জামাতে ইসলামের নেতারা কখনও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবস্থানের জন্য ক্ষমা চান নি এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও তারা ক্ষমা চাইবেন না। এর প্রধান কারন ধর্ম সম্পর্কে এই দেশের মানুষের অজ্ঞতা, মুর্খতা এবং অন্ধ বিশ্বাস। ধর্ম সম্পর্কে সাধারন মানুষের এই মুর্খতাকে পুঁজি করে তারা নানা রকম গল্প বলে থাকেন। ১৯৭১ সালের কর্মকান্ডের জন্য তাদের অন্যতম সেরা যুক্তি হচ্ছে - তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ ছিলো না, পাকিস্তানই ছিলো তাদের দেশ। তারা তাদের দেশকে রক্ষার জন্যই এই অবস্থান নিয়েছেন। ফলে তাদের নেতারা আদর্শগতভাবে কোন ভুল করেন নি এবং তাদের দ্বারা মানবতাবিরোধী কোন অপরাধ হয় নি।
অথচ তৎকালীন নিরপেক্ষ ইতিহাস ও পরিসংখ্যান ঘাটলে স্পষ্ট বুঝা যায় পশ্চিম পাকিস্তানীরা কখনও পুর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সমমর্যাদা দিতে চায় নি। আপনার পুর্ব পুরুষদের মধ্যে যারা লেখাপড়া করে সরকারী চাকরী ও অন্যান্য কাজে যুক্ত হবার চেষ্টা করেছিলো, তাদেরকে অনুগ্রহ করে জিজ্ঞেস করবেন। আমাদের অঞ্চলের কোন মানুষ যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও পাকিস্তান সরকারের কোন শীর্ষ পদে সহজে যেতে পারত না, দেয়া হতো না। তারা এই দেশের মানুষকে কখনও সম্মানের চোখে দেখে নি এমন কি ধর্ম পালনের ক্ষেত্রেও আমরা তাদের চেয়ে এগিয়ে ছিলাম। এই দেশের সাধারন মানুষ ধর্মকে অন্তরে ধারন করে পালন করত আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা করত লোক দেখানো হিসাবে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পেছনে অন্যতম ভুমিকা ছিলো ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের। কয়েক হাজার মানুষ এই ঘুর্নিঝড়ে মৃত্যু বরণ করেন। এই ঘুর্নিঝড় এই দেশের মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো তাদের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের উদাসীনতা ও নিষ্ঠুরতাকে। যার ফলশ্রুতিতে এই দেশের হাজারো সাধারন মানুষ ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে জালিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। এই যুদ্ধের প্রথম স্তর ছিলো জাতীয় নির্বাচন। সেখানে বাংলার মানুষ একচেটিয়া জয় লাভ করে।
তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের জামাতে ইসলামী তো এই বিষয়ে কোন প্রতিবাদ করে নাই, আন্দোলন করে নাই! তারা তো ইসলামি দল ছিলো, জালিম শাসকের ভুল ধরিয়ে দেয়া তো ইসলামিক নিয়ম, আদর্শ। ইতিহাসে কি এমন কোন ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে, যেখান থেকে জানা যায় জামাতে ইসলামির পুর্ব পাকিস্তান অংশ এই দেশের মানুষের উপর সংঘটিত বৈষম্যের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে?
এরপর আসেন, যুদ্ধকালীণ সময়ে তাদের ভুমিকা সম্পর্কে। ইসলামী দল বলে দাবি করা একটি দল কি দেখে নি কি অন্যায়ভাবে এই দেশের হাজারো নিরিহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। গণিমতের ফতোয়া দিয়েছে এই দেশের তৎকালীন জামাত সমর্থন করা অনেক অশিক্ষিত হুজুর এবং রাজনৈতিক নেতারা। তাদের কি কখনও শুনেছেন জোর গলায় বলতে যে - যা হচ্ছে তার অন্যায়! এটা ইসলামের আদর্শের সাথে কনফ্লিক্ট করছে? এই অন্যায় মেনে নেয়া যায় না? বরং পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসরা যেভাবে এই দেশের মানুষের উপর জুলুম করেছে, অত্যাচার করেছে, বিনা অপরাধে মানুষ হত্যা করেছে - তেমনটা করত আরবের বিভিন্ন বর্বর গোত্র, পারস্যে এবং রোমান সাম্রাজ্যের লোকরা।
যেহেতু আমরা কথা বলছি, ইসলামিক দল নিয়ে, তাই ইসলামিক রেফারেন্স টেনেই কথা বলতে হবে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘জালিমরা কখনো সফলকাম হয় না।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৫৭)। আল্লাহর নবী মোহাম্মদ সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো জালিমের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে চলে অথচ সে জানে যে ওই ব্যক্তি জালিম, তখন সে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেল।
ফলে আপনি যদি একজন সত্যিকার মুসলিম হয়ে থাকেন এবং আপনি যদি ইসলাম ধর্মকে আপনার দ্বীন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন ও এর আদর্শকে বুঝে পালন করার চেষ্টা করেন তাহলে বুঝবেন - ধর্মের দোহাই দিয়ে কত বড় একটি জালিয়াতি তারা করেছেন এবং এই দেশের হাজারো ধর্মপ্রান মানুষদের সাথে তারা কিভাবে প্রতারণা করছেন।
তাই, ১৯৭১ এর জামাত ই ইসলামকে আমি কোনভাবেই একটি ইসলামিক দল হিসাবে মনে করি না এবং বর্তমানের জামাত ই ইসলামীও যেহেতু তাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় নি, সেহেতু আমি তাদেরকে আমি ইসলামী আদর্শভিত্তিক দল হিসাবে চিহ্নিত করি না বরং তারা ইসলামী আদর্শ বিক্রি করে চলা একটি রাজনৈতিক দল হিসাবেই আমি মনে করি। তারা যদি ইসলামিক ভাবধারা অনুসরন করা কোন দল হতো তাহলে ১৯৭১ সালে তাদের ভুমিকা ভিন্ন হতো। একই কারনে তাদের সেই সময়কার কোন রাজনৈতিক নেতাকে আলেম হিসাবে আমি স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাই। যে আলেম ইসলামের বেসিকটাই জানে না, তারে আমি অন্য কিছু স্বীকার করলেও ইসলামিক আলেম হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করি না।
যাদের মুখে এক এবং অন্তরে আরেক তারা মোনাফেক। মোনাফেকদের উপর আল্লাহর লানত। ইসলামের সেরা মোনাফেক ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। তার মৃত্যূর পর তার ছেলে কাফনের কাপড় হিসাবে রাসুল সাঃ এর জামা চেয়েছিলেন। তিনি সেটা দিয়েছিলেন। এরপর উবাইর ছেলের অনুরোধে রাসুল সাঃ তার জানাযাও পড়িয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে সুরা তওবার একটি আয়াত নাজিল হয়েছিলো।
'তুমি ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো বা না করো, একই কথা। তুমি ৭০ বার ওদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও আল্লাহ ওদের কখনোই ক্ষমা করবেন না। এ জন্য যে ওরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না।’
ফলে আমি মোনাফেকদের সমর্থন করি না। আমার ব্যক্তি জীবনে আমি এমন অনেক জামাতের নেতাকর্মীদের দেখেছি, যারা হয়ত দারুন মানুষ নিরিহ যারা কারো সাথে পাছে নেই, তারা রাজনীতি বুঝে না। তারা শুধু ইসলামকে ভালোবেসে জামাতকে সমর্থন করেন। তাদের জন্য আমার মায়া হয়। আমি আবার এমন অনেক জামাতের নেতাকর্মীদের চিনি যাদের আচরণ মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ। এমনও দেখেছি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে চার পাঁচটি প্রেম করে প্রতিনিয়ত ফেসবুকে শেয়ার করেন পর্দার করার গুরুত্ব সম্পর্কে। হাস্যকর!
যাইহোক, এই দেশের মানুষ এখন স্বাধীনতা উপভোগ করছে, নানা ভাবে চেখে দেখছে স্বাধীনতার স্বাদ। কেউ কেউ বায়ু নির্গত করেও ভাবছেন, এটাই বুঝি স্বাধীনতা। যেমন গোলাম আজম যাকে মানুষ গোয়াজম বলে ডাকে (আমি নাম বিকৃত করে ডাকলাম না), তার ছেলে কি বলছে না বলছে এই সব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নই। যদিও কিছুদিন আগে একটা টক শো বা আলোচনা অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম আরো একজন ব্যক্তি দেশের নাম ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে চেয়েছেন।
এই সব ঘটনায় আমরা প্রতিক্রিয়াশীল হুমকি দিচ্ছি, আবেগ দিয়ে চিৎকার বলে বলছি যে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে দিবো না বা এই করা যাবে না, আবার আরেক দল বলছে জাতীয় সংগীত চেঞ্জ করে প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ করতে হবে, আরেকদল বলছে, জেমসের একটি গানকে জাতীয় সংগীত করতে হবে, বা ধনধান্যে পুষ্পভরা এই গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসাবে রাখা হোক অর্থাৎ যার যা ইচ্ছে সেটা করা হোক!
বাস্তবতা হচ্ছে – জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা যাবে না এমন কোন বাধ্যবাধ্যকতা নেই। কিন্তু আপনাকে সেটা দলমত নির্বিশেষে যুক্তি দিয়ে বুঝাতে হবে কেন এই পরিবর্তন প্রয়োজন। এই জাতীয় সংগীতের কোন বিষয়টি আমাদের স্বাধীনতার চেতনা বা আমাদের দেশের আদর্শের সাথে কনফ্লিটিং বা জনগনের কোন অংশের সাথে কনফ্লিক্ট করে। যে পরিবর্তন আনা হবে সেই পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসাবে আমরা অন্যদের কি ম্যাসেজ দিচ্ছি?
এখন পর্যন্ত বিশ্বের পাঁচটি দেশ তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন বা পরিমার্জন করেছে। কিন্তু শতভাগ নতুন করে কোন জাতীয় সংগীত নির্বাচন করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যে পাঁচটি দেশ জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেছে তার মধ্যে আছে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, সাউথ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড। যেমন ২০১২ সালে অস্ট্রিয়া জেন্ডার ইনক্লুসিভিটি পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করার জন্য তাদের জাতীয় সংগীতে কিছুটা মোডিফিকেশন করে। আবার অস্ট্রেলিয়া ২০২১ সালে তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনে তাদের দেশের অ্যাবরোজিন এবং আদিবাসীদের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে।
এখন বাংলাদেশে যদি কেউ দাবি করে যে, জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে হবে, তাহলে সেটার পেছনে যৌক্তিক কারন আমাদেরকে জানাতে হবে, এর ফলে আমাদের জাতি হিসাবে কি অর্জিত হবে সেটাও ব্যাখ্যা করতে হবে। নইলে এই গান হিন্দু লিখেছে বা ভারতীয় কবি লিখেছে বা গায়ে উত্তেজনা আসে না বা যাই আপনার লজিক হোক না কেন এবং আপনি যতবড় বিদ্যানই হোন না কেন, সেটা লম্বা করে রোল পাকিয়ে আপনার উপযুক্ত স্থান নিয়ে প্রবেশ করানো হবে।
আমার সোনার বাংলা,
আমি তোমায় ভালোবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩০