সেই সাতসকাল থেকে সাতরঙা প্রজাপতির পিছনে ছুটতে ছুটতে যখন রোদেলা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো, সেই বিকেলটা ও যখন পাট চুকিয়ে সন্ধ্যের কোলে আশ্রয় নিতো চুপিসারে- আমি তখন মায়ের কোলে মাথা রেখে দুর্বার বেগে পঙ্খীরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে, সবুজ ঘাসের মাস্তুল ছুঁয়ে চলে যেতাম সাত সমুদ্র তের নদীর ওপাড়ের অচিন দেশে রাজকন্যা উদ্ধারে। অবশেষে আজ এতটা পথ পিছু ফেলে এসে দেখি, সবই আছে, শুধু নেই সেই সোনারঙ বিকেল, জোছনা ঝরা অবাক সন্ধ্যা আর মায়ের আঁচলের গন্ধ।
ডানপিটে শিমুলকে খুব পছন্দ করতাম ক্লাশে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকে। ওর সাথে মিলে কত যে দুষ্টুমি করেছি তা আজ কেবলই মধুর স্মৃতি। পরীক্ষার সময় শিমুল একটু বেশি ডিস্টার্ব করতো। একবার 'banana' শব্দের অর্থ লিখতে বলেছিল কোন এক পরীক্ষায় । শিমুলের ক্রমাগত প্যানপ্যানানিতে আমি একটু বিরক্ত। আমি তাকে বললাম লেখ- ক আকার ল আকার। সেও লিখে দিল- কালা। খাতা দেওয়ার দিন টিচার শিমুলকে দাঁড় করিয়ে বললো, তুই ব্যানানা অর্থ পারিস না। আজ থেকে তুই আর কলা খাবি না, কলার খোসা খাবি। দুরন্ত শিমুল আজ অনেক বড় ক্যাডার। আমার মতো পুরনো দিনের কথা ভেবে সময় নষ্ট করার মতো সময় এখন তার নেই।
আরো অনেক কিছুই আমার ছিলো যা আজ আর নেই। কলেজের সেই তুখোড় মেধাবী বন্ধুটি, যার নাম শ্যামলী। বন্ধুত্বের বাঁধন আড়মোড়া ভাঙ্গার আগেই সে হারিয়ে গেল চিরতরে। ব্রেইন টিউমার হয়েছিলো তার। হারিয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। টং-এর দোকানের চা, পার্সিভাল হিলের নির্জন সমতলে বন্ধুদের সাথে গিটারে সুর তোলা টুংটাং, কর্ণফুলীর ঢেউ, কবিতা ভাসান কিংবা রাত্রির নি:শব্দে একাকী তারা গোনা সময়। ঠিক যেন- দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না . . . . .
তবে এসব ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির বাইরে যে হারানোর ব্যাথা সবচেয়ে বেশি বাজে তা হলো হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধ। আমরা ভুলে গিয়েছি আমাদের অর্জন, আমাদের ত্যাগ, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পুরনো শকুনেরা আবার খামচে ধরেছে আমাদের পতাকা। ধর্মের লেবাসে আবার রক্তাক্ত করছে সবুজ জনপদ। আমার দু:খিনি মা আজ কাঁদছে, সেই কান্নার শব্দ আমরা শুনতে পাই না। তবুও বলি- তোমার ভয় নেই মা আমরা, প্রতিবাদ করতে জানি।
সবই তো শূন্যের ঘরে। তাহলে আমার রইলো বাকি কি? আমার আমি তো আছিই। আরো আছে ক্রোধ, ঘৃণা, হাহাকার আর দু'চোখ ভরা স্বপ্ন নতুন দিনের নতুন গানের। তাই সুমনের মতো বলি-
হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কনঠ ছাড়ো জোরে,
দেখা হবে তোমার আমার অন্য গানের ভোরে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ সকাল ৯:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



