জীবনে একবারই বৃত্তি পেয়েছিলাম, ১৯৯২সালে ক্লাস থ্রি’তে উঠার সময়। বেশী কিছু মনে নেই, খালি মনে আছে বহু লোকের বক বক শেষ হলে স্কুলের স্যারেরা স্টেজের একদিক দিয়ে লাইন করে উঠিয়ে দিলেন আর মাঝে এক বেটা হ্যান্ডশেক করে হাতে কিছু প্রাইজবণ্ড ধরিয়ে দিলে, আরেক পাশ দিয়ে সুড়ুত করে নেমে পড়লাম। তখনও বুঝতে পারিনি আমার বা হাতের আড়াইশ টাকার প্রাইজবণ্ড এর চেয়ে ডান হাতে আরও বহু মূল্যবান কিছু নিয়ে যাচ্ছি।
শুধু সেদিনের ওই প্রাইজবণ্ড বিলিকারীর সাথে করমর্দনটির জন্যই বলতে পারি জীবনে অন্তত একবার হুমায়ুন আহমেদের ছোঁয়াধন্য হয়েছিলাম। (ইহা তেল নয়, অভিব্যক্তি)
তো স্যার ঐদিন বক্তব্যে যা বলেছিলেন তার প্রায় কিছুই ক্ষুদ্র মস্তিস্কে ঢুকেনি, কারণ এ ধরণের অনুষ্ঠানগুলো বাচ্চাদের জন্য হলেও বক্তাদের শ্রোতা হিসেবে অভিবাবকরাই টার্গেট থাকেন। খালি মনে আছে, উনার ছোট মেয়েকে নিয়ে কোন একটি গল্প বলেছিলেন, পরে বাবার কাছ থেকে শুনে গল্পটি এরকম দাঁড়িয়েছিল-
“হুমায়ুন আহমেদ ছোট মেয়েকে কোন এক কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলে স্কুলের শিক্ষক উনাকে বললেন- আপনি নিশ্চিন্তে আমাদের উপর ভরসা করতে পারেন, আমরা কেজি ক্লাসেই ২০এর ঘর পর্যন্ত নামতা শিখিয়ে দেই।
শুনে উনি হতভম্ব হয়ে ওই শিক্ষককে বললেন- আমি ১০এর ঘর পর্যন্ত নামতা শিখে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করছি, আর এইটুকু বাচ্চা মেয়ের উপর আপনারা এখনি এতোটা চাপ দিবেন!!
তো উনি উনার মেয়েকে ওই স্কুলে ভর্তি না করিয়েই ফেরত এলেন।”
একজন প্রকৃত দরদী পিতা হিসেবে চিন্তা করে লোকটিকে বেশ ভালোই লেগেছিল সেদিন।
এরও ১১বছর পর উনার সেই আদুরে ছোট মেয়েটির সাথে আমার কোন একভাবে সামান্য বন্ধুত্ব হয়েছিল, কিন্তু তার কাছে স্যারের সেই কথার সত্যতা যাচাই করতে পারিনি; কারণ সেই দরদী পিতা যে ইতিমধ্যেই নিজ মেয়েদের কাছে ঘৃণিত ও অপাংক্তেয় হয়ে গিয়েছেন। আমি যে তার বাবার তথা হুমায়ুন সাহিত্যের একনিষ্ঠ একজন ভক্ত এই কথা আর আদুরে কইণ্যা’কে বলারই সাহস করিনি।
হুমায়ুন সাহিত্য চর্চা করার জন্য নটরডেম কলেজের আতলামিতে ভোগা অনেক বন্ধুর কাছ থেকেও কম কটূক্তি শুনতে হয়নি। তো তাদের সেই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস পড়ার চেষ্টাও করেছি, কিন্তু লেখা পড়ে রস আস্বাদনের আগেই দাঁত ও এন্টেনার উপর ভয়ঙ্কর চাপ পড়ায় শেষমেশ হুমায়ুন আহমেদের অপন্যাসকেই সুখ-পাঠ্য হিসেবে ভক্ষণ করে গিয়েছি।
বাংলাদেশের তথাকথিত সাহিত্য বিশারদদের মতে হুমায়ুন আহমেদের লেখা জীবনমুখী নয়। কিন্তু আমি বলি-
আরে ব্যাটা, উচ্চবিত্তের পরকীয়ার কামরসে সিক্ত না হলে, মধ্যস্বত্বের বৈঠকখানা পেরিয়ে টাট্টিখানার গন্ধ না শুঁকালে আর নিম্নবিত্তের খিস্তি-খেউরে সমৃদ্ধ না হলে বুঝি সাহিত্য জীবনমুখী হয় না??
বাংলার জীবন, বাংলার গ্রামকে আপনারা নিজেরা কতটুকু জানেন যে হুমায়ুনের লেখা বাস্তবতা বিবর্জিত মনে হয়?
হুমায়ুন সাহিত্য নীটশে, দন্তে মুখস্তকারী আর বিশেষ লেখকদের সাহিত্যের পাঠক হিসেবে যারা আত্ম-অহমিকায় ভোগা হামবড়াদের জন্য নয়। নিজের সাহিত্য সম্পর্কে হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, ‘আমি চেষ্টা করি সবার ভালোদিকটি তুলে ধরতে, সমাজের খারাপ মানুষটিরও কিছু ভালো এবং মজার দিক থাকে, পাঠক এগুলোর মাধ্যমেই সমাজকে জানুক’। (এলেবেলে ২য় পর্ব) এভাবেই তিনি স্থান, কাল, পাত্রকে তুলে এনেছেন লেখার মাধ্যমে। কিছু উদাহরণ দেই;
ত্রিশোর্ধ ব্লগাররা হয়তো জানেন একসময় ময়মনসিংহের গফরগাঁও, নান্দাইলের ভয়ঙ্কর দস্যুবৃত্তির কথা। শহুরে পরিবেশে থেকে সেই সমাজ আমরা চিন্তা করতে পারি না, কিন্তু তিনি সেই সময় এবং সমাজকে আমাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন জনপ্রিয় চরিত্র নান্দাইলের ইউনুসের মাধ্যমে।
লীলাবতী ডাউনলোড লিঙ্ক
আমার অসম্ভব প্রিয় একটি উপন্যাস 'লীলাবতী'। এই উপন্যাসে একটি বিশাল সম্ভ্রান্ত পরিবার হঠাৎ করেই ধ্বংস হয়ে যায়। কিভাবে জানেন? বাড়ির কর্তা ‘গইড়ার ভিটা’ নামক একটি অলক্ষুণে ভিটা কেনার পর। এটাই কুসংস্কার, বাংলার ৮৫,০০০ গ্রামেই কোন সম্ভ্রান্ত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পিছে ঠিক এরকম একটি কাহিনী রয়েছে। কিন্তু বলেনতো, আর কে এই সুক্ষ দিকগুলো লেখায় প্রকাশ করেছেন!!
গ্রামে যে চৈত্র, ভাদ্র মাসের অসহ্য গরমে সুস্থ মানুষের মাঝে পাগলামি ভাব হয়ে থাকে, আমি নিজের চোখে দেখেছি; যারা দেখেননি তারা গ্রাম থেকে আসা পূর্ব পুরুষদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এই সব পাগলদের আমরা খুঁজে পাই হুমায়ুন আহমেদের হাবলঙ্গের বাজারের মত নাটকে।
অয়োময়ের হানিফের মত বিশ্বস্ত পাহারাদার; পরিবারের কর্তার কোন এক দুর্বল মুহূর্তে জন্ম দেওয়া অবৈধ সন্তান- যে কিনা বাড়ির চাকর বাকরদের সাথেই বড় হচ্ছে, হাওরের ভয়ঙ্কর খুনি মহাজন কিংবা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন কোন পাগল কিসিমের মানুষ এরা সবাই প্রকৃত গ্রাম-বাংলার অংশ। শুধুই যে চরম দারিদ্র্য আর ফতোয়াবাজ মোল্লাদের দৌড়াত্বেই গ্রাম-বাংলা সীমাবদ্ধ নয়, এটা সাচ্চা উপন্যাস লেখকরা বুঝতেই চান না।
আমরা সবাই হিমু হতে চাই, কিন্তু হুমায়ুন সাহিত্যের আরেকটু গভীরে যান না ভাইয়েরা। কোথাও অবশ্যই প্রকৃত নিজেকেই খুঁজে পাবেন। এই যে ব্লগে এতো কবি, তাদের কারও সাথেই কি ‘কবি’ উপন্যাসের আতাহারের মিল নেই। বেকারত্বের হতাশায় যারা একটি ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি থেকে জীবনের গন্ধ নেয় আর না বলা গোপন প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে একের পর এক কবিতা লিখে যায়!!
'আজ আমি কোথাও যাব না' ডাউনলোড লিঙ্ক
আজ থেকে কমপক্ষে এক যুগ আগে যারা প্রবাসী হয়েছেন, তারা অন্তত জানেন সে সময় একটা বিদেশী ভিসা ছিল সোনার হরিনের চেয়েও মূল্যবান। দালালের খপ্পর, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, গলাকাটা পাসপোর্ট আরও কত শিহরণ জাগানো স্মৃতিই না ছিল সে সময়। সকল প্রবাসী ভাইয়াদের অনুরোধ করব ‘আজ আমি কোথাও যাবনা’ উপন্যাসটি পড়ে দেখবেন, হয়তো অজান্তেই পুরান দিনের সেইসব স্মৃতিগুলো ভিড় করে চোখের কোণ সিক্ত করে দিবে। বাহিরে আসার নেশা কতটা উদগ্র হতে পারে, তা আমি নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারি। তাই প্রবাসী হবার আগে এই বইটা অনেকবার পড়েছি; আপ্সুস বাংলাদেশের শুধুমাত্র একজন অপন্যাসিকই যে আমাদের এই নেশার তীব্রতা বুঝতে পেরেছিলেন।
হুমায়ুন আহমেদই আমাদের চান্নী পসর রাত ছিনিয়েছেন, কখনো রবি ঠাকুরের নীপবনে নিয়ে নবধারায় ভিজিয়ে এনেছেন আমাদের মনকে আবার কখনো ভিক্ষুক মন্তাজকে দিয়ে চিনিয়েছেন বেহেস্তের লিলুয়া বাতাস। শুধু উনার জন্যই আজ রবি ঠাকুরের ভাষায় প্রিয়াকে বলতে পারি-
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা।
আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক, প্রিয় ব্যক্তিত্ব হুমায়ুন আহমেদ। হয়তো আজীবন লেখলেও উনার সম্পর্কে আমার সব অনুভূতি বোঝাতে পারব না। খুবই ইচ্ছে হচ্ছিল স্যার’কে নিয়ে কিছু লিখতে, কিন্তু চাইনি উনাকে জানানো সামান্য শ্রদ্ধাটুকুও লাশের নীচে চাপা পড়ে যাক; তাই একটু দেরী করেই লিখলাম।
অনেকেই কাদা ছোড়াছুড়ি করলেন তাঁকে নিয়ে। কাউকে কিছু বলার নেই, যে উনার কাছ থেকে যতটুকু পেয়েছে ততটুকুই উনাকে ফেরত দিচ্ছে। কিন্তু যেই অনন্ত নক্ষত্ররাজি সম সাহিত্য সম্পদ উনি রেখে গেলেন আমাদের জন্য, হয়তো কোনকালেই তার প্রতিদান আমরা দিতে পারবো না। স্যারের জন্য দোআ রইল, আল্লাহ যেন উনার আত্মাকে শান্তি দেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ ভোর ৫:০৪