকে গোসল করাও। ইহরামের কাপড় দু’টি দিয়েই তার কাফন সম্পন্ন কর। তার দেহে কোন সুগন্ধি লাগাইও না এবং তার মাথা ঢেকো না। কেননা ক্বিয়ামতের দিন তাকে তালবিয়া পড়া অবস্থায় উঠানো হবে’ (বুখারী, হা/১৮৫১; মুসলিম, হা/২৮৯২)।
উপরোক্ত হাদীছসমূহ প্রমাণ করে যে, মুহরিম ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় সুগন্ধি ব্যবহার করবে না। কেননা এটি শৌখিনতার অন্তর্ভুক্ত। তবে মুহরিম ব্যক্তি ইহরাম বাঁধার পূর্বে তার শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করতে পারে; কাপড়ে নয়। ইহরাম বাঁধার পর সুগন্ধি অবশিষ্ট থাকলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কেননা শরঈ ক্বায়দা হচ্ছে, يَجُوْزُ فِيْ الْاِسْتِدَامَةِ مَا لاَ يَجُوْزُ فِي الْاِبْتِدَاءِ ‘কিছু বিষয় অব্যাহত রাখা জায়েয হলেও নতুনভাবে শুরু করার ক্ষেত্রে তা জায়েয নয়’। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন,
«كُنْتُ أُطَيِّبُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- لإِحْرَامِهِ قَبْلَ أَنْ يُحْرِمَ وَلِحِلِّهِ قَبْلَ أَنْ يَطُوفَ بِالْبَيْتِ»
‘ইহরাম বাঁধার সময় ইহরামের উদ্দেশ্যে এবং ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার উদ্দেশ্যে ত্বওয়াফে ইফাদ্বার পূর্বে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গায়ে সুগন্ধি লাগিয়ে দিতাম’ (বুখারী, হা/১৫৩৯; মুসলিম, হা/২৮৪১)। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) আরো বলেন,
«كَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَى وَبِيصِ الطِّيبِ فِى مَفْرِقِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- وَهْوَ مُحْرِمٌ»
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহরিম থাকা অবস্থায় আমি যেন তাঁর মাথার সিঁথিতে সুগন্ধির ঔজ্জ্বল্য দেখতে পাচ্ছি’ (বুখারী, হা/২৭১; মুসলিম, হা/২৮৩২)।
চার. মুহরিম ব্যক্তি কর্তৃক মাথা বা মুখের সাথে লেগে থাকে এমন কিছু দ্বারা মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা: ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছে এসেছে,
«لاَ يَلْبَسُ الْقُمُصَ وَلاَ الْعَمَائِمَ»
‘মুহরিম ব্যক্তি জামা এবং পাগড়ী কোনটাই পরবে না’ (বুখারী, হা/১৫৪২; মুসলিম, হা/২৭৯১)। উটের আঘাতে যে ব্যক্তি ঘাড় ভেঙ্গে মারা যান, তার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘তোমরা পানি এবং বরই পাতা দিয়ে তাকে গোসল করাও। ইহরামের কাপড় দু’টি দিয়েই তার কাফন সম্পন্ন কর। তার দেহে কোনো সুগন্ধি লাগাইও না এবং তার মাথা ঢেকো না। কেননা ক্বিয়ামতের দিন তাকে তালবিয়া পড়া অবস্থায় উঠানো হবে’ (মুসলিম, হা/২৮৯৬)। তবে মাথা বা মুখের সাথে লেগে থাকে না এমন কিছু দ্বারা ছায়া গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: ছাতা, গাড়ীর ছাদ, কাপড়, তাঁবু ইত্যাদি। কেননা জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কাপড় দ্বারা ছায়া দেওয়া হয়েছিল (মুসলিম, হা/৩১৩৮, উম্মুল হুছায়ন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত)। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হজ্জের বিবরণ সম্বলিত জাবের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর হাদীছে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য নামিরাতে যে তাঁবু খাটানো হয়েছিল, তিনি সূর্যাস্ত পর্যন্ত তার মধ্যেই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন’ (মুসলিম, হা/২৯৫০)।
পাঁচ. পুরুষ কর্তৃক সারা দেহ আবৃত করে- এমন সেলাই করা পোষাক পোষাকের স্বীয় আকৃতিতে পরা, যেমন: জামা; অথবা শরীরের কিছু অংশ আবৃত করে- এমন সেলাই করা পোষাক স্বীয় আকৃতিতে পরা, যেমন: পায়জামা, চামড়ার মোজা, কাপড়ের মোজা, গেঞ্জী ইত্যাদি। ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, ‘এক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! মুহরিম ব্যক্তি কোন্‌ কোন্‌ পোষাক পরিধান করবে?’ তিনি বললেন,
«لاَ يَلْبَسُ الْقُمُصَ وَلاَ الْعَمَائِمَ وَلاَ السَّرَاوِيلاَتِ وَلاَ الْبَرَانِسَ وَلاَ الْخِفَافَ، إِلاَّ أَحَدٌ لاَ يَجِدُ نَعْلَيْنِ فَلْيَلْبَسْ خُفَّيْنِ، وَلْيَقْطَعْهُمَا أَسْفَلَ مِنَ الْكَعْبَيْنِ، وَلاَ تَلْبَسُوا مِنَ الثِّيَابِ شَيْئًا مَسَّهُ الزَّعْفَرَانُ أَوْ وَرْسٌ»
‘সে জামা, পাগড়ী, পায়জামা, মাথাওয়ালা জামা, মোজা পরিধান করবে না। তবে কারো যদি সেণ্ডেল না থাকে, তাহলে সে টাখনূর নীচ পর্যন্ত মোজা কেটে ফেলে তা পায়ে দিবে। অনুরূপভাবে তোমরা যাফরান এবং ওয়ার্‌স (এক প্রকার উদ্ভিদ) রঞ্জিত কাপড় পরবে না’ (বুখারী, হা/১৫৪২; মুসলিম, হা/২৭৯১)। হাদীছের ভাষ্য অনুসারে সেন্ডেলের মতই বিধান হবে টাখনূর নীচ পর্যন্ত মোজার। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে টাখনুর নিচে মোজা কাটার যে নির্দেশ এসেছে তা ছিল মদীনা থাকা অবস্থায়; কিন্তু তিনি আরাফাতে থাকা অবস্থায় না কেটেই মোজা পরার নির্দেশ দেন। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, আমি আরাফাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«مَنْ لَمْ يَجِدِ النَّعْلَيْنِ فَلْيَلْبَسِ الْخُفَّيْنِ وَمَنْ لَمْ يَجِدْ إِزَارًا فَلْيَلْبَسْ السَّرَاوِيلَ لِلْمُحْرِمِ»
‘যার সেণ্ডেল নেই, সে যেন মোজা পরে। অনুরূপভাবে কেউ যদি পরনের কাপড় না পায়, তাহলে সে যেন পায়জামা পরে; এই হুকুম মুহরিমের জন্য’ (বুখারী, হা/১৮৪১; মুসলিম, হা/২৭৯৪)। তাঁর এই খুৎবা সব জায়গার হাজী শুনেছিলেন। অতএব, এই হাদীছ দ্বারা ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বর্ণিত মোজা (টাখনুর নিচ থেকে) কেটে ফেলার হাদীছটি মানসূখ।
মুহরিম তার পরনের কাপড়ের পার্শ্ব সূতা দিয়ে বাঁধতে পারে বা বেল্ট বাঁধতে পারে। অনুরূপভাবে সেলাই করা মানি ব্যাগ, সেলাই করা সেণ্ডেলও ব্যবহার করতে পারে। পরনের কাপড় এবং গায়ে দেওয়ার চাদরের পার্শ্ব সেলাই দ্বারা আটকানো থাকলে অথবা পরনের কাপড় বা গায়ের চাদরের কোনো একটি দুই টুকরা কাপড়ের সমন্বয়ে সেলাইয়ের মাধ্যমে তৈরীকৃত হলেও তা পরা যাবে। কেননা এখানে সেলাই করা পোষাক পরিধান থেকে নিষেধাজ্ঞা উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে পোষাক তার স্বাভাবিক আকৃতিতে পরা হয়। যেমন: জামা, পায়জামা। অতএব, যদি কেউ হজ্জ বা ওমরার ইচ্ছা নিয়ে মীক্বাত দিয়ে যায় এবং তার কাছে পরনের কাপড় এবং গায়ের চাদর না থাকে, তাহলে সে তার জামাকে পরনের কাপড়ের মত করে পরতে পারে, যদি তা দ্বারা তার নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা সম্ভব হয়। অনুরূপ আরেকটি জামা বা পায়জামাকে চাদরের মত করে গায়ে দিতে পারে অথবা পরনের কাপড় এবং গায়ের চাদর না পাওয়া পর্যন্ত পায়জামা পরতে পারে এবং জামাকে গায়ের চাদরের মত করে গায়ে দিতে পারে।
অনুরূপভাবে মুহরিম পুরুষ আংটি, ঘড়ি ইত্যাদি পরতে পারে। যেমন: কেউ প্রয়োজনে তার হাঁটুতে বা গোছায় কাপড় অথবা অন্য কিছু বাঁধতে পারে।
মহিলা মানুষ শরী‘আতসম্মত স্বাভাবিক যে কোন পোষাক পরতে পারে। হাত মোজা এবং নেক্বাবসহ মুখমণ্ডলের মাপে তৈরীকৃত অন্যান্য কাপড় ছাড়া তার জন্য অন্য কোন পোষাক নিষেধ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَلَا تَتَنَقَّبْ الْمُحْرِمَةُ وَلَا تَلْبَسْ الْقُفَّازَيْنِ»
‘মুহরিম মহিলা মুখাচ্ছাদন ব্যবহার করবে না এবং হাত মোজা পরবে না’ (বুখারী, হা/১৮৩৮, ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত)। তবে বেগানা পুরুষের উপস্থিতিতে সে তার কাপড় দ্বারা হাত এবং ওড়না দ্বারা মুখমণ্ডল ঢেকে দিবে। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন,
«كَانَ الرُّكْبَانُ يَمُرُّونَ بِنَا وَنَحْنُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مُحْرِمَاتٌ فَإِذَا حَاذَوْا بِنَا سَدَلَتْ إِحْدَانَا جِلْبَابَهَا مِنْ رَأْسِهَا إِلَى وَجْهِهَا فَإِذَا جَاوَزُونَا كَشَفْنَاهُ»
‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালীন সময় আরোহী পথযাত্রীরা আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত। তারা আমাদের বরাবর পৌঁছলে আমরা আমাদের মাথার বড় চাদর টেনে মুখমণ্ডলের উপরে ঝুলিয়ে দিতাম এবং তারা আমাদেরকে অতিক্রম করে চলে গেলে আবার মুখ খুলে দিতাম’ (আবূ দাঊদ, হা/১৮৩৩, হাদীছটির সনদে দুর্বলতা রয়েছে)। দারাক্বুতনী উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে হাদীছটি (হা/২৭৬৪) বর্ণনা করেছেন, এই সনদেও আগের হাদীছের সনদের সেই দুর্বল রাবী রয়েছে; সুনানে সা‘ঈদ ইবনে মানছূর-এ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক্ব ছহীহ সনদে আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) হতে বর্ণিত হাদীছও উক্ত হাদীছকে শক্তিশালী করে। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন,
«تَسْدِلُ الْمَرْأَةُ جِلْبَابَهَا مِنْ فَوْقِ رَأْسِهَا عَلَى وَجْهِهَا»
‘মহিলা তার মাথার চাদর টেনে মুখমণ্ডলের উপর ঝুলিয়ে দিবে’ (ফাৎহুল বারী, ৩/৪০৬)। এর আরেকটি ‘শাহেদ ’ (شاهد) রয়েছে, যেটি ইমাম মালেক (রহেমাহুল্লাহ) ফাতেমা বিনতুল মুনযির (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) থেকে বর্ণনা করেন। ফাতেমা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন,
«كُنَّا نُخَمِّرُ وُجُوهَنَا وَنَحْنُ مُحْرِمَاتٌ وَنَحْنُ مَعَ أَسْمَاءَ بِنْتِ أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ»
‘আসমা বিনতে আবূ বকর ছিদ্দীক্ব-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় আমরা আমাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতাম’ (মুওয়াত্ত্বা, ১/৩২৮)। হাদীছটি ইমাম হাকেমও বর্ণনা করেন; আসমা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, ‘পুরুষদের থেকে আমরা আমাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতাম এবং এর পূর্বে ইহরাম অবস্থায় আমরা মাথা আচড়াতাম’ (মুস্তাদরাক, ১/৪৫৪, হাকেম বলেন, বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীছটি ছহীহ, কিন্তু তাঁরা এটি বর্ণনা করেননি; হাফেয যাহাবী (রহেমাহুল্লাহ) এই তাঁকে সমর্থন করেছেন)।
ইবনুল মুনযির (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, মহিলা সেলাইকৃত সব ধরনের পোষাক এবং মোজা পরতে পারে। সে তার মাথা এবং চুল ঢেকে রাখতে পারে। সে তার মুখমণ্ডলের উপর একটি কাপড় ঝুলিয়ে দিবে, যাতে সে বেগানা পুরুষের দৃষ্টিগোচর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে’ (ফাৎহুল বারী, ৩/৪০৬)। এ বক্তব্যের পক্ষে ইবনে আব্দুল বার্র (রহেমাহুল্লাহ)ও ইজমা উল্লেখ করেছেন (আত-তামহীদ, ১৫/১০৮)। চতুর্দশ শতাব্দী হিজরীর শুরুর দিকে মহিলাদের বেপর্দা শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা বেগানা পুরুষ থেকে তাদের মুখমণ্ডলকে ঢেকে রাখত। হাফেয ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পূর্বে এবং বর্তমানে বেগানা পুরুষ থেকে মহিলাদের মুখমণ্ডল ঢাকার অভ্যাস অব্যাহত রয়েছে’ (ফাৎহুল বারী, ৯/৩২৪)।
কেউ অজ্ঞতা বা ভুলবশতঃ উক্ত নিষিদ্ধ ৫টি বিষয়ের কোনটি করে ফেললে তাতে কোন সমস্যা নেই। তবে অজ্ঞ ব্যক্তি জানার পরে এবং ভুলকারী স্মরণ হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে; সেলাইকৃত পোষাক পরে থাকলে খুলে ফেলবে, মাথা ঢাকলে মাথা আলগা করে ফেলবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকলে তা দূর করবে। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলি করলে সে একদিকে যেমন পাপী হবে, অন্যদিকে তেমনি তার উপর ফিদ্‌ইয়া ওয়াজিব হবে। তবে প্রয়োজনের তাকীদে কেউ সেগুলি করলে সে গোনাহগার হবে না বটে, তবে তাকে ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে। অবশ্য সুগন্ধির ক্ষেত্রে এ হুকুম প্রযোজ্য নয়। কেননা সুগন্ধি ব্যবহার মানুষের যরূরী কোনো বিষয় নয়। উক্ত নিষিদ্ধ বিষয়সমূহের ফিদ্‌ইয়া হচ্ছে, ছাগল যবেহ করা বা মাথাপিছু আধা ‘ছা’ হারে ছয়জন মিসকীনকে খাওয়ানো অথবা তিন দিন ছওম পালন করা। এ তিনটির যে কোন একটি বেছে নেওয়া যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ بِهِۦٓ أَذٗى مِّن رَّأۡسِهِۦ فَفِدۡيَةٞ مِّن صِيَامٍ أَوۡ صَدَقَةٍ أَوۡ نُسُكٖۚ﴾ [البقرة: ١٩٦]
‘তোমাদের মধ্যে যারা অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিংবা মাথায় যদি কষ্টদায়ক কিছু থাকে, তাহলে তার পরিবর্তে ছওম পালন করবে, কিংবা ছাদাক্বা করবে, অথবা কুরবানী করবে’ (বাক্বারাহ ১৯৬)। ছাহাবী কা‘ব ইবনে উজরা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত হাদীছ উক্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অসুস্থতার কারণে তাঁর মাথার উকুন তাঁকে কষ্ট দেওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে মাথা মুণ্ডন করতে বললেন এবং তাঁকে কাফফারাহ স্বরূপ ছাগল যবেহ করা, বা মাথাপিছু আধা ‘ছা’ হারে ছয় জন মিসকীনকে খাওয়ানো, অথবা তিন দিন ছওম পালন করার আদেশ করলেন (বুখারী, হা/৪৫১৭; মুসলিম, হা/২৮৮৩)।
পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ হাদীছে শুধুমাত্র মাথা মুণ্ডনের ক্ষেত্রে এই ফিদ্‌ইয়ার কথা এসেছে। তবে অবশিষ্ট চারটি নিষিদ্ধ বিষয়ও এই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা মাথা মুণ্ডনের মত এগুলিতেও শৌখিনতা রয়েছে।
৬. স্থলের শিকারযোগ্য প্রাণী শিকার করা: মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقۡتُلُواْ ٱلصَّيۡدَ وَأَنتُمۡ حُرُمٞۚ﴾ [المائ‍دة: ٩٥]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহরাম অবস্থায় শিকারযোগ্য প্রাণী হত্যা করো না’ (মায়েদাহ ৯৫)।
﴿وَحُرِّمَ عَلَيۡكُمۡ صَيۡدُ ٱلۡبَرِّ مَا دُمۡتُمۡ حُرُمٗاۗ ﴾ [المائ‍دة: ٩٦]
‘আর তোমাদের ইহরামকারীদের জন্য স্থলের শিকার হারাম করা হয়েছে, যতক্ষণ তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাক’ (মায়েদাহ ৯৬)।
﴿غَيۡرَ مُحِلِّي ٱلصَّيۡدِ وَأَنتُمۡ حُرُمٌۗ﴾ [المائ‍دة: ١]
‘কিন্তু ইহরাম অবস্থায় তোমরা শিকারকে হালাল মনে করো না’ (মায়েদাহ ১)।
﴿وَإِذَا حَلَلۡتُمۡ فَٱصۡطَادُواْۚ﴾ [المائ‍دة: ٢]
‘যখন তোমরা ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে, তখন শিকার কর’ (মায়েদাহ ২)। উক্ত আয়াতসমূহ প্রমাণ করে যে, হজ্জ ও ওমরার ইহরাম বাঁধার পর থেকে হালাল হওয়া পর্যন্ত মুহরিম ব্যক্তির জন্য স্থলচর শিকারকে হত্যা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। এমনকি শিকারকার্যে সহযোগিতা করা এবং অন্য কাউকে শিকারের নির্দেশনা দেওয়াও তার জন্য বৈধ নয়। আবূ ক্বাতাদাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) কতিপয় ছাহাবীর সাথে সফরে ছিলেন; কিন্তু তাঁরা ইহরাম অবস্থায় থাকলেও তিনি ইহরাম অবস্থায় ছিলেন না। সফরে তাঁরা কতগুলি বন্য গাধা দেখতে পেলেন। আবূ ক্বাতাদাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) সেগুলির মধ্যে একটি গাধীকে শিকার করলেন এবং তাঁরা সেই গোশত থেকে খেয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, ‘আমরা বললাম, ইহরাম অবস্থায় আমরা কি স্থলচর শিকারের গোশত খাব? একথা বলে আমরা অবশিষ্ট গোশত সঙ্গে করে আনলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«أَمِنْكُمْ أَحَدٌ أَمَرَهُ أَنْ يَحْمِلَ عَلَيْهَا أَوْ أَشَارَ إِلَيْهَا»
‘তোমাদের কেউ কি তাকে শিকার করতে আদেশ করেছে, অথবা এটির প্রতি ইশারা করেছে?’ তাঁরা বললেন, না। তিনি বললেন,
«فَكُلُوا مَا بَقِىَ مِنْ لَحْمِهَا»
‘তাহলে তোমরা তার অবশিষ্ট গোশত থেকে খেতে পার’ (বুখারী, হা/১৮২৪; মুসলিম, হা/২৮৫৫)।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে স্থলের শিকারযোগ্য প্রাণীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকারীর বিনিময় উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে,
﴿وَمَن قَتَلَهُۥ مِنكُم مُّتَعَمِّدٗا فَجَزَآءٞ مِّثۡلُ مَا قَتَلَ مِنَ ٱلنَّعَمِ يَحۡكُمُ بِهِۦ ذَوَا عَدۡلٖ مِّنكُمۡ هَدۡيَۢا بَٰلِغَ ٱلۡكَعۡبَةِ أَوۡ كَفَّٰرَةٞ طَعَامُ مَسَٰكِينَ أَوۡ عَدۡلُ ذَٰلِكَ صِيَامٗا لِّيَذُوقَ وَبَالَ أَمۡرِهِۦۗ ﴾ [المائ‍دة: ٩٥]
‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে স্থলচর শিকারকে হত্যা করবে, তার উপর ঐ প্রাণীর সমান বিনিময় ওয়াজিব হবে, যাকে সে হত্যা করেছে; দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এর ফায়ছালা করবেন। বিনিময়ের প্রাণীটি উৎসর্গ হিসাবে কা‘বায় পৌঁছাতে হবে, অথবা কাফফারা স্বরূপ তার উপর কয়েকজন দরিদ্রকে খাওয়ানো ওয়াজিব হবে, অথবা তার সমপরিমাণ ছওম পালন করবে, যাতে সে স্বীয় কৃতকর্মের প্রতিফল আস্বাদন করে’ (মায়েদাহ ৯৫)। উক্ত আয়াতের আলোকে বলা যায়, ইহরাম অবস্থায় কেউ শিকারযোগ্য স্থলচর প্রাণীকে হত্যা করলে যদি তার সমকক্ষ কোনো গৃহপালিত পশু পাওয়া যায়, তাহলে তার সামনে তিনটি পথ: হয় সে হত্যাকৃত প্রাণীর সমকক্ষ প্রাণীটিকে হারাম এলাকায় যবেহ করে তার সম্পূর্ণ গোশত ছাদাক্বা করে দিবে, তা থেকে সে নিজে মোটেও খাবে না, অন্যথায় সমকক্ষ পশুটির মূল্য খাদ্যের হিসাবে হিসাব করে মাথাপিছু আধা ‘ছা’ হারে মিসকীনদের মাঝে বণ্টন করতে হবে, অথবা মিসকীনদের সংখ্যার সমপরিমাণ ছওম পালন করতে হবে। কিন্তু যদি হত্যাকৃত প্রাণীটির সমকক্ষ পশু না পাওয়া যায়, তাহলে উক্ত বিবরণ মোতাবেক খাদ্য খাওয়াতে হবে অথবা ছওম পালন করতে হবে।
আয়াতটি আরো প্রমাণ করে যে, কেবলমাত্র ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকারীর উপরেই এই বিনিময় ওয়াজিব হবে; ভুলবশতঃ বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকারীর উপরে নয়। আমাদের শায়খ আব্দুল আযীয ইবনে বায তাঁর ‘মাজমূউ ফাতাওয়া (১৭/২০৩)’-তে, শায়খ মুহাম্মাদ আমীন শানক্বীত্বী ‘আযওয়াউল বায়ান (২/১৬৯)’-এ এবং শায়খ আব্দুর রহমান সা‘দী সূরা মায়েদাহ্‌র উক্ত আয়াত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই অভিমতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
উল্লেখ্য যে, হারাম এলাকার শিকারযোগ্য প্রাণী মুহরিম এবং সাধারণ মানুষ সবার উপরই হারাম; বরং সেটিকে তাড়ানোও হারাম। অনুরূপভাবে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় এমনিতে উদগত গাছ-গাছালি কাটাও হারাম। মানুষের রোপনকৃত গাছ-গাছালির ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য নয়। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বর্ণিত হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ مَكَّةَ فَلَمْ تَحِلَّ لِأَحَدٍ قَبْلِي وَلَا تَحِلُّ لِأَحَدٍ بَعْدِي وَإِنَّمَا أُحِلَّتْ لِي سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ لَا يُخْتَلَى خَلَاهَا وَلَا يُعْضَدُ شَجَرُهَا وَلَا يُنَفَّرُ صَيْدُهَا وَلَا تُلْتَقَطُ لُقَطَتُهَا إِلَّا لِمُعَرِّفٍ»
‘আল্লাহ মক্কাকে হারাম এলাকা হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এটিকে আমার পূর্বে কারো জন্য হালাল করা হয়নি এবং আমার পরেও কারো জন্য হালাল করা হবে না। তবে আমার জন্য কিছুক্ষণ সেটিকে হালাল করা হয়েছিল। এখানকার তাযা ঘাস ছাটা যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, শিকারযোগ্য প্রাণীকে তাড়ানো চলবে না এবং পতিত বস্তু উঠানো যাবে না; তবে মূল মালিকের সন্ধান নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তি তা উঠাতে পারে’ (বুখারী, হা/১৮৩৩; মুসলিম, হা/৩৩০২)। হাদীছে উল্লেখিত الخَلَا অর্থ হচ্ছে, তাযা ঘাস।
মদীনার হারাম এলাকার ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। জাবের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَإِنِّى حَرَّمْتُ الْمَدِينَةَ مَا بَيْنَ لاَبَتَيْهَا لاَ يُقْطَعُ عِضَاهُهَا وَلاَ يُصَادُ صَيْدُهَا»
‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম মক্কাকে হারাম এলাকা হিসাবে ঘোষণা করেছেন এবং আমি মদীনার কালো পাথরবেষ্টিত দুই এলাকার মধ্যবর্তী অঞ্চলকে হারাম অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা দিলাম। এখানকার গাছ-গাছালি কাটা যাবে না এবং শিকারযোগ্য পশু শিকার করা যাবে না’ (মুসলিম, হা/৩৩১৭)। আলী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত হাদীছে এসেছে,
«وَلاَ تُلْتَقَطُ لُقَطَتُهَا إِلاَّ لِمَنْ أَشَادَ بِهَا»
‘মূল মালিকের সন্ধান নিতে আগ্রহী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য এখানকার পতিত বস্তু উঠানো যাবে না’ (আবূ দাঊদ, হা/২০৩৫, সনদ ছহীহ)।
মূল মালিকের সন্ধান নিতে আগ্রহী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো জন্য দুই হারাম এলাকায় পতিত বস্তু উঠানো নিষেধ হওয়ার কারণ হচ্ছে, এই দুই জায়গায় মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করে। ফলে কেউ কোন জিনিস হারালে সে কয়েক বছর পরে হলেও তার হারানো জিনিস পেয়ে যাবে। আর সে কারণে মক্কা ও মদীনায় আমানতদার এমন কর্তৃপক্ষ থাকা উচিৎ, যারা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মানুষের হারানো জিনিস গ্রহণ করবে এবং তার মূল মালিক যখনই আসুক, তা তাকে ফেরৎ দিবে।
আর আল্লাহ যেহেতু হারাম এলাকার শিকারযোগ্য প্রাণী হত্যা করা হারাম করেছেন এবং তিনি এটিকে নিরাপদ করেছেন, সেহেতু ঐসব প্রাণীর খাদ্য গাছ-গাছালি, সবুজ ঘাস নষ্ট করাও হারাম করেছেন। ফলে এই বিধানের মাধ্যমে ঐসব প্রাণী হারাম এলাকায় যেমন তাদের নিরাপত্তা পেল, তেমনি তাদের খাবার ব্যবস্থাও নিশ্চিত হল।
৭. বিবাহ সম্পন্ন করা এবং বিবাহের প্রস্তাব দেওয়া: উসমান ইবনে আফফান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لاَ يَنْكِحُ الْمُحْرِمُ وَلاَ يُنْكَحُ وَلاَ يَخْطُبُ»
‘মুহরিম ব্যক্তি নিজে যেমন বিয়ে করবে না, তেমনি অন্যকেও বিয়ে দিবে না এবং বিবাহের প্রস্তাবও পেশ করবে না’ (মুসলিম, হা/৩৪৪৬)। কোন মুহরিম কর্তৃক বিবাহ সংঘটিত হলে উক্ত বিবাহ সঠিক গণ্য হবে না। সেজন্য উক্ত বৈবাহিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে হলে নতুনভাবে আবার বিয়ে পড়াতে হবে।
৮ ও ৯. স্ত্রী সহবাস করা এবং যৌন উত্তেজনার সহিত স্ত্রীকে আলিঙ্গন করা: মহান মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ﴾ [البقرة: ١٩٧]
‘হজ্জের জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস রয়েছে। এসব মাসে যে ব্যক্তি হজ্জের ইহরাম বাঁধবে, তার জন্য হজ্জে স্ত্রী সহবাস করা, অশোভন কোন কাজ করা এবং ঝাগড়া-বিবাদ করা জায়েয নয়’ (বাক্বারাহ ১৯৭)। আয়াতে ‘রফাছ’ (رَفَثَ) শব্দটি স্ত্রী সহবাস এবং যৌন উত্তেজনার সহিত স্বামী-স্ত্রীর আলিঙ্গন উভয়কে শামিল করে। অনুরূপভাবে ইহা অশোভন কথা এবং কাজকেও শামিল করে। ‘ফুসূক্ব’ (فُسُوقَ) শব্দটি যাবতীয় পাপাচারকে বুঝায়। অনর্থক এবং হিংসা-বিদ্বেষ মূলক তর্ক-বিতর্ক ও ঝগড়া বুঝাতে ‘জিদাল’ (جِدَالَ) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে হক্বকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে বিতর্ক করা যায়; বরং তা করা উচিৎ। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ﴾ [النحل: ١٢٥]
‘তাদের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করুন’ (নাহ্‌ল ১২৫)। অন্য আয়াতে এসেছে,
﴿ ۞وَلَا تُجَٰدِلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلۡكِتَٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡۖ﴾ [العنكبوت: ٤٦]
‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করবে না। তবে তাদের সাথে নয়, যারা তাদের মধ্যে যুলম করেছে’ (আনকাবূত ৪৬) ।
মুহরিম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে বা যৌন উত্তেজনার সহিত পরস্পরে আলিঙ্গন করলে কি আবশ্যক হবে, তদ্বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন হাদীছ পাওয়া যায় না। তবে এ বিষয়ে ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকে কতিপয় আছার বর্ণিত হয়েছে। আমর ইবনে শু‘আইব তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর নিকটে এসে ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাসকারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর দিকে ইশারা করে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বললেন। শু‘আইব বলেন, লোকটি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) না চেনায় আমি তার সাথে গেলাম। লোকটি ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাবে বলেন, «بَطَلَ حَجُّكَ» ‘তোমার হজ্জ বাতিল হয়ে গেছে’। লোকটি বললেন, এখন আমার করণীয় কি? তিনি বললেন,
«اخْرُجْ مَعَ النَّاسِ وَاصْنَعْ مَا يَصْنَعُونَ فَإِذَا أَدْرَكْتَ قَابِلاً فَحُجَّ وَأَهْدِ»
‘লোকদের সাথে বেরিয়ে যাও এবং তাদের মত তুমিও হজ্জের কার্যাবলী সম্পন্ন কর। তবে আল্লাহ বাঁচালে আগামী বছর আবার হজ্জ করবে এবং একটি ফিদ্‌ইয়া দিবে’। (শু‘আইব বলেন) অতঃপর লোকটি আমার সাথে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর নিকটে গিয়ে তাঁকে সবকিছু বললেন। এবার তিনি ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর নিকটে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বললেন। শু‘আইব বলেন, আমি তার সাথে ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর নিকটে গেলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনিও ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর মত জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি আমার সাথে আবার আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর নিকটে এসে তাঁকে ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর বক্তব্য শুনালেন এবং বললেন, এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন,
«قَوْلِى مِثْلَ مَا قَالاَ»
‘তাঁদের অভিমতের মতই আমার অভিমত’ (হাকেম, ২/৬৫, তিনি বলেন, হাদীছটির রাবীগণ নির্ভরযোগ্য এবং হাফেয। শুআইব ইবনে মুহাম্মাদ যে তাঁর দাদা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর কাছ থেকে হাদীছ শুনেছেন, এই হাদীছটি তারও বাস্তব এবং নিশ্চিত প্রমাণ। হাফেয যাহাবী হাকেমকে সমর্থন করেছেন)। ইমাম বায়হাক্বী (রহেমাহুল্লাহ) হাকেমের সূত্রে হাদীছটি বর্ণনার পর বলেন, ‘এর সনদ ছহীহ এবং হাদীছটি আরো প্রমাণ করে যে, শু‘আইব ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ তাঁর দাদা আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর কাছ থেকে হাদীছটি শুনেছেন’ (সুনানে কুবরা, ২/৬৫)। যাহোক, উক্ত আছারে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর সর্বসম্মতিতে প্রমাণিত হয় যে, ইহরাম অবস্থায় স্ত্রী সহবাসকারীর হজ্জ নষ্ট হয়ে যাবে; তবে হজ্জের অবশিষ্ট কার্যাবলী তাকে পূর্ণ করতে হবে। আর পরবর্তী বছর তাকে আবার হজ্জ আদায় করতে হবে এবং একটি ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে। তাঁদের সবার উক্তি ‘লোকদের সাথে বেরিয়ে যাও এবং তাদের মত তুমিও হজ্জের কার্যাবলী সম্পন্ন কর। তবে আল্লাহ বাঁচালে আগামী বছর আবার হজ্জ করবে এবং একটি ফিদ্‌ইয়া দিবে’ প্রমাণ করে যে, প্রাথমিক হালাল হওয়ার পূর্বেই ঐ ব্যক্তি কর্তৃক স্ত্রী সহবাস সংঘটিত হয়েছিল।
প্রাথমিক হালাল হওয়ার পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে একটি উট কুরবানী করে তার গোশত হারাম এলাকার দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। পক্ষান্তরে প্রাথমিক হালালের পরে স্ত্রী সহবাস করলে সর্বসম্মতিক্রমে তার হজ্জ নষ্ট হবে না এবং এক্ষেত্রে তাকে একটি ছাগল ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে।
আর ওমরার ক্ষেত্রে বিধান হচ্ছে, সা‘ঈ অথবা ত্বওয়াফের পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে ওমরা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ঐ ওমরা সম্পন্ন করতে হবে এবং প্রথম ওমরার মীক্বাত থেকে ইহরাম বেঁধে নতুন আরেকটি ওমরা করতে হবে। সাথে সাথে তাকে একটি ফিদ্‌ইয়াও দিতে হবে। এক্ষেত্রে ফিদ্‌ইয়া হচ্ছে, ছাগল যবেহ করে তার গোশত হারাম এলাকার দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়া। পক্ষান্তরে যদি সে সা‘ঈর পরে এবং মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটার পূর্বে স্ত্রী সহবাস করে, তাহলে তার ওমরা নষ্ট হবে না। তবে তাকে একটি ছাগল ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে। অবশ্য যদি যৌন উত্তেজনার সহিত স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে আলিঙ্গন করে এবং বীর্যপাত ঘটে, তাহলে তার হজ্জ নষ্ট হবে না। কেননা যেনার ক্ষেত্রে এমন অবস্থায় হাদ্দ অর্থাৎ শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি ওয়াজিব হয় না। তাছাড়া যে সহবাসের মাধ্যমে হজ্জ নষ্ট হয়, এটি সে পর্যায়ের নয়। তবে প্রাথমিক হালালের পূর্বে এমনটি করে থাকলে তাকে উট ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে। আর প্রাথমিক হালালের পরে করলে ছাগল ফিদ্‌ইয়া দিতে হবে।
উক্ত বিধিবিধান পুরুষের মত মহিলাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে স্ত্রীকে যদি একাজে বাধ্য করা হয়, তবে তার উপর ফিদ্‌ইয়া ওয়াজিব হবে না।
হজ্জ ও ওমরার সংক্ষিপ্ত এবং বিস্তারিত নিয়ম
এক নযরে ওমরাঃ মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধবে। হারামে পৌঁছে ত্বওয়াফ এবং সা‘ঈ করবে। অতঃপর মাথা মুণ্ডন করে বা চুল ছেটে হালাল হয়ে যাবে। ওমরার ক্ষেত্রে মক্কাবাসীদেরকে হারাম এলাকার বাহির থেকে ইহরাম বাঁধতে হবে।
এক নযরে হজ্জঃ বহিরাগত হাজীরা নিজ নিজ মীক্বাত থেকে এবং মক্কাবাসী ও সেখানে অবস্থানকারীরা মক্কা থেকেই ইহরাম বাঁধবে। ক্বিরান এবং ইফরাদ হজ্জ পালনকারী ত্বওয়াফে ক্বুদূম বা আগমনী ত্বওয়াফ করবে এবং ছাফা-মারওয়া সা‘ঈ করবে। তবে ত্বওয়াফে ইফাদ্বার পরে সা‘ঈ করতে চাইলে তারা এই সা‘ঈ পিছিয়ে দিতে পারে। ৮ই যিল-হজ্জের দিনের বেলায় এবং ৯ই যিল-হজ্জের রাতে হাজীরা মিনায় থাকবে। অতঃপর তারা আরাফায় অবস্থান এবং মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করতে যাবে। ঈদের দিন জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপ করবে, তার উপর কুরবানী থাকলে কুরবানী করবে, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছাটবে, ত্বওয়াফে ইফাদ্বা করবে এবং তামাত্তু হজ্জ পালনকারী হলে ছাফা-মারওয়া সা‘ঈ করবে। অনুরূপভাবে ক্বিরান ও ইফরাদ হজ্জ পালনকারী ত্বওয়াফে ক্বুদূমের সাথে সা‘ঈ না করে থাকলে তারাও এসময় সা‘ঈ করবে। অতঃপর তাশরীক্বের দিনগুলিতে মিনায় রাত্রিযাপন করবে এবং প্রত্যেকদিন সূর্য ঢলে যাওয়ার পরে তিন জামরাতেই কংকর নিক্ষেপ করবে। অতঃপর মক্কা ত্যাগের সময় বিদায়ী সাত চক্কর ত্বওয়াফ করে মক্কা ছাড়বে।
হজ্জ ও ওমরার বিস্তারিত নিয়ম
ইহরামের প্রস্তুতি
হজ্জ ও ওমরা পালনেচ্ছু মুসলিম ব্যক্তি মদীনার মত মীক্বাতের নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে গাড়ী যোগে মক্কায় আসতে চাইলে বাড়ী থেকেই সে ইহরামের প্রস্তুতি নিতে পারে। ইহরামের প্রস্তুতি হিসাবে প্রয়োজন দেখা দিলে নখ কাটবে, গোঁফ ছাটবে, নাভীর নীচের চুল চেঁছে ফেলবে, বগলের লোম ছাফ করবে। অতঃপর ইহরামের জন্য গোসল করবে, সুগন্ধি ব্যবহার করবে এবং পরনের কাপড় ও গায়ের চাদর পরবে। অতঃপর মীক্বাত থেকে ইহরাম বাঁধবে। সে যদি যুল-হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশক শুরু হওয়ার পরে ইহরাম বাঁধে এবং কুরবানী করতে চায়, তাহলে চুল, নখ কোনটিই কাটবে না। উম্মে সালামা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا رَأَيْتُمْ هِلاَلَ ذِى الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّىَ فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ»
‘যখন তোমরা যুল-হিজ্জাহ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করবে, তখন সে যেন তার চুল-নখ না কাটে’ (মুসলিম, হা/৫১১৯)। তবে যুল-হিজ্জাহ্‌র প্রথম দশকে সম্পাদিত ওমরা থেকে হালাল হওয়ার জন্য যে চুল ছাটা হয়, তা এই হুকুমের মধ্যে পড়বে না। কেননা তা ওমরার একটি ওয়াজিব কাজ।
কেউ যদি দূর থেকে গাড়ী যোগে হজ্জ বা ওমরা করতে আসে, তাহলে সে মীক্বাতে নামবে এবং যা কিছু কাটা বা ছাটা দরকার, করবে। অতঃপর ইহরামের জন্য গোসল করে পরনের কাপড় এবং গায়ের চাদর পরবে। তারপর ইহরাম বাঁধবে। যেমন: কোনো ইয়েমেনী যদি ইয়ালামলাম অতিক্রম করে, তাহলে সে সেখানে নেমে উক্ত কাজগুলি করবে। তবে সে যদি বিমান যোগে আসে, তাহলে তার দেশ থেকেই গোসলসহ ইহরামের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে। অতঃপর বিমান মীক্বাত বরাবর আসলে অথবা মীক্বাতের নিকটবর্তী হলে ইহরাম বাঁধবে।


ইহরাম
১. হজ্জ বা ওমরার কার্যাবলী শুরু করার নিয়তকেই ইহরাম বলে। অতএব, নিয়্যত ছাড়া কেউ মুহরিম হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ»
প্রত্যেকটি আমল নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল’ (বুখারী, হা/১; মুসলিম, হা/৪৯২৭)। নিয়্যতবিহীন ইহরামের কাপড় পরাকে ইহরাম বলা যায় না; বরং ইহা ইহরাম বাঁধার প্রস্তুতি হিসাবে গণ্য। অতএব, সে যে প্রকারের হজ্জ করতে চায়, মনে মনে তার নিয়্যত করবে। তামাত্তু হজ্জ করতে চাইলে ওমরার নিয়্যত করবে, ইফরাদ হজ্জ করতে চাইলে শুধু হজ্জের নিয়্যত করবে এবং ক্বিরান হজ্জ করতে চাইলে হজ্জ ও ওমরা উভয়ের নিয়্যত করবে। হজ্জের মাসগুলিতে স্থলপথ, আকাশ পথ বা পানি পথে মীক্বাত অতিক্রম করলে অথবা মীক্বাত বরাবর স্থানে পৌঁছলে উক্ত নিয়্যত করতে হয়। আর হজ্জের মাসগুলি হচ্ছে, শাওয়াল, যুল-ক্বা‘দাহ এবং যুল-হিজ্জাহ মাসের প্রথম দশক। তবে হজ্জের মাসগুলির বাইরে অন্য মাসে কেউ যদি মীক্বাত অতিক্রম করে বা মীক্বাত বরাবর স্থানে পৌঁছে, তাহলে সে শুধুমাত্র ওমরার ইহরাম বাঁধবে এবং হজ্জের সাথে এই ওমরার কোনরূপ সম্পর্ক থাকবে না।
২. মুহরিম ব্যক্তি মনে মনে যে নিয়্যত করেছে, তা মুখে উচ্চারণ করা ভাল। সে তার হজ্জের প্রকার অনুযায়ী বলবে, لَبَّيْكَ عُمْرَةً ‘লাব্বাইক উমরাতান’ (অর্থ: আমি আপনার ডাকে সাড়া দিতে ওমরার জন্য হাযির), বা لَبَّيْكَ حَجًّا ‘লাব্বাইক হাজ্জান’ (অর্থ: আমি আপনার ডাকে সাড়া দিতে হজ্জের জন্য হাযির), অথবা لَبَّيْكَ عُمْرَةً وَحَجًّا ‘লাব্বাইক উমরাতান ওয়া হাজ্জান’ (অর্থ: আমি আপনার ডাকে সাড়া দিতে ওমরা ও হজ্জের জন্য হাযির)। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বিরান হজ্জ করেন এবং একসাথে হজ্জ ও ওমরার নিয়্যত করেন। আনাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,
«سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ لَبَّيْكَ عُمْرَةً وَحَجًّا»
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে 'লাব্বাইক উমরাতান ওয়া হাজ্জান' বলতে শুনেছি’ (মুসলিম, হা/২৯৯৫)। অনুরূপভাবে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা উমরাতান’ (অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিতে ওমরার জন্য হাযির), বা ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা হাজ্জান’ অথবা ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা উমরাতান ওয়া হাজ্জান’ও পড়া যায়। জাবের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, ‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হজ্জে গিয়ে বলেছিলাম, ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা বিল-হাজ্জ’। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের হজ্জের নিয়্যতকে ওমরায় পরিণত করার আদেশ করেছিলেন, আর আমরা তা-ই করেছিলাম’ (বুখারী, হা/১৫৭০)।
হজ্জ এবং ওমরার নিয়্যত ব্যতীত অন্য কোনো ইবাদতের নিয়্যত মুখে উচ্চারণ করা যাবে না। যেমন: ত্বওয়াফ, সা‘ঈ, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম ইত্যাদির নিয়্যত। কেননা অন্য ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছ বর্ণিত হয়নি। অন্যান্য ইবাদতে মুখে নিয়্যত উচ্চারণ করা যদি কল্যাণকর হত, তবে ছাহাবায়ে কেরামসহ এই উম্মতের অন্যান্য সালাফে ছালেহীন তা করতেন।
৩. মুহরিম ব্যক্তি ইহরাম বাঁধার সময় শর্ত জুড়ে দিতে পারে। সে বলতে পারে, فَإِنْ حَبَسَنِى حَابِسٌ فَمَحِلِّي حَيْثُ حَبَسْتَنِي (উচ্চারণ: ফাইন হাবাসানী হা-বিসুন ফামাহিল্লী হায়ছু হাবাসতানী), অর্থ: যদি আমার হজ্জ ও ওমরা পালনে কোন বাধা আসে, তাহলে (হে আল্লাহ!) যেখানে আপনি আমাকে বাধা দিবেন, সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান গণ্য হবে। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন,
«دَخَلَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- عَلَى ضُبَاعَةَ بِنْتِ الزُّبَيْرِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَتْ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى أُرِيدُ الْحَجَّ وَأَنَا شَاكِيَةٌ. فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- حُجِّى وَاشْتَرِطِى أَنَّ مَحِلِّى حَيْثُ حَبَسْتَنِى»
‘দ্বুবা‘আহ বিনতে যুবায়ের ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসলে দ্বুবা‘আহ বলেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমি হজ্জ করতে চাই; কিন্তু আমি অসুস্থ? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি হজ্জ করতে যাও এবং এই বলে শর্ত কর যে, (হে আল্লাহ্‌!) আপনি যেখানেই আমাকে বাধা দিবেন, সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান গণ্য হবে’ (বুখারী, হা/৫০৮৯; মুসলিম, হা/২৯০৩)। এরূপ শর্তারোপ করার উপকার হচ্ছে এই যে, মুহরিম ব্যক্তি অসুস্থতা বা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যদি হজ্জ বা ওমরা পালন করতে ব্যর্থ হয়, অথবা তাকে হজ্জ বা ওমরা শেষ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে সে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে এবং তার উপর কিছুই বর্তাবে না।
৪. মুহরিম ব্যক্তি যদি মদীনাবাসীর মীক্বাত যুল-হুলায়ফা থেকে ইহরাম বাঁধে, তাহলে সে ইহরাম বাঁধার আগে ফরয বা নফল ছালাত আদায় করে ইহরাম বাঁধতে পারে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেন, ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আক্বীক্ব উপত্যকায় বলতে শুনেছি,
«أَتَانِى اللَّيْلَةَ آتٍ مِنْ رَبِّى فَقَالَ صَلِّ فِى هَذَا الْوَادِى الْمُبَارَكِ وَقُلْ عُمْرَةً فِى حَجَّةٍ»
‘রাতে আমার নিকটে আমার প্রভুর পক্ষ থেকে একজন আগমনকারী (জিবরীল) এসে বলেন, আপনি বরকতময় এই উপত্যকায় ছালাত আদায় করুন এবং বলুন, 'উমরাতান ফী হাজ্জাহ' (অর্থাৎ একসঙ্গে হজ্জ ও ওমরার ইহরাম বাঁধুন)’ (বুখারী, হা/১৫৩৪)।
মীক্বাতে যানবাহনে আরোহণের পর ইহরাম বাঁধা উত্তম। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন,
«أَهَلَّ النَّبِىُّ - صلى الله عليه وسلم - حِينَ اسْتَوَتْ بِهِ رَاحِلَتُهُ قَائِمَةً»
‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে তাঁর বাহন দাঁড়ানোর পর তিনি নিয়্যত করেন এবং উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়েন’ (বুখারী, হা/১৫৫২; মুসলিম, হা/২৮২১)। ইমাম বুখারী অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে, بَابُ التَّحْمِيدِ وَالتَّسْبِيحِ وَالتَّكْبِيرِ قَبْلَ الْإِهْلَالِ عِنْدَ الرُّكُوبِ عَلَى الدَّابَّةِ ‘সওয়ারীর পিঠে আরোহনের সময় নিয়্যত বাঁধা এবং তালবিয়া পাঠের পূর্বে আল্লাহ্‌র প্রশংসা করা, তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং বড়ত্ব বর্ণনা করা’ অনুচ্ছেদ। এরপর তিনি এমর্মে বর্ণিত আনাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর হাদীছ উল্লেখ করেন (হা/১৫৫১)। হাফেয ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) এর ব্যাখ্যায় বলেন, وَهَذَا الْحُكْمُ -وَهُوَ اسْتِحْبَابُ التَّسْبِيِحِ وَمَا ذُكِرَ مَعَهُ قَبْلَ الْإِهْلاَلِ- قَلَّ مَنْ تَعَرَّضَ لِذِكْرِهِ مَعَ ثُبُوْتِهِ ‘ইহরাম বাঁধার পূর্বে তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি উত্তম হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও খুব অল্প সংখ্যক বিদ্বানই তা উল্লেখ করেছেন’।
৫. ইহরাম না বেঁধে মীক্বাত অতিক্রম করবে না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীক্বাত নির্ধারণ করে দেওয়ার সময় বলেন,
«هُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِهِنَّ مِمَّنْ أَرَادَ الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ»
‘এসব এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরা করতে চায় এবং তারা ব্যতীত যারাই এসব এলাকা দিয়ে হজ্জ ও ওমরা করতে আসবে, এগুলি তাদের সকলের মীক্বাত’। মীক্বাতের আলোচনার সময় হাদীছটি গত হয়ে গেছে।
৬. যার বাড়ী মক্কা এবং মীক্বাতের মধ্যবর্তী স্থানে, সে তার বাড়ী থেকেই ইহরাম বাঁধবে। ইহরাম না বেঁধে বাড়ী ত্যাগ করবে না। কেননা তার বাড়ীই হচ্ছে তার মীক্বাত। তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মীক্বাতসমূহ নির্ধারণ করেন এবং সেখান থেকে ইহরাম বাঁধার আদেশ দেন, তখন তিনি বলেন,
«وَمَنْ كَانَ دُونَ ذَلِكَ فَمِنْ حَيْثُ أَنْشَأَ حَتَّى أَهْلُ مَكَّةَ مِنْ مَكَّةَ»
‘যারা মীক্বাতসমূহের ভেতরে বসবাস করে, তারা তাদের অবস্থান থেকেই ইহরাম বাঁধবে; এমনকি মক্কাবাসী মক্কা থেকে’। হাদীছটি ইতোপূর্বে গত হয়ে গেছে।
৭. মক্কাবাসী এবং সেখানে অবস্থানরত অন্যান্যদের হজ্জের ইহরাম হবে মক্কা থেকেই। পক্ষান্তরে তাদের (মক্কাবাসী এবং সেখানে অবস্থানরত অন্যান্যদের) ওমরার ইহরাম হবে হারাম এলাকার বাইরে যে কোনো হালাল এলাকা থেকে। কেননা হজ্জের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে ওমরার অনুমতি দিয়েছিলেন, তখন তিনি হারাম এলাকার বাইরে তান‘ঈম থেকে ইহরাম বেঁধেছিলেন (বুখারী, হা/১৭৮৫; মুসলিম, হা/২৯১০)।
ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কাবাসী কর্তৃক হারাম এলাকার বাইরে থেকে ইহরাম বাঁধার কারণে তাদের ওমরায় হারাম এবং হালাল উভয় এলাকার সমন্বয় ঘটে। অনুরূপভাবে হজ্জের জন্য হারাম এলাকা থেকে ইহরাম বাঁধলেও হালাল এলাকা আরাফায় অবস্থানের কারণে তাদের হজ্জেও হারাম এবং হালাল উভয় এলাকার সমন্বয় ঘটে।
৮. তামাত্তু হজ্জের ক্ষেত্রে মুহরিম ব্যক্তি হজ্জের মাসগুলির কোনো এক সময় মীক্বাত থেকে ওমরার ইহরাম বাঁধবে। অতঃপর ত্বওয়াফ এবং সা‘ঈ সম্পন্ন করে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেটে হালাল হয়ে যাবে। অতঃপর যুল-হিজ্জাহ মাসের ৮ তারিখে হজ্জের ইহরাম বাঁধবে এবং পর্যায়ক্রমে হজ্জের কার্যাবলী সম্পন্ন করবে। তামাত্তু হজ্জ পালনকারী কুরবানী করবে। সে একটি ছাগল কুরবানী দিতে পারে অথবা সাত জনে একটি উট বা গরুতে অংশগ্রহণ করতে পারে। কেউ কুরবানী দিতে অক্ষম হলে তাকে ১০টি ছওম পালন করতে হবে; তিনটি হজ্জে এবং অবশিষ্ট ৭টি হজ্জ থেকে ফিরে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿فَمَن تَمَتَّعَ بِٱلۡعُمۡرَةِ إِلَى ٱلۡحَجِّ فَمَا ٱسۡتَيۡسَرَ مِنَ ٱلۡهَدۡيِۚ فَمَن لَّمۡ يَجِدۡ فَصِيَامُ ثَلَٰثَةِ أَيَّامٖ فِي ٱلۡحَجِّ وَسَبۡعَةٍ إِذَا رَجَعۡتُمۡۗ تِلۡكَ عَشَرَةٞ كَامِلَةٞۗ ذَٰلِكَ لِمَن لَّمۡ يَكُنۡ أَهۡلُهُۥ حَاضِرِي ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ﴾ [البقرة: ١٩٦]
‘আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরা একত্রে পালন করতে চাও, যা কিছু সহজলভ্য, তা দিয়ে হাদঈ (হজ্জের কুরবানী) যবেহ করাই তাদের উপর কর্তব্য। কিন্তু যারা হাদঈর পশু পাবে না, তারা হজ্জের দিনগুলির মধ্যে তিনটি ছওম পালন করবে আর সাতটি পালন করবে হজ্জ থেকে ফিরে যাওয়ার পর। এভাবে দশটি ছওম পূর্ণ করতে হবে। এ বিধান তাদের জন্য, যাদের পরিবার-পরিজন মসজিদে হারামের আশে-পাশে বসবাস করে না’ (বাক্বারাহ ১৯৬)। তামাত্তু এবং ক্বিরান হজ্জ পালনকারীর উপর শুকরিয়াস্বরূপ এই হাদঈ যবেহ করা ওয়াজিব হয়; ক্ষতিপূরণ হিসাবে নয়। অর্থাৎ এক সফরে হজ্জ ও ওমরা দু’টি ইবাদত সম্পন্ন করার কারণে সে আল্লাহ্‌র শুকরিয়াস্বরূপ হাদঈ প্রদান করবে; হজ্জে ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে যাওয়ার কারণে নয়। মহান আল্লাহ্‌র বাণী, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরা একত্রে পালন করতে চাও, যা কিছু সহজলভ্য, তা দিয়ে কুরবানী করাই তাদের উপর কর্তব্য’-এর তাফসীরে হাফেয ইবনে কাছীর (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তামাত্তু হজ্জ করবে। আর তামাত্তু হজ্জ দুইভাবে হতে পারে: একই সাথে হজ্জ ও ওমরা উভয়ের ইহরাম বাঁধবে । অথবা প্রথমে ওমরার ইহরাম বেঁধে ওমরা সম্পন্ন করার পর হজ্জের ইহরাম বাঁধবে। শেষোক্তটিই খাছ এবং প্রসিদ্ধ তামাত্তু হজ্জ। তবে সাধারণ অর্থে তামাত্তু বলতে উল্লেখিত দুই প্রকার হজ্জকেই বুঝায়; ছহীহ হাদীছসমূহ একথার প্রমাণ বহন করে। কেননা কোনো কোনো বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তামাত্তু হজ্জ করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি ক্বিরান হজ্জ করেছেন। যদিও তিনি যে কুরবানী সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে কোনো মতানৈক্য নেই’ ।
ক্বিরান হজ্জের ক্ষেত্রে মুহরিম ব্যক্তি মীক্বাত থেকে হজ্জ ও ওমরা উভয়ের ইহরাম বাঁধবে। অতঃপর মক্কায় পৌঁছে ত্বওয়াফে ক্বুদূম বা আগমনী ত্বওয়াফ শেষে ছাফা-মারওয়ায় সা‘ঈ করতঃ কুরবানীর দিন পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকবে। কুরবানীর দিন জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপ শেষে মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেটে হালাল হয়ে যাবে। তামাত্তু হজ্জ পালনকারীর মত ক্বিরান হজ্জ পালনকারীকেও কুরবানী করতে হবে।
ইফরাদ হজ্জের ক্ষেত্রে মুহরিম ব্যক্তি মীক্বাত থেকে শুধুমাত্র হজ্জের ইহরাম বাঁধবে এবং ক্বিরান হজ্জ পালনকারীর মত একই কাজ করবে। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, ক্বিরান হজ্জ পালনকারীকে কুরবানী করতে হয়; কিন্তু ইফরাদ হজ্জ পালনকারীকে কুরবানী দিতে হয় না।
৯. তিন প্রকার হজ্জের মধ্যে তামাত্তু হজ্জ সর্বোত্তম। যেসব ছাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হজ্জ করেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ওমরার ইহরাম বাঁধেন, কেউ কেউ হজ্জের ইহরাম বাঁধেন, আবার কেউ কেউ হজ্জ-ওমরা উভয়ের ইহরাম বাঁধেন। তাঁরা মক্কায় পৌঁছলে তাঁদের মধ্যে যাঁরা ক্বিরান অথবা ইফরাদ হজ্জ পালনকারী ছিলেন এবং সঙ্গে হাদঈ নিয়ে যান নি, তাঁদের প্রত্যেকের ইহরামকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমরার ইহরামে পরিণত করার আদেশ করেন। কারণ এর মাধ্যমে তাঁরা তামাত্তু হজ্জ পালনকারী হয়ে যেতে পারবেন। আর এটি সর্বোত্তম এবং শ্রেষ্ঠতম না হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি তাঁদেরকে পথনির্দেশ করতেন না। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু ক্বিরান হজ্জের ইহরাম বেঁধেছিলেন এবং সঙ্গে হাদঈ নিয়ে গিয়েছিলেন, সেহেতু তিনি তাঁর আগের ইহরামের উপরেই অব্যাহত থেকে গিয়েছিলেন। ছাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) তাঁকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন,
«لَوْ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ مَا أَهْدَيْتُ وَلَوْلَا أَنَّ مَعِي الْهَدْيَ لَأَحْلَلْتُ»
‘আমি আগে যে কাজটি করেছি তা যদি এখন করতে পারতাম, তাহলে হাদঈ সঙ্গে আনতাম না। আর আমার সাথে যদি হাদঈ না থাকত, তাহলে আমি হালাল হয়ে যেতাম’ (বুখারী, হা/১৬৫১; মুসলিম, হা/২৯৪৩, জাবের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত)।
১০. কোনো কোনো বিদ্বান তামাত্তু হজ্জকে ওয়াজিব বলেছেন। তবে অধিকাংশই এটিকে ওয়াজিব বলেন নি। কেননা আবূ বকর, ওমর এবং উছমান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) ইফরাদ হজ্জ করতেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্ত বক্তব্য থেকে তাঁরা যদি তামাত্তু হজ্জ ওয়াজিব বুঝতেন, তাহলে তাঁরা অন্য হজ্জ করতেন না। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈসা (‘আলাইহিস্‌সালাম) শেষ যামানায় আসমান থেকে অবতরণের পর তিনি তিন প্রকার হজ্জের যে কোন একটির ইহরাম বাঁধবেন (মুসলিম, হা/৩০৩০)। হাদীছটি এরূপ:
«وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَيُهِلَّنَّ ابْنُ مَرْيَمَ بِفَجِّ الرَّوْحَاءِ حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا أَوْ لَيَثْنِيَنَّهُمَا»
‘যার হাতে আমার প্রাণ, সেই সত্ত্বার কসম! অবশ্যই মারইয়াম তনয় (ঈসা) ফাজ্জুর রওহা (মক্কা-মদীনার মধ্যবর্তী একটি) স্থানে হজ্জ অথবা ওমরা অথবা উভয়ের তালবিয়া পাঠ করবেন’। উক্ত হাদীছও প্রমাণ করে যে, ক্বিরান এবং ইফরাদ হজ্জের বিধান অবশিষ্ট রয়েছে।
১১. ক্বিরান এবং ইফরাদ হজ্জ পালনকারী যদি সঙ্গে করে হাদঈ নিয়ে যায়, তাহলে কুরবানীর দিন পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর হজ্জে তা-ই করেছিলেন। পক্ষান্তরে তারা যদি হাদঈর পশু সঙ্গে না নিয়ে যায়, তাহলে তাদের ইহরামকে ওমরার ইহরামে রূপান্তর করবে। ইতোপূর্বে আমরা এমর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ উল্লেখ করেছি। ওমরা পালনকারী যদি হজ্জের মাসের বাইরে অথবা হজ্জের মাসে হাদঈর পশু সঙ্গে নিয়ে যায়, কিন্তু তার হজ্জের নিয়্যত না থাকে, তাহলে ওমরা শেষে সে সেটাকে যবেহ করে ফেলবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিইয়ার ওমরাতে হাদঈর পশু সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু মুশরিকরা তাঁকে তাঁর ওমরা সম্পন্ন করতে বাধা দিয়েছিল। ফলে তিনি হুদায়বিইয়াতে সেটিকে যবেহ করেছিলেন। আর যদি কেউ তামাত্তু হজ্জ তথা হজ্জ ও ওমরা উভয়ের ইহরাম বাঁধে এবং সঙ্গে করে হাদঈর পশু হাঁকিয়ে বা বহন করে নিয়ে যায়, তাহলে সে ক্বিরান হজ্জ পালনকারী হিসাবেই বিবেচিত হবে এবং কুরবানীর দিন পর্যন্ত সে ইহরাম অবস্থায় থাকবে। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) হতে বর্ণিত হাদীছটি একথার প্রমাণ বহন করে (বুখারী, হা/১৫৫৬ ও ৪৩৯৫; মুসলিম, হা/২৯১০)।
১২. যদি কোনো পুরুষ বা মহিলার সাথে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তান থাকে, তাহলে তারা তাকে হজ্জ এবং ওমরা করাতে পারে। অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তান ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম হলে সে অভিভাবকের অনুমতিক্রমে ইহরাম বাঁধবে। আর ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ে সক্ষম না হলে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে ইহরাম বাঁধবে। তবে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানের ইহরাম বাঁধা তার অভিভাবকের উপর ওয়াজিব নয়। অতএব, অভিভাবক যদি অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানের ইহরামের ব্যবস্থা না করে, তাহলে তার কোন গোনাহ হবে না।
উল্লেখ্য যে, অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বাচ্চা কর্তৃক হজ্জ ও ওমরা সম্পাদিত হলেও তা নফল হিসাবে গণ্য হবে। সেজন্য প্রাপ্ত বয়ষ্ক হওয়ার পরে তার উপর হজ্জ ও ওমরা ওয়াজিব হবে। হজ্জ ও ওমরার শর্তসমূহ উল্লেখ করার সময় এ বিষয়ে আমরা দলীল পেশ করেছি। বাচ্চা কংকর নিক্ষেপে সক্ষম না হলে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে নিক্ষেপ করে দিবে। ইবনুল মুনযির (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, বাচ্চা কংকর নিক্ষেপে সক্ষম না হলে তার পক্ষ থেকে নিক্ষেপ করে দেওয়া যাবে’ (আল-ইজমা/৬৬)। প্রাপ্ত বয়ষ্করা হজ্জের যেসব কাজ করে, বাচ্চাদেরকেও সেগুলো করতে হবে। অনুরূপভাবে প্রাপ্ত বয়ষ্করা যেসব নিষিদ্ধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকে, বাচ্চাদেরকেও সেগুলি থেকে বেঁচে থাকতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তার অভিভাবক ত্বওয়াফ বা সা‘ঈ করলে অভিভাবক নিজের পক্ষ থেকে যেমন ত্বওয়াফ বা সা‘ঈর নিয়্যত করবে, তেমনি ঐ বাচ্চার পক্ষ থেকেও ত্বওয়াফ বা সা‘ঈর নিয়্যত করবে।
বাচ্চাদেরকে নিয়ে তাদের অভিভাবকদের পৃথক ত্বওয়াফের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা যে মহিলাটি তার বাচ্চার হজ্জ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁকে তিনি এমনটি নির্দেশ করেন নি। মহিলাটি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! এর কি হজ্জ হবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ! আর তুমি নেকী পাবে’ (মুসলিম, হা/৩২৫৪)।
১৩. হজ্জ বা ওমরা পালনেচ্ছু ঋতুবতী অথবা প্রসূতি মহিলা মীক্বাত অতিক্রম করলে তারাও ইহরাম বাঁধবে এবং ত্বওয়াফ ব্যতীত সাধারণ হাজীরা যা করে, তারাও তাই করবে। পবিত্র হওয়ার পর গোসল করে ত্বওয়াফ করে নিবে। জাবের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত হাদীছে এসেছে, ‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হয়ে যখন যুল-হুলায়ফাতে পৌঁছলাম, তখন আসমা বিনতে উমাইস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) মুহাম্মাদ ইবনে আবূ বকরকে প্রসব করলেন। অতঃপর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জানতে চেয়ে খবর পাঠালেন যে, আমি এখন কি করব? তিনি বললেন,
«اغْتَسِلِى وَاسْتَثْفِرِى بِثَوْبٍ وَأَحْرِمِى»
তুমি গোসল করে নাও এবং একটি নেকড়া বেঁধে ইহরাম বাঁধ’ (মুসলিম, হা/২৯৫০)। আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বিদায় হজ্জে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ওমরার ইহরাম বাঁধলেন। কিন্তু তিনি ঋতুবতী হয়ে গেলেন। লোকজন হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও তিনি ঋতুস্রাব মুক্ত হলেন না। ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ঐ ওমরার সাথে হজ্জের ইহরাম বাঁধতে বললেন এবং এর মাধ্যমে তিনি ক্বিরান হজ্জ পালনকারিণীতে পরিণত হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বলেছিলেন,
«إفْعَلِي مَا يَفْعَلُ الْحَاجُّ غَيْرَ أَنْ لَا تَطُوفِي بِالْبَيْتِ حَتَّى تَطْهُرِي»
‘একজন সাধারণ হাজী যা করে, তুমিও তাই কর। তবে পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তুমি বায়তুল্লাহ ত্বওয়াফ করো না’ (বুখারী, হা/৩০৫; মুসলিম, হা/২৯১৯)।
১৪. ঋতুগ্রস্ত হওয়ার কারণে আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) হজ্জ থেকে পৃথক একটি ওমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হন নি বলে তিনি হজ্জের পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একটি ওমরা করার আবেদন করেন। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা)-এর ভাই আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বকর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) কে তাঁর বোনকে সঙ্গে করে মক্কার নিকটতম হালাল এলাকা তান‘ঈম-এ নিয়ে যেতে বলেন এবং আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) সেখান থেকেই ওমরার ইহরাম বাঁধেন (বুখারী, হা/১৭৮৫; মুসলিম, হা/২৯১০)। অতএব, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা)-এর মত যার অবস্থা হবে, সে হজ্জের পরে তাঁর মত ওমরা করতে পারে। উল্লেখ্য যে, কিছু কিছু হাজী হালাল এলাকা থেকে ইহরাম বেঁধে একাধিক ওমরা করে থাকে। এটি একটি অনুচিৎ কাজ। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে ওমরার অনুমতি দিয়ে তিনি এবং তাঁর ছাহাবীগণ যখন আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা)-এর ওমরা সমাপ্তির অপেক্ষায় ছিলেন, তখন তিনি আর কাউকে এমন ওমরা পালন করতে বলেন নি। তাছাড়া এর মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রচণ্ড ভীড়ের সৃষ্টি হয়, তেমনি ত্বওয়াফ এবং সা‘ঈকারীদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সবগুলি ওমরাই ছিল মক্কায় প্রবেশের সময়ে; মক্কায় অবস্থানরত অবস্থায় সেখান থেকে বাইরে গিয়ে একটি ওমরাও তিনি সম্পন্ন করেন নি।
১৫. ইহরাম অবস্থায় পোষাক হবে একটি পরনের কাপড় এবং একটি গায়ের চাদর। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَلْيُحْرِمْ أَحَدُكُمْ فِي إِزَارٍ وَرِدَاءٍ، وَنَعْلَيْنِ»
‘তোমাদের যে কেউ একটি পরনের কাপড়, গায়ের চাদর এবং সান্ডেল পায়ে ইহরাম বাঁধবে’ (আহমাদ, হা/৪৮৯৯, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত, হাদীছটির সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত সাপেক্ষে ছহীহ)। কাপড় দু’টি সাদা এবং পরিষ্কার হওয়া উত্তম। ইহরামের কাপড় ময়লা হলে মুহরিম ব্যক্তি তা ধুতে পারে। অনুরূপভাবে প্রয়োজনে বদল করে ঐ জাতীয় অন্য কাপড়ও পরতে পারে। ইহরাম অবস্থায় মুহরিম ব্যক্তি গোসল করতে পারে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশের সময় যূ-তুওয়া এলাকার কূপ থেকে গোসল করেছিলেন (বুখারী, হা/১৫৫৩, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) হতে বর্ণিত)। আবূ আইয়ূব আনছারী (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকেও অনুরূপ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে (বুখারী, হা/১৮৪০; মুসলিম, হা/২৮৮৯)।
১৬. মুহরিম ব্যক্তিকে তার স্বাভাবিক পোষাক রেখে একটি পরনের কাপড় এবং একটি গায়ের চাদর পরতে হয়। এক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইহরামের ক্ষেত্রে পোষাকের এই সমতা হাজীদেরকে মৃত্যুর পরে কাফন পরিধানের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের সমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কোন মুসলিম যখন মৃত্যুকে স্মরণ করবে, তখন সে সৎআমলের মাধ্যমে নৈকট্য অর্জন করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে পারবে।
১৭. হজ্জের মাসসমূহে কেউ ওমরা করে তার দেশে বা অবস্থান স্থলে ফিরে গেলে তার সফর শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে সে তামাত্তু হজ্জ পালনকারী গণ্য হবে না।
হজ্জের মাসসমূহে কেউ ওমরা করে মদীনায় গেলে তার হজ্জের সফর শেষ না হওয়ার কারণে সে তামাত্তু হজ্জ পালনকারী গণ্য হবে। অতএব, আবার মীক্বাত অতিক্রমের সময় সে হজ্জ বা আরেকটি ওমরার ইহরাম বাঁধবে। তবে ওমরার ইহরাম বাঁধাই উত্তম। কেননা এর মাধ্যমে সে মীক্বাত থেকে দু’টি ওমরা এবং একটি হজ্জ পালনে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে তামাত্তু হজ্জের জন্য নির্ধারিত একটি হাদঈ দিলেই চলবে।
১৮. যে ব্যক্তি নিজের পক্ষ থেকে ফরয হজ্জ আদায় করেছে অথবা ওমরা পালন করেছে, সে নিজ আত্মীয়-স্বজনসহ অন্যদের পক্ষ থেকে হজ্জ বা ওমরা আদায় করতে পারে। তবে যাদের পক্ষ থেকে হজ্জ বা ওমরা করা জায়েয, কেবলমাত্র তাদের পক্ষ থেকেই সেটি করা যাবে। ফরয এবং নফল উভয় হজ্জই এই বিধানের আওতাভুক্ত হবে। কেউ কারো প্রতি অনুগ্রহ করে তার পক্ষ থেকে এই হজ্জ বা ওমরা আদায় করতে পারে অথবা অর্থের বিনিময়েও আদায় করতে পারে। অর্থ-কড়ি কিছু নিলেও যেন সেটিই হজ্জ পালনের মূল উদ্দেশ্য না হয়। এমনটি নিন্দনীয়। কেননা সে তার আমলের মাধ্যমে দুনিয়া পেতে চেয়েছে। নেওয়ার জন্য হজ্জ করা এবং হজ্জ করার জন্য নেওয়া এক নয়; আমাদেরকে এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। কেননা নেওয়ার জন্য হজ্জ করা নিন্দনীয়। কারণ এক্ষেত্রে হজ্জ হচ্ছে মাধ্যম আর নেওয়া হচ্ছে মূল লক্ষ্য। পক্ষান্তরে হজ্জের জন্য নেওয়া প্রশংসনীয়। কারণ এক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে মাধ্যম এবং হজ্জ হচ্ছে মূল লক্ষ্য। যেমন: কেউ হজ্জ করতে চায়, কিন্তু তার হজ্জ করার মত সম্বল নেই। ফলে সে কারো কাছ থেকে গৃহীত অর্থ দিয়ে হজ্জে যেতে চায়।
কেউ কারো পক্ষ থেকে হজ্জ করলে মনে মনে ঐ ব্যক্তির পক্ষ থেকে নিয়্যত করবে, যার পক্ষ থেকে সে হজ্জ করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। সে তার নিয়্যতটা মুখেও উচ্চারণ করতে পারে। যেমন: বলতে পারে, لَبَّيْكَ حَجًّا عَنْ أَبِيْ أَوْ أُمِّيْ أَوْ عَنْ فُلَانٍ (উচ্চারণ: লাব্বাইকা হাজ্জান আন আবী আও উম্মী আও আন ফুলান), ‘আমার পিতা, মাতা বা অমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ্জের জন্য আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি’। যার পক্ষ থেকে হজ্জ করবে, তার নাম বলবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে বলতে শুনলেন, আমি শুবরুমার পক্ষ থেকে নিয়্যত করছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি নিজের হজ্জ করেছ? তিনি বললেন, না। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«حُجَّ عَنْ نَفْسِكَ ثُمَّ حُجَّ عَنْ شُبْرُمَةَ»
“তুমি আগে তোমার নিজের হজ্জ করো, তারপর শুবরুমার পক্ষ থেকে হজ্জ করো” (ত্ববারানী, আল-মু‘জামুছ্‌ ছগীর, পৃ: ২২৬, আব্দুর রহমান ইবনে খালেদ রক্কী ব্যতীত হাদীছটির বর্ণনাকারীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য (ثقات)। আব্দুর রহমান সম্পর্কে ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) ‘তাক্বরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে বলেন, তিনি বিশ্বস্ত (صدوق)। অতএব, হাদীছটির সনদ ‘হাসান’। শায়খ আলবানী (রহেমাহুল্লাহ) হাদীছটির আরো কয়েকটি সূত্র (طرق) উল্লেখ করেছেন, যেগুলির মাধ্যমে এটি ‘ছহীহ লিগায়রিহী’ হবে। তিনি নিজেও এটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন এবং বায়হাক্বী, ইবনুল মুলাক্কিন ও ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ)-এর পক্ষ থেকে ছহীহ হওয়ার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন)। হাদীছটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি নিজের হজ্জ করে নি, সে অন্যের হজ্জ করতে পারবে না।
কোনো মহিলা কোন পুরুষের পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারে। ফায্‌ল ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছে খাছ‘আম গোত্রের এক মহিলা কর্তৃক তাঁর পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ পালনের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে (বুখারী ও মুসলিম, হাদীছটি হজ্জ ও ওমরার শর্তসমূহ আলোচনার সময় গত হয়ে গেছে)।
অনুরূপভাবে কোনো পুরুষ কোনো মহিলার পক্ষ থেকে হজ্জ করতে পারে। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে বললেন, আমার বোন হজ্জ করার মানত করেছিল, কিন্তু সে মারা গেছে? নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«لَوْ كَانَ عَلَيْهَا دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ»
‘সে যদি ঋণী হত, তাহলে কি তুমি তার ঋণ শোধ করে দিতে?’ লোকটি বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি বললেন,
«فَاقْضِ اللَّهَ، فَهْوَ أَحَقُّ بِالْقَضَاءِ»
‘তাহলে তুমি আল্লাহ্‌র ঋণ পরিশোধ করে দাও। কেননা তিনি ঋণ পরিশোধের অধিকতর হক্বদার’ (বুখারী, হা/৬৬৯৯)।
তিন শ্রেণীর মানুষের পক্ষ থেকে হজ্জ এবং ওমরা করা যায়: মৃত ব্যক্তি, অতিশয় বৃদ্ধ, যিনি ভ্রমণে সক্ষম নন এবং এমন অসুস্থ ব্যক্তি, যার অসুখ ভাল হওয়ার আশা করা যায় না। যে ব্যক্তি তার বোনের হজ্জ করেছিলেন, সে ব্যক্তির হাদীছ প্রমাণ করে যে, মৃতের পক্ষ থেকে হজ্জ করা যায়। খাছ‘আমা গোত্রের মহিলা কর্তৃক তাঁর পিতার হজ্জ সম্বলিত হাদীছটি প্রমাণ করে যে, অতিশয় বৃদ্ধের পক্ষ থেকে হজ্জ করা যায়। সুস্থ হওয়ার আশা করা যায় না এমন রোগীর ক্ষেত্রেও শেষের বিধানটি বলবৎ থাকবে।
তালবিয়া
১. ‘তালবিয়া’ শব্দটি ‘লাব্বা’ (لَبَّى)-এর ক্রিয়ামূল। আর ‘লাব্বা’ অর্থ হচ্ছে, মুহরিম ব্যক্তি হজ্জ ও ওমরাতে ‘লাব্বাইক’ বলল। ইতোপূর্বে আমরা বলেছি যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ইহরাম বাঁধার সময় বলেছিলেন, ‘লাব্বাইক উমরাতান ওয়া হাজ্জাতান’। ‘লাব্বাইক’ (لَبَّيْكَ) শব্দটি কারো ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য সুন্দর একটি শব্দ। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় ছাহাবীকে ডেকেছেন এবং তাঁরা ‘লাব্বাইক’ বলে সাড়া দিয়েছেন মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ডাকে তাঁদের কেউ কেউ বলতেন, ‘লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! (لَبَّيْكَ يَا رَسُوْلَ الله), আবার কেউ কেউ বলতেন, ‘লাব্বাইকা ওয়া সাদাইক’ (لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ)। ছহীহ বুখারীতে এমন বেশ কয়েকটি হাদীছ পাওয়া যায় (দেখুন: হা/১২৮, ৪৫৭, ৫৩৭৫ এবং ৬২৬৮)। ইমাম আবূ দাঊদ তাঁর ‘সুনান’-এর ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়ে (হা/১৬৭) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে, ‘কাউকে ডাকা হলে সে বলবে, লাব্বাইক’। ইমাম বুখারী তাঁর ‘আল-আদাবুল মুফরাদ’ গ্রন্থে (৪২৭) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে, ‘যে ব্যক্তি ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় লাব্বাইক বলবে’।
আর স্বয়ং মহান আল্লাহ মানুষদেরকে হজ্জ করতে ডেকেছেন। তিনি তাঁর নবী ইবরাহীম ‘আলাইহিস্‌সালামকে বলেন,
﴿وَأَذِّن فِي ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ يَأۡتُوكَ رِجَالٗا وَعَلَىٰ كُلِّ ضَامِرٖ يَأۡتِينَ مِن كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٖ ٢٧ ﴾ [الحج: ٢٧]
‘আর মানুষের মধ্যে হজ্জের জন্য ঘোষণা দিয়ে দাও। তারা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার হালকা-পাতলা উটের পিঠে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে’ (হজ্জ ২৭)। অতএব, কোন মুসলিম যখন মীক্বাতে এসে ইহরাম বেঁধে ফেলবে, তখন তালবিয়া পড়বে। যার অর্থ হচ্ছে, হে প্রতিপালক! আপনি আপনার পবিত্র গৃহে হজ্জ করার জন্য আমাকে ডেকেছেন এবং আমার জন্য তা সহজসাধ্য করে দিয়েছেন। অতএব, হে আল্লাহ! আমি আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ অর্থ হচ্ছে, ‘সাড়া প্রদান করার পর সাড়া দেওয়া’।
২. রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে তালবিয়া পড়তেন:
«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ»
(উচ্চারণ: লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান-নি‘মাতা লাকা ওয়াল-মুলক, লা শারীকা লাক), অর্থাৎ ‘আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আমি আাপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার কোন শরীক নেই, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নে‘মত এবং সাম্রাজ্য আপনারই। আপনার কোন শরীক নেই’ (বুখারী, হা/১৫৪৯; মুসলিম, হা/২৮১১, ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে বর্ণিত)। বুখারী ও মুসলিমের অন্য বর্ণনায় তালবিয়ার পরে এসেছে, ‘তিনি এই চারটি বাক্যের বেশী বাড়াতেন না’ (বুখারী, হা/৫৯১৫; মুসলিম, হা/২৮১৪)। ছহীহ মুসলিমে জাবের (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণিত হাদীছেও এরূপ তালবিয়ার কথা এসেছে (হা/২৯৫০)। ছহীহ বুখারীতে আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) হতেও এরূপ তালবিয়া এসেছে, তবে সেখানে শেষোক্ত لَا شَرِيكَ لَكَ কথাটি নেই (হা/১৫৫০)। সুনানে নাসা‘ঈতে বুখারী ও মুসলিমের শর্ত সাপেক্ষ ছহীহ সনদে আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালবিয়া ছিল, লাব্বাইক ইলাহাল হাক্ব (لَبَّيْكَ إِلَهَ الْحَقِّ)’ (হা/২৭৫২)।
ছহীহ মুসলিমে হাদীছের শেষাংশে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা তালবিয়াতে কিছু শব্দ বৃদ্ধি করে এভাবে বলতেন,
«لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ بِيَدَيْكَ لَبَّيْكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ»
(হা/২৮১২)। ছহীহ মুসলিমে (হা/২৮১৪) হাদীছের শেষাংশে আরো এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলতেন, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মত চারটি বাক্যে তালবিয়া পড়তেন, তিনি বলতেন,
«لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِى يَدَيْكَ لَبَّيْكَ وَالرَّغْبَاءُ إِلَيْكَ وَالْعَمَلُ»
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালবিয়ায় তাওহীদের বাণী বিঘোষিত হয়েছে এবং শির্কের সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। আর ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’-এর দাবীও তাই। এখানে لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ অর্থ (إِلاَّ الله) বা ‘আল্লাহ ব্যতীত’। আর لَا شَرِيكَ لَكَ অর্থ (لاَ إَلهَ) বা ‘কোনো মা‘বূদ নেই’। অন্যান্য ইবাদতের মত হজ্জও একটি ইবাদত। সুতরাং কেবল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পদ্ধতিতেই তা আদায় করতে হবে। কেননা ইবাদাত কবুল হওয়ার দু’টি শর্ত হচ্ছে, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি কামনা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ। তালবিয়ায় আল্লাহ্‌র বড়ত্ব এবং প্রশংসা রয়েছে। তিনিই রাজাধিরাজ, অনুগ্রহ পরায়ণ এবং যাবতীয় প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। পক্ষান্তরে মুশরিকদের তালবিয়ায় শির্কের সংমিশ্রণ রয়েছে। তারা ত্বওয়াফরত অবস্থায় বলত, لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ ‘আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার কোন শরীক নেই’। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, وَيْلَكُمْ قَدْ قَدْ ‘এখানেই ক্ষান্ত কর, আর সামনে বেড়ো না’। অতঃপর তারা বলত, إِلاَّ شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ ‘তবে ঐ শরীক ব্যতীত, যা আপনার জন্য রয়েছে, আপনি যার মালিক আর যা কিছুর সে মালিক’ (মুসলিম, হা/২৮১৫)। وَيْلَكُمْ قَدْ قَد -এর অর্থ হচ্ছে, তাওহীদের কালেমা পর্যন্ত বলেই থেমে যাও, এর সাথে শির্কের সংযোজন ঘটাইও না।
৪. পুরুষদের উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়া উত্তম। সায়েব ইবনে খাল্লাদ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«جَاءَنِي جِبْرِيلُ فَقَالَ لِي يَا مُحَمَّدُ مُرْ أَصْحَابَكَ أَنْ يَرْفَعُوا أَصْوَاتَهُمْ بِالتَّلْبِيَةِ»
‘জিবরীল (‘আলাইহিস্‌সালাম) এসে আমাকে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আপনি আপনার সঙ্গীগণকে উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়ার আদেশ করুন’ (নাসা‘ঈ, হা/২৭৫৩, সনদ ছহীহ)।
তবে মহিলারা নিম্নস্বরে তালবিয়া পাঠ করবে। ইমাম তিরমিযী ৯২৭ নং হাদীছ উল্লেখ করার পর বলেন, ‘মহিলাদের উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পড়া মাকরূহ’।
৫. হজ্জ বা ওমরার ইহরাম বাঁধার পর থেকে তালবিয়া পাঠ শুরু করবে এবং হজ্জ পালনকারী ১০ তারিখে জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপের পর তালবিয়া বন্ধ করবে। ফাযল ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বর্ণিত হাদীছ এর দলীল (বুখারী, হা/১৬৮৫)। হাদীছটির ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) বলেন (ফাতহুল বারী, ৩/৫৩৩), জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তালবিয়া পড়তে থাকতেন। তিনি বলেন, ‘জামরাতুল আক্বাবায় প্রথম কংকরটি নিক্ষেপের সাথে সাথে তালবিয়া বন্ধ করবে নাকি সবগুলি কংকর নিক্ষেপের পর বন্ধ করবে, তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ বিদ্বানই প্রথম মতের পক্ষে রায় দিয়েছেন। অবশ্য আহমাদ এবং শাফে‘ঈ মাযহাবের কেউ কেউ দ্বিতীয় মতটিকে সমর্থন করেছেন। শেষের মতাবলম্বীদের দলীল হচ্ছে, ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) ফাযল থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
«أَفَضْتُ مَعَ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- مِنْ عَرَفَاتٍ فَلَمْ يَزَلْ يُلَبِّى حَتَّى رَمَى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ يُكَبِّرُ مَعَ كُلِّ حَصَاةٍ ثُمَّ قَطَعَ التَّلْبِيَةَ مَعَ آخِرِ حَصَاةٍ»
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আরাফা থেকে এসেছিলাম। তিনি জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপ পর্যন্ত তালবিয়া পড়তেই ছিলেন, প্রত্যেকটি কংকর নিক্ষেপের সময় তিনি তাকবীর দিচ্ছিলেন। অতঃপর শেষ কংকরটি নিক্ষেপের সাথে সাথে তালবিয়া বন্ধ করে দিলেন’ (ছহীহ ইবনে খোযায়মা, হা/২৮৮৭)। হাদীছটি বর্ণনার পর ইবনে খোযায়মা (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হাদীছটি ছহীহ এবং অন্যান্য অস্পষ্ট বর্ণনাসমূহের ব্যাখ্যা স্বরূপ। এখানে ‘জামরাতুল আক্বাবায় কংকর নিক্ষেপ পর্যন্ত তালবিয়া পড়লেন’-এর অর্থ হচ্ছে, কংকর নিক্ষেপ শেষ করা পর্যন্ত তালবিয়া পড়লেন’। তিনি আরো বলেন, ‘এই হাদীছটি স্পষ্ট বর্ণনা করে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ কংকরটি নিক্ষেপের সাথে সাথে তালবিয়া বন্ধ করেছিলেন; প্রথম কংকর নিক্ষেপের সময় নয়’। উল্লেখ্য যে, ইবনে খুযাইমার সনদের ওমর নামক একজন রাবীকে ভুলক্রমে মুহাম্মাদ বলা হয়েছে। কিন্তু ইমাম বায়হাক্বী (রহেমাহুল্লাহ) হাদীছটি বলার সময় রাবীর সঠিক নামটি উল্লেখ করেছেন (সুনানে বায়হাক্বী, ৫/১৩৭)।
আর ওমরা পালনকারী ত্বওয়াফ শুরু করার সময় তালবিয়া বন্ধ করে দিবে। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বর্ণিত হাদীছে এর প্রমাণ মিলে (সুনানে বায়হাক্বী, ৫/১০৪)। ইমাম তিরমিযী (হা/৯১৯) হাদীছটি বর্ণনার পর বলেন, এটিই অধিকাংশ বিদ্বানের অভিমত। এরপর তিনি সুফইয়ান, শাফে‘ঈ, আহমাদ, ইসহাক্ব প্রমুখের নাম উল্লেখ করেন। তবে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে মারফূ সূত্রে বর্ণিত তিরমিযীর এই হাদীছটির সনদ যঈফ।

মসজিদে হারামে প্রবেশ
১. মসজিদে হারামের দু’টি পরিভাষা রয়েছেঃ এক. কা‘বা সম্বলিত পুরো মসজিদ এবং দুই. পুরো মক্কা। নিম্নোক্ত আয়াতটি দ্বিতীয় পরিভাষাটির প্রমাণ বহন করে: মহান আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَاۚ ﴾ [التوبة: ٢٨]
‘হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা অপবিত্র। সুতরাং এ বছরের পর তারা যেন মসজিদে হারামের নিকটে না আসে ’ (তওবাহ ২৮)।
২. মসজিদে হারামসহ যে কোনো মসজিদে প্রবেশের সময় আগে ডান পা রাখবে (মুস্তাদরাকে হাকেম, ১/২১৮, তিনি মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন এবং হাফেয যাহাবী তাঁকে সমর্থন করেছেন)। অতঃপর বলবে,
«بِسْمِ الله, اَللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ, اَعُوْذُ باللهِ الْعَظِيْمِ, وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيْمِ, وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ, اَللَّهُمَّ افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ»
‘আল্লাহ্‌র নামে প্রবেশ করছি। হে আল্লাহ! আপনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ এবং সালাম বর্ষণ করুন। আমি মহান আল্লাহ, তাঁর সম্মানিত চেহারা ও সত্ত্বা এবং অনাদি শক্তির অসীলায় বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দুয়ারসমূহ খুলে দিন’। এই দো‘আটি কয়েকটি হাদীছ গ্রন্থ থেকে চয়ন করে একত্রিত করা হয়েছে (দ্রষ্টব্য: ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৫২; সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৪৬৬; জামে তিরমিযী, হা/৩১৪; ইবনুস সুন্নী প্রণীত ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল-লায়লাহ’, পৃ: ৮৯ এবং ইসমাঈল ক্বাযী প্রণীত ‘ফাযলুছ-ছালাতি আলান্‌-নাবী’, পৃ: ৮২)।
৩. হজ্জ ও ওমরা পালনকারী মসজিদে হারামের যে দিক দিয়ে প্রবেশ করতে সহজ হয়, সে দিক দিয়ে প্রবেশ করবে। মসজিদে হারামে প্রবেশ করলে সে স্বচক্ষে কা‘বা দেখবে, নমুনা নয়, সে সরাসরি মানুষদেরকে বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফ করতে এবং ছালাত আদায় করতে দেখবে। সে স্মরণ করবে, এই কা‘বাকে ঘিরেই পৃথিবীর সবপ্রান্ত থেকে মুসলিমরা ছালাত আদায় করে, প্রার্থনা করে। এটি সকলের মিলনস্থল। সবাই গোলাকার বৃত্তের মত কা‘বামুখী হয়ে ছালাত আদায় করে; কা‘বার সবচেয়ে নিকটবর্তী গোলাকার বৃত্তটি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা ছোট বৃত্ত এবং পৃথিবীর শেষ প্রান্তের বৃত্তটি হচ্ছে সর্বাপেক্ষা বড় বৃত্ত।
৪. ত্বওয়াফ করার ইচ্ছা নিয়ে কেউ মসজিদে হারামে প্রবেশ করলে ত্বওয়াফই তার জন্য ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ হিসাবে গণ্য হবে। অতঃপর ত্বওয়াফ শেষে সে মাক্বামে ইবরাহীমের পেছনে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করবে। পক্ষান্তরে ছালাত আদায় বা কুরআন তেলাওয়াত অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যে মসজিদে হারামে প্রবেশ করলে তাকে ‘তাহিইয়াতুল মাসজিদ’ হিসাবে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
«إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلاَ يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّىَ رَكْعَتَيْنِ»
‘তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করবে, তখন দুই রাক‘আত ছালাত আদায় না করা পর্যন্ত যেন সে না বসে’ (বুখারী, হা/১১৬৩; মুসলিম, হা/১৬৫৪, আবূ কাতাদাহ (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত)।

ত্বওয়াফ
১. ত্বওয়াফ আল্লাহ নির্ধারিত একটি ইবাদত এবং এটি কা‘বার বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি। অতএব, কা‘বা ব্যতীত কোনো ক্ববর বা অন্য কোনো কিছুকে কেন্দ্র করে ত্বওয়াফ করা যাবে না। কা‘বা ব্যতীত অন্য কোথাও যদি ত্বওয়াফের কথা শোনা যায়, তাহলে বুঝতে হবে, শরী‘আতে সেটির কোন স্থান নেই; বরং তা আল্লাহ্‌র দ্বীনে নতুন আবিষ্কার। সেজন্য আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর সব জায়গায় কত মুছল্লী বা দানশীল বা ছিয়াম পালনকারী বা আল্লাহ্‌র যিক্‌রকারীইনা রয়েছে। কিন্তু আমরা বলতে পারি না যে, পৃথিবীর সব জায়গায় কত ত্বওয়াফকারীইনা রয়েছে। কেননা কা‘বা কেন্দ্রিক ত্বওয়াফ ব্যতীত শরী‘আতে আর কোথাও ত্বওয়াফের কোনো অস্তিত্ব নেই।
২. বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফ কখনও রুকন হিসাবে গণ্য হয়। যেমন: হজ্জের ক্ষেত্রে ‘ত্বওয়াফে ইফাদ্বা’, ওমরার ক্ষেত্রে ওমরার ত্বওয়াফ। আবার কখনও ওয়াজিব হিসাবে গণ্য হয়। যেমন: বিদায়ী ত্বওয়াফ। অনুরূপভাবে ত্বওয়াফ কখনও নফল হিসাবে গণ্য হয়। যেমন: উপরোক্ত ত্বওয়াফগুলি ব্যতীত অন্যান্য ত্বওয়াফ। উক্ত বক্তব্যের প্রমাণাদি ইতোপূর্বে ‘হজ্জ ও ওমরার রুকনসমূহ’ এবং ‘হজ্জ ও ওমরার ওয়াজিবসমূহ’ আলোচনার সময় গত হয়ে গেছে।
ত্বওয়াফের ফযিলত বর্ণনায় যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার নিম্নোক্ত হাদীছটি অন্যতম,
«مَنْ طَافَ بِهَذَا الْبَيْتِ أُسْبُوعًا فَأَحْصَاهُ كَانَ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ»
‘যে ব্যক্তি সাতবার এই ঘরের এমনভাবে ত্বওয়াফ করবে যে এতে গণনায় ভুল কিংবা কম-বেশি করবে না, তার একটি দাসমুক্তির নেকী হবে’ (তিরমিযী, হা/৯৫৯, তিনি বলেন, হাদীছটি ‘হাসান’; হাদীছটি ইমাম বাগাভীও বর্ণনা করেন এবং তিনিও এটিকে ‘হাসান’ বলেন (শারহুস সুন্নাহ, হা/১৯১৬)।
ত্বওয়াফকারী ত্বওয়াফের সময় ‘হাজারে আসওয়াদ’ এবং ‘রুকনে ইয়ামানী’ স্পর্শ করবে। এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবূ আব্দির রহমান! আপনাকে বায়তুল্লাহ্‌র এই দুই কোণ ছাড়া অন্য কোথাও স্পর্শ করতে দেখি না যে? তিনি বললেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
«إِنَّ مَسْحَهُمَا يَحُطَّانِ الْخَطِيئَةَ»
‘এই কোণদ্বয় স্পর্শ করলে তা গোনাহ ঝরিয়ে দেয়’। আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি,
«مَنْ طَافَ سَبْعًا فَهُوَ كَعِدْلِ رَقَبَةٍ»
‘যে ব্যক্তি সাতটি ত্বওয়াফ করল, সে যেন একটি দাস মুক্ত করল’ (নাসা‘ঈ, হা/২৯১৯, সনদ হাসান)।
৩. বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফ হবে সাতটি চক্করের মাধ্যমে। প্রত্যেকটি চক্কর হাজারে আসওয়াদ থেকে শুরু হয়ে সেখানেই আবার শেষ হবে। উল্লেখ্য যে, কা‘বার দরজার পাশের কোণটিতে হাজারে আসওয়াদ রয়েছে। ত্বওয়াফকারী পবিত্র হয়ে কা‘বাকে বাম পাশে রেখে ত্বওয়াফ করবে। ত্বওয়াফের সময় ‘হিজ্‌র’ নামক স্থানটির বাহির দিয়ে ত্বওয়াফ করবে; ভেতর দিয়ে নয়। কেননা এই স্থানটিও কা‘বার অন্তর্ভুক্ত। মনে রাখতে হবে, হিজ্‌রের ভেতর দিয়ে ত্বওয়াফ করলে তা শুদ্ধ হবে না। কেননা সে পুরো বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফ করে নি। তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও হিজ্‌রের বাহির দিয়েই ত্বওয়াফ করতেন। মসজিদে হারামের ভেতরের যে কোন জায়গা দিয়ে ত্বওয়াফ করলে হয়ে যাবে, তবে মসজিদের বাহির দিয়ে করলে হবে না। ইবনুল মুনযির (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সবাই একমত যে, মসজিদের বাহির দিয়ে ত্বওয়াফ করলে হবে না’ (আল-ইজমা/৬২)।
৪. ত্বওয়াফকারী যখন হাজারে আসওয়াদ বরাবর পৌঁছবে, তখন সহজ হলে হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করবে। সম্ভব না হলে হাত অথবা অন্য কোন কিছু দিয়ে তা স্পর্শ করবে এবং যা দিয়ে স্পর্শ করেছে, তা চুম্বন করবে। সেটিও সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইশারা করবে। পাথরটি চুম্বন করার দলীল নিম্নরূপ: ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হাজারে আসওয়াদ চুম্বন করে বলেন,
«إِنِّى أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّى رَأَيْتُ النَّبِىَّ - صلى الله عليه وسلم - يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ»
‘নিশ্চয়ই আমি জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি যেমন কোন ক্ষতি করতে পারো না, তেমনি কোন উপকারও করতে পারো না। আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যদি তোমাকে চুমু দিতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না’ (বুখারী, হা/১৫৯৭; মুসলিম, হা/৩০৭০)। যুবায়ের ইবনে আরাবী বলেন, এক ব্যক্তি ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) কে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
«رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْتَلِمُهُ وَيُقَبِّلُهُ»
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাথরটি স্পর্শ করতে এবং চুমু দিতে দেখেছি’ (বুখারী, হা/১৬১১)। কোন কিছু দিয়ে পাথরটি স্পর্শ করে তা চুম্বন করার দলীল নিম্নরূপ: নাফে‘ বলেন,
«رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ يَسْتَلِمُ الْحَجَرَ بِيَدِهِ ثُمَّ قَبَّلَ يَدَهُ وَقَالَ مَا تَرَكْتُهُ مُنْذُ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَفْعَلُهُ»
‘আমি ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) কে হাত দিয়ে পাথরটি স্পর্শ করতে, অতঃপর হাতে চুমু খেতে দেখেছি। হাতে চুমু খেয়ে তিনি বলেন, যখন থেকে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমনটি করতে দেখেছি, তখন থেকে আমি আর তা পরিত্যাগ করি নি’ (মুসলিম, হা/৩০৬৫)। আবুত্‌ ত্বুফাইল (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন,
«رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَطُوفُ بِالْبَيْتِ وَيَسْتَلِمُ الرُّكْنَ بِمِحْجَنٍ مَعَهُ وَيُقَبِّلُ الْمِحْجَنَ»
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফরত অবস্থায় একটি মাথাবাঁকা লাঠি দিয়ে রুকন (হাজারে আসওয়াদ) স্পর্শ করতে এবং লাঠিটিকে চুমু দিতে দেখেছি’ (মুসলিম, হা/৩০৭৭)। হাত দিয়ে হাজারে আসওয়াদের দিকে ইশারা করার দলীল নিম্নরূপ: ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন,
«طَافَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْبَيْتِ عَلَى بَعِيرٍ كُلَّمَا أَتَى عَلَى الرُّكْنِ أَشَارَ إِلَيْهِ»
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের পিঠে আরোহণ অবস্থায় বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফ করেন। তিনি যখনই রুকন (হাজারে আসওয়াদ)-এর নিকটে আসছিলেন, তখনই সেটার দিকে ইশারা করছিলেন’ (বুখারী, হা/১৬১২)। উটের পিঠে আরোহণ করে ত্বওয়াফের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক লাঠি দিয়ে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করার হাদীছটিও একথার প্রমাণ বহন করে (বুখারী, হা/১৬০৭; মুসলিম, হা/৩০৭৩)।
চুম্বন বা স্পর্শ করার জন্য হাজারে আসওয়াদের নিকটে পৌঁছতে হলে যদি কাউকে কষ্ট দেওয়া লাগে, তবে সেখানে যাবে না; বরং ইশারা করে ত্বওয়াফ চালিয়ে যাবে। কেননা পাথর স্পর্শ করা উত্তম, কিন্তু মানুষকে কষ্ট দেওয়া হারাম। আর কোনো হারাম কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে কোনো উত্তম কাজের প্রতি ধাবিত হওয়া যাবে না।
হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুম্বন করার সময় বলবে, بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ (উচ্চারণ: বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার), অর্থাৎ ‘আল্লাহ্‌র নামে চুমু দিচ্ছি বা স্পর্শ করছি। আল্লাহ মহান’। আর পাথরের দিকে ইশারা করার সময় বলবে, اللَّهُ أَكْبَر ‘আল্লাহ মহান’। ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন,
«طَافَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْبَيْتِ عَلَى بَعِيرٍ كُلَّمَا أَتَى الرُّكْنَ أَشَارَ إِلَيْهِ بِشَيْءٍ كَانَ عِنْدَهُ وَكَبَّرَ»
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটের পিঠে আরোহণ করে বায়তুল্লাহ্‌র ত্বওয়াফ করেন। তিনি যখনই রুকন (হাজারে আসওয়াদ)-এর নিকটে আসছিলেন, তখনই কিছু একটা দিয়ে ইহার দিকে ইশারা করছিলেন এবং ‘আল্লাহ আকবার’ বলছিলেন’ (বুখারী, হা/১৬১৩)। পাথরটি স্পর্শ করার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ এবং ‘আল্লাহু আকবার’ উভয়ই পড়ার প্রমাণে ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকে ছহীহ সূত্রে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে (বায়হাক্বী, ৫/৭৯)। হাফেয ইবনে হাজার (রহেমাহুল্লাহ) বলেন (আত-তালখীছুল হাবীর, ২/২৪৭), ‘বায়হাক্বী এবং ত্ববারানী ‘আওসাত্ব’ ও ‘দো‘আ’ গ্রন্থে ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) এমর্মে হাদীছ বর্ণনা করেন যে, তিনি যখন হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করতেন, তখন বলতেন, «بِسْمِ اللَّهِ وَاللَّهُ أَكْبَرُ» ‘আল্লাহ্‌র নামে স্পর্শ করছি। আল্লাহ মহান’। হাদীছটির সনদ ছহীহ।
৫. ত্বওয়াফকারী যখন রুকনে ইয়ামানী বরাবর পৌঁছবে, তখন সহজ হলে হাত দিয়ে সে এটিকে স্পর্শ করবে; সে যেমন রুকনে ইয়ামানীকে চুম্বন করবে না, তেমনি হাত দিয়ে স্পর্শ করে হাতও চুম্বন করবে না। পক্ষান্তরে তার পক্ষে যদি রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করা সহজ না হয়, তবে তার দিকে ইশারা না করেই ত্বওয়াফ চালিয়ে যাবে। ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) বলেন,
«لَمْ أَرَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْتَلِمُ مِنْ الْبَيْتِ إِلَّا الرُّكْنَيْنِ الْيَمَانِيَيْنِ»
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রুকনে ইয়ামানী এবং হাজারে আসওয়াদ ব্যতীত বায়তুল্লাহ্‌র অন্য কোথাও স্পর্শ করতে দেখিনি’ (বুখারী, হা/১৬০৯; মুসলিম, হা/৩০৬১)। এমর্মে ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) থেকেও হাদীছ বর্ণিত হয়েছে (মুসলিম, হা/৩০৬৬)।
মনে রাখতে হবে, রুকনে ইয়ামানীতে স্পর্শ ছাড়া আর কিছুই করা যাবে না; চুম্বন করা যাবে না, দো‘আ পড়া যাবে না এবং ইশারা করাও চলবে না।
৬. রুকনে ইয়ামানী এবং হাজারে আসওয়াদ ব্যতীত কা‘বার অন্য কোন কোণ বা দেওয়ালের অন্য কোন স্থান স্পর্শ করা যাবে না। ইতোপূর্বে উল্লেখিত ইবনে ওমর এবং ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা)-এর হাদীছদ্বয় একথার প্রমাণ বহন করে। তাছাড়া ইয়া‘লা ইবনে উমাইয়া বলেন,
«طُفْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فَلَمَّا كُنْتُ عِنْدَ الرُّكْنِ الَّذِي يَلِي الْبَابَ مِمَّا يَلِي الْحَجَرَ، أَخَذْتُ بِيَدِهِ لِيَسْتَلِمَ، فَقَالَ: أَمَا طُفْتَ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قُلْتُ: بَلَى، قَالَ: فَهَلْ رَأَيْتَهُ يَسْتَلِمُهُ؟ قُلْتُ: لاَ، قَالَ: فَانْفُذْ عَنْكَ فَإِنَّ لَكَ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةً حَسَنَةً»
‘আমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর সাথে ত্বওয়াফ করলাম। আমি কা‘বার রুকনে শামী বা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এসে সেটিকে স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু)-এর হাত ধরলাম। তিনি বললেন, তুমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ত্বওয়াফ করোনি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তুমি কি তাঁকে এই কোণ স্পর্শ করতে দেখেছ? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে তুমিও সেটি স্পর্শ করো না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যেই তোমার জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে’ (আহমাদ, হা/২৫৩, মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীছটির সনদ ছহীহ)।
৭. স্পর্শ করা বৈধ কোণদ্বয় ব্যতীত কা‘বা ঘরের অন্য কোন কোণ এবং দেওয়াল যেমন চুম্বন বা স্পর্শ করা যাবে না, তেমনি পৃথিবীর অন্য কোন পাথর বা ভবন চুম্বন বা স্পর্শ করাও যাবে না। বরং সুন্নাত অনুযায়ী হাজারে আসওয়াদ চুম্বন বা স্পর্শ এবং রুকনে ইয়ামানী স্পর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই ওয়াজিব। সেজন্য ওমর (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হাজারে আসওয়াদ সম্পর্কে বলেছিলেন,
«وَلَوْلاَ أَنِّى رَأَيْتُ النَّبِىَّ - صلى الله عليه وسلم - يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ»
‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যদি তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না’। ইমাম নববী (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ববর ত্বওয়াফ করা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে ক্ববরের দেওয়ালে পেট ও পিঠ লাগানো মাকরূহ। আবূ ওবায়দিল্লাহ হালীমীসহ অনেকেই একথা বলেন। তাঁরা বলেন, দেওয়াল হাত দিয়ে স্পর্শ করা বা চুম্বন করা বৈধ নয়। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে আসলে যেমন সে তাঁর থেকে দূরে থাকত, ঠিক এখনও তেমনি তাঁর থেকে দূরে থাকতে হবে; ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য অনুযায়ী এটিই হচ্ছে সঠিক কথা। বেশীর ভাগ মানুষের এই বক্তব্য বিরোধী আমলের কারণে কেউ যেন প্রতারিত না হয়। কেননা ছহীহ হাদীছ এবং ওলামায়ে কেরামের বক্তব্য অনুযায়ী আমল করতে হবে; সাধারণ জনতার বিদ‘আতী কর্মকাণ্ড এবং মূর্খতার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা যাবে না। বুখারী ও মুসলিমে আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, তার সেই নবাবিষ্কৃত কর্ম প্রত্যাখ্যাত’। ছহীহ মুসলিমে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আমাদের প্রদর্শিত পথের বাইরে কোন আমল করল, তার সেই আমল প্রত্যাখ্যাত’। আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার ক্ববরকে ঈদ অনুষ্ঠানের দৃশ্যে পরিণত করো না; বরং তোমরা আমার উপর দরূদ পাঠ কর। কেননা তোমরা যেখান থেকেই দরূদ পাঠ করো না কেন, তা আমার নিকটে পৌঁছে যাবে’ (আবূ দাঊদ ছহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন)। ফুযাইল ইবনে আয়ায (রহেমাহুল্লাহ) বলেন, যার অর্থ হচ্ছে, ‘হেদায়াতের পথের অনুসরণ কর, এ পথে গমনকারীর সংখ্যা কম বলে তা তোমাকে কোনো ক্ষতি করবে না। পক্ষান্তরে তুমি বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে চলো; ধ্বংস প্রাপ্তদের সংখ্যা বেশী বলে তাতে তুমি প্রতারিত হয়ো না’। যে ব্যক্তি মনে করবে, দেওয়াল স্পর্শ করলে বেশি বরকত হাছিল করা যাবে, বুঝতে হবে সেটি তার মূর্খতা এবং অজ্ঞতারই পরিচায়ক। কেননা শরী‘আতের অনুসরণের মধ্যেই প্রকৃত বরকত নিহিত রয়েছে। সঠিক বিষয়ের বিরোধিতা করে কিভাবে অনুগ্রহ তালাশ করা সম্ভব! (মাজমূ শারহুল মুহাযযাব, ৮/২০৬)।
ইমাম নববী (রহেমাহুল্লাহ) যে হাদীছটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, তা ছহীহ বুখারী (হা/২৬৯৭) ও মুসলিমে (হা/৪৪৯২) এসেছে, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ»
‘যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, তার সেই নবাবিষ্কৃত কর্ম প্রত্যাখ্যাত’। ছহীহ মুসলিমে (হা/৪৪৯৩) অন্য শব্দে হাদীছটি এসেছে এবং এটি প্রথম হাদীছটির তুলনায় ব্যাপক অর্থবোধক। কেননা এটি প্রত্যেক আমলকারীকেই অন্তর্ভুক্ত করে, চাই সে নতুন কাজটি নিজে আবিষ্কার করুক বা অন্য কারও আবিষ্কারের অনুগামী হয়েই কাজটি করুক, সর্বাবস্থায় সে এই হুকুমের আওতায় পড়ে যাবে।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আরো একটি সফলতা যুক্ত হোলো আধা নোবেল জয়ীর একাউন্টে‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৮:৪০



সেদিন প্রথম আলো-র সম্পাদক বলেছিলেন—
“আজ শেখ হাসিনা পালিয়েছে, প্রথম আলো এখনো আছে।”

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আজ আমি পাল্টা প্রশ্ন রাখতে চাই—
প্রথম আলোর সম্পাদক সাহেব, আপনারা কি সত্যিই আছেন?

যেদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১১

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ নয়, আমরা শান্তি চাই

ছবি এআই জেনারেটেড

হামলা ভাংচুর অগ্নিসংযোগ প্রতিবাদের ভাষা নয় কখনোই
আমরা এসব আর দেখতে চাই না কোনভাবেই

আততায়ীর বুলেট কেড়ে নিয়েছে আমাদের হাদিকে
হাদিকে ফিরে পাব না... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুখ গুজে রাখা সুশীল সমাজের তরে ,,,,,,,,

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০৫


দুর্যোগ যখন নামে আকাশে বাতাশে আগুনের ধোঁয়া জমে
রাস্তা জুড়ে কখনো নীরবতা কখনো উত্তাল প্রতিবাদের ঢেউ
এই শহরের শিক্ষিত হৃদয়গুলো কি তখনও নিশ্চুপ থাকে
নাকি জ্বলে ওঠে তাদের চোখের ভেতর নাগরিক বজ্র
কেউ কেও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×