মৃদু বাতাসের হু হু শব্দ স্তব্ধ রাতের গভীরতাকে আরও বাড়ি্যে তুলছে।কোন জন মানুষের আস্তিত্বের সত্যতা চিন্তা করা বড় অশোভনীয়।মাঝে মাঝে শুধু দু একটা খেচরের ক্ষীন ডাক ভেসে আসছে।যা ভুতুরে রাতকে আরও ভীতিকর করে তুলেছে।কমল কতক্ষন এখানে পড়ে আছে সে জানে না।এখণ সে একটা অস্বস্তিকর ঝিম ঝিম অনুভব করছে।চোখ খুলতে মন চাইছে না।প্রচন্ড দুর্বলতায় এভাবে পড়ে থাকতে পারলে বোধহ্য় একটা আরাম বোধ করা যায়।এরকম একটা সুখের ঘোরে কমল অনিচ্ছা স্বত্তেও চোখ খোলার চেষ্টা করলো।একি চোখ খুলে কিছুই দেখা যায় না।চোখ বন্ধ করে অন্তত একটা রঙ্গিন স্বপ্ন দেখা যায়।স্বপ্নের পৃথিবী এমন ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়।মনের ইচ্ছে মত রঙ্গ দিয়ে সাজানো।সবকিছু স্বচ্ছ,পরিষ্কার।চোখ খুলে কমল হৎচকিয়ে গেলো।এক মুহুর্ত আগের পৃথীবি আর এখনকার পৃথিবীর কোন মিল নেই!তার কাছে মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে সে মাত্র জন্ম গ্রহন করেছে।আর জন্মলগ্ন থেকেই পৃথিবী এমন অন্ধকার, ঘোরতর অন্ধকার।
মুহুর্তের মধ্যেই কমল সম্বিত ফিরে পেল।না এই অন্ধকার তার অপরিচিত নয়।সেই কৈশরের ১৩ তে সে এই অন্ধকারে পা দিয়েছে।এখন যৌবনের ঠিকরে পড়া উদ্দামতা তার চোখে মুখে।কমল উঠে বসার চেষ্টা করলো।উফ! প্রচন্ড এক অন্ধকার শক্তি তার বাম হাতটাকে ছিড়ে নিয়ে যেতে চাইছে।কোন রকমে উবু হয়ে বসলো কমল।কিন্তু হাত?
সে ডান হাত দিয়ে ঝুলে পড়া বাম হাতের বাহুতে স্পর্ষ করলো।নাহ্।কোনরকম অনুভুতি নেই।ঘোরতর অন্ধকারে বুঝি অনুভুতি ম্লান হয়ে যায়?একটু আগে যে চোখ বন্ধ করে সজীব পৃথিবী দেখছিলো তা তো অন্ধকারাচ্ছ ছিলো না,তবে ম্লান হয়ে গেলো কেন?
চারপাশে কাশবন দুই মানুষ সমান উচু হয়ে কতদুর যে বিছিয়ে আছে কে জানে।মাঝখান দিয়ে একপেয়ে পথ সাপের মত একেবেঁকে অনেকদুর পর্যন্ত চলে গেছে।শুধু একটিমাত্র পথ নয়,অনেকগুলো ,জালের মত ছড়িয়ে।দিনের আলোতেও দু একবার দেখা,জানা রাস্তায় সাচ্ছন্দে আপন গন্তব্যে পৌছানো অসম্ভব।এ রাস্তায় কমল যখন প্রথম এসেছিলো তখন গা গুলিয়ে উঠেছিলো,বলেই ফেলেছিলো' খোদার ফেরেস্তাও এই রাস্তায় যাইতে পারবো না।পরক্ষনেই আবার তওবা করেছিলো"ইশ্বর সর্বশক্তিমান,ইশ্বর সর্বশক্তিমান।তখন তো তেরো বছর বয়স মাত্র!
এরপর আর সমস্যা হয় নি পথ চিনতে।অনেকগুলো বছর পর আজ এই গভীর অন্ধকারে দ্বীতিয়বার মনে হল এ পথে সে প্রোথম এলো।কখনোই এ পথের শেষ সে খুজে পাবে না।উদম গায়ে এ পথে হেটে এলে কাশবনের প্রাকৃতিক অস্ত্রাঘাতে ক্ষতবিক্ষতায় রক্তাক্ত হয়ে যায়।যার কারনে কমলরা চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহেও মোটা কুর্তি পড়ে ছুটে যেতো লক্ষ্যের দিকে।তখন মনে হত কে যেন নরকের মধ্য দিয়ে পথ করে দিয়েছে।পূর্বানুসারে এখনও তো সেই অগ্নিকুর্তি গায়ে থাকার কথা,তবে শীত করছে কেন?
তবে কি সে এখন স্বপ্নের পৃথিবীতে?
এখানে অন্ধকার কেন?
আলোকময় পৃথিবীও কি অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে?
নাকি এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীই শীতল হয়ে যাচ্ছে?
না।আর ভাবতে পারছে না কমল।দুই চোখের দুই পথিবীই এখন ঘুরতে শুরু করেছে।একটু পাশ ফিরতেই চিৎকার করে উঠলো।কে যেন দুরমুশ দিয়ে বামপাশটায় আঘাত করলো।তারপর ঝুপ করে শব্দ হল ঝোপের আড়ালে।না।কোন মানুষ নয়,শিয়াল অপেক্ষা করছিলো কখন মানুষটা মরবে।কখন সে পেট পুরে খেতে পারবে!চিৎকারের শব্দে হয়তো বুঝতে পেরেছে ,এ মরবার নয়।তাই ছুটে পালিয়েছে।কমলের সকল চিন্তার কুন্ডুলী এখন ছুটে যাচ্ছে নক্ষত্র খচিত অন্ধকার আকাশের দিকে।শেয়ালটা বোধহয় পালিয়ে ভুল করলো।খুব বেশি তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইছে।চারদিক নিরব হয়ে যাচ্ছে।নিরব থেকে আরও নিরব।এখন স্তব্ধ।শুনশান।
-এখন কেমন লাগছে? বিস্মিত কিংবা আবেগহীন স্বরে জিঙ্ঞেস করলো কেউ একজন।
কমল চোখ খুললো।সে প্রথমবারের মত চোখ খুলে অবাক হয়ে গেল।এযে রজনী ম্যাডাম!চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে অস্পস্ট স্বরে উত্তর দিলো
-ভালো।কিন্তু আপনি?
-আমি।কোনরকম আশ্চর্য না হয়ে বেশ সাচ্ছন্দের হাসি হাসলো রজনী ম্যাডাম।তারপর বললো,
-আমি জানি,ভালো আছো।অন্তত মরে যাবার ভয় নেই।ডাক্তার গুলি বের করে ফেলেছে।
ওহ্!তোমার জন্য খাবার করা আছে।আমি নিয়ে আসছি।
বলেই ম্যাডাম কুড়ে ঘরের বাইরে চলে গেলো।ম্যাডামের কথাগুলোতে কমলের মনে কেমন যেন খটকা লাগলো।মৃত্যু শব্দটা যেন তার কাছে খুব তাচ্ছিল্যর ব্যাপার।গুলিবিদ্ধ মৃতপ্রায়কে বাঁচিয়ে তার সামনে তাকেই তাচ্ছিল্য?ব্যাপারটা কেমন যেন লাগলো কমলের কাছে।তার চেয়ে বড় আশ্চর্য হল ম্যাডামকে দেখে।তিনি এখানে এলেন কি করে?আর তাকেই বা পেলো কোথায়?কমল তো পড়ে ছিল গহীন কাশবনের মাঝে।যেখানে দিনের আলোতেও সাধারনের কোন বিচরন নেই।তাছাড়া কমলের শরীর থেকে যে পরিমান রক্ত ঝরে গেছে,তাতে তো রাতেই শেয়াল কুকুরের খাদ্যপযোগী হয়ে যাবার কথা।তবে কি রাত শেষ হবার আগেই................................?
ম্যাডাম খাবার হাতে ঘরে ঢুকলো।ছোট একটা টি টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললো,
-কি?ভাবছো আমি এখানে কি করে?কলেজ আর এই জায়গাটা মেলাতে পারছো না, তাই না?তোমাকেই বা পেলাম কি করে,এই তো?ও সব পরে হবে।এখন কোন কিছু চিন্তা করা একদম নিষেধ।একটুখানি উঠে বসো।খেতে হবে।
-না মানে!
-উহু' কোন মানে নয়।আমি তোমার ম্যাডাম।
আধোশোয়া অবস্থায় বসতেই ভীষন এক ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো কমল।খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।ম্যাডাম না থাকলে কেঁদে ফেলতে পারতো খুব সাচ্ছন্দ্যেই।ধুর;কান্না আবার সাচ্ছন্দ্যে হয় নাকি?তবুও সে ম্যাডামের সামনে কাঁদতে পারে না।এটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।
-নাও,হাঁ কর।
কমল বাঁধা দেবার জন্য হাত উঠাবার চেষ্টা করলে শরীরের সকল যন্ত্রনার রুপ মুখের উপর তার ছায়া ফেলে। ম্যাডাম হাত উঠাবার চেষ্টায় বাঁধা দেয়,
-না।হাত দিয়ে খেতে হবে না।মেয়ে মানুষের হাতে খাবার খেলে সংস্কিতি অশুদ্ধ হয় না। তোমার সারা শরীর এখন ব্যাথায় জড়িয়ে আছে।নড়াচড়া করা অনুচিৎ।
-ম্যাম আমি তা মনে করি নি।পুরুষালী ব্যাক্তীত্বের সাথে মৃদু প্রতিবাদ করে কমন।
-আহ্!থামো।আগে খাবার খাও।
কমল তবুও থতোমতো হয়ে জিগ্যেস করে,
-ম্যাডাম, আপনার কলেজ?
-আছে।সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না।তোমাকে ঔষুধ দিয়ে যাচ্ছি,খেয়ে ঘুমোবে।
ম্যাডামের কথায় একটু বিরক্তের ছায়া পড়লো কমলের চোখে।কারন সে রাতেই দুই চার ঘন্টার বেশি ঘুমায় নি। কখনো বা কয়েকদিন...অথচ ম্যাডাম বলছে কিনা এই বিকেলে ঘুমোতে?
-আমি জানি,এই বিকেলে একটু ঘুরে বেড়ালেই তোমার বেশি ভালো লাগতো।কিন্তু তা তো সম্ভব নয়।
ম্যাডামের কথার প্রতিবাদ করতে কমল একবার উঠে বসার চেষ্টা করলো।সত্যিই তো তার পক্ষে দাড়ানো দুরে থাক সোজা হয়ে বসাও সম্ভব নয়।ম্যাডাম ঔষুধ এনে খাইয়ে দিলো।
-শুয়ে থাকো,এমনিতেই ঘুম এসে যাবে।আমার ফিরতে দেরি হবে। কথা শেষ করে কোন উত্তর শোনবার অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেল ম্যাডাম।
কমল শুধু ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে থাকলো ম্যডামের চলে যাওয়া পথের দিকে।দরজার পাল্লা অনেকখানি খোলা।এখানে ম্যডামকে যত দেখছে কমল, ততই অচেনা মনে হচ্ছে।২য় বর্ষে উত্তিন্ন হবার সময় মিস রজনী বাংলা বিষয়ের প্রভাষীকা হিসেবে যোগ দিয়েছিলো।তখন তার একদম অল্প বয়স।মনে হতো খুব বেশি হলেও ৫কি ৭ বছরের বড় হবেন।তবুও বোঝা যেত না।মনে হতো প্রায় সমবয়সী।বাংলায় তার পান্ডিত্য প্রথম ক্লাসেই কমল বুঝতে পেরেছিলো।তবুও ম্যাডাম ছিলো একদম আলাদা অথচ গম্ভীর যেন কদম ফুল।যেমন দুর থেকে মনে হবে সাদা রংগের,হাতে পেলে তা হয়ে যাবে হলদি।
কোনকিছু না ভেবে কমলের ভাবনাগুলিকে ম্যাডাম খুব সহজেই বলে গেল।কি করে সম্ভব?রজনী ম্যডাম বাংলার প্রভাষীকা।তার মানে সাহিত্যের,সাহিত্যিকরা কি মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে?হয়তো পারে।নইলে হৃদয়ের এতবড় গহীন যন্ত্রনাকে কলমের খোঁচায় সাহিত্য হিসেবে এতটা প্রজ্বলিত করে কি করে?ম্যাডামের শেষ কথাটা কমলের কানে বাজলো,
"ফিরতে দেরি হবে"তার মানে রাতে ফিরবে।রাতে সে কি একা ফিরবে?একটা মেয়ে কি করে রাতে চলাফেরা করে আমাদের দেশে?আমাকেও তো রাতেই ম্যাডাম এখানে নিয়ে এসেছে।রাতে কি সে এখানে থাকবে?তা কি করে হয়?ছোট্ট একটি ঘর।ছনের চালা।কোনরকম একটা চৌকি পাতা।ওতে ১ জন শুলেও পা বেরিয়ে থাকে।পাশেই একটা টি টেবিল আর দুইটা চেয়ার।একফোটা জায়গা খালি নেই যে মানুষ একটু আরামে বসাতে পারে।তাহলে ম্যাডাম শোবে কোথায়?কমল এখন আর ছোট বাচ্চাটি নয়,২৪ বছরের যুবক।কমল নিজের মনেই খানিকটা লজ্জা পেলো।কানে ভেসে আসতে লাগলো,"আমার ফিরতে দেরি হবে"।ক্রমশই তার চোখ আচ্ছন্ণ হয়ে যাচ্ছে।কমল কোন কিছুই আর স্পষ্ট করে ভাবতে পারছে না।শুধু মনে পড়লো"এমনিতেই ঘুম এসে যাবে"।
রাত দুই প্রহরের সময় ঘুম ভাঙ্গলো কমলের।অন্ধকার,ঘোর অন্ধকার।গতরাতেরর মত সেই অন্ধকার,ভয়াল কালো অন্ধকার।হঠাৎ বুকের মাঝে গতরাতের সেই ব্যথাটা আবার চিন্ চিন্ করে উঠলো।আজও কি ............................................................?
একটু নড়াচড়া করতেই হতবম্ভ হয়ে যায় কমল।মাথার নিচে সেই তুলতুলে বালিশটা নেই।কি যেন শক্ত একটা কিছু!চোখ খুলে তাকাতেই বেড়াকাঁটা জানালা গলিয়ে আসা চাঁদের আলোয় ভেসে উঠে নিকষ আঁধার কালো একঝাক এলোমেলো চুল।চেহারা অস্পষ্ট।তবুও দ্বীধাহীন কমল চিনতে পারে সে মুখ।এযে রজনী ম্যাম।
এক হাতে চুলগুলো সরিয়ে ম্যাম আলো-ছায়ার খেয়ালিতে খুব ক্ষীন কন্ঠে বললো।
-কি,ঘুম ভেঙ্গেছে?
-না,মানে বিকেলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তো! কমল বুঝতে পারে তার কন্ঠ খুব বেশি ক্ষীন।কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে।আশ্চর্য,সে কখনো তো এরকম কন্ঠে কথা বলে নি!সাধারন কথা বললেও দু চারজন মানুষ বুঝতে পারে কমল কথা বলছে।অথচ এখন?
-কি ভাবছো?
-তেমন কিছু না।এবারও কণ্ঠের কোন পরিবর্তন হল না।কিন্তু রজনি ম্যাম?তাকেও তো অচেনা মনে হচ্ছে।একি কলেজের বাংলা ক্লাসের সেই রজনী ম্যাম?সেও তো স্পষ্ট,দৃঢ় কন্ঠে কথা বলতো।অথচ এখন..........?
-চিনতে পারছো না,নাকি কলেজের ম্যাডামের সাথে মেলাতে পারছো না।কোনটা?
-ঠিক তাই।কলেজে আপনি দৃঢ়,কঠর আর এখানে? আপনি নরম, কমল।
-হুম।কলেজে আমি প্রফেশনাল।যাই হোক,এখন কেমন লাগছে?
-ভালো।
কমলের এতোক্ষন পরে খেয়াল হল যে সে অসুস্থ।তার বা হাতে গতরাতে গুলি লেগেছে।
একি?সে এতক্ষন ম্যামের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে?ম্যামও তার বা-হাতে চিবুকের কাছে আলতো করে ছুয়ে আছে।আশ্চর্য হলেও সত্যি,ম্যামের এলোচুলের অদ্ভুদ একটা গন্ধ কমলকে আচ্ছন্ন করে।তাছাড়াও জীবনে প্রথমবারের মত সে কোন নারীর কোলে মাথা রেখেছে,যদিও সে তার কলেজের ম্যাডাম।ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ লাগছে তা নয়।আস্তে আস্তে কমলের ডান হাতে নিজের হাত বুলিয়ে ধরে ফেললো,তারপর টেনে নিয়ে নিজের চিবুক ছুইয়ে হালকা চেপে ধরলো সে হাতকে।আশ্চর্য,মানুষের শরীর এতটা ঠান্ডা হয় নাকি কখনো?এতো সাপের চেয়েও ঠান্ডা!কমল অবাক হয়,কেমন যেন একটা অস্বস্তি অনুভব করে কমল।
-কি খারাপ লাগছে তাই না?দীর্ঘ নিঃস্বাশ ছুটে যায় সুদীর্ঘ হয়ে। না।ভয় পাবার কিছু নেই,এ কিছু হবে না।
-আমি তেমন কিছু মনেও করিনি। কমল গায়ে পরা অপমানকে ঠেলে ফেলার চেষ্টা করে।
আসলেই তো!একটা নারী-পুরষের মধ্যে নিভৃতে,নির্জনতার তরঙ্গে তেমন কিছু তো ঘটতেই পারে।কিন্তু.....................?
ম্যাডাম আমার চেয়ে ৫কি ৭ বছরের বড়। ব্যাপারটা সত্যি খুব ধিক্কারজনক।
-আমি এখানে কেন জানতে চাও না?
ম্যামের কথায় কমলের ঘোর কেটে গেলো।
-না।আমি জানি, মানুষ যখন যে অবস্থানেই অবস্থান করুক না কেন,তার জন্য দায়ী হচ্ছে দুইটা জিনিস।এক হচ্ছে তার ইচ্ছে আর অন্য হল, পরিস্থিতি।
ম্যাডাম একটু আশ্চর্য হয়ে..........
-আমি জানি, তুমি অনেক সুন্দর করে কথা বলো।অহংকারটাও একটু বেশি।
নাহ্।রজনী ম্যামকে এই মুহুর্তে ম্যাডাম ভাবতে ভালো লাগছে না।ম্যাডাম তো আর ক্লাস নিচ্ছে না আর কমলও কলেজের ছাত্র নয়। কিন্তু ম্যামের কথাগুলো কেমন যেনো রহস্যপুর্ন।
-আমাকে আপনি কোথায় পেলেন? তখন তো রাতও অনেক ছিলো তাই না?
-সেটা অনেক কষ্টে কুড়িয়ে পাওয়া আমার একটুকরো সুখ।তোমাকে না বলি? একটু হেসে,বললে হালকা হয়ে যাবো।এখন নিজেকে ভারী ভারী লাগছে।
-তা না হয় লাগছে।কিন্তু আমাকে আপনি সুখ বলছেন কেন?সুখ তো কোন বস্তু নয়,অনুভুতি মাত্র।বার্টান্ড রাসেলের সুখে লেখা আছে,"মানুষ যা অনুভব করতে পছন্দ করে তাই সুখ।যা সে তার চোখের দৃষ্টিতে সংগ্রহ করে থাকে।
-তুমি বরাবরই কেমন দার্শনিকের মত কথা বলছো!দর্শনের বাইরে কি মানুষের চিন্তা থাকে না? আমি সাহিত্য পড়াই,দর্শন অতো ভালো বুঝি নে।
শুধু এটুকু বুঝেছি যে, তুমি আমার কুড়ি্য়ে পাওয়া সুখ।
-আমি? আর কোন কথা বলতে পারে না কমল।
দুজনেই নীরব।স্তব্ধ।দুহাত দুরের কোন প্রানীও বুঝতে পারবে না যে এখানে কেউ জীবিত আছে।শুধু দুজনেই অনুভব করছে এক একজনের হৃদস্পন্দন।
ঘরে আলো আসছে।হঠাৎ কমল চোখ খুললো। আশ্চর্য! ম্যাম তার মুখের দিকে এমন অপলক তাকিয়ে আছে?তার দুচোখের মনির কোন সামণ্জস্য নেই।এই মুহুর্তে নিজেকে অবোধ শিশু বলে মনে হচ্ছে।নিজেকে গুটিয়ে হাত-পা মুড়িয়ে বুকের মধ্যে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করছে।
আচমকা ম্যাম বলে উঠলো,
-কমল;
-হুম;
-চোখ বন্ধ কর।
কমল একটু অপ্রস্তুত হয়ে,
-কেন?
আর কোন কথা না বলে ম্যাম আলতো করে হাত ছোঁয়ালো চোখে।কমল কোন প্রতিবাদ করতে পারলো না।সংকুচিত এক শিহরনে দুলে উঠল কমল।তারপর সে বুঝতে পারল ম্যামের এলোচুলে তার মুখ ঢেকে গেছে।কিছুক্ষন পর ঝুকে পড়ে ম্যাম ঠোট ছোঁয়ালো কমলের কপালে।ভেজা ঠোট।কেমন থরথরে।তবে বেশ উত্তপ্ত। শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় অসম্ভব ঝড়বেগে বয়ে যাওয়া অপ্রতিরোধ্য এক শিহরণ অনুভব করলো।এমনকি গুলি লাগা বিক্ষত অবশ হয়ে যাওয়া হাতেও এক ধরনের শিহরণ,শক্তি খুজে পেল কমল।ঠোট জোড়া আরও দৃঢ় হচ্ছে যেন।মনে হচ্ছে, মস্ত বড় এক জোক শরীরের সমস্ত শুষে নেওয়ার জন্য লেগে আছে।আরও কঠীনভাবে ঠোট চেপে ধরে ম্যাম।ম্যামকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছ করছে।কিন্তু............................?
একটা সংকোচ রয়েই গেল।বুভুক্ষ রাক্ষসীর পেটপুর্তি রক্তাহারের মত পুর্ণতৃপ্তি নিয়ে এক ঝটকায় মাথা উচু করলো রজনী ম্যাম।স্থীর,স্ট্যাচুর মত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো কমল আর ম্যাম।
হঠাৎ অতি ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলো ম্যাম........
-কমল।
উত্তর দেবে কিনা ভাবছে কমল।ম্যাম আবার ডাকলো.........,
-কমল?
-উম?কোন রকম শব্দ হল মাত্র..
-আপাতত কোন প্রশ্ন করবে না তুমি।ম্যামের কন্ঠ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে।কমল বুঝতে পারলো ম্যামের সারা শরীর কাঁপছে।
-কেন?
-আমি বলেছি কোন প্রশ্ন করবে না।
-ঠিক আছে।
ম্যাডাম উঠে দাড়ালো।মাথার নিচে বালিশটা টেনে দিয়ে আবার পাশে এসে হাত দিয়ে কপাল ছুঁয়ে দেখলো।ঝুকে পড়ে বুকের সাথে বুক মিশিয়ে চোখে চোখ রাখলো ম্যাম।কমল বুঝতে পারছে না, কেন এসব হচ্ছে?সুঠাম টলমলে স্তনজোড়া হালকা ভরে ছুঁয়ে আছে কমলের বুক।ঠোটের অনেকটা কাছাকাছি ঠোট নিয়ে কপাল ছুয়ে বলল,
-এই জায়গাটা আমার।আমাকে কথা দাও,(একটু থেমে)এটার অধীকার আর কাউকে দেবে না কখনো।তোমার এই একটা জিনিস আমার হয়ে থাকবে।
কমল কোন কিছু না বুঝেই আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,
-হু।
ম্যাম আলতো করে নাকের ডগা স্পর্ষ করে বলল,
-শুধু শুধু স্বার্থপরের মত তোমার একটি রাতকে নষ্ট করলাম।
-না।নষ্ট হবে কেন?আমি রাতে বেশি ঘুমাই না।দুই এক ঘন্টা হলেই কিংবা না হলেও........
কথাটা শেষ হবার আগেই ম্যাম থামিয়ে দিলো,
-উহু,আমি তোমাকে অনেক বেশি জানি।বোধহয় উপস্থিত সবকিছুই।যদিও সঠিক নাও হতে পারে।না--আর কথা নয়।
আবার কপালের ঠিক একই জায়গায় চুমু খেলো।আগের মত গভীর নয়,বেশ হালকা।উঠে দাড়িয়ে শুধু বলল,
-চেষ্টা কর।
তারপর ক্ষীণ পায়ে চলে গেল ঘরের বাইরে।কেমন যেন বুকের একটা জায়গা খট করে উঠলো।তার সারা শরীরই এখন অবশ হয়ে আছে।দুচোখ শুধু নির্লিপ্তের মত তাকিয়ে আছে ম্যামের চলে যাওয়া পথে।ম্যাম বাইরে চলে গেছে।চোখের আড়ালে.......................................
তারপর..................................
২
আজ আকাশ হালকা মেঘাচ্ছন্ন।বিকেল থেকেই পশ্চিম দিকটা্য মেঘের জমাট বাধাঁ ভেলা স্থীর হয়ে আছে।বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা সেই কখন থেকে হালকা শীতল বাতাসে ভেসে বেরাচ্ছে।ঝড়ও আসতে পারে।তাতে কি যায় আসে?অনেকদিন থেকেই যাই যাই করে কেষ্টনগর চরের দিকে যাওয়া হয়নি কমলের।এরমধ্যে কোরবানীর ঈদ চলে গেছে বেশ কয়েকদিন হল।এ কয়দিনে রজনীর কোন খোজ খবর নেয়া হয় নি।দুদিন আগে বাজারের দোকানদার ফারুকের কাছে বলে গেছে জরুরী দেখা করতে।সম্ভবত খুব বেশী গুরুত্বপুর্ন। সাধারনত কোন বিষয়েই মানুষকে অনুরোধ করতে দেখা যায় না।এটা তার চরিত্রের বড় দোষ কিংবা গুনও হতে পারে।সকালেই কমল ঠিক করেছে আজ সে রজনীদের বাড়িতে যাবে।আজ বহঃস্পতিবার।পার্টির সাপ্তাহিক মিটিং।সকালে শীকদার আসলাম ডাকতে এলে কমল তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে সে আজকের মিটিংয়ে থাকতে পারবে না।এ নিয়ে মাথা ব্যাথাও নেই তেমন একটা।মিটিংয়ের সববিষয়ই টাইগার আজিজ সময়মত বুঝিয়ে দেবে।টাইগার আজিজের কথা মনে পড়তেই নিজের মধ্যে আলাদা একটা সুখেরর আবেশ অনুভব করল কমল।যাকে সে নানা বলে ডাকে।নানা থাকতে তার কখনো চিন্তা করতে হবে না।সেকেন্ড ইন কমান্ড টাইগার আজিজ।
হাটতে হাটতে এসে বটতলার মোড়ে দাড়ালো কমল।তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার হাটতে শুরু করেছে।বেশ খানিকটা পথ।তারপর নৌকা।হালকা বাতাসে নৌকা হেলেদুলে এগিয়ে যাচ্ছে কেষ্টনগর(চর)ঘাটের দিকে।পদ্মানদীর মাঝখানে অনেক বড় একটা দ্বীপ এই কেষ্টনগর চর।চারপাশে শুধু বালু আর বালু।পদ্মানদীর এই বিশালাকার বালু দ্বীপের মাঝেই হাজারো মানুষের বাস।হাজারো ঘরবাড়ি।ছোট ছোট ঘরবাড়ির মাঝে মাঝে দুএকটা বেশ বড় বাড়ি।এদের মধ্যে ঘাটের নেমে প্রথম যে বাড়িটা চোখে পড়ে সেটা রজনীদের।বেশ বড় বাড়ি।বাড়িতে অনেকগুলো টিনের ঘর।নৌকা থেকে নেমে কমল আস্তে আস্তে রজনিদের বাড়ির দিকে হাটতে থাকে।ঠিক বাড়ির মধ্যে ঢোকার মুখে আড়াল থেকে ভুতের মত সামনে এসে দাড়ায় রজনী_
-দাড়াও।ভেতরে যাবার দরকার নেই।
-কিন্তু?
এখন আর অবাক হয় না কমল।সে বেশ বুঝে গেছে,রজনীর আড়ালে তার পক্ষে আর কোনকিছু করা সম্ভব নয়।এমনকি ভাননাগুলোও রজনী জেনে যায় ঠিক ছায়ার মত।হাত ধরে টানতে থাকে রজনী...
-উফ!আমি জানি তুমি আসতেছ। চল বাইরে বসি।কোথায় বসবে? বাড়ির পেছনে নাকি নদীর পাড়ে?না পেছনে নয়,চল নদীর পাড়ে বসি।
একপা এগুতেই হঠাৎ থমকে দাড়ালো রজনী।
-একটু দাড়াও,আমি ভেতর থেকে আসছি।
-কেন? অবাক হয়ে জিগ্যেস করে কমল।
কোন জবাব না দিয়ে চলে গেল রজনী।কয়েকমুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে মৃদু উচ্ছাসে বা হাতে কমলের কোমড় জড়িয়ে ধরে নদীর পাড়ে এসে বসলো।কত বাজে এখন?রাত ১০ কি ১১ টা হবে হয়তো।কিন্তু কোন মানুষের সাড়া শব্দ নেই কোথাও।আসবেও না।কমল এইজায়গাটাতে অনেকবার এসেছে।কোনদিন রাত ৯ টার পড়ে কোন মানুষের দেখা পায় নি।নদী পাড়ের ঢালুতে রজনী কমলকে ঠিক সামনে বিচারাধীন অপরাধীর মত হাটু মুড়ে বসালো।তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
-চোখ বন্ধ কর।
-কপালে তো?
-যা বলছি শোন।
কমল চোখজোড়া বন্ধ করতই রজনী মুখের সাথে মুখ লাগালো।কমল ঠোটের মধ্যে কিছু একটা অনুভব করতেই মুখগহ্বরে চালান করে দিল।চোখ খুলে জিগ্যেস করলো
-কি এটা?
-কোরবানীর গোস্ত।
-কোরবানীর গোস্ত?কমল অবাক হয়।আবারও জিগ্যেস করে
-সে তো এক কি দেড় মাস হয়ে গেছে!
-হুম,আমি শুকিয়ে রেখে প্রতিদিন একবার করে ভেজে রেখেছিলাম।নষ্ট হতে দেই নি।
-ওহ্,তাহলে এজন্যেই কি আসতে বলা?
-কথা বোল না।খাও।সময় কম।
-সময় কম?মানে?
-হ্যাঁ।একটু পরেই ডাকতে আসবে।
-কে?
হঠাৎ করে পেছন থেকে ডেকে উঠলো,
-আম্মা আমি কি আসব?
-না।যাও,বলো আধঘন্টা অপেক্ষা করতে।আমি পাঠিয়ে দেবো।
কমল পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখল কমান্ডার কুদ্দুসের ছোট ভাই ওমর তাকে ডাকতে এসেছে।কমল এর আগেই জেনে গেছে পার্টিতে একজন অজানা মহিলা উপদেষ্টা ও লিডার আছে।আর সেই অজানা মহিলা লিডার হল এই রজনী।তারমানে আজকের মিটিংটা এখানেই হচ্ছ।কমলের খাওয়া শেষ হতেই রজনী বলল,
-তোমাকে যেতে হবে।আজকের মিটিংয়ে তোমাকে নতুন দায়ীত্ব দেওয়া হতে পারে।তুমি কিছুদিনের জন্য বাইরে চলে যাচ্ছ।দেখা হবে না।বাইরে গেলে তুমি সিগারেট বেশি খাও।এবার দয়াকরে একটু কম খেও।
-বাইরে?কোথায়?
-কুমারখালী।গড়াই নদীর চরে।জায়গার নাম সোনাপুর চর।চরের মাঝে ছন্নছাড়া মানুষগুলো হাড়ভাংগা পরিশ্রমে উৎপন্ন ফসল ঘরে নিতে পারে না।নদীর দুইপারের জেলা-উপজেলার বড় বড় নেতারা জবড় দখল করে খায়।ঐ সকল উদ্বাস্তুদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা মানে দখল নিতে হবে।ওই সকল নেতারা যাতে এদের উচ্ছেদ করতে না পারে সে দিকে কিছুদিন খেয়াল রাখতে হবে।শোন,ওদের নুন্যতম একটা ব্যবস্থা করে এসো।
-পুরো দায়ীত্বটা কি আমাকে নিতে হবে?
-তোমার সহকারিরা তোমার সাথে থাকবে।
-আমি সে কথা বলি নি।
-তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
-না।
-মনে কর তাই।
কমল উঠে দাড়ালো।পায়ে পা দিয়ে রজনী দাড়িয়ে দুহাতে কমলকে জড়িয়ে ধরে।আলতো করে পা দিয়ে কমলের পায়ে ঘষে দেয়।কমলের ২৪ বছরের জিবনে এটুকুই তার শারীরিক সম্পর্কের কিংবা প্রাকিতিক সুখের সর্বচ্চমাত্রা।তাই কমল এটাকে পৃথিবীর সর্বচ্চ সুখ মনে করে।আরও অনেকবার মিটিংয়ের মধ্যে কিংবা রাস্তার ভীড়ে এরকম সুখের আবেশে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে।সেও ঐ রজনির দয়ায়। কমল মাথা নিচু করতেই কপালে চুমু খেলো রজনী
-যাও কমরেড।ফিরে এসো বীরের বেশে।
চোখের উপর চোখ তুললো কমল,
-কি? একটু থেমে, আমার জমির দখল রেখো।বলেই নির্লিপ্ত চাপা একটা হাসি দিল রজনী।কমল আশ্চর্য হল।ম্ত্যুকূপে আপনাকে ঠেলে দিয়ে কোন মানুষ এমন হাসতে পারে?
কমরেড শব্দটা মাথার মধ্যে ঘুরছে।রজনীর মুখে শব্দটা প্রথোম শুনলো কমল।যদিও অনেকেরের মুখে শুনেছে।এলাইনের দ্বীতিয়তম অপারেশন "বিদ্যুৎ সংকট" এর লিডার সেকেন্ড ইন কমান্ড টাইগার আজীজ উচ্চস্বরে প্রকাশ করেছিলো 'কমরেড কমল'।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ৯:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




