★যে গল্পের কোন নাম নেই★
#জাকারিয়া_জ্যাক
_______________
বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে মারুফ। একমাত্র ছেলে হলে সাধারণত বখাটে হয়ে যায় কিন্তু মারুফ একটা আদর্শ ছেলে। লেখাপড়ায়ও ভাল। এস.এস.সি ও এইচ.এস.সিতে আশাতীত ভাল রেজাল্ট করে বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বাবা ডাক্তার আর মা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সবমিলিয়ে সুন্দর ও সুখী পরিবার। নভেম্বরের ঊনিশ তারিখে মারুফের বিশ বছর পূর্ণ হল। এবারের জন্মদিনের পার্টি তার বাড়িতে করে নি। বন্ধুদের সাথে একটা রেস্টুরেন্টে পার্টি করেছে। পার্টিতে অনেক মজা হয়েছে-এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পার্টি শেষে বাসায় ফিরে মারুফের মনে পড়ল যে সে পার্টির ছবিগুলো না এনেই চলে এসেছে। সে তার বন্ধু রাকিবকে ফোন দিয়ে তার ইমেইলে ছবিগুলো দিতে বলল। এরপর বাবা-মায়ের সাথে ডিনার করতে গেল মারুফ।
ডিনার শেষে মারুফ ফেসবুকে বসল। আর ইমেইল থেকে ছবিগুলো ডাউনলোড করে সেভ করে রাখতে গিয়ে লক্ষ করল, তাদের প্রত্যেকটা ছবির পিছনে একটা লোক দাঁড়িয়ে। শুধু দাঁড়িয়ে না, লোকটা মারুফের দিকে কেমন যেন কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কৌতূহল বশত সে তার ফ্রেন্ড রাকিবকে ফোন দিয়ে লোকটার কথা বলল। রাকিব ছবিগুলো দেখে বলল যে সে লোকটাকে চিনে না। অন্য যে বন্ধুরা ছিল, তারাও একই জবাব দিল। অগত্যা মারুফ কী মনে করে আগের ছবিগুলো দেখল। সেখানেও সেই একই লোকের উপস্থিতি। মারুফ বুঝতে পারছে না যে এই লোক তার পিছনে লেগেছে কি না। বর্তমানে আতঙ্কবাদীদের অভাব নেই। কিন্তু তার সাথে এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। রাত একটা বাজে। এতরাতে বাবামাকে ডেকে তোলার প্রশ্নই ওঠে না। আর ডেকে তুলেই বা কী হবে? টেনশনে মারুফ সারারাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারে নাই। জীবনের প্রথম নির্ঘুম রাতের কারণ এক অচেনা বয়স্ক লোক যার চেহারায় সাত জনমের প্রশ্ন।
পরদিন সকালে মারুফ ভার্সিটিতে যায়নি। তার মা স্কুলে যাওয়ার আগে ডাকেননি কারণ তিনি ভেবেছেন যে মারুফ হয়তো ক্লান্ত হয়েছে পার্টি করে।আর ছেলেও বড় হয়েছে। নিজের খেয়ালখুশিমত চললে বাঁধা দেয়া উচিৎ না। আর মারুফের উপর ভরসা করা যায়। সারারাতে না ঘুমিয়ে সকালের দিকে মারুফের তন্দ্রার মত এল। দশটার দিকে রাকিবের ফোন।
-কই তুই?
-বাসায়।
ভার্সিটিতে আসবি না?
-না, তুই একটু বাসায় আসতে পারবি?
-কোন সমস্যা?
-হুম।
-ওকে, আমি আসছি। বলেই রাকিব ফোন কেটে দিল। মারুফের ব্রেকফাস্ট করতে ইচ্ছে করছে না। তারপরও সে চা বানাতে গেল।
বিশ মিনিটের মধ্যে রাকিব হাজির।
-আঙ্কল, আন্টি বাসায় নেই?
-না, চা নে।
চায়ে লম্বা করে চুমুক দিয়ে রাকিব জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রে? তোকে দেখে মনে হচ্ছে ঘুম কম হয়েছে। চোখ ফোলা ও কটকটে লাল। ব্যাপার কী?
-এত ব্যস্ত হোস না। বলছি।
মারুফ বুঝতে পারছে না, কিভাবে শুরু করবে।
-তোকে রাতে লোকটার কথা বলেছিলাম না...
-তুই এখনো এই ব্যাপারটা নিয়ে পড়ে আছিস? আরে ইয়ার, রাস্তাঘাটে কত লোক থাকে, ছবি তুললে মাঝেমাঝে তারাও ক্যামেরাবন্দি হয়। এটা নিয়ে এত টেনশন করার কী আছে?
-আমার ল্যাপটপটা অন কর। দেখ, আমাদের প্রত্যেকটা প্রোগ্রামের ছবিগুলো।
রাকিব ল্যাপটপ অন করে ছবি দেখছে। গত এক বছরের প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানের ছবিতে লোকটা আছে। রাকিব বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে বলল, হাউ ইজ ইট পসিবল?
-আমিও তো বুঝতে পারছি না। চল এককাজ করি। লোকটাকে খুঁজে বের করি।
-তোর মাথা খারাপ? ঢাকা সিটিতে এককোটিরও বেশি লোক আছে। এর মধ্য থেকে জীর্ণশীর্ণ এক বয়স্ক লোককে খুঁজে বের করা অসম্ভব।
-মোটেই অসম্ভব নয়। দেখ, আমরা গত এক বছরে যেখানে যেখানে ছবি তুলেছি, তা জানি। সেই জায়গাগুলোতে খুঁজলে পাওয়া যাবে। আর আমার মনে হয়, লোকটা আমাকে ফলো করছে। যে ছবিতে আমি আছি, সেই ছবিতে এই লোকটা আছে।
-তাতে কী প্রমাণ হয়?
-আমি নিশ্চিত লোকটা আমাকে ফলো করছে।
-আঙ্কল-আন্টিকে জানিয়েছিস?
-না। আপাতত জানাবো না। চল, আজকেই বের হয়ে পড়ি।
মারুফের পিড়াপিড়িতে রাকিব অনিচ্ছাসত্ত্বেও বের হল। কয়েকটা যায়গায় তারা খুঁজল। কিন্তু কোথাও পেল না। আর পাওয়ার কথাও না। সন্ধ্যায় সে ঘর অন্ধকার করে বসে আছে। তার মা এসে বলল, কী হয়েছে রে? তুই ঘর অন্ধকার করে বসে আছিস কেন?
-কিছু হয়নি মা, এমনিতেই ভাল লাগছে না। মারুফের মা লাইট অন করলেন। ছেলের পাশে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, তুই আমার কাছে না বললে কার কাছে বলবি? চল, ছাদে গিয়ে চা খেতে খেতে তোর মন খারাপের গল্প শুনি। মাফলার নিয়ে আসিস। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা।
মারুফের মা ফ্লাস্ক আর দুইটা মগ নিয়ে ছাদে এসেছেন। মারুফ আসেনি। তাঁর অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। কারণ শিক্ষিকা হওয়ার কারণে তিনি সবাইকে ভাল বুঝাতে পারেন, মোটিভেট করতে পারেন। হয়তো ছেলের মন খারাপের কথা শুনে হেসেহেসে তার সহজ ব্যাখ্যা দিবেন। মারুফ মাফলার হাতে নিয়ে ছাদে এসে পৌঁছেছে।
মগে চা ঢালতে ঢালতে মারুফের মা বললেন, কী এমন কারণ ঘটেছে যা আমার ছেলের মন খারাপ করে দিয়েছে? কোন মেয়েলী ব্যাপার?
-না, মা। তুমি তো জান, আমি কোন মেয়েলী ব্যাপারে জড়াই না। সারাজীবন লেখাপড়া নিয়ে পড়ে আছি।
-হুম। দেখ, এই বয়সে এরকম হতে পারে।
-সেরকম কিছু না, মা। ব্যাপারটা ভিন্ন।
চায়েরকাপ নামিয়ে মারুফের মা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন ব্যাপার?
-গত একবছর ধরে একটা লোক আমাকে ফলো করছে। বয়স্ক এক লোক।
-তুই কিভাবে বুঝলি যে লোকটা তোকে ফলো করছে?
-গত একবছরে আমি ফ্রেন্ডসদের সাথে যতগুলো ছবি তুলেছি, প্রত্যেকটা ছবিতে এই লোকটা উপস্থিত।
অনেক কষ্টে হাসি চেপে মারুফের মা বললেন, তাতেই তুই ধরে নিচ্ছিস যে লোকটা তোকে ফলো করছে?
-তুমি যদি ছবিগুলো দেখ, তাহলেই বুঝতে পারবে।
-চল, ছবি দেখি।
মারুফ ল্যাপটপ অন করে মাকে ছবি দেখালো। ছবি দেখে তিনি থ হয়ে গেলেন। মারুফ বুঝতে পারল যে কোন কারণে তার মা শক খেয়েছেন। মারুফ বলল, কী হয়েছে মা?
-কিছু না। তোর বাবা কখন আসবে?
-রাত দশটার দিকে।
-ও।
মারুফের মা উঠে চলে গেলেন। তিনি দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। মারুফের মনে হচ্ছে, এই লোকটা একটা ভাইরাস। নাহলে যে দেখে সেই চিন্তিত হয়ে যায় কেন?
দশটার দিকে মারুফের বাবা আরমান সাহেব বাসায় এলেন। আজ বাসার অবস্থা কেমন যেন থমথমে। মারুফ ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার মাও অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে।
আরমান সাহেব লাইট অন করলেন। তার স্ত্রীর মাথার কাছে এসে আস্তে করে ডাকলেন, জরী। এই নামটা তিনি দিয়েছিলেন আর তিনিই ডাকেন এই নামে।
জরী উঠল।
-কী হয়েছে? দুজনেই ঘর অন্ধকার করে আছ?
জরী কিছু বলল না। উঠে বাথরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ডিনার রেডি করলেন। আরমান সাহেব বুঝতে পারছেন না যে ঘটনা কী।
খাবার টেবিলে টুকটাক গল্প হয়। আজ কেউ কোন কথা বলছে না। জরী কিছুই খেল না। মারুফ নিঃশব্দে খেল। খাওয়া শেষে আরমান সাহেব জরীকে বললেন, কী হয়েছে বল তো?
-লোকটা ফিরে এসেছে।
-কোন লোকটা?
-যে লোকটার আগমন সমসময় আমার জন্য ভয়ের ছিল।
-মারুফ কি জানে?
-লোকটা মারুফকে ফলো করছে। মারুফের প্রত্যেকটা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে লোকটা আছে।
-তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, জরী। আমার আরও আগেই তোমাকে বলা উচিৎ ছিল।
আতঙ্কের পরিমাণ বেড়ে গেছে জরীর। তাহলে কি বিশ বছরের লালিত স্বপ্নের অচিরেই অবসান হবে?
কাঁপা কাঁপা গলায় জরী জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা?
আরমান সাহেব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, একবছর আগে লোকটা আমার অফিসে এসেছিল। আমি তাকে কিছু টাকা দিয়েছিলাম জোর করে। সে শুধু একটা দাবী রাখল যা সে একবছর ধরে করে আসছে। আমার মনে হয় মারুফের সাথে এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিৎ। তুমি কী বল?
জরী কোন কথা বললেন না। খোলা জানালায় তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। আরমান সাহেব মারুফকে ডাকলেন। সে তার মায়ের গা ঘেঁষে বসল। মারফ আঁচ করতে পারছে যে তার বাবার বক্তব্য কী হতে পারে।
-তোমাকে আজ কিছু কথা বলার দরকার। তুমি হয়তো কোন মানসিক চাপে আছ। কথাগুলো তোমার মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধরে নিতে পার।
এটুকু বলে আরমান সাহেব থামলেন। তিনি আশা করলেন, মারুফ কিছু একটা বলুক। কিন্তু মারুফ কিছু বলল না। সে শুধু তার মায়ের হাতটা সজোরে চেপে ধরল।
-আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের কথা। তোমার মা তখন প্রেগন্যান্ট। আমরা খুবই আশাবাদী ছিলাম যে আমাদের একটা ফুটফুটে বাচ্চা হবে। আমি আর তোমার মা লং ড্রাইভে ঢাকার বাইরে যাই। তখন আমাদের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়। আমরা দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। স্থানীয় লোকজন আমাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তুমি বুঝতেই পারছ, আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন মরে যায়। তোমার মায়ের গর্ভের সন্তানের অ্যাবনরমাল অ্যাবর্শন হয়। আর তোমার মা সন্তান ধারন করার ক্ষমতা হারায়। অনেকটা সিনেমাটিক ঘটনা। তুমি কি এটা বুঝতে পারছ, ঐ মুহূর্তে তোমার মায়ের কী অবস্থা ছিল?
মারফ মাথা নেড়ে সায় দিল কিন্তু কোন কথা বলল না।
-ঠিক সেইসময় একটা লোকের খবর পত্রিকায় পড়লাম। যে তার স্ত্রীর খুনের দায়ে জেলে যাচ্ছে। তাদের দুইমাসের একটা বাচ্চা আছে। লোকটা খুনি ছিল না। মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গিয়েছিল। আর সত্য মামলা থেকে মিথ্যা মামলা শক্ত হয়। লোকটার যাবজ্জীবন জেল হয়। আমরা সেই লোকের ছেলেটাকে দত্তক নেই। তুমি কি বুঝতে পারছ সেই ছেলেটা কে?
মারুফ কথা বলল না।
-তুমিই সেই ছেলে। তোমাকে আমরা কখনো অন্যের সন্তান মনে করিনি।
মারফ বলল, বাবা। আমি তোমাদের বাবামা বলেই জানি। এর বেশি কিছু জানতে চাই না। শুধু একটা কথা, আমি সেই লোকটাকে সামনাসামনি একবার দেখতে চাই। ব্যবস্থা করবে?
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
এরপর আরমান সাহেব কয়েকদিন লোকটাকে খুঁজল। কিন্তু লোকটাকে আর পাওয়া গেল না। মারুফ এখন আর কোন ছবি তুলে না, যদি ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে লোকটাকে দেখা যায়- এই ভয়ে। হয়তো নতুন এই মায়ায় সে নিজেকে জড়াতে চায় না।