প্রারম্ভিকাঃ আলোচনার তত্ত্ব-তালাশ
ধর্মভাব আর কাব্যভাব দুই মেরুর নয় । রূপের মধ্যে অরূপের ইশারা আর অরূপ-কে দৃষ্টিগ্রাহ্য করার পিপাসা এ দুই ভাবেরই অন্তরগত প্রবণতা । ‘ পরম অনুপুস্থিত’কে ভাষার মধ্যে গ্রেফতার করে জিকিরে ও জপে, প্রতীকে ও রুপকে,ভাবে ও ব্যাঞ্জনায় বিহ্বল হয়ে থাকেন মুমিন-কবি ।নজরুল সেই কবি যিনি বিগলিত হতে পারেন প্রেমে ও প্রার্থনায়,আবার ফেটে পরতে পারেন বিক্ষোভে ও প্রতিবাদে । একদিকে নবীপ্রেম ও নবীবন্দনা , অন্যদিকে শ্যামাপ্রেম ও কালিবন্দনা , শক্তির আরাধনার উচ্চকিত ঘোষণা একদিকে, অন্যদিকে তার ভক্তিবিহ্বলতা ---এই বিবিধ বৈপরিত্য নজরুল অবচেতনের (Unconscious) এক গভীর দশার ইশারা দ্যায়। এ কথা ইতিমধ্যেই রাষ্ট্র হয়েছে যে,কবি হিসেবে তিনি হৃদয়বাদী। কোন্ কবি হৃদয়বাদী না বা হৃদয়বাদী হওয়া কবিত্বের জন্য কতটুকু হানিকর সে প্রশ্ন উহ্য রেখেও আমরা বলতে পারি ইসলাম প্রশ্নে তার ভাবনায় হৃদয়াবেগের প্রাবল্যই প্রধান । কঠোর-কঠিন শাস্ত্রানুগত্যের বিপরীতে তার ইসলামী কবিতা ও গানে আমরা লক্ষ্য করি ‘ইশক’এর জোয়ার ।নজরুলের নিরেট প্রেমের বা বিচ্ছেদের কবিতার ভেতরেও প্রার্থনার সুর ও স্বর আছে । নজরুল আসলে মর্মে মরমী ।
ইমাম তাইমিয়ার চুলচেরা শাস্ত্রীয় যুক্তিতর্ক ও নীরস বিশ্লেষণী যুগের পর মাওলানা রুমি যেমন তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের হৃদয়ের শুষ্কভুমিতে জাগিয়ে তুলেছিলেন ভাবাবেগ ও ভালবাসার তুমুল বারি, নজরুলও তেমন তার কবিতা ও গানে আল্লা,নবী ও মানবপ্রেমের বাণী গেয়ে বাঙালির হৃদয়ানুভুতির জগতকে সম্প্রসারিত করে ‘ অভেদ মানবজাতির’ জন্য সেখানে ‘পরিসর’(space) তৈরীর প্রয়াস নিয়েছিলেন । অবশ্যই এ প্রয়াস ছিল তার কাব্যিক প্রয়াস । এখানে বলে রাখা প্রয়োজন,নজরুলের ইসলাম ভাবনার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের কারণ নজরুলের ভেতর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার কোন বয়ান আবিষ্কার নয় অথবা ধর্ম প্রশ্নে,বিশেষত ইসলাম প্রসঙ্গে, তাকে খুব উদার ও আধুনিক প্রমান করাও নয় অথবা তাকে সাচ্চা মুসলিমের উদাহারন হিসেবে গন্য করে আদর্শ হিসেবে সমাজে প্রতষ্ঠা করার আরোপিত ইচ্ছাও নয় । আমাদের আগ্রহ আরও গভীর । কারণ নজরুলের রচনা থেকে তাকে যেমন ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে শক্তিমদমত্ততার সমর্থক প্রমান করা যায়; তেমনি সুফি -মুসলিম বলার পাশাপাশি তাকে ‘কাফের’-‘মুশরিক’ হিসেবে প্রমানের মালমসলাও অনেক শাস্ত্রবিদের কাছে আছে । যাহোক , ইসলামের পরিমণ্ডলে থেকেই মানুষ , স্রসটা এবং মানুষ ও স্রস্টার সেতুবন্ধ হিসেবে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ(নবী) সম্পরকে নজরুল এমন উপলবধিতে, ঈমান থেকে ইয়াকিনের এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছিলেন যেখানে ভক্তি,প্রেম আর জাতিধর্ম নির্বিশেষে মিলন ও যাপনই সত্য।
আমাদের১ অভিপ্রায় হচ্ছে ,নজরুলের উপ্লব্ধির সেই অপরিজ্ঞাত জায়গাটি চিহ্নিত করা আর বুঝে নেয়া যে, ইসলাম কি নজরুলের কাছে কোনো পথ,অনেক পথের একটি ? নাকি ইসলাম তার কাছে একটি মতাদর্শ বা ইসলাম মানে কাজ বা বিশেষ গুন অর্জন নাকি অনুভুতির এক তুরীয় অবস্থা যেখানে সকলে ও সবকিছু লীন ? নজরুলের শক্তি এই যে, তিনি ‘অনেক’ কে ধারণ করতে পারেন;নানা ক্ষেত্রে তার চিন্তার স্ববিরোধীতাও ইঙ্গিতবহ কেননা কোন চিন্তাই স্ববিরোধীতা মুক্ত নয় ।এ ব্যাপারে নজরুল রচনা শুধু নয় নজরুলের জীবন ও যাপনও অর্থোৎপাদক।
ইসলামের ভাব ও ব্যঞ্জনা, সুর ও সুধা নজরুল হৃদয়কে আশ্রয় করে যেন স্বতোপ্রকাশিত হয়ে উঠে কবিতা ও গান রূপে যেখানে আবেগের তলায় আছে অন্তরগত যুক্তির চাপ ও তাপ যাকে আমরা দর্শন নামে অভিহিত করতেই পারি,পাশ্চাত্য দর্শনের প্রবল(Dominant) ধারা তাকে যতই অস্বীকার করুক।ইসলাম সম্পর্কে নজরুলের ‘ভাবনা’ আরও সুস্পস্ট ও সুনির্দিষ্ট , জনবোধ্য ও প্রায়োগিক হতে থাকে তার প্রবন্ধ ,চিঠিপত্র ,আর অভিভাষণে । ইতিহাসের যে পর্বে নজরুলের বিকাশ ও বিস্তৃতি,সেই কাল খণ্ডের বস্তুগত অবসথা মোকাবেলার উপযোগী ইসলামের এক ‘মানবিক’ ভাষ্য নজরুল উপস্থাপন করছিলেন। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামের বিশেষ বিশেষ বয়ান প্রধান হয়ে উঠে সামাজিক,রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে ।আমাদের মনে রাখতে হবে,পরাধীন ভারতে হিন্দু-মুসলিম দুই সমপ্রদায়ের অস্তিত্বের বাস্তবতার নিরিখে তাকে ইসলামের ব্যাখ্যা উপলব্ধি করতে হয়েছিল। পরাধীন ভারতবর্ষে নানা অর্থেই পশচাৎপদ মুসলিম সমাজে হাতের কাছেই সামাজিক ও ব্যাক্তিগতভাবে প্রতিপালনযোগ্য যে আচরণীয় বিধান বা মতাদর্শ ছিল ,তার নাম ইসলাম । সাধারণ বাঙালি মুসলমানের ভাবনার জগত দীর্ঘকাল ধরেই ধর্মীয় ধারনা,শব্দ বা পরিভাষা দ্বারা গঠিত। তাই পরাধীন ভারতবর্ষে শোষক ও শোষিতের কাঠামোর মধ্যে শোষিতের পক্ষে লড়াইয়ের এক প্রেরনাদায়ী পাটাতন ছিল ইসলাম । অত্যাচারীর বিরুদধে লড়াইয়ের আত্মিক ন্যায্যতা (Spiritual legitimacy) ও সাম্য বা মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা বাঙালি মুসলমান হিসেবে অন্য অনেকের মতই নজরুলও খুঁজে পেয়েছিলেন ইসলামের সাম্য ও মানবিকতার শিক্ষার মধ্যে ।মুসলমান হওয়ার কারণে তিনি লজ্জিত ছিলেন না ।বাঙালি না মুসলমান ---এমন অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নে নজরুল দ্বিধাদীর্ণ ছিলেন না কখনই । কেননা, ইসলামকে যদি আমরা দুই ভাগ করি যেমন,আইনগত ইসলাম(Legal Islam ) ও আধ্যাত্মিক ইসলাম (Spiritual Islam ),তবে আমরা দেখব নজরুলের পক্ষপাত আধ্যাত্মিক ইসলামের দিকে। নজরুলের প্রানের পরিভ্রমণ ছিল শরীয়তের দরোজা থেকে মারেফতের অন্দর মহলে । রূপ থেকে অরূপের দিকে আত্মিক যাত্রার যাত্রী ছিলেন নজরুল ।
নজরুল সাহিত্য থেকে নজির টেনে আমাদের মুল আলোচনায় প্রবেশের আগে আবার বলে রাখা দরকার, নজরুল আপাদমস্তক কবি । স্বভাবে তিনি কবিই, দার্শনিক নন । তার ধর্ম ও দর্শনচিন্তায় কারয -কারণ সম্পকের নিগূড়তা ও চিন্তার সুষম কাঠামো আমরা সবসময় আশা করতে পারি কি? কোন তত্ত্ব বা আদর্শের অনুপুঙ্খ বিচার- বিশ্লেষণ করে তা প্রচার ও প্রতষ্ঠাও তাঁর দায়িত্ব নয় । নানা অভিজ্ঞতা ,চিন্তা ভাবনা ,কবিসুলভ অনুভূতি আর উপলবধির মিশেলে এক দার্শনিক দৃষ্টিভঙগি তিনি অর্জন করেছিলেন। নিম্োক্ত শীর্ষনামে নজরুলের ভাব ও অনুভুতিকে আমরা বোঝার চেস্টা করতে পারি। আরেকটি কথা বলে রাখি, নজরুলের ‘ইসলাম’ নিয়ে আলচনা করতে হলে ধর্ম সম্পর্কে তার সাধারণ উপলবধি ও নানা পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমান প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবেই আসতে বাধ্য। কেননা অন্তর্গত-সমর্পিত নজরুল ছাড়াও বাহ্য পরিবেশ-প্রতিবেশের সাথে ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ারত নজরুলও আমাদের প্রতিপাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ।নজরুলের ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধের দোহাই দিয়ে আমরা বলতে পারি, নজরুলের‘কাজ’ তার ‘ভাবের রূপ’ বুঝতে সহায়ক । (ইসলাম[২০০৬/১:৪১৮])
১। নজরুলের মুসলমানঃ আজাদ-মানুষ,আজাদ চিত্ত ,মুক্ত-স্বদেশ
নজরুলের মুসলমানের সংজ্ঞায়ন মৌলিক ও বিস্তৃত অর্থবোধক । তিনি মুসলমানকে চিহ্নিত করেছেন ‘নাজাত পথের আযাদ মানুষ’ হিসেবে । কোরআনের অনুসরনে [আল-কোরান ৩:১১০] তিনি ব্যক্তি মুসলিম কিংবা মুসলিম উম্মাহকে মনে করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ বা মানবসমস্টি যারা নিজেরা মুক্ত থাকবে ও অপরকে মুক্ত করবে অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কীর্ণতা থেকএ,প্রথা ও সামজিক-রাজনইতিক দাসত্ব থেকে;যারা প্রতিবাদ করবে অন্যায়ের আর বিকাশ ঘটাবেন কল্যাণকামিতার।তাই নজরুল আক্ষেপ করে বলেছেন,” কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ-মুক্ত মুসলমান?” নজরুল মুসলিমকে চিনে নিতে চান তার ‘আখলাক’ আর‘সিফত’ দেখেঃ “অন্তরে ভোগী বাইরে যে যোগী ,মুসলমান সে নয়” ( বকরীদঃ শেষ সওগাত ) । অন্তরের ভোগবাদীতা ও ইন্দ্য়ের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত হয়ে ‘আজাদ চিত্ত’এর অধিকারী যে মানুষ তার ডাকনাম মুসলিম ।
কথা ও কাজ,অন্তর ও বাহিরের বাইনারি(binary)কমিয়ে মানুষ হয়ে উঠে মুসলমান(অথবা,হে পাঠক, আপনি চাইলে পড়তে পারেন, ‘মুসলমান’ হয়ে উঠে ‘মানুষ’ )। উপলবধির এক আলোক উদ্ভাসিত মুহূর্তে নজরুল গেয়ে উঠেনঃ
আল্লাতে যার পূর্ণ ঈমান
কোথা সে মুসলমান
কোথা সে আরেফ
অভেদ যাহার জীবন -মৃত্যু- জ্ঞান
‘পূর্ণ ঈমান’দার মানুষের নিরন্তর সনধানী নজরুল । ঈমান হচ্ছে মুসলিমের বিশ্বদৃষ্টি(World View) । সত্য মুসলিমের জীবনে ঈমান ব্যাপ্ত থাকে জীবনের পূর্ণ পরিসরে । ‘অভেদ যাহার জীবন- মৃত্যু-জ্ঞান’। ঈমান এমন এক আলোকোজ্জ্বল চৈতন্য যেখানে জীবন ও মৃত্যু অভেদ। এটি এমন এক বোধি, যেখানে জীবন ও মৃত্যু উপলবধ হয় আত্নার অসীম পরিভ্রমণের দুটি দিকচিহ্ন হিসেবে।নজরুলের গানে যেখানে ঈমান / ইমান শব্দটি ব্বহৃত হয়েছে সেখানে এটি দ্বারা এমন এক প্রত্যয় বোঝানো হয়েছে যেটি যুক্তি বহির্ভূত নয় কেননা মুমিনের কাছে“ঈমান বনাম যুক্তির দ্বৈধতা অচল।“২
নজরুলের কাছে মুসলমান মানেই ‘পূর্ণ মুক্ত’ মুসলমান । আজাদ মানুষই শুধু মুসলিম পদবাচ্য। ‘নতুন চাঁদ’ কবিতায় নজরুল উচ্চারন করেছেন, যেই ছেলে-মেয়ে এই দুনিয়ায় আজাদ মুক্ত রহে / তাহাদেরি শুধু এক আল্লার বান্দা ও বাঁদি কহে ।“ নজরুল প্রজ্ঞাময় কণ্ঠে বলে উঠেন, মুসলমান আসেনি ‘অন্যেরে দাস করিতে কিংবা নিজে দাস হতে’ ।মুসলমান একটি মূল্যবোধের শরীরী রূপ । মুসলমান দেশবিহীন নয় ,আবার দেশও তার সব নয় ।
মানুষকে মানুষের দাসত্ব বা পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে এসেছে ইসলাম। কিন্তু যে মানুষ নিজেকে খোদার আসনে বসিয়ে অরাজকতা আর কর্তৃত্ববাদ কায়েম করে আর দাস করে রাখে অপরকে বা নিজেও প্রতিবাদবিহীন ও নির্বিকারভাবে অধীনতা স্বীকার করে নেয় নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার,সে ব্যক্তির মনুষত্ব ও মুসলমানিত্য নিয়ে নজরুল নিঃসংশয় নন ।নজরুল ক্ষুব্ধ ও বেদনাদীর্ণ কণ্ঠে গেয়েছেন “আজাদ করিতে এসেছে যে জন / ......সে আজ ভিখ মাগে” । নজরুলের বাসনায় মুসলমান হচ্ছে এমন এক জাতি যারা সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উরধে উঠে পালন করবে Emancipatory role :
“ কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনিক ইসলাম
সত্য যে চায় আল্লায় মানে মুসলিম তার নাম”
যে যত সত্যান্বেষী আর ‘অসহায় আর উৎপীড়িতের বন্ধু’, নজরুলের মতে, তার সিফতী(qualitative) নাম মুসলিম,গোত্রীয় বংশীয় ডাকনাম তার যাই হোক । ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করা আর ইনসাফের ‘ধেয়ান’ তার অভীষ্ট লক্ষ্য, চরিত্রের সৌন্দর্যঃ
ন্যায়েরে বসাবে সিংহ আসনে লক্ষ্য তার
মুসলিম সেই , এই ন্যায় -নীতি ধেয়ান যার ।
এভাবে আদর্শ মুসলিমের তাৎপর্য এঁকে নজরুল আসলে প্রকাশ করতে চান মানুষ হওয়ার মানে ও মর্তবা।
ডিসেম্বর,২০১৩।
[এটি নজরুল বিষয়ক বিশেষসংখ্যা ‘কাজীকথা’য় প্রকাশিত আমার একটি প্রবন্ধের অংশ বিশেষ।নজরুলের ৩৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে লেখাটির কিছু অংশ শেয়ার করলাম।বাকী অংশটুকুও ধীরে ধীরে শেয়ার করার আশা রাখি]