ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ঢাকা অফিসগুলোও বন্ধ হচ্ছে। ঢাকায় থাকা তাদের ২৩টি অফিসের ৫টি অফিস বন্ধ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এছাড়া রাজধানীর ২৩টি কার্যালয়ের যোগাযোগের নম্বর এখন বন্ধ। গতকাল দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওইসব নম্বরে ফোন করেছেন গ্রাহকরা। কিন্তু নম্বর বন্ধ থাকায় কারও সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারেননি। এতদিন ওই নম্বরগুলোতেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ডেসটিনির বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারীকে এসব নম্বর দেয়া হয়েছিল। নম্বরগুলোর মধ্যে ১২টি এয়ারটেল মোবাইল নম্বর। বাকিগুলো গ্রামীণফোনের। এ অফিসগুলোতে কোন টিঅ্যান্ডটি সংযোগ নেই। ওদিকে অবৈধ ব্যাংকিং ও আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ডেসটিনির অনেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। এতদিন তাদের যেসব সদস্য সাধারণ মানুষকে রাজধানীতে বহুতল মার্কেট আর দিনে লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে এসেছেন তাদের তৎপরতাও কমেছে। হঠাৎ করে ডেসটিনির প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও (সেমিনার) বন্ধ হয়ে গেছে। ডেসটিনির প্রতিটি অফিসের কোড নাম রয়েছে। ঢাকা অফিস বোঝাতে ব্যবহৃত হয় ‘ডিএইচএ’ এই তিনটি অক্ষর। কোড অনুযায়ী ডিএইচএ ২-এর অফিস চৌধুরী কমপ্লেক্স, তেতলা, ১৫ পুরানা পল্টন, ঢাকা। গতকাল সেখানে গিয়ে অফিসটি বন্ধ পাওয়া যায়। আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন কয়েক দিন ধরেই এ অফিস খুলছে না। আগে সারা দিনই এখানে গ্রাহকদের ভিড় লেগে থাকতো। ডিএইচএ ৬-এর অফিস খদ্দরবাজার শপিং কমপ্লেক্স, চার তলা, জিপিও, গুলিস্তান। ডিএইচ ৭-এর ঠিকানা স্কাইলার্ক পয়েন্ট, ১৭৫ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, বিজয়নগর। গতকাল এ দু’টি অফিসে গিয়েও মূল ফটক তালাবদ্ধ দেখা যায়। ফটকের বাইরে অফিস বন্ধ সংক্রান্ত কোন নোটিস দেখা যায়নি। ডিএইচএ ৩-এর অফিস মোতালেব সেন্টার, ছয় তলা ১৭৭ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি, বিজয়নগর। ডিএইচএ ৪-এর ঠিকানা, অসি সেন্টার, নয় তলা, ৪০ বিজয়নগর। গতকাল সরজমিনে গিয়ে এ দু’টি অফিসও তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। স্কাইলার্ক পয়েন্টের নিরাপত্তরক্ষী জানান, ২-৩ ধরে ডেসিটিনির অফিস খুলছে না।
ডিএইচএ ১৮-এর অফিস মালিবাগের হোসাফ শপিং কমপ্লেক্স। চার তলার পুরোটা জুড়েই ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের কার্যালয়। এ অফিস সবসময়ই ডেসটিনির গ্রাহকদের আনাগোনায় প্রাণচঞ্চল থাকে। কিন্তু গতকাল সেখানে লোকজন ছিল হাতেগোনা। হোসাফ কমপ্লেক্সের উত্তর দিকে ভবনের দেয়াল ঘেঁষে আলিমের চায়ের স্টল। আলিম বলেন, লোকজন কয়েক দিন থেকে কম আসছে। প্রতিদিন ৪-৫শ’ কাপ চা বিক্রি করি। কিন্তু ক’দিন থেকে ১০০-১৫০ কাপও বিক্রি হচ্ছে না। ডিএইএ ২০-এর অফিস বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ ভবন, ২২/১ তোপখানা রোড, তেতলা। এ ভবনের চার তলা পুরোটাই ডেসটিনি ২০০০-এর অফিস। এছাড়া পাশের ‘খবরপত্রে’র ভবনটি ভাড়া নিয়ে চলছে তাদের কার্যক্রম। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায় ভবনের সামনে ছোট ছোট জটলা। পাশে দাঁড়িয়ে শোনা গেল নানা কথা। রনি নামের একজন আরেকজনকে বলছেন, ভাই পত্রিকায় ডেসটিনির বিষয়ে তো অনেক কিছু লিখছে। আমরা টাকা ফেরৎ পাবো তো। ভাইয়ের উত্তর- আরে বাদ দাও এসব। এসব পত্রিকা পড়বা না। শুধু দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকা পড়বা। জসিম নামের আরেকজনের প্রশ্ন- ভাই, ডেসটিনির কি আসলেই অনুমোদন নেই। ভাইয়ের উত্তর- সব গুজব। অনুমোদন না থাকলে একটা প্রতিষ্ঠান ১২ বছর চলতে পারে? ডেসটিনিকে বন্ধ করা অত সহজ না। ১৫ মিনিট পরে জটলা ভাঙলো। রনি নামের ওই তরুণকে একা পাওয়া গেল। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে তিনি নীল রঙের শার্টের সঙ্গে টাই পরেছেন। গলার বোতাম লাগানো। দরদর করে ঘামছেন। রনি জানালেন, তিনি ডেসটিনিতে ৪৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আরও দেড় লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে তার দু’ভাই ও এক বোন। সবাই গার্মেন্টেসে চাকরি করে। অনেক কষ্টের টাকা। খবরপত্র ভবনের সিঁড়িতে পাওয়া গেল জরিনা বেগম নামের এক যুবতীকে। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করেন তিনি। ডেসটিনিতে তিনি ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বললেন, কয়েক দিন ধরে শুনতে পাচ্ছি ডেসটিনি নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এসেছি খোঁজখবর নিতে।
ডেসটিনির ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান বলেছেন, ডেসটিনির ব্যাপারে দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে বসে কোম্পানিটির অনিয়ম ও আইন লঙ্ঘনের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে করণীয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এককভাবে কিছুই করার নেই। গতকাল ব্যাংক ভবনের নিজস্ব কার্যলয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তার নির্ধারিত ক্ষমতাবলে তদন্ত করে দেখছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম ও আইনি সীমা লঙ্ঘন ডেসটিনি কতটুকু করেছে তা এককভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলতে পারবে না। আইন পর্যালোচনা করতে হবে। যারা এর নিয়ন্ত্রক, তাদের বলতে হবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কি আইন লঙ্ঘন করেছে ডেসটিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডেসটিনির প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে অধিক গুরুত্ব দিয়ে রোববার দু’টি নির্দেশনা জারি করেছে। তাতে এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে লেনদেন না করার জন্য জনগণকে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ডেসটিনির প্রতারণা ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২টি পরিদর্শন কমিটিকে মাঠে নামানো হয়েছে। এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, সাধারণ মানুষ অনেক সময় ধারণা করে, একটি প্রতিষ্ঠান যখন দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তা আইনি কাঠামোর মধ্যে থাকে। তাছাড়া লোভেও বিনিয়োগ করে। অনেকেই মনে করে, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিছু হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে। তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করবে। কিন্তু অনেক সময় তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনসচেতনতা বাড়াতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। নিরীহ ও সহজ সরল মানুষকে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে শিগগিরই মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ডেসটিনির নানা ধরনের প্রতারণা খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে পৃথক কার্যক্রম শুরু করেছে।