somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জাহিদুল হক শোভন
এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

গল্প: বিকল্প

১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আয়রা দুইজনের সাথেই যখন সমান অধিকার খাটাচ্ছিলো বা বলা চলে দুইজনের সাথে তার রিলেশন আর এই ব্যাপারটা আমি যখন বুঝতে পারি তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম “বিরক্ত লাগে না?”

ও একটা মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে বললো “এই লাইনে বিরক্তের কোন বিষয় না, শুধু মাত্র একটু সতর্ক আর মাথা খাটালেয় হয়। জানেন আমার চোখ হলো কবিতার চোখ, এই চোখকে যে আকড়ে ধরবে সে চাইলেও দুরে ঠেলে দিতে পারবে না। ভালোবাসায় ভাবনা গুলো সাজিয়ে রাখতে হয়। ছয় ঋতুর মত। যখন যে ‍ঋতু সম্মুখে আসবে তখন সে ঋতুর কবিতা শোনাতে হয়। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন আমি আমাকে আমার নিজের ভিতর বন্ধি করে রেখেছি। একটা সীমাবদ্ধতার মাঝে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলি।”

আমি ইতস্তত হয়ে বললাম “আমি একটু কম বুঝি। তোমার কথা আমার কানের একপাশ দিয়ে গেছে। এই ধরো রবি ঠাকুরের কবিতার সাথে সুনীলের কবিতা গুলিয়ে ফেলছি। কেমন সীমাবদ্ধতা?” সে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে চেয়ার টেনে আমার কাছে এসে বললো “আপনি সোজা সাপটা মানুষ। এসব বিষয় না বুঝারি কথা। শুনেন ভালোবাসা একটা মোহ, এই মোহকে কেন্দ্র করেই আমরা মানুষেরা উজ্জবিত থাকি আবার কান্না করি। এই মোহতে না পাওয়ার কান্নাটাই বেশি থাকে। আমার ভিতরে যে আবেগ, মায়া কিংবা মোহ আছে সেটা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন যেটা বিদ্যমান আছে সেটা শুধু মাত্র আকাঙ্খা বললেই হয়। আমি এখন কাউকে বিশ্বাস করি না। ভালোবাসার কথা বলি না। যারা যারা আমার চোখের কবিতার প্রেমে পড়ে আমাকে ভালোবাসতে চায়। আমি তাদেরকে ফিরিয়ে দেই না, আবার তাদের ভালোবাসা গ্রহণও করি না। সহজ করে বললে, তাদের সাথে কথা বলি, বুঝতে চেষ্টা করি, কে আমাকে বেশি ভালোবাসে, কে যত্ন নেয়, খোঁজ খবর রাখে। কিন্তু সব গুলাই না এক টাইপের।”

এই টুকু বলে ও থামে। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখন ও আবার বললো “আমার মন চায় দেশে চলে যেতে। দেশের স্বাদ নেই না কতকাল। এক ক্লাইন্টের সাথে আমার পাঁচ মাস আগে পরিচয়। বিজনেস এর কারণে প্রথম প্রথম এমনি টুকটাক কথা হলেও ভিডিও কলে এক কি দুইবার কথা হয়েছে মাত্র।তাতেই ফিদা হয়ে গেছে।কি করি বলুন। ছেলের নাম আবিদ। কুমিল্লা শহরে থাকে। বাবার বিজনেস দেখা শুনা করে। ছেলে মা শা আল্লাহ। এর মাঝে সত্যিকারের মানুষটা নির্বাচন করে ফেলতে পারলে সব বাদ দিয়ে দেশে চলে গিয়ে তিন বার কবুল বলে সোজা বিয়ে করে ফেলবো। ভালো হবে না? ঘর সংসার করে ছেলের সেবা যত্ন করবো। লক্ষি বউ হয়ে যাবো। আর না হয় অন্য কাউকে নির্বাচন করতে হবে। আপনি মনে মনে ভাবতে পারেন এইটা অনেকটা এমসিকিউ এর মত। অপশনাল টাইপের।”

আয়রার এসব অবচেতন কথা শুনে আমি কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলিনি। শুধু ভিতরটা কেমন করে যেন উঠলো। যে পথ ধরে আমি বড় হয়েছি সে পথে আমার একটা অস্থির সময় অতিবাহিত হয়েছে। আমার এতোটা অশান্ত লাগতো একটা সময় কেমন একদম নিরব হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও ওর এসব কথায় আমি তেমন কিছু না ভাবলেও এমসিকিউ এবং অপশনালের কথা বলে আমাকে কেমন যেন ভাবান্তর করে দিয়েছে। আমিও একজনের কাছে অপশনাল ছিলাম। ও এখনো আমার ভিতরে বাস করে, কথা বলে। কিন্তু আমি ওকে আর চাইলেও ভালোবাসতে পারি না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে সে এখন কেমন আছে, কেমন দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু আফসোস খোঁজ রাখার অভ্যাস আমার কোন কালেই ছিলো না। শেষ বার ও যখন আমার সাথে কথা বিনিময় করেছিলো আমি একটা শব্দও করিনি।

ও যখন বলেছিলো “ডিভোর্স ছাড়া তো আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। দেখো তোমায় আমি ঠান্ডা মাথায় বলি, আমাদের মাঝে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির সংখ্যাটা বেশি।তোমার সাথে সংসার করার পর কয়টা দিন আমি শান্তি এবং স্বচ্ছতার সহিত দিন কাটিয়েছি বলতে পারো? প্রতিবার তুমি একই কথা বলো, আর এমন হবে না। এরপর থেকে ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। ঠিক হয়েছি কি? চারদিন পাঁচ দিন একটু ঠিক থাকে তারপর সেই আবার তোমার সাথে ঝগড়া কথা কাটাকাটি। আমার এসবে অশান্তি লাগে। যেখানে মানসিক শান্তি নেই সেখানে থাকা কি উচিৎ? বলো উচিৎ? মোট কথা কি জানো তোমার সাথে আমার যাচ্ছে না। এই বিষয়টা তুমি বুঝতে পারলে দুজনের জন্য মঙ্গলকর।”

আমি কোন প্রতুত্ত্যর না দিয়ে বুকের সাথে হাতের উপর হাত রেখে ভাবছিলাম নাজিবাহ এর সাথে আমার কেন যাচ্ছিলো না? ও যেটা বলেছিলো ওর সাথে কিছুদিন পর পর ঝগড়া হয়। আসলে কি ওর সাথে আমার ঝগড়া হতো নাকি কথা বিনিময় হতো? আমাদের সংসার জীবনটাই বা কত দিনের? কোন কোন বিষয় গুলোর মাঝে এতো অশান্তি? যেখানে অপ্রাপ্তির সংখ্যাটা এতোটা বেশি? কোন প্রাপ্তিটা বা অভিলাষটা আমি পূরণ করতে চেষ্টা করিনি? আর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছি? কিন্তু কি উদ্ভুত আমি কোন কিছু মিলাতে পারছিলাম না। কোন জবাব দিতে পারছিলাম না। সেদিন এই শীতের রাতে আমি একটা চাদর মুড়ি দিয়ে উদ্ভ্রান্ত চোখে সারাটা রাত বারান্দার চেয়ারে বসে ছিলাম।কিছুক্ষণ পর পর দাড়িঁয়ে এপাশ ওপাশ হাটছিলাম আর উত্তর খুঁজছিলাম। যতবার আমি উত্তর খুঁজছিলাম ঠিক ততবার মনে হতে লাগলো ভিতর থেকে কি যেন বের হয়ে আসতে চায়। আমার চোখে তখন চোখ ভরা শূন্যতা আর মন ভরা হাহাকার। একবার আমি দরজা খুলে নাজিবাহ এর ঘুমন্ত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভয়ংকর ব্যাপার আমার তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। ইচ্ছে করছিলো ওর হাত ধরে বলতে আমি তোমাকে অনেক চাই। এই দেখো তোমার এই ঘুম ঘুম চেহারায় যে মায়া আমাকে উদ্ভাসিত করছে সেটাকে আমার আরো অনকে ভালোবাসতে হবে। কিন্তু আফসোস যাকে ভালোবাসলাম, যাকে এতো আপন করলাম সে আমার থেকে হারিয়ে গিয়েছে।

কোন কিছু হারানো বিষয়টা আমার জীবনে নেই যার কারণে পূর্বে এই বিষয়ে উপলব্দি করতে না পারলেও সেদিন বুঝতে পারছিলাম কেউ কাছের হয়ে বা পরিচিত হয়ে একটা সময় দুরের হয় বা অপরিচিত হয়ে যায় তার অন্তর্যাতনা কেমন করে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দেয়, জ্বালিয়ে দেয়।

৭৯৯০ কিলোমিটার দুরে বাংলাদেশ থেকে এই ফ্রান্সের শহরের অফিসে বসে আমি ভাবছি আসলেই আমি একটা অস্থির সময়ের মধ্যে যাচ্ছি। নাজিবাহ এর সাথে আমার ডিভোর্স হয়েছিলো সেই কথোপকথনের একমাস পরেই। সারাটা দিন রাত আমার কেমন কেটেছিলো আমার এক আল্লাহ জানে। আমি কাউকে আমার ভিতরের চাপা কথা গুলো বলতে পারতাম না। আমিও বলতে চাইতাম না। আমি এটা অন্তত বুঝতাম এইসব নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাকে নানান কথা শুনতে হবে। বিশেষ করে ওকে নিয়ে নানান কথা উঠবে যেটা আমি চাইতাম না। কিন্তু কথা উঠতো, আমার মনে হতো আশপাশের মানুষ গুলো এই বিষয়টা নিয়ে করুনা করছিলো। এসবের মধ্যে আমার দিনগুলো যাচ্ছিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম দেশ ছেড়ে চলে যাবো।

আমার মন যখন বিষণ্নতায় ছুয়ে যায় আমি তখন প্যারিসের বুক ধরে হাটি, আকাশের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের হাহাকার গুলো তার সাথে ভাগাভাগি করি। কিন্তু আমার বুঝ আসে না এই এতো বড় আকাশের মাঝে আমার হাহাকার গুলো জায়গা দেয়ার জন্য আকাশের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। মাঝে মাঝে ভাবি আকাশের থেকে আমার বুকের হাহাকার গুলো কি অনেক বিশাল? আমি যখন নটর ডেম ক্যাথেড্রালের পাশে হাটি তখন আমার কেন যেন একটু হালকা লাগে। এর বিশাল বিশাল বাকানো পিলার আর জানালার কাছে দাঁড়ালেই মনে হয় আমার মত সেও একা। সবাই তার মাঝে এসে মুগ্ধতা ছড়ায়, আনন্দটুকু নিজের অনুভূতিতে ধারণ করে নিজ নিজ গন্তেব্যে ফিরে যায়। কিন্তু কে জানে আমার মত তার বাহিরের আর ভিতরের চমৎকারের রুপটায় জড়িয়ে আছে এক নানান ইতিহাস। আমি নিশ্চুপ হয়ে নটর ডেম ক্যাথেড্রালের সাথে মনে মনে কথা বলছিলাম ঠিক এমন সময় দিবা হঠাৎ করে এসে আমাকে বললো “কি জনাব আজকেও মন খারাপ?” আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই। একটা স্বস্থি ফেলি। ফ্রান্সে এই প্যারিস শহরে দিবার সাথে এক কফি শপে আমার পরিচয়। প্রায় যখন ওখানে যেতাম তখন ও আস্ক করেছিলো আপনি কি বাঙ্গালি? তারপর থেকেই ওর সাথে টুকটাক কথা। সেই কফি শপে সে চাকরি করতো। ও কেমন করে যেন বুঝে ফেলতো আমার মনের বিষন্নতার ছাপ। কিন্তু আমি কখনো তাকে কিছু বলিনি। শুধু বলেছিলাম “দেশ ছেড়ে এসেছি, এখানে পরিচিত কেউ নেই। পরিবারের সবাইকে ছাড়া দুরে আছিতো একটু বিষণ্ন লাগে।” যেদিন ওকে এই কথাটা বলেছিলাম সেদিনই সে আমাকে এই নটর ডেম ক্যাথেড্রালের কাছে নিয়ে এসেছিলো। ও বলেছিলো “চলেন আপনার মন ভালো করে দেই।” সেদিনই ওর থেকে শুনে ছিলাম এই নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ইতিহাসের ব্যাপারে। যার সার সংক্ষেপ ছিলো ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যে একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলছিলো। তার মধ্যেই ফ্রান্সের অন্যতম আলোচিত নারী জোয়ান অব আর্ককে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আগুনে পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মতে জোয়ান অব আর্ক ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের যুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সকে তার বুদ্ধিদীপ্ত সামরিক কৌশল দিয়ে সাহায্য করেন। তার নেতৃত্বে ফ্রান্স কয়েকটি যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। যা-ই হোক, যুদ্ধশেষে ১৪৫৬ সালের একটি নতুন বিচারে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। পরে ১৯০৯ সালে নটর ডেম ক্যাথেড্রালে তাকে বিটিফাই করা হয়।সেখান থেকেই এটি নির্মাণ। পরে অবশ্য এটিকে বহুবার পুন নির্মাণ করে এই রুপে আনা হয়েছে।

আমি দিবাকে বললাম “তুমি কি করে বুঝলা আমি এখানে?” সে একটা হাসি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো “জানেন আমরা সব কিছু মনে আকঁতে পারলেও বিষণ্নতার বিচিত্র দৃশ্যটা আঁকতে পারি না। চারাপাশে তখন ভাল্লাগেনা ভাল্লাগেনা কাজ করে। তখন আমাদের হারিয়ে যেতে মন চায়। কল্পনার একাকীত্ব ছেলেটা/মেয়েটার মত। যখন কল্পনা ভাঙ্গে তখন জগতটা অনেক অচেনা লাগে তাই না? প্রথমত আমি একজন মানুষ। একজন মানুষের অন্তরে আরেকজন মানুষের খোঁজ রাখা কি দরকার না?” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কি চমৎকার করে কথা বলে মেয়েটা। ও যখনি এমন করে কথা বলে প্রায় আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। আমি বললাম “জীবনটাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই জীবনে আমাদের হাজার মানুষের সাথে পরিচয়, কিছু কিছু মানুষ পরিচিত হয়েও সম্মান/অবজ্ঞা না করলে বুঝতেও পারতাম না বিষণ্ণতা কি? জীবনে বিষণ্নতার স্বাদ নেওয়ার দরকার আছে। দরকার আছে বলেই আমার আল্লাহ এই বিষণ্নতার অনুভূতি মানুষের অন্তরে দিয়ে দিয়েছে। একটা কথা কি জানো যার অন্তরে বিষণ্নতা/অভিমান/দুঃখ বেশি তার সাথে আমার আল্লাহর সম্পর্ক খুব গভীর।মনে দুঃখ ভরাক্রান্ত হলেই আল্লাহকে হৃদয় দিয়ে ডাকতে পারি। তিঁনি চিনিয়ে দেয় বুঝিয়ে দেয় এই পুরো জগতের মায়া গুলো, মানুষ গুলোকে। কিন্তু কি জানো, আমরা যখন বিষণ্নতায় অবতীর্ণ হই তখন আমরা পুরো জগতের মানুষকে, মানুষের মায়াকে বুঝতে চাই না।শুধু চাই সব কিছু থেকে হারিয়ে যেতে।

আজকাল প্রায় দিবার সাথে আমার একটা ভালো সময় কাটে। দেশ ছেড়েছি প্রায় দু বছর। আত্মাটা সারাক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরতে মন চায়। অবশ্যই এই চাওয়ার পিছনে ওর অবদান সবচাইতে বেশি। ও প্রায় বলে “জীবনকে উপভোগ করুন। এই জীবন আল্লাহ থেকে প্রদত্ত। কেন তাঁর দেওয়া জীবনকে নানা রকম চিন্তায় হতাশায় কাটিয়ে জীবন পার করে দিবেন? নিজে কিছু করুন, অপরকে সাহায্য করুন, আমার মত। এই দেখুন না আপনার সাথে কেমন করে বন্ধুত্ব করে নিলাম।” দিবা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার প্রায় মনে হয় ও যখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে ও তখন চোখ দেখে নিরবে আমার মনের কথা বুঝে। ও বলে উঠলো “এই পৃথিবীতে বিষণ্নতা ছাড়া আরো অনেক আবেগ আছে, অনুভূতি আছে।একেক জনের কাছে অনুভূতি ভিন্ন রকমের। এই দেখুন না, আজকে কয়েকটা মাস ধরে একজন আমাকে কি চমৎকার চিঠি লিখে যাচ্ছে। অথচ তার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি, দেখা হয়নি। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন, তার দেওয়া চমৎকার চিঠি গুলো আমাকে ভাবাপন্ন করে তুলেছে। এটা কেমন অনুভূতি বলতে পারেন?”

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওর কথার ‍উত্তর না ‍দিয়ে বললাম “আমি যাই। কাল অফিসের একটা মিটিং আছে। রিপোর্ট তৈরি করতে হবে।” যেই আমি চলে যাচ্ছিলাম কোন প্রত্যুত্তরের আশা না করে ঠিক তখন ও আমার হাত ধরে বললো “রাগ করলেন? যখনি এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলি, আমি খেয়াল করেছি আপনি হয়তো প্রসঙ্গ বদলে ফেলেন, না হয়তো কোন অযুহাত দেখিয়ে চলে যান। এমন কারা করে জানেন? কেউ যখন তার কাছের মানুষকে কারো সাথে সাক্ষাত করা/গল্প করা দেখা পছন্দ করে না কিংবা সে চায় না তার সাথে কেউ কথা না বলুক। কারন ভয় হয়। যদি সে হারিয়ে যায়। আমার মনে হয় কি জানেন আপনি আমায় পছন্দ করেন। কথা কি সত্য?”

আমি ওর কথায় ইতস্ততবোধ করছিলাম। কিন্তু আমি কোন উত্তর না দিয়ে চলে আসি। রাতে যখন শুয়ে শুয়ে ফেনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখন মনে হলো আসলে সত্য কথা। ও যখন চিঠির ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলে আমার তখন কেন যেন অস্থির অস্থির লাগে। কিন্তু কেন ‍লাগে? আমি ওকে পছন্দ করি, বা ওর প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়েছে বিষয়টা এমনও না। মাঝে মাঝে মনে হয় ও মিথ্যা একটা কাহিনী বলে আমাকে এমন রাগাতে চায়। বুঝতে চায় বা জানতে চায় আমি ওকে পছন্দ করি কিনা। ওকে এই ব্যাপারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করা উচিৎ। কিন্তু কেন আমার এমন অস্তির অস্থির লাগে?

এক সপ্তাহ পর অফিস শেষে বিকেলের দিকে ওর কফি শপে যখন গেলাম তখন অবগত হলাম ও কফি শপে নেই। তিন বার ফোন দিয়ে অবশেষে দিবা জানালো একটু শরীর খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করলাম বেশি সিরিয়াস কিছু কিনা। ও জানালো একটু রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

আমি প্যারিসের সেইন নদীর তীর ধরে হাটতে থাকি। নদীর তীর ধরে হাটলেই যে শীতল বাতাসটা বয়ে যায় তখন মনে হয় আমার মনটটা এমন শান্ত নদীর মত। কিছুক্ষণ পর পর স্রোত গুলো আঘাত করে যায়। কিন্তু প্রকৃতির মত সব সময় যে কোন পরিস্থিতে নিজেকে ঠিক রাখতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতেই দিবার সাথে আমার দেখা। ও আমাকে দেখেই আতকে উঠলো। আমার সাথে এইভাবে দেখা হবে ও নিশ্চয় কল্পনায়ও ভাবে নি। আমি বললাম “বাসায় ভালো লাগছে না তাই বের হয়েছো ঘুরতে? তোমার শরীর ঠিকাছে?” ও একটু ইতস্ততবোধ করলো। কি বলবে তা হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা নেড়ে আমার কথার হ্যাঁ সূচক ইশারা দিলো। আমি মনে মনে একটু হাসলাম। তবে আমি তাকে কিছু বললাম না। যতক্ষন ওর সাথে ছিলাম ও সারাটাক্ষণ চুপচাপ ছিলো। আমারও তেমন কিছু বলার ইচ্ছা ছিলো না।

সন্ধ্যার দিকে দিবাকে বাসায় পৌছে দিলেও আমি বাসায় ফিরলাম না। আকাশের নিচে আমি বসে ভাবতে লাগলাম আর হাসতে লাগলাম এই জগতের মানুষ গুলোকে চিনা বুঝা বড় মুশকিল। আমার জীবনটা একটা অপশানালের মত। আসলে দিবাকে যে ব্যক্তি চিঠি লিখতো সেটা আর কেউ না। আমি। দিবার সাথে যত সময় পার হচ্ছিলো ওর কথা বলা, আচার আচরণ, আমার প্রতি কেয়ার সব কিছুই আমাকে আবার নতুন করে একটা মানুষ হিসেবে ভাবিয়ে তুলে ছিলো। আমি বুঝতে চেষ্টা করছিলাম একটা মানুষ হয়ে আরেকটা মানুষের প্রতি প্রায়োরিটি/ স্বচ্ছতা নিয়ে। আজকে দিবার সাথে চিঠির ব্যক্তিটার সাথে দেখা করার কথা ছিলো। দিবাও কয়েকবার চিঠির উত্তর দিয়েছিলো। তার ভালো লাগার কথা শেয়ার করে ছিলো। কিন্তু এই ব্যক্তিটা যে আমি দিবাকে বুঝতেও দেইনি।

আমাদের জীবনটা এমন আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি বা পছন্দ করি তখন তার সাথে শুরুর দিকে ভালো একটা সময় কাটানো হয়। কিন্তু একটা সময় যখন কোন বিষয় নিয়ে কোন খুত/কথা কাটাকাটি হয় যেটা কিছুদিন পর পর চলতে থাকে অথবা কোন ঝামেলা নাই হোক এই সম্পর্কের ভিতরেই তখন আমরা এই কিছু কিছু মানুষেরা ভিতরে ভিতরে অপশনাল হিসেবে কাউকে ঠিক করে ফেলি। যাকে অপশনাল হিসেবে রাখা হয় তার সাথে তেমন একটা কথা না হলেও ভালোবাসার মানুষটার সাথে যখন একটু দুরত্ব তৈরি হয় তখন সেই অপশনালের মানুষটার সাথে কথা বাড়তে থাকে। যার পরিস্থিতি নাজিবাহ এর মত। আয়রার সাথে যে ছেলে আবিদের এখন সম্পর্ক চলছে সেই আবিদ আর কেউ না। ফ্রান্সে এসে দেড় বছর পর সব খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই সেই আবিদ যার মোহে পড়ে নাজিবাহ আমাকে ডিভোর্স দিয়েছিলো। আমি বিষয়টা মানতে পারছিলাম না। আমার বন্ধু ফারাজের মাধ্যমে আবিদকে একটা বিজনেসের অফার দেই। আর এই বিজনেসের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার আয়রা। আমি শুরুর ‍দিকে বুঝতে পেরেছিলাম আয়রা এমন একজন। ফারাজ, আবিদকে প্রায় সময় আয়রার ব্যাপারে ফান করে উৎসাহ দিত, ওর মনে একটা ভালো লাগা তৈরি করতে কাজ করেছিলো। নাজিবাহ যার জন্য আমাকে ডিভোর্স দিলো সেই আবিদ আজ আয়রার জন্য নাজিবাহকে ডিভোর্স দিতে না রকম খুত ধরে। মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে নাজিবাহকে কথা শোনায়। ভাবলাম সব কিছু এখানে সমাপ্তি করি। আয়রাকে জানিয়ে দি। মানুষের বিকল্প হওয়া খুবই ভয়ানক ব্যাপার। এটা মানুষকে শেষ করে দেয়। আজকের আকাশটা স্বচ্ছ। শীতের শীতলতা নেই। তবুও আমার শরীরটা কাপছে। আমি খেয়াল করলাম আমার চোখটা ভেজা।এর কিছুক্ষন পর আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো। দিবার। যেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তাতে ছোট্ট করে লিখা “আপনি অনেক ক্লান্ত তাই না? বিকল্পের চালে আমাকে জড়ালেন? কি ভাবছেন আমি কিছু জানি না? আমি বুঝিনি। আপনার সাথে আমার অনেক হিসাব বুঝার বাকি। বিকল্পের হিসাব...
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:৪৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×