একটা বই খুঁজতে নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, নিউমার্কেট থেকে ধীরে ধীরে বইয়ের দোকানগুলো সব হারিয়ে যাচ্ছে। হাতে গনা অল্প কয়েকটি দোকান সেখানে ক্রেতার অভাবে ধুঁকছে। যে কোন দিন হয়ত বন্ধও হয়ে যাবে। যেমনটা হারিয়ে গেছে আজিজ সুপার মার্কেট।
আমাদের অনেকের জীবনের শৈশব, কৈশোর এমন কি যৌবনের প্রথম দিনগুলোতে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোর সাথে হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বহু তরুন তরুণীকে দেখেছি কখনও হাস্যজ্জল বা অশ্রুসজল চোখে প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে গল্প উপন্যাসে বর্নিত এই দৃশ্যগুলোকে খুব জীবন ঘনিষ্ঠ বলেই মনে হতো, মিথ্যে মেকি মনে হতো না।
আমাদের তরুন প্রজন্মের খুব ছোট একটা অংশ বই পড়ার প্রতি আগ্রহী। এরা নিরবে নিভৃতে বই সংগ্রহ করে, পড়ে। বইয়ের নেশা খুব আনন্দদায়ক একটি নেশা। বাকিরা বই পড়ার চাইতে "বই পড়ি এবং প্রচুর বই কিনি" টাইপের শো অফ করতে পছন্দ করে। আমি বিশ্বাস করি, এই শো অফের জন্য কেনা বই গুলো একদিন ঠিকই তাদের পাঠক স্বত্তাকে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু সেদিন হয়ত হাতে খুব একটা সময় থাকবে না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরানো বই কিনে পড়তে পছন্দ করি। আগের মত ভালো কোয়ালিটির বই যদিও এখন পাওয়া যায় না, তবে অন্ধের লাঠির মত নীলক্ষেত এখনও আছে, এখনও সেখানে খুজলে মাঝে মাঝে ভালো বই পাওয়া যায়। একবার একটা পুরানো বইয়ের শুরুতে অনবদ্য একটি প্রেম পত্র পেলাম। ছোট্ট দুই লাইনে একটা ফুল, আর কিছু নকশা করা লতাপাতার নিচে লেখা,
আমার মৃতপ্রায় ফ্যাকাসে হৃদয়,
এখনও যাকে দেখে চমকে উঠে,
- শুভ জন্মদিন।
বইটা ছিলো জীবনানন্দ দাশের একটি অপ্রকাশিত কবিতার বই। ২০ টাকায় বইটা কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ থেকে তখনকার সময়ের ভলভো দোতলা বাসের একদম পেছনের সিটে বসে পড়েছিলাম। বইটা পড়ছি আর জানলা দিয়ে আসা বাতাসের সাথে অদেখা সেই প্রেমিকের ভালোবাসা অনুভব করার চেষ্টা করে ভীষন নষ্টালজিক হচ্ছিলাম।
বহু বছর পর এবার কলকাতায় গিয়ে মনে হলো, সেই পুরানো দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে। কলকাতাবাসীদের দুটো বিষয় আলাদা করে চোখে পড়ার মত। এক, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাদের এক ধরনের প্রচ্ছন্ন শো অফ আর দুই, বই পাঠে তাদের আগ্রহ। কলকাতার বই প্রেমীদের সংখ্যা আমাদের ঢাকার চাইতে কিছুটা বেশি বলেই মনে হয়েছে। বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের মধ্যে বইয়ের প্রতি আগ্রহ দেখে আমার মন খারাপ হয়েছে এবং বিনা দ্বিধায় কিছুটা হিংসাও করেছি। আমাদের তরুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারী মাসের বই মেলা কেন্দ্রিক পাঠক।
কলকাতায় বেড়াতে গেলে আমার পছন্দের একটা কাজ হচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারা। যদিও পার্ক স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলোতে ইদানিং ভালো কালেকশন পাওয়া যায় তবে সেখানে ইংরেজী বইয়ের প্রাধান্যই বেশি। এই সব দোকানগুলোতে ঢুঁ মারতে আমার দারুন লাগে। আমি বাংলাদেশে ফেরত আসার আগের দিন বই কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাই নচেৎ যাত্রার শুরুতে এই আগ্রহ দেখালে হাওড়া স্ট্রেশনে গিয়ে বাকি রাতগুলো কাটাতে হবে।
প্রচুর নতুন পুরানো বইয়ের দোকানের জন্য আমার কাছে কলেজ স্ট্রিট খুবই প্রাণবন্ত লাগে। যে দৃশ্যগুলো হয়ত বিখ্যাত সব লেখকদের বইয়ে যে খন্ডদৃশ্য হিসাবে দেখেছি, সেগুলো বাস্তবে দেখতে পেয়ে কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভুতির সৃষ্টি হয়। আমাদের আজিজ সুপার মার্কেট এক সময় এমন ছিলো। বর্তমানে সেখানে বইয়ের দোকানের চাইতে জামাকাপড়ের দোকানই বেশি দেখা যায়। এটা একটা দীর্ঘ আফসোস ছাড়া আর কিছু না।
কলকাতার কলেজ স্ট্রীট ধরে মহত্মাগান্দী লেনের দিকে কিছুটা হাটলেই একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান চোখে ভেসে উঠে। আর তা হলো প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। আহা! কত লেখকদের বইয়ে এই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম শুনেছি। এটা সামনে গেলেও সেই একই অনুভুতি কাজ করে।
তবে এই সকল অনুভুতিকে মোটামুটি পিষে মারতে চাইলে ইন্ডিয়ান কফি হাউজে চলে যেতে হবে। প্রতি বছর পাল্লা দিয়ে এদের খাবারের মান কমছে। দারুন বিস্বাদ কফি খেয়ে সত্যি মনে হবে - কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, সত্যি আজ আর নেই।
তবে এই বিখ্যাত কফি হাউজে গিয়ে দেখা হলো বিখ্যাত ব্লগার পদাতিক ভাইয়ের সাথে। তাঁর আতিথিয়েতার ব্যাপারে আলাদা পোস্ট দিয়ে আলাপ করতে হবে। আমি সেদিন খুবই ক্লান্ত আর প্রায় বিধ্বস্ত ছিলাম গরমে। তিনিও সেই বারাসাত থেকে নানান হ্যাপা করে আমার সাথে দেখা করতে আসলেন। অল্প কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমি আবার নতুন শহরে যাবার জন্য গাড়িতে উঠে পড়লাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০২৩ বিকাল ৩:৪৮