আমি আসলে কোন কিছুই আটকাতে পারিনা।
বাল্যকালে বন্ধুরা সবাই ঝিঝিপোকা ধরতো। নারিকেলের আইচা একটার সাথে আরেকটা ঘষলে একটা খসখসে শব্দ হয় যার আকর্ষনে ঝিঝি পোকারা ধরা দেয়। ছেলেরা যখন একের পর ঝিঝি পোকা ধরতো, পেটের মাঝখানে চাপা দিয়ে ঝিঝিঝিঝিঝি শব্দ বের করতো, আমি তখন তাদের দেখতাম।হিংসা করতাম। ভাবতাম কেন তারা পারে আর আমি পারিনা। সেই ভাবা আমার কোনদিনই শেষ হয়নি। আর সারাজীবনে আমি একটি ঝিঝি পোকাও ধরতে পারিনি।
বিকেলে যেখানে ক্রিকেট খেলতাম সেই মাঠে প্রচুর ফড়িং ছিল। হেলিকপ্টারের মত দেখতে। ছেলেরা খেলার ফাকে ফাকে ফড়িং ধরতো। পা টিপে টিপে কাছে গিয়ে ফড়িংটা বোঝার আগেই দুই হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেলতো। তার পরে পাখা ছিড়ে ছেড়ে দিত। পাখাহীন ফড়িং নিরন্তর ব্যর্থ চেষ্টা করতো পালিয়ে যেতে। তার প্রলম্বিত ছটফটানি ছেলেদের আনন্দকে দীর্ঘায়িত করতো, পালাতে সে পারতোনা। আমি সারাজীবন অন্যের ফড়িং ধরাই দেখে গেলাম। আমি যতবারই যত পা টিপে টিপেই যাই না কেন কি করে যেন তারা টের পেয়ে যেত। আমার আর ফড়িং ধরা হয় নি।
ধানকাটা হয়ে গেলে মাঠের ভেতরে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো। কার ঘুড়ি কে কাটতে পারে তা নিয়ে প্রবল উত্তেজনা। মাঝে মাঝে ঘোষনা দিয়ে ম্যাচ। দুবাই ওয়ালা বনাম সৌদি ওয়ালা। বাজার থেকে দামী সুতো কেনা হতো, সেই সুতায় মাখা হতো কাচের গুড়ো। আমরা ছোটরা অপেক্ষায় থাকতাম কখন কার ঘুড়ি কেটে যায়। তারপর দৌড়ে সেই সুতোসহ ঘুড়ি ধরতাম। যে ধরতে পারে তার সুতোসহ ঘুড়ি। সারাজীবনে আমার মাথার উপর দিয়ে, কাধের পাশ দিয়ে কত সুতো ভাসতে ভাসতে চলে গেল ধরতে আর পারলাম কই। একজন শিখিয়ে দিয়েছিল সবসময় অপরের জন্যে দোয়া করবি তাহলে দেখবি আল্লাহ তোর ইচ্ছা মিটিয়ে দিয়েছে, তার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শুধু অন্যের জন্যে প্রার্থনা করে গেলাম, তারাই ঘুড়িগুলো নিয়ে গেল। আমার জন্যে হয়তোবা কেউ প্রার্থনা করে নি। এ কারনে আমারও আর একটা সুতাসহ ঘুড়ি আটকানো হলোনা।
আরো বড় হয়ে সবাই আরো দুরন্ত হয়ে গেল। কচুরীপানা আর মোতরার ঝোপের আড়ালে হঠাৎ করে যদিবা একটা ডাহুক দেখা যেত অমনি হৈ হৈ করে ঢিল ছুড়ে পেছন পেছন মাইলের পর মাইল দৌড়ে তাকে ধরে আনা হতো। তারপরে সবাই মিলে চাদা দিয়ে সেটা দিয়ে খিচুড়ী রান্না হতো। সেই খিচুড়ী খাওয়ার জন্যে সবসময় আমাকে দ্বিগুন চাদা দিতে হতো। কারন ডাহুক ধরায় আমার যে কোন অবদান থাকতোনা। থাকবেই বা কি করে? আমি যে কিছু মায়ায় ভুলাতে পারিনা।
এইভাবে আমার জীবন ধরতে না পারার এক বিশাল মিলনমেলায় রুপান্তরিত হল। আমি কিছুই ধরতে পারিনা। সেটা হোক বড়শী ফেলে মাছ কিংবা বন্ধুদের ছুড়ে দেয়া বল। সব হাতের ফাক গলে ফস্কে বেরিয়ে যায়। ধরতে পারিনা।
একসময় আমার স্বপ্ন বেড়ে গেল।
আমি রিমিকে ধরতে গেলাম। আমার হাতে আসার আগেই মাঝপথে কেউ একজন তাকে ছো মেরে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল।
আমার আর তাকে ধরা হলোনা।
সারাজীবনভর সব আকাংখিত সব বস্তু আমার কাছে অধরাই থেকে গেল।
একজীবন কেটে গেল ধরতে না পেরে, এক হৃদয় ভেঙ্গে গেল রিমিকে হারিয়ে।
(রাসেলের ডাইরি থেকে)