০১।
জীব্রাঈল( আঃ) এসেছিলো নবীর(সা)কাছে। হাতে ছিল লিখিত কোন ‘কাগজ’ বা বর্ণ অঙ্কিত কোন বাঁকল।তাকে বলা হোল , “ পড়ুন, আপনার প্রভুর নামে”। হযরত উত্তর দিলেন “ আমি তো পড়তে জানিনা” । জীব্রাঈলের পুনঃপুন অনুরোধে তার ছিল সেই একই উত্তর “ আমি তো পড়তে পারিনা ,আমি তো পড়তে জানিনা”। নিজের অজ্ঞতার এই বিনীত স্বীকৃতিই ছিল তাঁর প্রজ্ঞার প্রথম মুহুর্ত।প্রজ্ঞাবান ফলভারে নত বৃক্ষসম। জ্ঞানের মমিনকে স্বীকৃতি দিতে হয় “ আমি তো জানিনা” । সক্রেটিসও দিয়েছিল তার না-জানার অনুভুতির স্বীকৃতি। “আমি তো জানিনা” এই সংক্ষিপ্ত ঘোষণার চেয়ে বৃহৎ কোন জ্ঞানবাক্য নাই।
০২।
রাতের পর রাত আর দিনের পর দিন কি করেছিলেন নবি হেরাগুহায়?চিন্তা ও অনুভবের মধ্যবর্তীতায় দেহ ,আত্মা ও মহাবিশ্বের কোন সত্য উন্মোচিত হচ্ছিল তার ক্কলবের আয়নায়?মানুষের মধ্যেই বিরাজিত স্বর্গীয়তা কি তিনি জাগ্রত করছিলেন অই তন্ময় মুহুর্তগুলোয়? সৃষ্টির পর সকল রুহকে করা খোদার সেই প্রশ্ন “ আমি কি তোমাদের প্রভু নই” আর আদি-অন্তের সকল মানবের সমস্বরে দেয়া উত্তর “ হ্যা ,আপনিই আমাদের প্রভু”---এই প্রশ্ন-উত্তরের আদিম মুহুর্তকে কি তন্নিষ্ঠ মগ্নতায় তিনি জাগরূক করতে চাচ্ছিলেন বক্ষপটে? জিকিরের অর্থ তো স্মরণ। কী স্মরণ?আত্মায় প্রথিত থাকা সেই শ্বাশত সমাবেশের স্মরণ ? মুহাম্মদ (সা) কি জিকিরে উদ্ভাসিত করছিলেন সেই মুহুর্ত? যেখানে চিন্তাই অনুভব ,যেখানে অনুভবই চিন্তা এমন একাবস্থা কি তিনি তৈরি করেছিলেন তার ধ্যানের শক্তিতে?
মিরাজ আর হেরা গুহা যেন প্রজ্ঞার পথের দুই মঞ্জিল।মিরাজে নবি মহাম্মাদ প্রত্যক্ষ করেন ব্রহ্মাণ্ড পরিচালনার পদ্ধতি, অতীত ও ভবিষ্যৎ,শাস্তি ও পুরস্কার।তার এই যে প্রত্যক্ষন ,এই যে অভিজ্ঞতা সেটা তার কামালিয়াতের (পুর্ণতার)অন্যতম কারণ।তাহলে বুঝতে পারি, প্রত্যক্ষণ আর অভিজ্ঞতা প্রজ্ঞার জন্মভুমি। একদিকে হেরাগুহার ‘ধ্যানমগ্নতা’ আর অন্যদিকে মেরাজে তার মহাবৈশ্বিক অভিজ্ঞতা--- এ দুয়ে মিলে নির্মিত হয় নবির প্রজ্ঞার জমিন, কর্মের পাতাটন।প্রত্যেক প্রজ্ঞাবানকেই তাহলে হতে হয় হেরা গুহার ধ্যানমগ্ন মুহাম্মাদ; প্রত্যেক ভাবুককেই তবে হতে হয়ে বোরাক ও রফরফের সওয়ারী?
একদিকে অনন্ত অসীমের সামনে নিজের ক্ষুদ্রতাবোধ, নিজের বিন্দুঅস্তিত্বের স্বীকৃতি,অন্যদিকে নিজের ‘আকল’ এর উপর আস্থা আর ঐশী প্রেরণার উন্মীলিত ভরসায় মেরাজ ও হেরাগুহা থেকে নবি নেমে আসেন মানুষের ময়দানে। তবে কি প্রজ্ঞা দাবি করে সক্রিয়তা? নিথর অলসতা আর ভাবালু নিস্ক্রিয়তা কি তবে প্রজ্ঞার অনুপস্থিতি? চরাচরের বিস্তৃত কর্মমুখর অঙ্গনই তবে মানুষের বিকাশের শর্ত? ‘আত্মায়’ পরমার্থিক প্রেরণা ছাড়া কি তবে ইতিহাস নির্মিত হয়না,সত্যিকার মানুষের ইতিহাস?
০৩।
মোমিনগণ ‘খোদার আলোয়’ দেখেন।মুহাম্মাদ(সা) প্রায়শই প্রার্থনা করতেন, “ হে প্রভু,আমাকে দেখাও বস্তুকে তার স্বরূপে”। ‘রাব্বি যিদনি ইলমা’ বলে একটা প্রার্থনা বাক্য আছে যেটা প্রবল আকুলতা নিয়ে পড়তে হয় জ্ঞানের পথের পথিককে।ইস্লামের ইতিহাসে দেখতে পাই,জ্ঞান নিজেই একটা আমল। প্রার্থনা আর জ্ঞানার্জন এক হয়ে গিয়েছিল হযরতের নিস্তব্ধ রাত্রির অজস্র মুহুর্তে।মন্থরগতিতে একেকটা আয়াত পাঠে নিজের হৃদয়কে আলোড়িত করে করে এগিয়ে চলত তার সুরেলা তিলাওয়াত,বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা শতজল ঝর্ণারধ্বনিতে মুর্ছিত হত অর্থের চৌষট্টি গলি।অর্থকে হৃদয়ে জাগরূক রেখে হৃদয়কে নাড়া দেয়ার এই পাঠ- পদ্ধতি বিস্ময়কর। হযরত উমর সুরা বাকারার পাঠ নিয়েছিলেন দীর্ঘ বারো বছর।আব্দুল্লাহ ইবনে উমর বাকারায় লাগিয়েছিলেন আট বছর যদিও তারা হযরতের সঙ্গী হওয়ার বদৌলতে জানতেন প্রতিটি পঙক্তি নাযিলের প্রেক্ষাপট ও স্থানিক অর্থ।তবুও কেন এ মেহেনত?এ শুধু ‘কিরাত’ ছিলনা নিশ্চয়। প্রলম্বিত ও নিস্তব্ধ রাত্রির অস্ফুট তেলাওয়াত ‘কলবের’ শক্তি ও স্বস্তি ; নিস্তবব্ধ রাত্রিই ভাবনামগ্নতার সুসময়।
০৪।
বিশ্বাসে নিষ্ঠাবান হয়েও আত্নিক প্রশান্তি পেতে হযরত ইব্রাহীম প্রাণির মৃত্যুর পর তার পুনঃসৃজন প্রক্রিয়া জানার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন স্রস্টাকেঃ কি করে স্রস্টা জীবন্ত করেন মৃতকে, কি করে তিনি প্রাণ সৃজন করেন?স্রস্টাও কতক পাখির ছিন্নভিন্ন দেহ পর্বতে রেখে জীবন্ত করে দেখালেন তার মহিমা, মেটালেন ইব্রাহিমের জ্ঞান পিয়াশা। ইমানদারের হৃদয়ও ব্যাকুল থাকে এই ‘how’ টুকু বুঝবার জন্য।কে বলে ইমান মানে শুধু বিশ্বাস? ইমান শুধু নিশ্চেস্ট বিশ্বাস নয়, নিশ্চয়তা পাওয়ার আকুলতাও বটে। ইমানে নিহিত থাকে ‘প্রক্রিয়া’ বুঝবার ও প্রশ্ন করে জানবার বিনীত ব্যাকুলতাও।
জায়নামাজের বুকে হযরত ইব্রাহিমের প্রার্থনা ছিলঃ “আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে শুধু নতজানু হলাম তোমারই দিকে। আমি তো অংশীবাদীদের অন্তভুর্ক্ত নই”।জ্ঞানের পথের পথিককে ইব্রাহিমের( আঃ) এর মতই এই প্রার্থণা করতে হয়; সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে এই প্রেমময় একমুখীনতায় আবেশিত হতে হয়।
০৫।
আদম-হাওয়ার বিচ্ছেদ ও স্বর্গচ্যুতির মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে আগমন জ্ঞানের একটা অনিন্দ্য মুহুর্ত ।বিচ্ছিন্ন হয়েই তারা জানলেন একে অপরকে, বিচ্ছেদে তারা আত্নসচেতন হলেন, বুঝলেন স্বর্গ কি। স্বর্গে আদম – হাওয়া পরিচয়ের অভিন্নতা বোধে লীন; এ ‘সত্যযাপন’ ও লীনাবস্থায় আলাদা করে ‘জ্ঞান’, ‘প্রজ্ঞা’ , ‘জানা’ ইত্যাদি কোন অর্থ নির্দেশ করেনা। জলের ভেতর জল হয়ে তবে কি জলকে জানা যায়না? জিহ্বা তো নিজের স্বাদ নিজে পায়না; চক্ষু তো দেখতে পায়না নিজেকে। তবে কি জানার শর্ত বিচ্ছেদ?দূরত্ব রচনা? অবজেক্টিভিটি? এস্থেটিক ডিস্টেন্স?তাহলে তো পৃথিবীতে আদমের জ্ঞান সম্ভব হয়ে উঠেছিল এই ডিস্টেন্সের কারণেই।তবুও, মানুষ স্বর্গের জীব;তার প্রথম বাসস্থান স্বর্গ ।তাই বিচ্ছেদ সত্বেও সে মিলন পিয়াসী।‘মিলন’ তার আদি পিপাসা।‘মিলনে’ পুর্ণতা,বিচ্ছেদে ‘জ্ঞান’।মিলনের মুহুর্ত ভাষাহীন; বিচ্ছেদ বাকময়। তাহলে, ক্ষেত্রমতে বিচ্ছেদ আর মিলনেই সম্ভব জ্ঞান ও প্রজ্ঞা?
০৬।
এক সুফি বলছেন , কোরআন ব্রহ্মাণ্ডের ঘনীভূত রূপ।আর এই মহাবিশ্ব কোরাআনের সম্প্রসারণ। “আমি দিকচক্রবালে দেখাতে থাকব আমার নিদর্শনসমুহ এবং তোমাদের সত্তায়ও। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হয় ইহা সত্য” । বিশ্বপ্রকৃতি,মানবসমাজ ও সভ্যতার গতিধারা, নিজ জৈবিক ও পরমার্থিক সত্তার অনুধাবন আর ‘কিতাব’ অনুধাবন সমার্থক যেনবা। একে অপরের প্রত্যয়নকারী।তাই, হোক তা ‘পুজি’, ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ বা মানবীয় সৃজনশীলতা বা প্রচেস্টার অন্যকোন উৎপাদ, তা যেকোনো পরম গ্রন্থেরই অর্থ উন্মোচনে/নির্মানে সহায়ক।প্রজ্ঞাবান তাকাবে মহাবিশ্ব নামক এই আয়াতের( আয়াত মানে চিহ্ন) দিকে;সে নিদর্শন পরম্পরার পাঠ নিবে ধইর্যের পরাকাষ্ঠায় । সে পাঠ করবে যেকোনো পরম কিতাব ‘মানুষের’ চর্চা, সম্ভাবনা ও পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা ও অনুসন্ধানের আলোকে।
‘তাবীরে নাখাল’ নামে পরিচিত নবিজীর একটি হাদিস আছে যেখানে তিনি মদিনার আনসারদের নিষেধ করেছিলেন কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে। দেখা গেল পরের বছর শস্য উৎপাদন কমে গেছে ব্যাপকহারে। তখন তারা নবিকে বাপারটা জানালেন; নবির উত্তরঃ “ জাগতিক বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে অধিক অবগত”।নবি তো তবে স্বীকৃতিই দিলেন যে, জাগতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা মানুষের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষন ও পরীক্ষনের উপরই নির্ভর করবে। প্রজ্ঞাবান লক্ষ্য করবেন ধর্মের ভেতরকার সেকুলার মুহুর্ত, আর সেকুলার পরিসরেও তিনি দেখবেন কিভাবে মানুষের ধর্মবোধ ক্রিয়াশীল।
নিসিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার পর আদমকে পৃথিবীতে পাঠানোর প্রাক্বালে বিধাতা যখন বললেনঃ “ তোমরা(আদম ও ইবলিস) নেমে যাও, পরস্পরের শত্রু হয়ে”। এই যে পৃথিবীতে আদমের ‘নেমে আসা’ এর প্রক্রিয়া কি, আমরা জানিনা। এ কি পুর্নাংগ মানুষরূপেই পৃথিবীতে তার আবির্ভাব নাকি বহুকালের ইতিহাস ও পরিবর্তন বা বিবর্তন পেরিয়ে এ জগতে তার আগমন? অনেকার্থের সম্ভাবনায় মোমিন বা প্রজ্ঞাবান আশ্বস্ত ও অপেক্ষমাণ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১০