আজ আমাদের বিজয় মাসের প্রথম দিন। ৭১ এর সেই দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী কালো রাত্রিময় রক্তাক্ত দিনগুলোতে ডিসেম্বর আমাদের জন্য একটি আলোকময় সম্ভাবনা এনে দিয়েছিল। সেই সম্ভাবনা আমাদের বাঙালীর জীবনে মুক্তির আলোর পরিপূর্ণতা দিয়ে, পূণ্যতা দিয়ে এবং অমূল্য সাফল্য দিয়ে জন্ম দিয়েছিল একটি শান্তির পায়রা, ১৬ই ডিসেম্বর, আমাদের গৌরবময় বিজয় দিবস।
আজ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিনা কিভাবে আমরা সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছি। হঁ্যা, সহ্য করেই তো চলেছি। নয়তো এতো এতো নিরিহ মানুষের আগুনে দগ্ধে, ঝলসে বিভৎস মৃত্যু, অসহনীয় যন্ত্রনা, মানুষের বুকভাঙা হাহাকার, হাজারো শিশুর জীবনের স্থায়ী অনিশ্চয়তা, হাজারো পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ তার সাথে প্রিয় দেশটার সর্বাঙ্গজুড়ে যে ক্ষত তৈরী হচ্ছে, যে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে তা কেবল দেখে যাচ্ছি কি করে! কিভাবে আমরা প্রতিদিন এইসব ভয়াবহতা নিয়েও খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, হাসি-কান্নায় সাধারণ থেকে যাচ্ছি! মানুষ ক'টা দিনই বা বাঁচে, মানুষের জীবনতো কচ্ছপের মত দীর্ঘ নয়। এই ছোট্ট জীবনে নিজের দেশে, এই সোনার বাংলাতেই একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই। নিশ্চিন্তে নিরাপদে ঘুমোতে চাই আমরা।
আমাদের প্রাণপ্রিয় অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অভিভাবকেরা মহানন্দে আমাদের প্রাণ নিয়ে খেলে যাচ্ছেন। মেতে উঠেছেন বারুদ খেলায়, অগ্নিখেলায় আর রক্ত খেলায় কেবল ক্ষমতার হীরকক্ষন্ড হাতে পাবার লালসায়! তাঁরা আমাদের যত্ন করেই ঢাল বানিয়ে রেখেছেন সেইসব লালসায় সফল হবার জন্যে, পরবর্তিতে ও বারবার বহুবার ব্যবহারের সুযোগ পাবেন বলে। আমরা মস্তিষ্কসম্পন্ন বিবেকবান দামী ঢাল তাঁদের। নিজেদের জীবন ক্ষত-বিক্ষত বা নিঃশেষ করে হলেও তাঁদের লোলুপ চকচকে জীবন বাঁচিয়ে চলেছি প্রতিদিন...! এমনটা কি দীর্ঘ হতে পারে? না, তবে তো ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ আর ....... আসতো না আমাদের জীবনে।
আমি বিশ্বাস করি, আমি অনুভব করি ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন তারুণ্যের আগ্নেয়গীরি টগবগ করে ফুটছে। আমাদের এই তারুণ্যের অগ্নুৎপাতের ছিটে-ফোঁটা কেবল দেখতে পেয়েছে বাংলার মানুষ এবং সারাটা পৃথিবী এই গেল ফেব্রুয়ারীতে। বড় অগ্নুৎপাতটি খুব বেশী দূরে নয়। আর যাই হোক, স্বদেশ, জাতীয় স্বার্থ, মানুষ আর মানবিকতা নিয়ে ছেলেখেলা তরুণরা বেশীদিন সইবে না। আর সত্যিকারের তারুণ্য বিক্রী হয়ে যায় না, তাকে গায়ের জোরে বিকৃত করাও যায় না- ঠিক যেমন ইতিহাস। ইতিহাস বিকৃত করার নোংরা যুদ্ধের পরিণাম বরাবরই লজ্জাষ্কর এবং মর্মান্তিক হয়। হাজার দহনে ইতিহাস কেবল সর্বোচ্চ শক্তিরই সত্য জায়গাটিই নিশ্চিত করে।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, অনুভব করতে চাই, ভেতরে ভেতরে কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই শান্তির পায়রারা জন্ম নিচ্ছে একের পর এক। ডানায় খানিকটা সময়ের জোর পেলেই উড়বে নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে খুব কাছাকাছি একদিন। দুর্যোগময় এবং বেদনার রাত যত দীর্ঘই হোক, তা ফুরোবেই। আমরা আবারও আলোকময় হবো, উজ্জল হবো, বিশ্বময় প্রকাশিত হবো ১৯৭১ এর সেই দিনটির মত। আমাদের বিজয়ের সেই ১৬ই ডিসেম্বরের মতই। মানুষের জয় হবেই। মানবতার জয় হবেই।