somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমিঃ একজন সিরিয়াল কিলার

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেখুন, আমি কোন লেখক নই । আমার কাছ থেকে দারুন কোন গল্প শুনবার আশায় যদি এই লেখা পড়তে বসেন তাহলে এখনও বলছি, দয়া করে পড়বার দরকার নেই । এই লেখাটা একটা কনফেশনের মত । আমার মনের ভেতর ইদানীং একটা খচখচানি চলছে । সারাক্ষণ একটা দমবন্ধ ভাব । নিজের উপর অতীষ্ট হয়েই লিখতে বসেছি । কারও কাছে শেয়ার করতে পারছি না বলেই লেখা । একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা । যে কথাগুলো হুট করে কাউকে বলে বসলে আমাকে যে কেউ পাগল ভাববে । কিন্তু, আমি পাগল নই । আমি জানি, আমি পাগল না । আমি খুনী । খুনী হলেই যে মানুষ খারাপ হবে তা কিন্তু না । আমার কথাই ধরুন ! হ্যাঁ, হয়তো... । হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার মত খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আর নেই ।

...আপনিও খুব একটা ভাল মানুষ নন । কারন এই লেখাটা আপনি একটা অসুস্থ্য আগ্রহ নিয়েই পড়তে বসেছেন । শিরোনাম দেখেছেনঃ ‘আমি একজন সিরিয়াল কিলার’ । এই ভেবেই পড়া শুরু করেছেন যে খুনের কিছু রোমহর্ষক বর্ণনা পড়া যাবে- এটা কি একটা অসুস্থ্য চিন্তা নয় ?

এই প্রসঙ্গ বাদ থাক । খুনের কথা বলি । সবগুলো খুনের কথা লিখব না । একটা । শুধু একটার কথা । যে খুনটা করতে গিয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম । একটু হলেও বোধহয় অনুশোচনাবোধ জেগে উঠেছিল আমার মধ্যে । আমার সবচে’ মেমোরেবল খুনের গল্পটা । ভাব-ভাষা মিশিয়ে লিখতে পারবো না । যেটা মাথায় আছে সেটাই লিখে যাবো । আপনার পড়তে ভাল লাগবে কিনা বুঝতে পারছি না । আর ভাল না লাগলেও আমার কিছু যায় আসে না । You must not be a big deal …

কোথা থেকে শুরু করা যায় ? ও আচ্ছা... ভাল কথা ! আমার খুনের থিমটা না জানা থাকলে পরে আপনি পড়ে মজা পাবেন না । এটা আগে বলা দরকার । আমার আজ পর্যন্ত কোন পুরুষ ভিকটিম নেই । মেয়েদেরকে খুন করাটাই আমি প্রেফার করি । সত্যি কথা বলতে, মেয়েদেরকে আমার সহ্য হয় না । বিশেষ করে সুন্দরী মেয়ে । আমার মনে হয়, শৈশব থেকেই ওদের মধ্যে রূপের একটা অহংকার জন্মে যায় । আর অহংকার ‘লুসিফার’-এর প্রতীক – শয়তানের প্রতীক । ওদের ভিতরে থাকা শয়তানটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে আমার বড় ভালো লাগে ।

আষাঢ় মাসের কোন একটা সন্ধ্যা হবে । নাকি রাত ? আমার মনে পড়ছে না । বাদ দেন । আর সময় জেনে করবেনটাই বা কি ? It’s not a big deal । সরি, বারবার ‘বিগ ডিল’ বলা আমার অভ্যাস । রনোর তাসের আড্ডায় একবার লিপু এই কথাটা বলেছিল । আমার মনে ধরে যায় । সেই থেকেই এই রোগে ধরেছে । লিপুর বেশিরভাগ কথাই অসাধারন । অথচ সে যে খুব একটা মেধাবী, তা নয় । অনার্স পাস করতেই তার ঘাম ছুটে গেছে । তিনবার পরীক্ষা দিয়ে সে অ্যাকাউন্টিং এ একটা থার্ড ক্লাস জুটিয়েছে । তবে তার কাছ থেকে সবসময় চমৎকার চমৎকার সব তথ্য পাওয়া যায় । যা হয়তো যে কেউকে ভাবতে বাধ্য করবে, লিপু একটা জিনিয়াস ।

তনয়ের বিয়ের পরপরের একটা ঘটনা বললেই বুঝবেন । একবার তনয়ের শ্বশুরবাড়িতে গেলাম সবাই মিলে দাওয়াতে । মালিটোলাতে পাঁচতলা ফাউন্ডেশনে নিজেদের বাড়ি । চারতলা কমপ্লিট হয়েছে । তনয়ের শ্যালিকা মিতু সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল । বারান্দার সামনে দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ একটা টিয়া পাখি দারুনভাবে আমার কন্ঠ নকল করে করে কথা বলতে শুরু করল । আমরা সবাই অবাক । টিয়াপাখিটা মিতু পোষে । দেখতে সুবিধার না, তবে মেরিটোরিয়াস । আমি বললাম, ‘এ তো দেখি টেপ-রেকর্ডার’ । আমরা সবাই হেসে উঠলাম । তার মধ্যে লিপু বলল, ‘বেচারার ভোকাল কর্ড থাকলে নিশ্চিত স্বনামধন্য গায়িকা হয়ে যেতো ।’
আমি বললাম, ‘ওর ভোকাল কর্ড আছে কি নেই- এটা তো তোর জানবার কথা না !’
লিপু গম্ভীর মুখ করে বলল, ‘কোন টিয়াপাখিরই ভোকাল কর্ড থাকে না ।’

আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলাম । আমার কৌতূহল মারাত্মক । ঐদিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারলাম । মাথার ভেতর কেবলই খচখচ করতে লাগল, টিয়াপাখিদের কি আসলেই কোন ভোকাল কর্ড থাকে না ? তা কি করে হয় ? পরদিন খুব সকালে উঠে কাঁটাবন চলে গেলাম । দশটা টিয়াপাখি কিনে বাসায় নিয়ে এলাম । প্রত্যেকটার গলাই কায়দা করে কাটলাম যাতে ভোকাল কর্ড মিস না করে ফেলি । আশ্চর্য কান্ড ! কোনটারই ভোকাল কর্ড পাইনি । এরপর থেকেই লিপুর সব কথা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি । শুনতে ভাল লাগে ।

আরেকবার সে বলল, আদিম যুগে যেসব ম্যাটেরিয়াল দিয়ে মিউজিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট তৈরী হতো- তার মধ্যে সবচে ডিমান্ডেবল ছিল মানুষের হাড় । আমার তখনও খুন করার অভ্যেস গড়ে ওঠেনি । রনো বলল, ‘আরে ধুর, ব্লাফ দিস না...’
লিপু স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, ‘তোরা খুঁজে দেখতে পারিস । আমাকে কি কখনো চাপাবাজি করতে দেখেছিস ?’

সত্যি সত্যি দেখা গেল ওর কথা ঠিক । এরপর থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে মানুষের শরীরের হাঁড়গোড় দিয়ে নতুন কিছু ইন্সট্রুমেন্ট বানানো যায় কিনা । তারও এক’দুমাস পরে প্রথম খুনটা করি । একেবারেই নিরর্থক খুন । কিছুই বানাতে পারি নি । পরে ভাবলাম এসব নিয়ে একটু পড়াশোনা করি । পড়াশোনা করে লাভ হয়েছে । অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্য জানা গেছে । যেমনঃ অনেক ইন্সট্রুমেন্টই প্রানীর অন্ত্র বা নাঁড়িভুড়ি দিয়ে তৈরী হয় । অবাক হওয়ার মত ব্যাপার না ? যে গিটার বা সেলো আপনি হররোজ বাজিয়ে গান গাচ্ছেন তার স্ট্রীং যদি মানুষের অন্ত্রে তৈরী হয়, ব্যাপারটা কেমন না ? তবে, মানুষের অন্ত্রে স্ট্রীং বানানো হয় না । গরু-মহিষ দিয়ে কাজ চালানো হয় । একই কথা । ওদেরও তো প্রান আছে । বেঁচে থাকবার জন্যে ওরাও তো ছটফট করে, তাই না ? আমি ভাবলাম এক কাজ করি... । ...পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি কোন একটা মানুষকে খুন করে তার অন্ত্র দিয়ে গিটার বানানোর চিন্তা করেছি । হাহাহা ।

একেবারেই না । আমার মাথায় অন্যরকম একটা আইডিয়া এলো । একটা মানুষের অন্ত্র দিয়ে যদি গিটারের স্ট্রীং বানানো যেতে পারে, তার ভোকাল কর্ড দিয়েও বানানো সম্ভব হওয়ার কথা । আমি সেই পথে এগুনো শুরু করলাম । অনেকগুলো খুন করে করে শিখেছি । সফল হয়েছি কি হইনি সেটা পড়ে লিখব । তবে আমার অধ্যবসায় রবার্ট ব্রুস কোয়ালিটির । আমি নিশ্চিত ছিলাম একটা মানুষকে ‘বাজানো’ সম্ভব । ভায়োলিনের মত করে ! এপর্যন্ত পড়ে অনেকেই ভাববেন আমি পাগল । আমার মাথায় সমস্যা আছে । তবে, এতটুকু পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা কি ঠিক হবে ? আমি অস্বীকার করছি না যে অতিরিক্ত কৌতূহল পাগলামির সমার্থক । কিন্তু আপনিও অস্বীকার করতে পারবেন না কৌতূহল আছে বলেই বিজ্ঞান আছে, প্রগতি আছে । পৃথিবীর যত মহান আবিষ্কার- সবটার মূলেই কিন্তু কৌতূহল !

কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি । আমার সবচে মেমোরেবল খুনের গল্পটা লেখার কথা ছিল । আমি চলে এসেছি লিপুর বর্ণনায় । আমি আগেই স্বীকার করে নিয়েছি, আমি লেখক নই । এমন হবে । তবে আসল প্রসংগ থেকে সরে গিয়ে লাভ একটা হয়েছে । বাড়তি বর্ণনাটুকু থেকে পাঠক আমার খুনের মোটিভ বুঝতে পারবেন । যাই হোক, কোথায় যেন ছিলাম ? হ্যাঁ । আষাঢ় মাস । আষাঢ় মাসের এক সন্ধ্যায় বা রাতে । আমরা তখন রেডিসনে কোন একটা বিয়ের প্রোগ্রামের শো করছিলাম । আমি মাঝখান থেকে বেড়িয়ে গেলাম । বিকেল থেকে টানা গান গাইতে গাইতে গলার অবস্থা খুবই খারাপ । বসে গেছে । তার ওপর ভড্‌কার প্রতি পেগে অনেকটা করে আইস ফেলেছিলাম । শেষে দেখা গেল, ভড্‌কা আর পানির পার্থক্য ধরতে পারছি না । হাহাহা । মাতালদের পেগ লিমিট হিসেব করা থাকে । এরা লিমিট ক্রস করতে গেলে দ্বিধাগ্রস্থ হয় । হবেই । আর দ্বিধান্বিত বেশীরভাগ মাতালই লিমিট ক্রস করার সিদ্ধান্তটাই নেয় । আমি মাতাল হই না । বেশি নেশা হলে ঝিম ধরে বসে থাকি । ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে অতীত রোমন্থন করতেই আমার বেশি ভাল লাগে ।

ঐদিন একটা অ্যাবসলিউটের বোতল ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে হোটেল থেকে ধবধবে করোলাটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম । গাড়ি আমার না । তনয়ের । তনয়ের কথা তো আগেই লিখেছি । তবে পুরো পরিচয় দেয়া হয়নি । তনয় হচ্ছে আমাদের ব্যান্ডের বেজিস্ট প্লাস ভোকাল । একের ভেতর দুই । ওর গাড়ির চাবি ও সাধারনত আমাকে দেয় না । যখন মন খুব ভাল থাকে তখন দেয় । আজ ওর মন ভালো ।

আমি ভালো ড্রাইভ জানি না । টুকটাক জানি আর কি । ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে অনবরত । উইন্ডশীল্ড আর এফ এম দুটোই চালু করে দিয়ে উত্তরার ব্রডওয়ে ধরে চলছি । কবির সুমনের গান বাজছে,

“জানিনা এ পৃথিবীর ঘাতকরা গান শোনে কিনা ...”

বাহ্‌ ! অদ্ভুত লাইন তো । আমি ভয়াবহ ধরনের ঘাতক । সব মিলিয়ে বারোটা খুন করেছি । এখনও ধরা পড়িনি । আমি তো গান শুনছি । গান করছি । এতো চমৎকার মোটামুটি নামী-দামী একটা ব্যান্ডের লীড ভোকাল আমি । ভায়োলিন বাজাতে পারি, বাঁশি বাজাতে পারি, সাথে পিয়ানোও । আমাদের ব্যান্ডে পিয়ানো বাজাতো রনো । ও কানাডা চলে যাওয়ার পর তনয় আমাকে বলেছিল পিয়ানোটা দেখতে । আমি স্রেফ মানা করে দিয়েছি । আমি এগুলি বাজাই নিজের জন্য । স্টেজে দাঁড়িয়ে পিয়ানো আমি বাজাতে পারবো না । আমি গান করি, কারন গান গাইতে আমার যতটা না ভাল লাগে, শোনাতে তারচে’ বেশি ভাল লাগে । গাড়িতে একটানা কবির সুমন চলছে । “জানিনা এ পৃথিবীর ঘাতকরা গান শোনে কিনা ...”, “জানিনা এ পৃথিবীর ঘাতকরা গান শোনে কিনা ...”,... । এই লাইনের মানে কি ? ঘাতকরা কি গান শুনতে পারে না ? শোনাতে পারে না ? আমি তো গায়ক, গান ভালবাসি- গান অন্তঃপ্রান মানুষ । আবার আমি কবির সুমনের ‘ঘাতক’ও । এমন হতেই পারে ! It’s not a big deal । আমার হঠাৎ মাথায় এলো আজকে একটা খুন করলে কেমন হয় ! গত এক বছর ধরে কোন খুন করিনি । কোন আকুতি শুনিনি ।

বড়মামার গাজীপুরের বাগানবাড়িটা খালি আছে । বাংলোটা নতুন না । পুরোনো । এই বাগানবাড়িটাতেই আমি ছয়টি খুন করেছি । বাগানবাড়িটা একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়েছে । আশেপাশে পাঁচ-দশ মাইলের মধ্যে মানুষের বসতি নেই । খুনের জন্য সবচে’ উপযোগী জায়গা । রফিককে পয়সা দিয়ে বাগানবাড়ি ম্যানেজ করতে হয় । নিজের মামার বাগানবাড়িতে ঢোকার জন্যও ঘুষ – এই হচ্ছে আমার কপাল । রফিক ভাবে, মেয়ে নিয়ে ফষ্টি-নষ্টি করতে যাচ্ছি । খুনের ব্যাপারটা রফিক জানে না । আমার যদিও মাঝে মধ্যে মনে হয় কেউ একজন খুনের সময় দর্শক হিসেবে থাকুক । আমার খুন করা শেষ হলে বলুক, ‘ভাই, আপনার খুন আসলে খুন না । একটা শিল্প !’

আমার বড়মামা রাশিয়া থাকেন । কোটিপতির উপরে কিছু থাকলে তিনি সেই পতি । পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার । ভয়ংকর রকমের সৌখিন মানুষ । মাঝেমধ্যে দেশে আসলে তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের বাসাবোর ফ্ল্যাটে উঠিয়ে নিজে ‘রুবিক’কে নিয়ে গাজীপুরে চলে যান । রুবিক হচ্ছে মামার পোষা অ্যালসেশিয়ান । বাগানবাড়িটা রুবিকের বেশ প্রিয় । এখানে এলেই সে তার দুই সঙ্গিনীকে পেয়ে যায় । তাদের সাথে খেলাধুলা করে সময় কাটায় । এই দুটো অ্যালসেশিয়ান গাজীপুরেই থাকে । ম্যানেজার রফিক এদের দেখাশোনা করে ।

বড়মামা আসার আগে থেকেই তার জন্য ‘আনন্দ-উল্লাস’ এর সব রকম ব্যবস্থা করা থাকে । তার পুরোনো দিনের বন্ধু-বান্ধবরা আসে । পার্টি হয় । কেউ কেউ কম বয়েসী রূপবতী প্রস্টিটিউট’ও সঙ্গে করে নিয়ে আসে । ভদ্র আধুনিক প্রস্টিটিউট । এদের কথার ভঙ্গি বা আচরণ দেখে ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া সম্ভব না যে এরা এই জিনিস । ইংরেজী বলার দৌড় আমার চেয়ে বেশী । এ ধরনের বাঙালি মেয়েরাও যে টাকার অভাবে এসব পেশার সাথে জড়িত, বিশ্বাস করাটাই কষ্টকর । রফিক আমাকে না বললে আমি কখনও বিশ্বাস করতে পারতাম না । বড়মামার পার্টির কোন খাবারই বাইরে থেকে আসে না । বাবুর্চি হাসমত আলিকে খবর দেয়া হয় । বড়মামা যতদিন বাংলাদেশে আছেন, ইনিও গাজীপুরে আছেন । বড়মামা এর রান্না পছন্দ করেন । লোকটা রাঁধেও ভালো । একবার বাগানবাড়িতে রাতের খাবারের দাওয়াত পেয়েছিলাম । আমি দুপুরে-দুপুরেই চলে গেলাম গাজীপুর । টিভির চ্যানেল ঘোরাচ্ছি, হঠাৎ দেখি রফিক একবস্তা কাদামাখা শিকড়সুদ্ধ পদ্মফুল বাংলোর রান্নাঘরে নিয়ে ঢুকছে । আমি ডেকে বললাম, ‘এগুলি কি ?’
‘হাসমত চাচা চাইছে । কিয়ের ‘কারী’ করবে ।’
আমি হাসমত চাচাকে ডেকে বললাম, ‘চাচা, কারী বানাচ্ছেন নাকি ?’
‘হুম... স্পেশাল ফুড ।’
‘কিসের কারী ?’
‘পদ্মের শিকড়, মিষ্টি আলু আর করল্লার ।’
আমি প্রথমে ভাবলাম সে ঠাট্টা করছে । আমি পরিস্থিতি হালকা করার জন্য শব্দ করে হাসতেই সে গম্ভীর মুখে বললো, ‘বাঙালি অভ্যস্ত হয়ে গেছে ডিমের কারী খেতে খেতে । কারী বলতেই মনে করে ডিম-শিম । নতুন স্বাদ তারা সহজে নিতে পারে না ।’

আমি হো-হো করে হাসলাম এবং শপথ করলাম খাবার টেবিলে ঐ বস্তুর ধার দিয়েও যাবো না । কিন্তু ঘটনা ঘটলো উলটো । খাবার টেবিলে সব খাবারের চেহারা দেখে ঐ বস্তুই আমি প্রথমে নিলাম এবং যারপর নাই মুগ্ধ হলাম । এতো সুস্বাদু খাবার জীবনে খুব কম খেয়েছি । বড়মামা বললেন, ‘কিরে ? খেতে কেমন হয়েছে ?’
আমি বললাম, ‘ওয়াও ।’
‘শুধু ওয়াও ?’
আমি টেবিলে তবলার বোল বাজিয়ে গাইলাম,

“That's why I say WOW
Never felt a love so good
I look up and my world is brighter now
There's no more rainy clouds...”

rainy clouds থেকে মেঘলার কথা মনে আসলো । হুম, মেঘলাকে খুন করা যায় । There will no more rainy clouds.. মেঘলা তনয়ের স্ত্রী । ওদের বিয়ে হয়েছে দু’বছর । মেঘলাকে খুন করলে তনয়েরই তো খুশী হবার কথা । দ্রুত আরেকটা বিয়ে করে নিতে পারবে । বাচ্চা-কাচ্চা নেই । মানে বন্ধন নেই । এক স্ত্রী আর কতো ?

দুটি সমস্যা আছেঃ
১। মেঘলা তনয়ের কাছে ফোন করতে পারে ।
২। মেঘলার বাসায় ওর ছোট বোন মিতু থাকতে পারে ।

আমি খানিকটা ভেবে মেঘলার নাম্বারে একটা ফোন করলাম । অনেকক্ষণ পর ঘুমজড়িত কন্ঠে সে ফোন ওঠালো, ‘হ্যালো ।’
‘ভাবী, ভালো আছো ?’
‘হ্যাঁ । তোমাদের শো শেষ ?’
‘তনয়ের সাথে তোমার কথা হয়নি ?’
‘না । ফোন দিয়েছিলাম । বন্ধ । তোমরা আজগুবি মানুষ । শো-এর সময় ফোন বন্ধ করে রাখার মানে কি, বলো তো ? কত ইম্পর্টেন্ট কিছু হতে পারে – সেলফোন সুইচড্‌ অফ রাখতে হবে কেন ? ফোনে কি সাইলেন্ট অপশন নেই ?’
‘ভাবী, তুমি তনয়ের রাগ আমার উপর ঝাড়ছো !’
‘তোমরা তো একই গোয়ালের গরু । শো এর সময় তোমার ফোনও অফ থাকে ।’
‘আচ্ছা ভাবী, কাজের কথা শোনো । তোমার একটা লাল পাড়ের হোয়াইট শাড়ি আছে না ?’

মেঘলা একটু চুপ করে থেকে বললো, ‘হ্যাঁ । কি ব্যাপার বলতো ?’
‘ঐটা পড়ে সেজেগুজে থাকো । তোমাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিতে আসছি !’
‘কেন ?’
‘কারন তোমার স্বামীর এই আজ্ঞা । তনয়সহ সবাই শো শেষ করে আধ ঘন্টার মধ্যে জয়দেবপুর যাচ্ছে । ওখানে একটা সারপ্রাইজ পার্টি হচ্ছে । আর পার্টির উদ্যোক্তা তোমার পতিদেব ।’
‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না । কিসের পার্টি ?’
‘সেকথা আমি কি করে বলবো ? তোমাদের অ্যানিভার্সারি ছিল নাকি আজকে ?’
‘না । সে তো ডিসেম্বর মাসে !’
‘প্রনয়কালীন কোন বিশেষ দিবস ?’
‘কই ? কিছু তো মনে পড়ছে না !’
‘সে যাই হোক । তুমি চট করে রেডি হয়ে নাও । তনয় আর তোমাকে সামনাসামনি ধরা হবে । আমি আসছি ।’
‘আচ্ছা । তনয় কি আর কিছু বলেছে তোমাকে ?’
‘মিতুর কথা বলছিল ।’
‘মিতু কেন ?’
‘কি জানি তোমাদের কি গোপন ব্যাপার ! আমাকে বললো, তুই শুধু তোর ভাবীকে পিক করবি । মিতুকে এসব জানানোর দরকার নেই । মিতু জানতে পারলে লজ্জার ব্যাপার হবে ।’
‘ওরে আল্লা ! কি আহ্লাদ ! মিতু এমনিতেও আম্মার বাসায় । রাখো । রেডি হচ্ছি । আজকেই পার্টি আর ভ্রু’ও প্লাক করা নেই । নিজেকে জংলীর মত দেখাচ্ছে ।’

আমি ফোন রেখে দিলাম । অ্যালকোহলের ঘ্রানে বৃষ্টি-বৃষ্টি পরিবেশটা স্বর্গীয় লাগছিল । সিগারেট ধরানোর জন্য ড্যাশবোর্ড হাতরালাম । লাইটার, দিয়াশলাই কিচ্ছু নেই । আশেপাশে কোন ছাপড়া-টং’ও খোলা নেই । মেজাজ খারাপ করে রাস্তার পাশের একটা কনফেকশনারী দোকানে গাড়ি থামালাম । কিছু চকলেটও কিনে রাখা দরকার । মাতাল মাথায় দ্রুত অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা আসছিল । সবচে মজার ভাবনাটা হচ্ছেঃ বাঙালি মেয়েদের আর যাই থাকুক না থাকুক লাল পাড়ের শাদা শাড়ি ঠিক থাকে । হাহাহা ।

আমার স্পষ্ট মনে আছে মেঘলাকে সেদিন কি দারুন রূপবতী মনে হচ্ছিল । অথচ সে রূপবতী নয় । গড়পড়তা চেহারার অতিরিক্ত ফর্সা একটি মেয়ে । রোগা, একহারা গড়ন । চেহারার মধ্যে কিছুটা ছেলে-ছেলে ভাব আছে । তবু বৈশাখী রঙের শাড়িতে গাড়ির ভেতর তাকে খুব মায়াবী লাগছিল । আমি বললাম, ‘ভাবী তোমাকে দেখলে তনয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে পারে ।’
‘এটা কি প্রশংসা হিসেবে নেবো ?’
‘আমি প্রশংসাই করেছি ।’
‘দেন- থ্যাংক ইউ ।’
‘ভাল কথা । ড্যাশবোর্ডে চুইংগাম আছে । অরবিট । নিতে পারো । অথবা চকলেট ।’, আমি ড্রাইভ করতে করতে ফুর্তিবাজ গলায় বললাম । মেঘলা ড্যাশবোর্ড খুলে চকলেট নিতে নিতে বলল, ‘ক্যাডবেরীর বাকীটা তুমি খেয়েছো ?’
‘কেন আমি অর্ধেক খেলে সেটা খাওয়া যাবে না ?’
মেঘলা চকলেটে কামড় দিতে দিতে বলল, ‘কামড়ে খেয়েছো না ভেঙে খেয়েছো সেটা হচ্ছে প্রশ্ন ।’

আমি হেসে উঠলাম । হাসতে হাসতেই দেখলাম মেঘলা গা এলিয়ে সিটে পড়ে গেছে । চকলেটে হায়ার সিডাটিভ পিল মিশিয়ে রেখেছিলাম । এমনটাই হওয়ার কথা । আজমপুর এসে আমি গাড়ি থামালাম । মেঘলার মোবাইলটা বের করলাম ওর ভ্যানিটি-ব্যাগ থেকে । তনয় বারোটার আগে আগেই বাসায় ফিরবে । মেঘলাকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেবে । তার আগেই মেঘলার ফোন থেকে তনয়কে একটা sms করে দিতে হবে । গাজীপুরে গিয়ে করলে হবে না । পুলিশ ট্রেস করে ফেলতে পারে । এখান থেকেই করবো । তনয়কে ফোন করে মেঘলা পায় নি । কাজেই আমি লিখবোঃ ‘তোমাকে ফোন করেছিলাম । পাই নি । অনেকদিনের পুরোনো স্কুলের এক বান্ধবীর সাথে দেখা হল । হঠাৎ করেই প্ল্যান হল ওদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার । সিলেটে হাসন রাজার বাড়ির কাছাকাছি । তিনদিন পরে ফিরবো । ফোনে নাও পেতে পারো । মোবাইলে কিছুদিন যাবত সমস্যা হচ্ছে । তোমাকে বলে লাভ কি ? ফ্যামিলির জন্য তোমার কোন সময় নেই । টেনশন করো না । আমার বাসায় জানানোর দরকার নেই । ওদের জানাই নি আমি ।’

sms সেন্ডিং রিপোর্ট আসবার সাথে সাথে আমি মোবাইল থেকে সিমটা বের করে ভেঙে ফেললাম । গাড়ির জানালা খুলে সেটাকে ছুঁড়ে ফেললাম ধূসর রাস্তায় । তারপর আবার গাড়ি চালাতে শুরু করলাম । সেলফোনটা কোথায় ফেলব এটাও একটা বিবেচ্য বিষয় । কোন ফাঁক রাখা যাবে না । A perfect crime should have no holes । হাহাহা । আমি ঘুমন্ত মেঘলার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলাম ।

এরপর যখন হাত-পা এবং মুখবাঁধা অবস্থায় মেঘলার ঘুম ভাঙল, সে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল । তাকে বেঁধে রেখেছি প্রিয় হুইলচেয়ারটাতে । খুনের সময় আমি সবসময় এই চেয়ারটাই ব্যবহার করি । মামার একবার অ্যাকসিডেন্টে ভাল রকমের ফ্রাকচার হয়েছিল পায়ে । তখনকার এটা, বেশ দামী । যারপরনাই অবাক মেঘলা গোঙাচ্ছে । বাঁধন থেকে হাত বের করার চেষ্টা করছে । তার ক্রমাগত চেষ্টায় হুইলচেয়ার নড়ে নড়ে উঠছে । আমি কিছুই বললাম না । তাকে পাত্তা না দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে সুর করে ‘এই মেঘলা দিনে একেলা...’ গাইতে গাইতে রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম । হাসমত চাচার তরকারি আর মাংস কাটার নানান টাইপের ছুড়ি আমার খুনে খুব কাজে দেয় । সেগুলো জোগাড় করতে হবে । আমি আমার ভাঙা বেহালা, দশ-বারোটা ছুড়ি আর দা নিয়ে বাড়ির পেছনের সুইমিংপুলের পাশে গিয়ে রাখলাম । বৃষ্টি থেমে গেছে । খুব একটা শীত শীত ভাব চারদিকে । পুলের নীলাভ পানি টলমল করছে । চারপাশ নিঃস্তব্ধ । ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ক্রমাগত শব্দ একটু পর পর কানে বাজছে শুধু । টুলবক্সটা আনা হয় নি । এখন আবার ওপরতলা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে ভেবেই মেজাজ খারাপ লাগছে । আমি ওপরতলা থেকে আমার টুলবক্সটা নিয়ে এসে হুইলচেয়ারটাকে ঠেলে ঠেলে সুইমিংপুলের পাশে নিয়ে এলাম । এখানে একটা গর্ত করে রক্ত সেখানে জমা করতে হবে । সুইমিংপুলের পানি তখন কাজে দেবে । অনেক দিনের অভিজ্ঞতা । সবকিছুই তাই হিসেব করা আমার ।

মেঘলা ইতোমধ্যেই সবটা আঁচ করে ফেলেছে । সে ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে । তার গাল ভেজা । কাঁদতে কাঁদতে সে তার চোখও লাল করে ফেলেছে । তাকে দেখাচ্ছে জীবনানন্দ দাশের ‘শঙ্খমালা’র মতঃ

কড়ির মতন শাদা মুখ তার
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে : দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায় ।
চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার !

আমি টুলবক্স থেকে বেছে বেছে তিনটি ছুড়ি বের করলাম । সার্জারির ডাক্তারদের ভাষায় এগুলিকে বলে স্ক্যালপেল । কাটলেট কাটার ছুড়ির মত রূপালি রঙের লম্বা ঋজু ছুড়ি, ব্লেডের ধার ওপর দিকের অর্ধেক বা তারও কম অংশ জুড়ে । আমি বাঁ হাতে মেঘলার চিবুক উঁচু করে ডান হাতে ওর বুকের উপরের অংশের চামড়া নীচের দিকে টেনে ধরে ওর ধবধবে ফর্সা গলাটা টানটান করে ধরলাম । ওর গলার ভেতরটা কাঁপছে । গোঙানির শব্দও বেড়ে গেছে । খুব সাবধানে গলার মাঝামাঝি জায়গায় বাইরে থেকে লম্বা করে কাটতে হবে । শ্বাসনালীতে যাতে কিছুতেই ব্লেডের আঁচড় না পড়ে । এবার নিস্ফল হওয়া যাবে না । কিছুতেই না । মেঘলা হবে আমার প্রথম সার্থক ভায়োলিন ।

মেঘলা খুব বেশী ছটফট করছিল । চেয়েছিলাম ওকে সজাগ রেখেই কাজটা করবো । ওর আকুতি শুনবো । করুণ মিনতি করলে মেঘলার চোখ কেমন হয়, দেখার ইচ্ছা ছিল । তবু, আমি রিস্ক নিলাম না । ছুড়ি বসানোর আগে ওকে আবার ঘুম পাড়াতে হবে । হায়ার সিডাটিভ দরকার । এই বাসাতেই আছে । আমি এনে রেখেছি । ছুড়ি ঘাসের ওপর রেখে আমি আবার ঘরের দিকে গেলাম । সব খারাপ দিকের একটা ভাল দিক থাকে । সিগারেটের প্যাকেট বাইরে আনা হয় নি । এই ফাঁকে সিগারেটও আনা হবে । আমি ইঞ্জেকশনে লিকুইড ভরতে ভরতে ভেবে নিলাম আর কোন কিছু কি মিস করছি ? না বোধহয় ।

আমি শঙ্খমালার হিম হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করলাম । তার ছটফটানি দেখতে দেখতে কমে এল । হ্যাঁ, এবার হবে । আমি খুব সাবধানে ওর গলার ওপরের দিকে একটা পয়েন্ট ঠিক করে স্ক্যালপেলের ব্লেড বসিয়ে দিলাম । ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে । আমি ব্লেড টেনে একেবারে গলার নীচ পর্যন্ত নিয়ে এলাম । মেঘলার গলার চামড়ার মাঝখানটা নিঁখুতভাবে চিঁড়ে নিয়েছি । এবার স্বরযন্ত্রের ঢেকে রাখা চামড়ার পুরোটা উন্মুক্ত করতে হবে । আমি ছুড়ি বদলে খুব ধীরে ধীরে কাজ করতে লাগলাম । খুব সাবধানে চামড়াগুলো কেটে দুদিকে ফোল্ড করে টুলবক্স থেকে চারটা আংটা নিয়ে চামড়াগুলোকে দুপাশে লাগিয়ে দিলাম । অনেকটা কাঁঠাল যেমন করে চেঁড়ে, ঠিক তেমনি । শ্বাসনালী এবার পুরোপুরি উন্মুক্ত । ভেতরের সবটা দেখা যাচ্ছে । রক্তে মেঘলার পহেলা বৈশাখের শাদা শাড়ি লাল হয়ে গেছে । আমি সেদিকে নজর না দিয়ে গলার ভেতরের রক্ত সতর্কভাবে পরিষ্কার করে ফেললাম ।

এখন স্বরযন্ত্রটাকে ঠিকঠাক মতো কেটে বেহালার চারটি স্ট্রীং বের করে আনতে হবেঃ মা, সা, পা, রে । সালফার ডাই অক্সাইড দিয়ে সেগুলোকে শক্ত করে তুলতে হবে, যাতে বেহালার ছড় চালালে নাজুক ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে না যায় । কোন তাড়াহুড়ো করা যাবে না । ধীরে । খুব ধীরে ধীরে । আমি টুলবক্সে রাখা সালফার ডাই অক্সাইড, অলিভ অয়েল আর সোডিয়াম কার্বনেটের শিশি বের করলাম ।

রাত যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আমার কাজ প্রায় শেষ হল । আমি ভাঙা বেহালার কাঁধটা মেঘলার মুখ হাঁ করিয়ে ভেতরের ভোকাল কর্ডের সঙ্গে কায়দা করে জুড়ে দিলাম । তারপর বেহালার ছড়ে রজন আর অলিভ অয়েল ঘষে কাঁপা কাঁপা হাতে ওর গলায় ছড় চালালাম । বের হল ! ঐন্দ্রিক মায়ামাখা সুর সৃষ্টি হল মেঘলার কন্ঠ থেকে । আহ্‌ ! কি মধুর সেই সৃষ্টি । করুণ বিষাদময় সেই সুর আমার চোখে জল এনে দিল । আমি বাজিয়েই চললাম, বাজিয়েই চললাম,... । এক পর্যায়ে এসে ছড়ের ধাক্কায় মেঘলার গলার একটা কর্ড কেটে গেল । তবু আমি থামলাম না । বিখ্যাত বেহালাবাদক ইসহাক পার্লম্যানের মত আমি বাজিয়েই চললাম ! একবার ভরা মজলিশে নাকি তার বেহালার একটা তাঁর ছিঁড়ে গিয়েছিল । তবু তিনি থামেন নি, তিনটি তাঁরের ওপর ভর করেই নাকি স্বর্গীয় সুর তৈরী করে গেছেন । আমি কেন থামবো ?

আমার গল্প প্রায় শেষ । আর একটুখানি বাকী । এমন না যে এরপর আমি আর কোন খুন করিনি অথবা আর কোন নারীর স্বরযন্ত্র ছিঁড়ে বেহালা বাজাইনি । বাজিয়েছি । তবে মেঘলাকে খুন করে আমি ভয়াবহ রকমের ভয় পেয়েছিলাম । ঐ ভয়ের অংশটুকু বলেই শেষ করবো ।
ঐদিন আজান হওয়ার পর আমি মেঘলাকে পুরোপুরি খুন করি । তারপর ওর শরীরটাকে খন্ড খন্ড করতে বসে যাই । পরিশ্রমের কাজ । ওর দেহের খন্ডগুলিকে রুবিকের দুই অ্যালসেশিয়ান সঙ্গিনীকে খাইয়ে দেবো, এই ইচ্ছা । এরপর রক্তগুলি ওয়াশার দিয়ে ধুয়ে গর্তে নিয়ে গিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিলেই হল । আমি সেই অনুযায়ী হিসেবমতো মেঘলাকে টুকরো-টুকরো করতে লাগলাম । হঠাৎ তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দে আমি সতর্ক হয়ে উঠলাম । মনে হচ্ছে কোন একটা বাচ্চার কান্না । আমি আবার কান পাতলাম । মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে কোন একটা বাচ্চা কাঁদছে । নিজেকে আমার মাতাল বলে মনে হল । এই জায়গায় বাচ্চা আসবে কোত্থেকে ? মামার এই বাগানবাড়ির আশেপাশে কোন জনবসতি নেই । থাকলেও এতো দূর থেকে আমার কান্নার শব্দ পাওয়ার কথা না ।

আমি দা ফেলে উঠে দাঁড়ালাম । সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম । নিচে চোখ পড়তেই দেখি আমার প্যান্টের নিচের অংশ পুরোটা রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে । এই রক্তের দাগ ওঠার কথা না । আমি বিরক্তমুখে সিগারেট ফেলে দিতে যাবো । ঠিক তখন খেয়াল করলাম একটা দু-তিন মাস বয়সের দুধের বাচ্চার মত কিছু একটা আমার পায়ের ঠিক দুহাত দূরত্বে পড়ে আছে । একটা বাচ্চার অর্ধেকের মতও তার শরীর না । মেঘলার খন্ড খন্ড দেহের রক্তে তার পুরো শরীর মাখামাখি । আমি হতভম্ব অবস্থায় কাছে এগিয়ে গেলাম । ভাল করে খেয়াল করে দেখি, এটা কোন বাচ্চা না । গলিত একটা মাংসপিন্ড । চোখ না ফোটা অপূর্ণ একটা শিশু ! একটা ভ্রূন !

আমি মৃতদেহ ঐ অবস্থায় ফেলে রেখেই টলতে টলতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম । পুরো মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেছে আমার । ঘুমুতে যাওয়ার জন্য ওপরতলায় যাবার মত শক্তিও নেই । আমি সোফার ওপর গা এলিয়ে দিলাম । তন্দ্রার মত এসেছে । আচমকা ঘুম ভেঙে গেল । দেখি চোখমুখে রক্ত মাখা একটা শিশু হামাগুড়ি দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে । আমি কেঁপে উঠলাম । ভয়ে আতংকে আমার মুখ শাদা হয়ে গেল । সোফার এক কোনায় সিঁটিয়ে পড়ে রইলাম । বাচ্চাটা অদৃশ্য হল না । ক্রমেই আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল । এক পর্যায়ে আমার খুব কাছাকাছি এসে আমার প্যান্টের নিচের অংশ কুকুরের মত চাটতে লাগল । ঐ অংশে রক্ত লেগেছিল । আমি চিৎকার করে উঠলাম ...।

তারপর কি হল সেটা জানতে নিশ্চয়ই সবাই আগ্রহ নিয়ে দ্রুত পড়তে চেষ্টা করছেন । বারবার পরের লাইনে চোখ চলে যাচ্ছে । কিন্তু, এই ঘটনার শেষাংশটা আমি লিখবো না । ইচ্ছে করেই লিখবো না । কিছু কিছু কথা লেখা যায় না । অথবা হয়তো লেখা যায় । লেখকরা লিখতে পারেন । আমি তো কোন লেখক নই । তাছাড়া আমি কোন গল্প লিখতেও বসিনি যে শেষ করতেই হবে । আগেই বলেছি এটা একটা কনফেশন । তারচে চলুন, আপনাকে একটা ব্যাপার ধরিয়ে দেই । নাকি ইতোমধ্যেই ধরে ফেলেছেন ? আমি আমার লেখার কোথাও কিন্তু আমাদের ব্যান্ডদলের নাম উল্লেখ করিনি । লিপু, রনো, তনয় এদের নাম কি কোন ব্যান্ডদলের তালিকায় আছে ? নেই । কারন নামগুলো আমি ইচ্ছাকৃতভাবে পালটে দিয়েছি । বলুন তো আমার নাম কি ?? আমার নামও কিন্তু কোথাও উল্লেখ করি নি । আমি বলেছি আমি কনফেশন করতে চাইছি । জেলে যেতে চাইছি একথা কখন বললাম ? হাহাহা ।

ও ! একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিস করে গেছি । মেঘলার নিঁখোজ হওয়ার পাঁচদিন পর যেদিন জিডি এন্ট্রি করতে রমনা থানায় গিয়েছি সেদিন তনয় আমাকে ফিসফিস করে বলেছিলঃ ‘গত মাসে মেঘলা আমাকে অসাধারন একটা নিউজ দিয়েছিল । she was expecting a baby । থ্রি উইকস অফ প্রেগনেন্সি । ...I was’ । তনয় কথা শেষ করতে পারে নি । আমার কাঁধের ওপর মাথা চেপে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল । আমি কিছু বলিনি । কে সারা সারা । ভবিতব্য পরিবর্তন করবার ক্ষমতা আমাদের মানবসম্প্রদায়ের হাতে কখনো ছিল না, এখনও নেই ।

__________________________
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৫:৫৩
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×