somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জাহিদুল হক শোভন
এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

গল্পঃ জলকণা

০২ রা মে, ২০১৯ দুপুর ২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হোচট খেয়ে পরে গিয়ে উফ করে যখন একটা আওয়াজ করলাম আমার স্বামী আমার দিকে ফিরে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললো “সাবধানে হাটবে নাহ? শাড়ি পরতে পারো না তারপরও শাড়ি পরেছো। বলেছি শাড়ি পরা লাগবে না। শুনেছো আমার কথা? শুনেছো?” আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না।এটাও বুঝতে পারলাম না আমার কি এখন বলা উচিৎ “আপনি একটা এক নম্বরের ছাগল।কোথায় আমাকে একটু ধরে তুলবেন তা না আমার সাথে এইভাবে কথা বলছেন।আপনার কি একটুও মায়া হয়না আমি এই ভাবে পরে গিয়েছি বলে?” কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি এই কথা গুলো বলার সাহস আমার নেই।আমার স্বামী জাহেদ সাহেব আমার থেকে নয় বছরের বড়।আর আমি ছোট্ট একটা মেয়ে।সবে ইন্টার পাস করা এক বালিকা।আমি একটু ইতস্তত হয়ে বললাম “আমাকে একটু ধরে তুলবেন?” এই কথা বলাতে সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমার হাত ধরে উঠায়।তারপর বললো “মেয়ে মানুষ শাড়ি পরে হাটতে পারো না বড় অদ্ভুত ব্যাপার।” এটা বলেই সে আবার হাটতে থাকে।আমি একটু বিরক্তবোধ হলাম।আশ্চর্য এটা কেমন মানুষ আমার কপালে জুটেছে?আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় এই লোকটাকে একটু আদব কায়দা শিখাই। কিন্তু আমি পারি না। আমি উনার পিছন পিছন হাটতে হাটতেই বললাম “শুনুন। কেউ এই ভাবে পরে গেলে জিজ্ঞেস করতে হয় তুমি কি ব্যাথা পেয়েছো? অবশ্য আমি কোন ব্যাথা পাইনি।আমাকে বলা লাগবে না।” উনি আমার দিকে কেমন করে যেন একটু তাকালো। এই তাকানোর মাঝে আমি বুঝতে পারলাম আমার এই কথাটায় উনার একটু খারাপ লেগেছে। আমি চুপচাপ হাটতে লাগলাম।আমার চারপাশটায় শো শো শব্দ।বিশাল সমুদ্রের শব্দ।আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই। তার বিশাল ঢেউ এর পানি একটু পর পর আমার পা কে স্পর্শ করে যায়। যখন স্পর্শ করে যায় তখন আমার আশ্চর্য রকমের অনুভূতি হয়।মনে হয় এই সমুদ্রটা আমাকে কিছু জানাতে চায়।জানাতে চায় যখন মাঝ রাতে এই সমুদ্রটা একলা হয়ে যায় নির্জন রাতে এই সমুদ্রের মাঝে কেউ থাকে না। শুধু থাকে বিশাল আকাশটার উপর একা চাঁদটা। চাঁদের রুপালি আলোয় সমুদ্রটা কি রুপালি ভাবে সাজে তখন? তখন নিশ্চয় সমুদ্র আর চাঁদ এই দুজনের মাঝে অনেক কথা হয়।আচ্ছা তাদের আবার কি কথা থাকতে পারে? আমি ভেবে কিছু বের করতে পারি না। এর একটু পরই হাটা বন্ধ করে উনি আমাকে ইতস্তত করে বললেন “ইয়ে মানে তুমি কি সত্যি ব্যাথা পেয়েছো?” আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটু হেসে এই কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “আপনি কি জানেন আপনি একটা গাধা?” উনি অবাক হয়ে বললো “আসলেই? কিভাবে বুঝেছো?” আমি আবার হাসি দিয়ে বললাম “ভাবছি আপনাকে আমি একটা বিশাল ছ্যাকা দিব।মানুষ প্রেম করে ছ্যাকা দেয় আর আপনাকে আমি বিবাহিত অবস্থায় ছ্যাকা দিব।ভালো হবে না? গাধা না হলে স্বামী হাটে সামনে আর বউ হাটে তার পিছন পিছন।এটা কি সুন্দর দেখায় বলুন?এই যে যদি পাশাপাশি হয়ে হাটতাম তাহলে পরার আগেই আপনি আমাকে ধরে ফেলতেন। কি ধরতেন না?” উনি মাথা চুলকিয়ে বললো “জেনিয়া তোমার পাশাপাশি হয়ে হাটা দরকার ছিল তাই না?” আমি শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিলাম। আর মনে মনে বুঝলাম উনি আমার সাথে মশকরা করছে। আমার হ্যাঁ সূচক ইশারা দেখেই এর কয়েক সেকেন্ড পর উনি হাসতে থাকে। হাসতে হাসতেই বললো “তোমাকে আমার বাবার কেন পছন্দ হয়েছে আমি বুঝি না।আমার বাবার বুদ্ধি একটু কম বুঝলা? তা না হলে তোমার মত পিচ্চির সাথে কি করে আমার বিয়ে ঠিক করে? বাবাকে কিছু বলতেও পারি নাই ভয়ে।এই টুকু একটা পিচ্চির সাথে আমি কেমন করে ভালোবাসা আদান প্রদান করবো?” আমি কিছু বললাম না।কথায় কথায় উনি আমাকে পিচ্চি বলে ডাকে।এই পিচ্চি ডাকাতে আমার খুব ইচ্ছা করছে উনাকে পানিতে চুবানোর। খবিশ একটা। আমি উনাকে বললাম “আমার আর হাটতে ইচ্ছে করছে না।” উনি আমার দিকে ফিরে বললো “হাটতে ইচ্ছে করছে না নাকি আমার সাথে এই ভাবে হাটতে চাও না? পিচ্চি বলেছি গায়ে লেগেছে তাই না? পিচ্চিকে পিচ্চি না বলে আর কি ডাকা যায় বলো তো? আচ্ছা তুমি থাকো। পিচ্চিরা বড়দের সাথে হাটতে নেই।আমি ওদিকটায় হেটে আসি।”

আমি উনাকে কিছুই বললাম না। আমি সমুদ্রের পারে বসে যতদুর চোখ যায় বিশাল সমুদ্রের অপর প্রান্তের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার এখন কেন যেন ইচ্ছে করছে বৃষ্টি হোক।এই বৃষ্টির ফোটা গুলো সমুদ্রের বুকে যখন টুপ টুপ করে পড়বে তখন দেখতে চাই সমুদ্রটা কি রকম উত্তাল হয়ে ওঠে।কিন্তু আকাশের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে আকাশের মন ভালো।তার মানে আমার আর এই ইচ্ছেটা পূরণ হবে না।কিছুক্ষন পর পর সমুদ্রটা ডাক শুনিয়ে যাচ্ছে। এমন ডাক শুনলে আমার কেমন যেন লাগে। আমি ভাবি আমার গ্রামের কথা। ছোট ভাইটার কথা। বাবার কথা।আমার ছোট ভাই বাবুর যখন চার বছর তখনই আমার মা ইন্তেকাল করেন।মাকে প্রায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো।বাবাকে একদিন বলেছিলাম “মায়ের কি হয়েছে?” বাবা আমাকে শান্তনা দিয়ে বললেন “কিছু না মা।তোমার মায়ের রক্ত কমতো তাই রক্ত দেওয়ার জন্য নিয়ে যাই। ডায়ালাইসিস করতে।” আমি কিছু বুঝতাম না। এই ছোট্ট জীবনে আমার বুঝার উপায় ছিল না। মাঝে মাঝে মা আমাকে আর বাবুকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির উঠানে বসে থাকতেন। গল্প শোনাতেন। রুপকথার গল্প। রাজা রানীর গল্প। সেই গল্পে রানী একসময় হারিয়ে যেত। সেই রাজার সংসারে কালো ছায়া নেমে আসতো। আমি চুপ করে মায়ের গল্প শুনতাম। বুঝতাম না মা কেন এমন গল্প শোনাতো। দক্ষিনের হাওয়াটা আমাদেরকে ছুয়ে দিয়ে যেত। একদিন আমাকে বললেন “মারে মেয়ে হয়ে জন্মাইছিস মেয়েদের অনেক ধৈর্য শক্তি থাকতে হয়।আমি যদি একদিন হারায় যাই তুই পারবি তোর বাবা আর তোর ভাই বাবুরে দেখে রাথতে? কি পারবি না? এই শক্তিটা কি তোর নাই মা?” আমি এর উত্তর দেইনি। শুধু শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম “আমি তোমাকে কোথাও হারায় যাইতে দিব না মা। কোথাও না।” মা আমাকে আর বাবুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। কিন্তু আমার মাকে আমি সত্যিই হারিয়ে ফেললাম। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা কেমন যেন হয়ে গেলো।আমি প্রায় দেখতাম বাবা রাতে ঘুমাতেন না।সারা রাত ধরে কান্না করতো। বাবা যখন আমাকে দেখে ফেলতো চোখের পানি মুছে আমার দিকে একটা চাপা হাসি দিয়ে বলতো “কিরে মা ঘুমাস না? ঘুম আসে না?” আমি বাবার কাছে গিয়ে বলেছিলাম “মায়ের কিডনি নষ্ট ছিল তাই না বাবা?” বাবা আমার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে কান্না করে দিয়েছিল। আমিও বাবার কান্না দেখে কেঁদে দিয়েছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম “বাবা তুমি কাঁদবা না। একদম না।মা তোমাকে আর বাবুকে দেখার জন্য আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেছে। তুমি কাঁদলে আমিও কাঁদবো কিন্তু। আমার যে অনেক ধৈর্য্য দরকার বাবা, অনেক।” আমার কথা শুনে আমার বাবা কেমন করে কেপে ওঠে আবার কান্না করতে থাকে। বাবার কান্না দেখে আমি রুমের ভিতর চলে গিয়েছিলাম। বাবার মুখে যেদিন শুনেছিলাম ডায়ালাইসিস সেদিনই স্কুলের ফাহমিদা ম্যাডামকে বলেছিলাম ম্যাডাম ডায়ালাইসিস কি?” ফাহমিদা ম্যাডাম বুঝিয়েছিল সাধারণত কিডনি নষ্ট হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়।আমরা যেমন ঘরবাড়ি সব সময় পরিষ্কার করার জন্য বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করে থাকি তেমনি আমাদের শরীরের রক্তের ভিতর প্রতিদিন বর্জ্য তৈরি হয় আর এটা পরিষ্কার করে কিডনি।কিডনি যদি রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে না দিত তবে মানুষ বাঁচতো না।কিডনি রক্ত থেকে বর্জ্য ছেকে পানির সাথে এটা মিশিয়ে মূত্র হিসেবে আমাদের শরীর থেকে বের করে দেয় মা।যেমনটা তোমার মায়ের হয়েছে।”

এতো গুলো বছর বাবাকে আর বাবুকে চোখে চোখে রেখেছি। মায়ের কথা পালন করেছি।কিন্তু আমি খুব দুঃখিত মা, আমি একজন মেয়ে। মেয়েরা যে বাবার পাশে ছায়া হয়ে থাকে না সব সময় সেটা কি তুমি জানতে না? জেনেও আমাকে কেন এমন দায়িত্ব দিয়েছিলে কেন? এই ছোট্ট জীবনে আমার বিয়ে করার কোন ইচ্ছেই ছিল না।আমি সেদিন সবে মাত্র কলেজ শেষে বাসায় এসে ভাত রান্না করার জন্য চাল ধুয়ে নিচ্ছিলাম। কিছক্ষন পর বাবা একজন লোককে ধরাধরি করে নিয়ে এসে বলতে লাগলো “জেনিয়া কইরে মা, তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।”এমন করে ডাকাতে আমি ছুটে যেয়ে দেখি লোকটাকে শুয়ে রেখেছে। বাবাকে বললাম “কে উনি?” কি হয়েছে উনার?” বাবা আমাকে বললেন “আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে একা হাইটা যাইতেছিল বুঝছিস মা। আমিও ওপাশ থেকে আসছিলাম। হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পরে যায়। তারপর ধরে নিয়ে আসছি।” আমি দ্রুত উনার কাছে গিয়ে হাতটা ধরি। বুঝতে পারলাম দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে।বুকে হাত দিলাম বুক ধড়ফড় করছে।উনি শুধু আমার দিকে একটু করে দেখে আবার চোখটা বন্ধ করে নিয়েছিল।আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাবার দিকে তাকাই।আমার কেন যেন মনে হয়েছিল উনার প্রেসারের সমস্যা। সাধারণত প্রেসার লো হয়ে গেলে এমন হয়। আমি তড়িগড়ি করে একগ্লাস পানিতে দু চা-চামচ লবণ মিশিয়ে উনাকে খাওয়াই। তারপর ফেনটা ছেড়ে দেই।একটু পর পর উনি শুধু চোখ খুলে আমাকে দেখছিল।যতক্ষন না উঠে বসতে পেরেছিল ততক্ষন আমি উনার পাশে বসে ছিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।কিছু সময় পর যখন পুরো চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন “আমি বললাম “এখন কি ভালো লাগছে?” উনি কিছুই বলেনি শুধু আমার দিকে তাকিয়েছিল।তারপর বাবার দিকে তাকাতেই বাবা বললেন “আমার মেয়ে। আপনি মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিলেন ভাইজান। আপনাকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে আসছি।” তার কিছুক্ষন পর উনি চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে বলেছিলেন ” তোমার নাম কি মা? তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

তার ঠিক একমাস পর উনি নিজেই আমাদের বাড়িতে আসেন এবং উনার ছেলের জন্য আমাকে চাইলেন বাবার কাছে। আমি বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম এই বিয়েতে আমি রাজি না। আমি এখনো পড়ালেখা করি। আর তোমাদের ছাড়া আমি কোথাও যাব না।” বাবা আমাকে অনেক বুঝালেন এবং বললেন “তুই যত পড়তে চাস তোকে পড়াবে মা। এমন ভালো সম্বন্ধ পাওয়া যায় না। আমার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তখন কি হবে।?” আমি আমার কথার এক পা ও নড়লাম না। রাত্রে বেলা বাবু আমার রুমে এসে আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থেকে বলেছিলো “বুবু তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?” আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম “এমনটা কখনো ভাববি না ভাই কখনো না। আমি তোদের ছেড়ে কোথাও যাবো না।” কিছুদিনের মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে আর কোন কথা উঠলো না। আমার পরীক্ষার সময় হলো। পরীক্ষা দিলাম। পাস করলাম। মনে করেছিলাম এই বিষয়টা মাথা থেকে চলে গেছে। কিন্তু হঠাৎ উনি আবার আসলেন। আমাকে বললেন “মা এই গ্রামে কিছু জমি দেখতে এসেছিলাম। পাশের গ্রামেই আমার বাড়ি আছে। যদিও আমি শহরে থাকি। সেদিন তুমি আর তোমার বাবা না থাকলে আমার কি হতো আমি জানি না। এটা কি তুমি জানো সেদিনের পর থেকে তোমাকে আমার পরিবারের একজন সদস্য মনে করি। আমি যখন মুখে বলে ফেলেছি তোমাকে আমার বাড়ির মেয়ে করবো তাহলে করবোই।” এই কথা বলার পর উনি বাবার দিকে তাকায়। বাবাকে বললেন “কি ভাইসাব আপনার আপত্তি আছে নাকি? মেয়েকে তো একদিন না একদিন অন্যের বাড়ি দিতে হবে তাই না? মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দেন। ছেলে কেমন তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। যাকে আমার পরিবারের সদস্য ভাবতে শুরু করেছি তাকে নিশ্চয় ঠকাতে চাইবো না। ছেলে আমার মা শা আল্লাহ। আমার ছেলে আমার কথার এদিক ওদিক করে না ভাইজান।” বাবা চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি জানি তোমারও পছন্দের ব্যাপার আছে মা। আমার ছেলের ছবি তোমার বাবাকে দিয়েছি। দেখে নিও। আমি নিশ্চিৎ ওকে তোমার পছন্দ হবে। হ্যাঁ তোমার থেকে একটু বড়। তবে এটা কোন ব্যাপার না মা।”

এর কয়েকদিন পরই আমার বিয়েটা হয়ে যায়। যেদিন বিয়ে হয়েছিল আমি অনেক কেঁদেছি অনেক। এমন করে আর কখনো কেঁদেছি কিনা আমি জানি না। এসব মনে করলেই আমার কেমন যেন লাগে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নেই। এই সমুদ্রের শিতল বাতাস আমাকে শিহরতি করে।আমি বসা থেকে উঠে হাটতে থাকি। যখন হাটছি এই সম্রেদ্রর ভেজা বালি গুলা আমাকে কেন যেন আকড়ে ধরে রাখতে চায়।

রাত্রে আমার তেমন ঘুম হয়নি সমুদ্রে দেখে এসে। আমি বুঝতে পারি না উনি হঠাৎ করে কেন আমাকে সমুদ্র দেখাতে নিয়ে গেলো। সারা রাত সমুদ্রের শো শো শব্দটা আমার কানে বেজেছে। আর চোখে ভেসেছে তার বিশাল বিশাল ঢেউ গুলো। আর এখন সকালের সূর্যের আলোটা আমাকে ছুয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমার স্বামী খুব আরাম করে নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। ঘুমানোর আগে আমাকে একবার বলেছে “একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম পিচ্চি।” আমি মুখ বাকিয়ে বললাম “আপনার মুখ আমি শেলাই করবো পিচ্চি বলে ডাকলে। আমি এখন বিবাহিত। পিচ্চি না।” উনি কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো “আমিও তাই ভাবছিলাম বুঝছো। শাড়ি পরলে তোমাকে পিচ্চি লাগে না। তবে সুন্দর লাগছিল আজকে শাড়ি পরাতে। এই কথাটা যে বললাম আবার ভেবো না তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। বাবার কথায় বিয়েটা হয়েছে। তোমার কোন দোষ নেই। তাই তোমার সাথে কিছু বলতেও পারি না রাগ দেখাতেও পারি না।” আমি চুপ করে উনার দিকে তাকিয়েছিলাম। একটু ইতস্তত হয়ে বললাম “আমি বিযের রাতেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনার কি একবার আমার সাথে কথা বলার দরকার ছিল না? আমি তো ছোট একটা মেয়ে এতো কিছু কি বুঝি বলেন? আমি একজন মেয়ে। মেয়েরা মায়ের জাত। একজন মেয়ের কাছে বিয়ের পর তার স্বামী অনেক আপন হয়ে যায়। আমি এই বিয়েটা করতে চাইনি বিশ্বাস করুন। বাবার মুখটার দিকে তাকিয়ে করেছি। আমাদের গ্রামের মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে বিয়ের পর যত ঝামেলা হোক তারা তাদের সংসারটা বাঁচিয়ে রাখে। আমার কিছু হলে আমার বাবা অনেক কষ্ট পাবে অনেক। আমাকে ভালোবাসতে হবে না। শুধু আপনার আশেপাশে একটু থাকতে দিয়েন। ঠিকাছে?” উনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। এই দীর্ঘশ্বাসটা আমার ভিতরটাকে নাড়িয়ে দেয়। আমি আবার বললাম “আমি এখন থেকে শাড়ি পরতে চেষ্টা করবো সব সময়। এই পরাতে যদি আপনার একটু ভালো লাগে।” উনি আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বালিশটা ঠিক করে বললেন “শুভ রাত্রি।” আমি শুধু নিঃশব্দ হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার একটুও ঘুম আসেনি।লোকটা যখন ঘুমিয়ে থাকে আমি প্র্রায় উনার দিকে তাকিয়ে থাকি। সারা শরীর জুড়ে একটা ভালো লাগা ছুয়ে যায়। তবে এই ভালো লাগার কোন নাম দিতে পারি না।

চায়ের কাপে চা ঢেলে শ্বশুর শাশুড়িকে দিতেই আমার শ্বশুর বললেন “বিয়ে তো হলো সাতটা মাস মা। আমাদের পরিবারটা কেমন লাগছে তোমার?” আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম “ভালো বাবা।তবে আপনার ছেলের না একটু সমস্যা আছে। কলেজে থাকতে নাকি এক মেয়েকে চিঠি লিখেছিল। পরে মেয়ে আর মেযের বাবা এসে আপনার কাছে নালিশ করে গিয়েছে। আপনি নাকি এর জন্য আপনার ছেলেকে মাইর দিয়ে দুই দিন বেধে রেখেছিলেন। এমন কেন করেছিলেন? একটু প্রেম করতে কি দেওয়া যেত না? এই যে এখন সে প্রেম করতে পারে না।প্রেম করতে গেলেই নাকি আপনার মারের কথা মনে পড়ে।” আমার কথা শুনে আমার শ্বশুর শাশুড়ি হাসতে থাকে। শাশুড়ি হাসতে হাসতেই বললেন “দেখো মেয়ের কথা।”

বিকেল বেলা উনি ফোন করে বললেন “অফিস থেকে ফেরার পথে তোমার জন্য কিছু আনবো?” আমি খানিক পর বললাম “আমি মানুষটার চাওয়া পাওয়া গুলো বেশি দামি না জানেন। সামান্য কিছুতেই খুশি হই। কিছু লাগবে না। আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসুন।” এটা বলার পরই উনি হুম নামক একটা শব্দ উচ্চারন করে ফোনটা রেখে দেয়। আজকাল উনি অফিসে গেলে আমার মন প্রায় ছটফট করে কখন উনি বাসায় আসবে। চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমার মাঝে কোন কিছুই কাজ করে না। শুধু একটাই চাওয়া উনার পাশে থাকা কিংবা উনার চারপাশে থেকে উনার ছায়াকে একটু ছুয়ে দেওয়া। কিন্তু আমার বার বার মনে হয় আমি উনাকে হারিয়ে ফেলবো। আমার ভয় হয় অনেক ভয়। এই ভয়ের মাঝে আমার নিশ্বাসটুকু যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন আমার বাবার কথা মনে পড়ে। আমি ভাবি এই ভয়টা যদি সত্যিই আমাকে আকড়ে ধরে বা তার করে নেয় তখন বাবার মুখটা কেমন দেখাবে? বাবা কি এটা সয্য করতে পারবেন?

ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে বাসায় এসে গোসল দেওয়ার পর বারান্দার চেয়ারে বসে চুল ছেড়ে দিয়ে বাহিরের ঘুমকাতুরে রোদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কয়েক মাস হলো তিনি আমাকে ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছেন। তবে আমি রোদের দিকে তাকিয়ে ভাবি রোদ কখনো কি ঘুম কাতুরে হয়? কিন্তু হেমন্তের রোদ কখনো রঙিন আবার কখনো ঘুমকাতুরে হয়।হেমন্তের ঋতুটা আমার বেশ পছন্দের। একেক ঋতুর একেক সৌন্দর্য।এই ছয় ঋতুর মাঝে কাঠফাটা রোদ, ঝিড়িঝিড়ি বৃষ্টি, ফুলে ফুলে ছড়াছড়ি, কখনও হেমন্তের স্নিগ্ধ পরিবেশ, হাড়-কাঁপানো শীত, কখনওবা বসন্তের কুহু কুহু কোকিলের গান। সব কিছুই মিলিয়ে প্রকৃতি মানুষের মত বহুরুপে সাঁজে। এই সাঁজার মাঝে হেমন্তের স্নিগ্ধ সকাল, সকালের কাঁচাসোনা রোদ, সন্ধ্যার মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নময় রুপালি আলোয় হেমন্তটা অদ্ভুত রুপে সাঁজে বলেই এটা আমার অনেক পছন্দের। গতকাল বাবু ফোন করে অনেক কথা বলার পর হঠাৎ করে যখন বলেছিল “আপু তোমার হাতের বিন্নি চালের পিঠা খেতে ইচ্ছে করছেরে।” আমি চুপ করে থেকে কিছুক্ষন পর ফোনটা কেটে দেয়েছিলাম। আমি জানি না সে কি ভেবেছে। ছোট বেলা থেকেই ও যেটা আবদার করেছে আমার কাছে আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চেষ্টা করেছি। ক্লাস আট এ পড়া আমার এই ভাইটা কি বুঝবে তার এই আবদারের কথা শুনে আমার চোখে পানি এসেছিল। আমার যে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না একদমি না।

বাড়ির বউরা স্বামীর বাড়িতে শাশুড়ির সাথে সিরিয়াল দেখাতে প্রায় ব্যস্ত থাকে। কিন্তু আমি এসবের ধারে কাছেও নেই। আমি প্র্রায় ব্যাস্ত থাকি যখন টেলিভিশন দেখি টেলিভিশনের পর্দার সামনে মূলত কার্টুন নিয়ে। কার্টুন দেখা শেষ করে রুমে যখন আসলাম তখন আমার স্বামী আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকলো। আমি ভ্রু নেড়ে ইশারা করে বুঝালাম কি মি.? উনি আমাকে বললেন “কার্টুন দেখা শেষ হয়েছে পিচ্চি?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। দেয়ালে ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা পনেরো বাজে। তারপর উনি খুব গভীর হয়ে বললেন “তোমার সাথে কিছু কথা আছে। আমি জানি না তুমি কথাটা কিভাবে নিবে।” এমন করে বলাতে আমি একটু অবাক হলাম। উনি বিছানা থেকে উঠে দরজাটা লাগিয়ে আমার কাছে এসে তাকিয়ে থাকলো। এমন তাকানোতে আমি দ্রুত নিশ্বাস নিতে লাগলাম। উনি একটু সময় নিয়ে বললো “আমি চাচ্ছি আলাদা হতে। যেটা বাবা কখনো হতে দিবে না। দিন দিন তুমি আমার যে সেবা করছো, আমার খেয়াল রাখছো, শুধু আমার নিশ্বাসের শব্দটুকু শোনার জন্য আমার পাশে থেকেছো এতে তুমি কি শান্তি পাও আমার জানা নেই। কিন্তু এইভাবে তোমাকে আমি ঠকাতে চাই না।তোমাকে এখনো আমার মনে করতে বা মেনে নিতে নিজের মনের সাথে যে যুদ্ধটা চালিয়ে যাচ্ছি তাতে আমি হেরে গিয়েছি। তোমার সাথে আমার থাকাটা সম্ভব না এটা কি তুমি বুঝতে পেরেছো?” আমি গম্ভীর মুখ নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বুকটা কেমন যেন ধরফর করছে। আমার চুপ থাকা দেখে উনি আবার বললেন “প্রত্যেক মানুষের নিজের মত বাঁচার অধিকার আছে। অন্যের ভালো লাগা আরেকজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া সেটাকে নিশ্চয় স্বাধীনতা বলে না। যেহেতু বাবার জন্য আলাদা হওয়া পসিবল না তাই আমি ভাবছি আমি বাসা থেকে চলে যাবো।” আমি তারপরও চুপ করে থেকে বেশ কিছুক্ষন পর নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললাম “ঘুম পেয়েছে সরেন তো। আপনার মাথা ঠিক নেই। পাগল ছাগলের মত কথা বলেন সব সময়।” এটা বলেই আমি বিছানায় ওঠি।উনি শুধু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।এই যে উনার কথার কোন পাত্তাই দিলাম না।

আজকাল আমার চোখে ঘুম আসে না। নিদ্রাহীন অবস্থায় আমি শুধু ঘুমের ভান করে থাকি। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা জাম গাছ আছে। এই গাছের ডান পাশেই আমার মা শুয়ে আছে। আমার ইন্দ্রজালে আকাশের বৃষ্টির মত গুড়ুম গুড়ুম যখন আওয়াজ হয় তখন আমি মায়ের কবরের পাশে এসে বসে থাকি। মনে হয় আমার মা একদম সামনে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তখন কি যে শান্তি লাগে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে “কাঁদিস ক্যান আমার মেয়েটা? একদম কাঁদমি না আমি আছি তো মা।”

বাবার বাড়িতে আসছি আজকে সাত দিন হয়ে গিয়েছে। সেদিন রাতে উনি যখন আলাদা হওয়ার কথা বললেন, বাসা থেকে চলে যাবেন বলেছিলেন সেদিন রাতেও আমার ঘুম হয়নি, একটুও হয়নি। সারাটা রাত ধরে শুধু আমি ভেবেছি। আমার জন্য কেন উনি উনার বাসা থেকে চলে যাবে? আমি না হয় বরং চলে যাই। আমি মানুষটা আরেকটা মানুষকে ভাবাতে কিংবা কষ্ট দিতে এই অধিকার কি আমার আছে? উনার সাথে কথা বলার ঠিক পরদিনই বাবাকে ফোন করে বলেছিলাম “আমাকে কিছু দিনের জন্য নিয়ে যাও। কতদিন গ্রামটাকে দেখি না। মায়ের গন্ধটা পাই না। নিয়ে যাওনা এসে বাবা ও বাবা।” বাবা ঠিকি দুদিন পর এসে আমাকে নিয়ে এসেছে। যদিও আমার শ্বশুর শাশুড়ি আমার চলে আসার আসল ব্যাপারটা জানে না। কেউই জানে না।আসার আগে উনাকে ছোট একটা চিরকুট লিখে এসেছিলাম...

“অফিসের কাজ অফিসে করবেন। অফিসের কাজ বাসায় এসে করবেন না। আপনি রাতে অনেক লেইট করে খাবার খান। আমি অনেকক্ষন বসে থাকতাম আপনার খাওয়ার জন্য। এটা করবেন না। ঠিক সময়ে খাবেন। বাসায় মাছ রান্না করলে সাবধানে খাবেন।আমি আম্মাকে বলে এসেছি কাটা যুক্ত মাছ বাসায় না আনতে। আপনি তো আবার কাটা যুক্ত মাছ খেতে পারেন না। যেদিন কাটা যুক্তমাছ আনতো আমি বেছে দিতাম। এখন নিশ্চয় সেটা হবে না। ঠান্ডা পানিতে গোসল করবেন না। আম্মাকে বলবেন পানি কুমকুম গরম করে দিতে। আপনি তো ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে পারেন না। জানেন মানুষের ভিতর একটা আত্মা বাস করে। মাঝে মাঝে এই আত্মাটা বের হয়ে জানান দেয় মনের ভিতরের ছন্দের কথা গুলো। সেই কথা গুলো শোনার জন্য আর একটা আত্মার প্রয়োজন হয়। আমার কথা শোনার কেউ নেই জানেন। আসলে আমার কথাগুলো যে ছন্দের মতই না তাই হয়তো। এই যে এই সামান্য কথা গুলো বললাম এই কথা গুলো বলার অধিকারও আমার নেই। আমি চলে গেলাম। নিজের যত্ন নিবেন। খুব ভালো থাকবেন।।”

সাতটা দিন আমার সময়গুলো, সময়ের বেদনাগুলো কেমন করে কেটেছে আমি জানি না। আমার শ্বশুর কয়েকবার ফোন করে খবর নিয়েছিল। আমি কিছুই বলতে পারিনি। বলতে পারিনি আমার মনের অবস্থাটা। আকাশের বুকে যখন কাক উড়ে যায় আমার তখন কেন যেন খুব উড়তে ইচ্ছে করে। উড়ে মায়ের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে শাড়ির আচলটা ঠিক করে বাবার এনে দেয়া বড় কাতলা মাছটা কাটতে থাকলাম । এমন সময় বাবু আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম “কিছু বলবি ভাই?” বাবু কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো “তোমার কি কিছু হয়েছে বুবু?” আমি বাবুর দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু মাথা নেড়ে না সূচক ইশারা দিলাম। বাবু আরও একটু সময় নিয়ে ইতস্তত হয়ে বললো “বাবা কাল রাতে ঘুমাইনি জানো। মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। উঠে দেখি বাবা পায়চারি করছে পিছনে এক হাতের উপরে আর এক হাত রেখে। বাবার মুখটায় অনেক চিন্তিত দেখাচ্ছিল। আমি বাবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করাতে বললো “তোমার কি যেন হয়েছে। তুমি কিছু লুকাচ্ছো। বাবা তোমার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছে। আমাকে বলবে কি হয়েছে? বলোনা বুবু।” আমার কি বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম না আমার কি বলা উচিৎ আমার মনের ভিতরে অসংখ্য জলকণা জমা হয়ে পাহাড় তৈরি হয়েছে সেই পাহাড়ে যে ঝড় বইছে। জলকণার ঝড়। আমার চোখের কোনে পানি জমা হয়। সেই পানি আড়াল করে আমি ঠিকঠাক উত্তর না দিয়ে বললাম “আজকে মাছের মাথাটা দিয়ে মুড়িঘন্ট রাধবো। খেয়ে বলবি কেমন হয়েছে ঠিকাছে ভাই?”

বিকেল বেলায় ঘরটা ঝাড়ু দিতেই একটা ছায়া খেয়াল করলাম। মাথা তুলে যখন তাকালাম দেখলাম আমার স্বামী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখে আমার ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। উনি আমাকে বললেন “তুমি তো অনেক স্বার্থপর। একা কেন পালালে?” আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। ঝাড়ুটা আমার হাত থেকে পরে যায়। আমার চুপ থাকা দেখে উনি আবার বললো “আমি তোমাকে নিতে আসছি।” আমি ইতস্তত করে শুধু বললাম “মানে?” উনি একটু সময় নিয়ে বললেন “সাতটা মাস পার হলো অথচ এই সাতটা মাস তোমাকে অনুভব করতে পারলাম না। কিন্তু এই সাতটা দিনে আমি বুঝতে পেরেছি কেন আকাশের নীল রংটা হঠাৎ করে কালো হয়ে যায়। আকাশ যখন কালো হয় আকাশটা তখন কাঁদে মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম করে চিৎকার দেয়। আমাদের মানুষের ভিতরটাও এমন। আকাশের চিৎকার বা কালো ছায়াটা সবাই দেখতে পারলেও আমাদের মানুষের চিৎকার কেউ শুনে না কেউ দেখে না। তুমি মাঝে মাঝে আমায় ছাগল বলো। আসলে আমি একটা ছাগল। তা না হলে কেন আমি আলাদা হতে যাচ্ছিলাম? সাতটা মাস তুমি আমার কত অবহেলা সহ্য করেছো। কোন পোশাকটা পড়লে আমাকে মানাবে, কোন খাবারটা আমার পছন্দের, ছুটির দিনে আমি কি করতে পছন্দ করি, আমি মাছ খেতে পারি না, ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে পারি না। আমার ভালো লাগা মন্দ লাগা সব তুমি জেনেছো। নিজে থেকে জেনেছো। আমি তোমাকে বলেছি কখনো? বলিনি তো। আমার এতো অবহেলা সহ্য করেও আমার পাশে একটু থাকতে চেয়েছো। কি থাকতে চেয়েছো না? অথচ দেখো তোমার একটা ভালো লাগার কথাও আমি বলতে পারবো না। ভেবেছিলাম সত্যি তোমার থেকে দুরে সরে যাবো। কিন্তু হলো কই। মনে করেছি তুমি চলে গেছো ভালো হয়েছে। শান্তি মত থাকতে পারবো। কিন্তু শান্তি মত থাকতে দিয়েছো তুমি? আমার বার বার মনে হতো তুমি আমার চারপাশে আছো। মনে হতো এই তুমি হুট করে এসে এটা ওটা বলছো। রাতের বেলা খাবার সময় হলে হুট করে এসে বলছো “এই যে পিচ্চির জামাই খেতে চলেন। রাত করে কেন খাবার খান? আমি যে আপনার জন্য অপেক্ষা করি বুঝেন না? আমার বুঝি ক্ষিধে লাগে না?” আমাকে এই সাতটা দিন এতো অত্যাচার কেন করেছো তুমি? এই অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে? বুঝতে পারলাম তোমার অনুপস্তিতিটা আমাকে কেমন পাগল করে দিচ্ছে। এই অনুপস্তিতিটা জানিয়ে দিয়েছে তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। যাবে না আমার সাথে?” আমি চুপ করে উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। উনার কথা শুনে আমার এই ঝাপসা চোখে জল গড়িয়ে পরে। শাড়ির আচলটা শক্ত করে ধরে কান্না কান্না করতে করতেই বললাম “আমি স্বার্থপর না। স্বার্থপর আপনি। আজ যখন বুঝলেন আমাকে ছাড়া আপনার চলবে না তাই নিতে আসছেন। নিজের স্বার্থ পূরণের জন্য। আমি কি মানুষ না? মানুষ বলে মনে হয় না? এই আমি সারাটাদিন একটু পর পর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি আপনি ফোন করেছেন কিনা। করেছেন ফোন আপনি? করেছেন বলেন? যাবো না আমি আপনার সাথে।” উনি একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন “ঠিকাছে যেতে হবে না পিচ্চি। আমারও ওখানে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি তোমার সাথে এখানে থেকে যাই?” এই কথার প্রত্যুত্তর কি দেওয়া উচিৎ বুঝলাম না। আমি ফের কাঁদতে কাঁদতে বললাম “আপনি আসলেই একটা ছাগল। বড় ছাগল। বলেন আর কখনো আলাদা হওয়ার কথা মুখে আনবেন না বলনে।” উনি শুধু চুপ করে আমার কাছে এসে চোখের জল মুছে দিতে লাগলো। মাঝে মাঝে সব কথা বলতে হয় না। মনের ভিতর যে কথাটা লুকিয়ে থাকে কাছের মানুষটা ঠিকি বুঝতে পারে সে কি বলতে চায়, কি বুঝাতে চায়। এই বুঝার মাঝে আমি অনুভব করলাম আমার ভিতরে জমে থাকা জলকণাকে। যে জলকণা পাহাড় হয়ে আমার বুকের মধ্যে গড়ে উঠেছে সে জলকণা। এই জলকণার পাহাড় নিজের ভিতরে আর ঠাই দিতে ইচ্ছে করে না , একদম না। যে জলকণা মানুষের মনকে বিষন্নতায় ডুবায়। আজ থেকে আমি নতুন করে পাহাড় বানাবো। একটা সতেজ সুবজে ঘেরা ভালোবাসার পাহাড়…
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৯ দুপুর ২:০৬
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×