somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদ্রোহী কবির অসহায় দশা- ঘরে বাইরে তার দুর্দশার দিনগুলো

২৮ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দুঃখ ও বেদনাঘেরা তার জীবনে সুখ এসেছিল সত্য, তবে তা ছিল ণস্থায়ী। বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে দারিদ্র ও অশান্তিতে।

তবে এতসব দুঃখ যন্ত্রণাকে জয় করে তিনি লিখেছিলেন কত শত অমর কাব্য কবিতা। অশান্ত মনের এ অস্থির ও বিদ্রোহী কবির জীবনে সবচেয়ে বড় অভিশাপ ছিল কোনটি?
তার জীবন ও জীবনী পড়লে একটি বিষয় খুব সহজে স্পষ্ট হয়ে যায় যা আজও অনেকের কাছে অস্পষ্ট ও আড়াল হয়ে আছে। কোন এক রহস্য কিংবা অজানা কারণে যারা তার জীবন নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান, তারাও এ বিষয়ে মুখ বুঁজে থাকেন। কবির বিস্ময়কর প্রতিভার কাছে এ বিপদ কিংবা মুসিবত তেমন কিছুই নয়, এসব যন্ত্রণা তাকে দমাতে পারেনি তার বিদ্রোহের বিস্ফোরণ থেকে। তবুও অবাক হতে হয় এমন তেজোদ্দীপ্ত ও বিদ্রোহী কবির পারিবারিক অশান্তির দৃশ্য দেখে।

ঘরের বাইরে এখানে ওখানে কবি যতই বিদ্রোহী কিংবা জ্বালাময়ী কবিতা ও গান গেয়ে বেড়াতেন, নিজের ঘরের চারদেয়ালের ভেতর পরিবারের কাছে নিতান্তই অসহায় ছিলেন এ শক্তিমান কবি। এ কথা তো সত্য যে, একজন মুসলিম কবি হয়েও তিনি বিয়ে করেছিলেন হিন্দু নারীকে। যদিও তার প্রথম বিয়ে হয়েছিল নার্গিস নামের এক তরুণীর সাথে কুমিল্লায়, তবে সেটি কোন এক কারণে টিকেনি এবং প্রথমদিকেই তা ভেস্তে যায়।

কুমিল্লা শহরে এই ২য় বিয়ের পর থেকে কবি তার হিন্দুধর্মাবলম্বী স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর কাছে অসহায় ছিলেন। অবস্থা এতোই করুণ ছিল যে, কবি নিজের ঘরে তাদের সামনে ‘ভগবান’ ও ‘জল’ বলতেন আর বাইরে এসে বলতেন ‘পানি’ ও ‘আল্লাহ’। যদিও কবি হিন্দুদের জন্য শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, ওদিকে ইসলামের জন্য এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের নামেও তিনি প্রচুর গজল ও লেখা রচনা করেছেন।

কিন্তু মুসলমান হয়ে তিনি ইসলামের জন্য হামদ নাত লিখবেন, এটা সহ্য হতো না তার গোঁড়া শ্বশুরগোষ্ঠীর। ইসলামী লেখার জন্য তারা সময় সুযোগ পেলেই কবিকে নির্মম কথা শোনাতো, উপহাস করতো। বিশেষ করে কবির শ্বাশুড়ী মহিলাটি এ বিষয়ে দারুণ ্যাপাটে ছিলেন।

তবুও কবি নজরুল এসব সয়ে এবং নানা প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে লিখতেন আল্লাহ ও রাসুলের নামে, রচনা করতেন স্বজাতির জন্য গান ও গজলসঙ্গীত। এখানেই শেষ নয়, প্রিয়কবি তার দুই ছেলেকে খৎনা করার কথা বলারও সাহস পেতেন না তার পরিবারের কাছে।

‘মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেছে’ এই অভিযোগে কবির স্ত্রীর পরে যেসব হিন্দুস্বজনরা ঐ পরিবারকে দূর দূর বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল, কবির নাম ও যশ চারিদিকে প্রচার হলে এ লোকগুলোই সব গোঁড়ামী ভুলে আবার দলে দলে এসে কবির বাড়ীতে দীর্ঘদিন ধরে থাকতো, খেতো, আমোদ ফূর্তিতে মত্ত হয়ে থাকতো।

কবির সমসাময়িক কালের বন্ধুদের লেখা থেকে জানা যায়, শ্বাশুড়ী পরিবারকে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কবি একরকম বাধ্য হয়ে ট্রেনের দু বগি রিজার্ভ করতেন, সেইসাথে সামানপত্র নেয়ার জন্য ওয়াগন ভাড়া করতেন। আর এসবের এত খরচ মেটাতে গিয়ে কবি যে কত মানুষের কাছে হাত পেতে ধার করেছেন, দেনা শোধ করতে না পেরে কবি যে কি এক যন্ত্রণায় ভোগতেন, তার পূর্ণ বিবরণ এখানে সম্ভব নয়। তার জীবনে তাই ঋণ আর দায় দেনার জটলা লেগেই থাকতো। এজন্য কবি কয়েকবার নীরবে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছিলেন।

এতো খাতির তোয়ায করেও কিন্তু কবি তার স্ত্রীর পরিবারের মন ভরাতে পারতেন না। তার বন্ধু মুন্সী জুলফিকারের কাছে একসময় তিনি বলেই ফেললেন কথা প্রসঙ্গে, ‘‘তুমি তো আমার শ্বাশুড়ীকে চেন না। ওরা হচ্ছেন যেন রাঘব বোয়াল, কিছুতেই আমি ওদের পেট ভরাতে পারলাম না।’’

কবির এই বন্ধু জুলফিকার হায়দার তার প্রত্য বর্ণনায় আরও লিখেছেন, ‘‘কবির শ্বাশুড়ী যেন তার প্রতি আরোপিত অপবাদ ও ঘৃণার জবাব দিতে তার বাড়ী থেকে আগত অতিথিদেরকে দু হাত ঢেলে আপ্যায়ন করতেন। কখনো কখনো দু একজনের খাবার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তিনি কবির পকেট থেকে তৎকালের দশ বিশ নয়, একেবারে চল্লিশ টাকা পর্যন্ত খরচ করাতেন।

নিজেদের আত্মঅহমিকা আর ভাব দেখানোর এতসব আয়োজনের সব দায় মেটাতে হতো একা কবি নজরুলের। ফলে অর্থ অভাব আর টানাটানি লেগেই থাকতো তার সংসারে। হিন্দু সাহিত্যিকদের একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছিল যারা সর্বণ কবিকে নির্দয় ভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিত, গোঁড়া হিন্দু সম্প্রদায় তাকে পরিহাস করত।’’

এই ছিল একদিকের দৃশ্য। আবার ওদিকে এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করায় তৎকালের মুসলিম সমাজও কবিকে তিরস্কৃত করত যেখানে সেখানে, এমনকি তৎকালের মৌলভীরা তাকে ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়েছিল। এ উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মজাগরণে যার গান প্রেরণা যোগায় ঘরে ঘরে, সেই কবি নজরুল স্বজাতির মৌলভীদের কাছে ছিলেন ঘৃণার পাত্র। এ বেদনা কবির জন্য ছিল অসহনীয়।

ফলে ‘ঘরের চারদেয়ালের ভেতর’ আর ‘বাইরের সমাজে’ এমন বিপরীত ও অসহনীয় একটি পরিবেশে কবি থাকতেন চরম দুঃখঘেরা মন ও মানসিক বেদনায়। আর এসব ভুলে থাকার জন্য তিনি সবসময় ছাদফাটানো হাসি আর আড্ডার উপায় বেছে নিতেন।

তবু আশ্চর্যের বিষয়, দুরন্ত মনের চঞ্চল কবি কাজী নজরুল ইসলাম কীভাবে তার জীবনের এ বৈপরীত্য মেনে দিন কাটাতেন, সুর সাগরে সাহিত্য ভান্ডারে প্রাণসঞ্চার করতেন, এমন অদম্য ফূর্তি ও শক্তি কিভাবে পেতেন তিনি ?

কাজী নজরুল ইসলাম মানুষ হিসেবে যে কতটা নিঃসঙ্গ ছিলেন, তার মনের অবস্থা কতো বেদনাহত ছিলো, এর প্রমাণ মিলে তার বিভিন্ন চিঠি থেকে। আর এসব কারণেই হয়তো তিনি ঘুরে বেড়াতেন নানা জায়গায়। কয়েকবার তিনি এসেছেন আমাদের এই ঢাকায়, এসেছেন কুমিল্লায়, ফরিদপুরে, যশোরে, খুলনায়, চট্টগ্রামে, সিরাজগঞ্জে, ঠাঁকুরগায়ে।

বেগম মাহমুদ নাহারকে লেখা চিঠির এক জায়গায় কবি লিখেছেন, ‘‘তোমরা ভালবাস আমাকে নয়, আমার সুরকে, আমার কাব্যকে। তোমরা কবিকে জানতে চাও না নজরুল ইসলামকে জানতে চাও?”

কাজী মোতাহার হোসনকে লেখা এক চিঠিতে কবি নিতান্ত দুঃখের সাথেই লিখেছেন, “বন্ধু আমি পেয়েছি- যার সংখ্যা আমি নিজেই করতে পারবো না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু। ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ। আমার চোখের জলের বাদলা রাতে এরা কেউ এসে হাত ধরেনি।”

এমনই অসংখ্য চিঠি থেকে কবির মনোবেদনার যে দুঃখময় চিত্র ফুটে ওঠে, তার পূর্ণ বিবরণ দিলে চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল। কবির ব্যক্তিজীবন তাই সত্যিই অবাক হওয়ার মতো। একনিষ্ঠভাবে সেসব পড়লে এক অন্যরকম মায়া ও করুণার অপূর্ব অনুভুতি ছুঁয়ে যায় পাঠকের মনমানসে।

বি.দ্র- কোন ধরণের সাম্প্রদায়িকতা কিংবা অন্য মোহে নয়, একান্তই কবির জীবনের একটি নির্মোহ চিত্র এটি। কারো মনে আঘাত দেয়ার জন্য এ লেখা নয়। অজানা সত্যকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্যই এ প্রয়াস।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×