somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব: একটি পর্যালোচনা

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দুনিয়ার মানুষের জীবনযাপনের জন্যে যে জীবন বিধানই রচনা করা হোক না কেন, কোনো না কোনো অতিন্দ্রিয় দর্শন থেকেই যে তার উৎপত্তি হবে এটা অবধারিত। জীবনের জন্যে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হলে প্রথমে মানুষ এবং মানুষের আবাসভূমি এ মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ধারণা অর্জন করা অপরিহার্য। তা না হলে উক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্ভব নয়। মানুষের চালচলন ও আচার-ব্যবহার কি ধরনের হওয়া উচিত এবং দুনিয়ায় তার কিবাবে কাজকর্ম করা উচিত –এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আগে জানতে হবে মানুষ বস্তুটা কি, এ মহাবিশ্বের অবস্থান ও মর্যাদা কি এবং তার ব্যবস্থাপনা কোন ধরনের যার সাথে মানবজীবনের সামঞ্জস্যশীল হতে হবে। এ শেষোক্ত প্রশ্নগুলোর যে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে, সে অনুসারেই একটা চারিত্রিক মতাদর্শ গড়ে উঠবে এবং সে চারিত্রিক মতাদর্শটি যে ধরনের হবে মানব জীবনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সে অনুসারেই গঠিত হবে। অতপর সে নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী ব্যক্তিগত চরিত্র এবং সামষ্টিক সম্পর্ক লেনদেন ও আচরণের বিস্তারিত বিধি-বিধান রচিত হবে। এবাবে চূড়ান্ত পর্যায়ে সমাজ ও সভ্যতার গোটা প্রাসাদ এর ভিত্তিতেই নির্মিত হবে।

বস্তুত পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত মানবজাতির জন্যে যত ধর্ম ও মতাদর্শ তৈরী হয়েছে তার সবটারই গোড়াতে নিজস্ব একটা মৌলিক দর্শন ও মৌলিক চারিত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক করে নিতে হয়েছে। ফলে মূলনীতি থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি নিয়ম-নীতি পর্যন্ত একটি মতাদর্শকে অন্য মতাদর্শ থেকে আলাদা করে রেখেছে এ মৌলিক দর্শন ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী। কেননা এটাই হল প্রতিটি জীবনপদ্ধতির মেজাজ বা স্বভাব প্রকৃতির নিয়ামক। জীবনপদ্ধতিকে যদি দেহ মনে করা হয় তবে ওটা তার প্রাণস্বরূপ।

জীবন সম্পর্কে চারটি মতবাদ

একটি জীবনপদ্ধতি খুঁটিনাটি বিষয় ও শাখা-প্রশাখার কথা বাদ দিয়ে কেবল মৌলিক কাঠামো নিয়ে যদি বিচার-বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে, মানুষ ও প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে সর্বমোট চারটি অতিন্দ্রিয় মতবাদ গ্রহণ করা যেতে পারে। দুনিয়ায় যতগুলো জীবন দর্শন রয়েছে তা এ চারটিরই কোনো একটিকে গ্রহণ করেছে। এ চারটি মতবাদের মধ্যে প্রথমটিকে আমরা নির্ভেজাল জাহেলিয়াত নামে আখ্যায়িত করতে পারি।

১. নির্ভেজাল জাহেলিয়াত

এ মতবাদের মূল কথা এই যে, সমগ্র বিশ্বজগতের ব্যবস্থাপনা একিট আকস্মিক দূর্ঘটনার বাস্তব প্রকাশ। এর পেছনে কোনো প্রজ্ঞা, কোনো নিগুঢ় তত্ত্ব বা কোনো উদ্দেশ্য নেই। এটি আপনা-আপনি তৈরি হয়েছে, স্বতঃস্ফুর্তভাবেই চলছে, আবার কোনো ফল বা পরিণতি ছাড়াই আপনা-আপনি তা একদিন অবলুপ্ত হয়ে যাবে। এর কোনো খোদা নেই। আর যদি থেকেও থাকে তবে মানুষের জীবনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ এক ধরনের জীব এবং অন্যান্য জীবের ন্যায় হয়তো ঘটনাক্রমেই তারও উদ্ভব হয়েছে। তাকে কে সৃষ্টি করেছে, কি জন্যে সৃষ্টি করেছে ইত্যাদি নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই। আমরা শুধু এতটুকু জানি যে, দুনিয়াতে মানুষের অস্তিত্ব রয়েছে। তার কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে, যেসব পূরণ করার জন্যে তার প্রকৃতি ভেতর থেকে প্রবল চাপ দেয়। এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এমন কিছু শক্তি এবং যন্ত্রাদিও তার রয়েছে। সে তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বেশ কিছু উপকরণ দেখতে পায়। এগুলোর ওপর নিজের শক্তি ও যন্ত্রগুলো প্রয়োগ করে সে তার আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে পারে। সুতরাং নিজের পার্শ্বপ্রবৃত্তির দাবী পূরণ করা ছাড়া তার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। এসব চাহিদা পূরণের নিমিত্ত উন্নতমাতের উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা ছাড়া তার মানবীয় শক্তি-সামর্থের আর কোনো কার্যকারিতাও নেই। মানুষের ঊর্ধে জ্ঞান এবং সত্য ও সঠিক পথে চলার পথনির্দেশের কোনো উৎস ও উৎপত্তিস্থল নেই যেখান থেকে সে তার জীবনের বিধান লাব করতে পারে। সুতরাং তার চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতির ও নিদর্শনাবলী এবং যেসব নিদর্শন ও পরিস্থিত বিরাজমান আপন ঐতিহাসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে নিজেই তার একটা জীবন বিধান রচনা করা উচিত। যেহেতু এমন কোনো স্বাভাবিকভাবেই একটি দায়িত্বহীন সত্তা। যদি তাকে জবাবদিহি করতেই হয় তাহলে তার নিজের কাছেই অথবা এমন এক কর্তৃ্বের কাছে যা মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে –মানুষের ওপরই কর্তৃত্বশীল হয়ে পড়ে।

কর্মফল যা কিছুই হবে তা এ দুনিয়ার জীবনেই সীমাবদ্ধ। দুনিয়ার জীবনের বাইরে আর কোনো জীবনই নেই। সুতরাং দুনিয়াতে প্রকাশিত কর্মফলের প্রেক্ষিতেই কোনো জিনিস ভুল না নির্ভুল, ক্ষতিকর না লাভজনক, গ্রহণীয় বা বর্জনীয় তা নিরূপিত হবে।

মানুষ যখন নির্ভেজাল জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত থাকে অর্থাৎ যখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর ঊর্ধে কোনো সত্য পর্যন্ত সে পৌঁছুতে পারে না অথবা প্রবৃত্তির দাসত্বের কারণে পৌঁছুতে চায় না তখন তার মন-মস্তিষ্কে এ মতবাদই প্রভাবশীল হয়। দুনিয়া পূঝারীগণ সকল যুগে এ মতবাদই গ্রহণ করেছে। মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া রাজা, বাদশা, আমীর-উমরাহ, শাসকবর্গ, সভাসদগণ, বিত্তশালীগণ এবং বিত্তের পেছনে জীবন উৎসর্গকারীগণ সাধারণভাবেএ মতবাদকেই অগ্রাধিকার দান করেছে। আর ইতিহাসে যেসব জাতির সভ্যতা সংস্কৃতির বন্দনা-গীত গাওয়া হয়, তাদের সকলের সংস্কৃতির মূলে এ মতবাদ কার্যকর ছিল। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলেও এ মতবাদ কার্যকর রয়েছে। যদিও সকল পাশ্চাত্যবাসী খোদা ও আখেরাতে অবিশ্বাসী নয় এবং বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়ে তারা সবাই জড়বাদ নৈতিকতারও সমর্থক নয়। কিন্তু যে প্রাণশক্তি তাদের গোটা সভ্যতা ও কৃষ্টির দেহে ক্রিয়াশীল, সেটা খোদা ও আখেরাতের প্রতি এ অবিশ্বাস এবং জড়বাদী নৈতিকতারই প্রাণশক্তি এবং এটা তাদের জীবনে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, যারা বুদ্ধি-বিবেচনার দিক দিয়ে খোদা ও আখেরাতের অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং নৈতিকতার ক্ষেত্রে একটা অজড়বাদী দৃষ্টিকোণ রাখে তারাও অবচেতনভাবে বাস্তব জীবনে নাস্তিক ও জড়বাদী ছাড়া আর কিছুই নয় কেননা চিন্তার ক্ষেত্রে তারা যে মতবাদের অনুসারী বাস্তব জীবনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের পূর্ববর্তী সৃদ্ধিশালী ও খোদাবিস্মৃত লোকদের অবস্থাও ছিল অনুরূপ। বাগদাদ, দামেস্ক, দিল্লী ও গ্রানাডার সমৃদ্ধিশালী লোকেরা মুসলমান ছিল বলে খোদা ও আখেরাতকে অস্বীকার করত না কিন্তু তাদের গোটা জীবনের কর্মসূচী এমনভাবে তৈরি হত যেন খোদা ও আখেরাত বলতে কোনো জিনিসের অস্তিত্বই নেই এবং কারও কাছে জবাবদিহি করার এবং কারও কাছ থেকে হেদায়াত গ্রহণের কোনো প্রশ্নই নেই। আছে শুধু তাদের কামনা-বাসনা ও আশা-আকাঙ্খা। তাদের এ আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্যে সব ধরনের উপায়, উপকরণ ও পন্থা অবলম্বনে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের মনোবল হল এই যে, যেহেতু এ জীবনের পর আর কোনো জীবন নেই, অতএব জীবনযাপনের যতটুকু সময় পাওয়া যায়, ভোগ-বিলাসিতার মাধ্যমেই তা সদ্ব্যবহার করতে হবে।

ওপরে বলা হয়েছে যে, এ মতবাদের প্রকৃতিই হল এই যে, এর ভিত্তিতে একটা নির্ভেজাল জড়বাদী নৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সে নৈতিক ব্যবস্থা পুঁথি-পুস্তকে লিপিবদ্ধ হোক অথবা শুধু মন-মানসেই সংকলিত হয়ে থাক তাতে কিছু আসে যায় না। অতপর এ জড়বাদী মানসিকতা থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তাধারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ক্রমান্বয়ে গোটা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নাস্তিকতাও বস্তুবাদের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। তারপর ব্যক্তি চরিত্র গড়ে ওঠে একই আদর্শিক ছাঁচে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও লেনদেনের নীতি তৈরী হয় একই পদ্ধতি ও ছাঁচে। আইন –কানুন রচনা এবং তার উৎকর্ষ সাধনও চলে সেই একই ভঙ্গীতে। তারপর এ ধরনের সমাজের নেতৃত্ব লাভ করে তারাই যারা সবচেয়ে বড় প্রতারক, আত্মসাৎকারী, মিথ্যাবাদী, ধোঁকাবাজ, নিষ্ঠুর এবং নীচ প্রবৃত্তির লোক। গোটা সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িথ্ব তাদেরই হাতে চলে যায়। তারপর তারা রাগামহীন উটের মতো বেপরোয়াভাবে মানবজাতির ওপর চালায় শোষণ-নিপীড়নের নিষ্ঠুর অভিযান। কোনো হিসাব-নিকাশের অথবা কোনো পক্ষ থেকে পাকড়াও হওয়ার ভয় থাকে না। তাদের সমস্ত বাস্তব কলাকৌশল তৈরী হয় মেকিয়াভেলীর রাজনৈতিক মূলনীতির ভিত্তিতে। তাদের আইন গ্রন্থে শক্তির অপর নাম সত্য দুর্বলতার অপর নাম মিথ্যা। বস্তুগত প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আর কোনো জিনিস তাদেরকে যুলুম-অবিচার থেকে বিরত রাখতে পারে না। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এ যুলুম-নিষ্পেষণ এমন রূপ ধারণ করে যে, শক্তিশালী আপন জাতির দুর্বল শ্রেণীকে নিষ্পেষিত করতে থাকে। আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ। জাহেলী মতবাদের আর একটি দিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেনঃ হযরত শোয়াইব (আ) যখন স্বজাতির লোকদেরকে এক আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণের আহবান জানালেন এবং ব্যবসায়িক লেনদেন দুর্নীতি থেকে বিরত থাকতে বললেন, তখন তারা জবাব দিলঃ

“হে শোয়াইব, তোমার নামায কি এ শিক্ষা দেয়, আমরা আমাদের ঐসব দেব-দেবী পরিত্যাগ করব আমাদের বাপ-দাদা যাদের পূজা-অর্চনা করতো? অথচা আমাদের ধন-সম্পদ আমরা ইচ্ছামত ব্যয় করতে পারব না?”-(সূরা হুদঃ ৮৭)

ইসলামের মোকাবিলায় জাহেলী মতাদর্শের এ হলো পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা। ইসলামের কথা হলো, আল্লাহর দাসত্ব ছাড়া অন্য সব মত ও পথ ভুল এবং অনুসরণের অযোগ্য। কেননা অন্য কোন মত ও পথের স্বপক্ষে আসমানী কিতাবে কোনো দলিল-প্রমাণ নেই্ আর আল্লাহর দাসত্ব শুধুমাত্র ধর্মীয়গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বরং সমাজ ও সভ্যতা, অর্থনীতি ও রাজনীতি তথা জীবনের সকল দিক ও বিভাগে তা হতে হবে। কেননা মানুষের কাছে শক্তি ও সম্পদ বা কিছু সবই মূলতঃ আল্লাহর এবং কোনো জিনিসই আল্লাহর মর্জির বিপরীত নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করার অধিকার মানুষের নেই। পক্ষান্তরে জাহেলিয়াতের মতবাদ হলো, বাপ-দাদার আমল থেকে যে রীতি-প্রথা চলে আসছে, তারই অনুসরণ করা উচিত। সেটা যে বাপ-দাদার রীতি, এটাই তার অনুসরণের যুক্তি-প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট। এ জন্যে আর কোনো যুক্তি প্রমাণের দরকার নেই। ধর্মের সম্পর্ক শুধু পূজা-উপাসনার সাথে। আমাদের জীবনের পার্থিব কাজ-কর্মে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত যাতে করে আমাদের ইচ্ছামতো তা আমরা সমাধা করতে পারি। এর থেকে এটাও ধারণা করা যেতে পারে যে, জীবনকে ধর্মীয় এবং পাতিৃব নামে পৃথক ভাগ করার অদরণাটা নতুন কিছু নয়। বরঞ্চ আজ থেকে তিন-চারহাজার বছর পূর্বে হযরত শোয়াইব (আ)-এর জাতিও যেমন এ বিভক্তির কথাটা জোর দিয়ে বলতো, ঠিক তেমনি পাশ্চাত্য জাতি ও তাদের অন্ধ অনুসারীগণ আজকাল বলে থাকে। আসলে এটা কোনো নতুন ‘আলোকরশ্মী’ নয় যা মানুষ আজ চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার ক্রমবিকাশের ফলে লাভ করেছে। বরঞ্চ এটা সে প্রাচীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাদারা –যা হাজার হাজার বছর আগে জাহেলিয়াতের মধ্যে এমনিভাবেই বিদ্যমান ছিল। এর সাথে ইসলামের যে দ্বন্দ্ব তাও নতুন নয়, বহু পুরাতন।(সংকলকবৃন্দ)] ও জাতি ধ্বংসের রূপে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে।

২. শির্ক মিশ্রিত জাহেলিয়াত

দ্বিতীয় অতি প্রাকৃত মতবাদ শির্কের মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্ব প্রকৃতির ব্যবস্থাপনা আকস্মিক কোন ঘটনার ফলশ্রুতি নয় এবং এর পেছনে কোনো খোদা নেই তাও নয়। তবে এর খোদা বা প্রভু (Master) একজনও নয়, বহু। এ ধারণার স্বপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ নেই। বরং নিছক আন্দাজ-অনুমান ভিত্তিক। এ জন্যে কল্পনা করা যায়, অনুভব করা যায় এবং বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করা যায় এমন সব বস্তুকে খোদারুপে গ্রহণ করতে মুশরিকদের মধ্যে কখনো ঐকমত্য হতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও কখনো হবে না। অজ্ঞানতার ঘোর অন্ধকারে দিশেহারা লোকদের হাত যে জিনিসের ওপরই পড়েছে, তাকেই তারা খোদা বানিয়ে নিয়েছে। এভাবে উপাস্যের সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধি হয়েছে। ফেরেশতা, জ্বিন, আত্মা, গ্রহ-নক্ষত্র, জীবিত ও মৃত মানুষ দেবতা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। প্রেম, সৌন্দর্য, কাম প্রবৃত্তি, সৃজনী শক্তি, রোগ-ব্যাধি, যুদ্ধ, লক্ষ্মী, শক্তি প্রভৃতি বিমূর্ত জিনিসকেও পর্যন্ত উপাস্যে পরিণত করা হয়েছে। এমনকি সিংহ মানব, মৎস্য মানব, পক্ষী মানব, চার-মস্তকধারী, সহস্রাভুজ হস্তিমুণ্ডধারী মানুষ প্রভতিও কিম্ভুৎকিমাকার মুশরিকদের উপাস্য শ্রেণরি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

অতপর এ পন্থার চারপাশে কল্পনা ও পৌরাণিকতার এক অপূর্ব তেলেসমাতি জগত তৈরী হয়েছে। প্রত্যেক অজ্ঞ জাতির উর্বর কল্পনাশক্তিও বিচিত্র শিল্পনৈপুণ্য এমন মজার মজার নমুনা পেশ করেছে যে, দেখরে অবাক হতে হয়। যেসব জাতির মধ্যে সর্বোচ্চ খোদা তথা আল্লাহ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, সেখানে খোদায়ীর ব্যবস্থাপনা কিছুটা এ দরনের যেন আল্লাহ তায়ারা বাদশাহ এবং অন্যান্য খোদা তাঁর উজির-নাজির, পারিষদবর্গ, মুসাহেব এবং বিভিন্ন দায়িত্বশীল, কিন্তু মানুষ বাদশাহের কাছে সরাসরি পৌঁছতে পারে না বলে যাবতীয় কাজকর্ম নিপ্নপদস্থ খোদাদের সাথেই সংশ্লিষ্ট থাকে। আর আল্লাহ সম্পর্কে যেসব জাতির ধারণা খুবই অস্পষ্ট অথবা যাদের বলতে গেলে কোনো ধারণাই নেই, সেখানে খোদার সকল কর্তৃত্ব বিভিন্ন খোদাদের মধ্যে বণ্টিত হয়ে রয়েছে।

নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের পর এটাই হলো ‘দ্বিতীয় প্রকারের জাহেলিয়াত যার মধ্যে আবহমানকাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ নিমজ্জিত হয়ে আছে। সবসময় নিম্নতম পর্যায়ের মানসিক অবস্থায় তারা এত দূর নেমে এসেছে। আল্লাহর নবীদের শিক্ষার প্রভাবে যারা এক পরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের মন থেকে অন্যান্য খোদার অস্তিত্ব মুছে গেছে বটে, কিন্তু নবী, শহীদ, পীর, অলী, গাওস, কুতুব, আবদাল এবং যিল্লুল্লাহ খেতাবপ্রাপ্ত রোকেরা কোনো না কোনো প্রকারে তাদের আকীদা-বিশ্বাসে স্থান লাভ করেছে। অজ্ঞ লোকেরা মুশরিকদের খোদারূপে গ্রহণ করেছে –যাদের সমগ্র জীবন ছিল মানুষের ওপর থেকে মানুষের খোদায়ী খতম করে একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্ব ও প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গীকৃত। একদিকে মুশরিকদের পূজাপাটের স্থলে ফালেহা, যিয়ারত, নযর-নিয়ায, ওরস, মাজার পূজা, কবরের ওপর ঝাণ্ডা উড়ানো তাযিয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য ধর্মীয় কার্যকরাপের এক নতুন শরীয়াত বানিয়ে নেয়া হলো। অপরদিকে কোনো তাত্ত্বিক দলিল প্রমাণাদি ছাড়া এসব বুযর্গানের জন্ম-মৃত্যু, আবির্ভাব ও অন্তর্ধান, কাশফ-কারামত, অস্বাভাবিক ক্ষমতা এবং আল্লাহর সাথে তাদের নৈকট্যের অবস্থা সম্পর্কে এক পরিপূর্ণ পৌরাণিকতা তৈরী করা হয়েছে। যা মুশরিকদের পৌরাণিকবাদের সাথে সর্বক্ষেত্রে সামঞ্জস্যশীল। তৃতীয়তঃ “অসীলা” ‘রূহানীমদদ’ ‘ফয়েয’ প্রভৃতি নামগুলোর মনোমুগ্ধকর আবরণের অন্তরালে আল্লাহ ও বান্দাদের যাবতীয় সম্পর্ক ঐসব বুযর্গানের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। কার্যতঃ অবস্থা ঠিক মুশরিকদের মতো হয়ে পড়েছে। যাদের মতে বিশ্বপ্রভু মানুসের নাগালের বহুদূরে এবং মানুষের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিষয় তাঁর নিম্নস্থ কর্মকর্তাদের হাতেই ন্যস্ত। পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, মুশরিকরা নিম্নস্থ কর্তকর্তাদেরকে প্রকাশ্যভাবে উপাস্য, দেবতা, অবতার, অথবা আল্লাহর পুত্র নামে আখ্যায়িত করে আর এরা তাদেরকে গাউস, কুতুব, আবদাল, আউলিয়া ও আল্লাহ ওয়ালা ইত্যাদি শব্দের আাড়লে ঢেকে রাখে।

এই দ্বিতীয় ধরনের জাহেলিয়াতের ইতিহাসের সকল যুগেই প্রথম ধরনের জাহেলিয়াত অর্থাৎ নির্ভেজার জাহেলিয়াতের সাথে সহযোগিতা করে এসেছে। প্রাচীনকালে ব্যাবিলন, মিশর, ভারতবর্ষ, ইরান, গ্রীস, রোম প্রভৃতি তামাদ্দুন তাহযিবে, এ দুই ধরনের জাহেলিয়াতের সহাবস্থান ছিল। অধুনা জাপানের অবস্থাও তদ্রুপ। এ সহযোগিতার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করছি।

প্রথমতঃ শির্কমিশ্রিত জাহেলিয়াতে মানুষের সাথে তার উপাস্যদের সম্পর্ক শুধু এতটুকু যে, তাদেরকে কর্তৃত্বশালীএবং লাভ-ক্ষতির মালিক মনে করে এবং বিভিন্ন উপাসনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পার্থিব উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে তাদের কৃপা ও সাহায্য লাভের চেষ্টা করে।–[হযরত সালেহ (আ) তার জাতিকে বলেছিলেন:

“সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও এবং তার আনুগত্যের দিকে ফিরে আস। নিশ্চয়ই আমার প্রভু নিকটবর্তী এবং দোয়া কবুলকারী”।–(সূরা হুদ: ৬১)

এখানে মুশরিকদের একটা বিরাট ভ্রন্ত ধারণা অপনোধন করা হয়েছে। এ ভ্রান্ত ধারণাটি সাধারণত সকল মুশরিকদের মধ্যে ছিল এবং সকল যুগে মানুষের শির্কে লিপ্ত হওয়ার একটা প্রদান কারণ ছিল। তারা মনে করতো আল্লাহ তাদের রাজা-মহারাজাদের মতই একজন, যিনি প্রজাসাধারণ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত রাজ-প্রাসাদে আমোদ-প্রমোদে মত্ত থাকেন। সেখানে সাধারণ প্রজাগণ পৌঁছুতে পারতো না। তাই তার কাছে কোনো প্রার্থনা জানাতে হলে তার নৈকট্য লাভকারীদের মধ্য থেকে কারও শরণাপন্ন হতে হয়। আর যদি সৌভাগ্যক্রমে কারও প্রার্থনা তার কাছে পৌছেও যায় তথাপি খোদায়ীর অহংকারে তিনি নিজে তার জবাব দেয়া পছন্দ করেন না। এ জবাব দেয়ার কাজটা ও নৈকট্য লাভকারী ভক্তদের কারও কাছেই ন্যস্ত করা হয়। এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এবং ধুর্ত লোকদের প্ররোচনায পড়ে তারা মনে করে যে, বিশ্বজাহানের মালিকের পবিত্র দরবার সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক দূরে। একজন মামুলী মানুষ সেখানে পৌঁছার আশা করতেই পারেনা। তার দরবারে দোয়া পৌঁছা এবং তার জবাব পাওয়া পবিত্র আত্মাসমূহের অসীরা ব্যতীত এবং দক্ষ ধর্মীয় কর্মকর্তাদের সাহায্যে নযর, নেয়ায ও ফরিয়াদ পৌঁছানো ছাড়া সম্ভবই নয়। এ ভ্রান্ত ধারণার দরুনই মানুষ ও তার খোদার মাঝে অসংখ্য ছোট-বড় খোদার সমাবেশ ঘটেছে এবং পোরহিত্য প্রথার উদ্বব হয়েছে যার মধ্যস্থতা ছাড়া জাহেলী ধর্মমতের অনুসারীরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও সম্পন্ন করতে পারে না।]

এখন কথা হলো এই যে, তাদের নিকট থেকে কোনো নৈতিক নির্দেশ অথবা জীবন যাপনের কোনো আইন-পদ্ধতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা, সেখানে কোনো খোদা থাকলে তো নির্দেশ দান ও আইন-পদ্ধতির প্রশ্ন আছে। আর নেই বলেই মুশরিকরা নিজেরাই অনিবার্যরুপে একটা নৈতিক মতবাদ বানিয়ে নেয় এবং সেই নৈতিক মতবাদরে ভিত্তিতে নিজেরাই একটা শরীয়াত প্রণয়ন করে। এভাবে সেই নির্ভেজাল জাহেলিয়াতই কার্যকর হয়। এ জন্যেই নির্ভেজাল জাহেলিয়াত ও শির্কমিশ্রিত জাহেলিয়াতের ভিত্তিতেই যে সমাজ ও সভ্যতা গড়ে ওঠে, তাতে এ ছাড়া আর কোনো পার্থক্য থাকে না যে, এক জায়গায় জাহেলিয়াতের সাথে সাথে মন্দির, পূজারী ও উপাসনার ধারাবাহিকতা শুরু হয় আর অন্য জায়গায় তা হয় না। নৈতিক চরিত্র ও কার্যধারা উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের হয়ে থাকে; প্রাচীন গ্রীস ও পৌত্তলিক রোম সাম্রাজ্যের নৈতিক মেজাজ প্রকৃতির সাথে আধুনিক ইউরোপের নৈতিক মেজাজ-প্রকৃতির যে মিল দেখা যায় তার কারণ এটাই।

দ্বিতীয়তঃ জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদির জন্যে শির্ক মিশ্রিত মতবাদ আলাদা ও স্থায়ী কোনো ভিত্তি রচনা করে দেয় না। এ ক্ষেত্রেও একজন মুশরিক নির্ভেজাল জাহেলিয়াতেরই পক্ষ অবলম্বন করে এবং মুশরিক সমাজের সমগ্র মানসিক ও চিন্তাগত বিকাশ ঘটে নির্ভেজার জাহেলিয়াতেরই আদর্শে। পার্থক্য শুধু এতটুকু যেম মুশরিকদের কল্পনাশক্তি সীমাতিরিক্ত এবং সে জন্যে তাদের চিন্তাধারার কল্পনার প্রবণতা অত্যন্ত বেশী। কিন্তু নাস্তিকরা কিছুটা বাস্তববাদী হয়ে থাকে। তাই নিছক কাল্পনিক দর্শনের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ-অনুরাগ নেই। অবশ্যই খোদা ছাড়াই তারা যখন বিম্ব প্রকৃতির সৃস্টি রহস্য উদঘাটনের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়, তখন তারা যে যুক্তির জাল বোনে, তাও মুশরিকদের পৌরাণিক মতবাদের মতোই অযৌক্তিক হয়। বস্তুতঃ চিন্তার দিক দিয়ে শির্ক এবং নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। এর জ্বলন্ত প্রমান এই যে, আজকের ইউরোপ তার মতবাদের দিক দিয়ে প্রাচীন গ্রীস ও রোমের সাথে এমন সূত্রে বাঁধা, যেন মনে হয় –ইউরোপ ওদের সন্তান।

তৃতীয়তঃ নির্ভেজার জাহেলী যেসব সমাজের তামাদ্দুনিক রীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করে মুশরিক সমাজও সেগুলো গ্রহণ করার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত থাকে যদিও সমাজের গঠন ও বিন্যাসে শির্ক ও নির্ভেজাল জাহেলিয়াতের মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্র রয়েছে। শির্কের রাজত্বে বাদশাহদেরকে খোদার আসনে বসানো হয়। আর আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতাদের একটা শ্রেণী বিশেষ আভিজাত্য ও অধিকার নিয়ে আবির্ভূত হয়। আর রাজ-পরিবার ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যোগসাজসে একটা চক্র গড়ে ওঠে। এক বংশ-গোত্রের ওপর অন্য বংশগোত্রের এবং একশ্রেণীর ওপর অন্য শেণীর শ্রেষ্ঠত্ব –প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার একটা স্থায়ী মতবাদ গড়ে তোলা হয়। এভাবে অজ্ঞ জনসাধারণকে ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে তাদের ওপর নির্যাতনমূলক আধিপত্য বিস্তার করা হয়। অন্যদিকে নির্ভেজাল জাহেলী সামজে এসব দোষত্রুটিগুলো বংশপূজা, জাতিপূজা, জাতীয় সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কত্ব, পুঁজিবাদ ও শ্রেণী সংগ্রামের রূপ ধারণা করে। কিন্তু প্রাণশক্তি ও মৌলিক প্রেরণার দিক দিয়ে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করা, মানুষের দ্বারা সমাজকে খণ্ডবিখণ্ড করা এবং এক শ্রেণীর লোকদেরকে অন্য শ্রেণীর লোকদের রক্তপিপাসু বানিয়ে দেয়ার ব্যাপারে উভযে একই পর্যায়ভুক্ত।

৩. বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত

তৃতীয় যে অতি প্রাকৃত মতবাদ বৈরাগ্যবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার সারমর্ম নিম্নরূপঃ এ দুনিয়া এবং দৈহিক অস্তিত্ব মানুষের জন্যে কারাগারের শাস্তিস্বরূপ। মানুষের আত্মা এ দেহের খাঁচার ভেতর সাঁজাপ্রাপ্ত কয়েদী হিসেবে অবস্থান করে। দেহের সাথে সম্পর্কের কারণে মানুষ যেসব কামনা-বাসনা ও ভোগের আকর্ষণ অনুভব কর এবং যেসব জৈবিক চাহিদার সম্মুখীন হয় তা প্রকৃতপক্ষে এ কারাগারেরই বেড়ী ও শৃঙ্খল। মানুষ এ দুনিয়া এবং তার বিভিন্ন বস্তুসমূহের সাথে যত বেশী সম্পর্ক রাখবে, সে ততই কলুষিত হবে এবং সে পরিণামে অধিক শাস্তির যোগ্য হবে। তার মুক্তির একমাত্র পথ হলো এ পার্থিব জীবনের ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত হওয়া, কামনা-বাসনাকে নির্মূল করা, আনন্দ-সম্ভোগ থেকে দূরে থাকা ও দৈহিক চাহিদা ও প্রবৃত্তির লিপ্সা পূরণ করতে অস্বীকার করা, বস্তু, প্রেম ও রক্ত-মাংসের সম্পর্ক থেকে উদ্ভুত স্নেহ, প্রেম-ভালোবাসা মন থেকে মুছে ফেলা এবং আপন শত্রুকে অর্থাৎ দেহ ও প্রবৃত্তিকে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে এত বেশী নিপীড়ন ও নির্যাতন করা যাতে আত্মার ওপর তার আর আধিপত্যই বহাল না থাকে। এতে করে আত্মা ভারমুক্ত, কলুষমুক্ত ও পবিত্র হয়ে যাবে এবং ত্রাণ লাভের উচ্চমার্গে আরোহণ করতে সক্ষম হবে।

এ মতবাদ মূলতঃ একটি অসামাজিক (Anti-Social) মতবদা। তবে সমাজ ব্যবস্থার ওপর এটি বিভিন্ন উপায়ে প্রভাব বিস্তার করে। এর ভিত্তিতে এক বিশেষ দরনের দার্শনিক ব্যবস্তা গড়ে ওঠে, বেদান্ত দর্শন, মনুদর্শন, নব্য প্লেটোবাদ (New-Platonism), যোগবাদ, সুফিবাদ, খৃষ্টীয় বৈরাগ্যবাদ, বৌদ্ধমত প্রভৃতি এ দর্শনের বিভিন্ন রূপ। এ দর্শন থেকে এমন একটা নৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব হয় যা খুব কমই ইতিবাচক (Positive) এবং খুব বেশীর ভাগই বরং পুরোপুরি নেতিবাচক (Negative)। এ দু’টিই মিলিতভাবে সাহিত্যে, আকীদা বিশ্বাসে, নৈতিকতায় এবং বাস্তব জীবনে অনুপ্রবেশ করে এবং যেখানে যেকানে তার প্রবাব পৌঁছে সেখানে তা আফিম ও কোকেনের কাজ করে। প্রথম দু’প্রকারের যাহেলিয়াতের সাথে এ তৃতীয় জাহেলিয়াত সাধারণত তিন উপায়ে সহযোগিতা করে থাকেঃ

একঃ এ বৈরাগ্যবাদী জাহেলিয়াত সৎ ও ধর্মভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার কর্মক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নির্জন কক্ষে বসিয়ে দেয় এবং নিকৃষ্ট ধরনের দুষ্কৃতকারীদের জন্যে কর্মক্ষেত্র খালি করে দেয়। অসৎলোকেরা পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব হাতে পেয়ে নির্বিঘ্নে অরাজকতা ছড়ায় আর সৎলোকেরা আপন মুক্তির চিন্তায় তপস্যা চালিয়ে যেতে থাকেন।

দুইঃ এ জাহেলিয়াতের যেটুকু প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে তা তাদের মধ্যে ভ্রান্ত ধরনের ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং নৈরাশ্যকর দৃ্ষ্টিভঙ্গী সৃষ্টি করে তাদেরকে জালেমদের সহজ শিকারে পরিণত কর্ এ কারণেই রাজা-বাদশাহ, আমীর-ওমরা ও ধর্মীয় কর্তৃত্বশালী শ্রেণী এ বৈরাগ্যবাদী দর্শন ও নৈতিকতার প্রচার প্রসারে বিশেষ আগ্রহ পোষণ করতো। তাদের তত্ত্বাবধানে নির্বিঘ্নে এর প্রচার প্রসার চলতো। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও পোপতন্ত্রের সাথে বৈরাগ্যবাদী দর্শন ও নৈতিক আদর্শের কখনো সংঘর্ষ চলেছে এবং দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।

তিনঃ যখন এ ব্যরাগ্যবাদী দর্শন ও নৈতিক আদর্শ মানবীয় স্বভাব-প্রকৃতির কাছে পরাজয় বরণ করে তখন নানা ধরনের কলা-কৌশল উদ্ভাবন করা শুরু হয়। কোথাও কাফফারা দানের আকীদা-বিশ্বাস উদ্ভাবন করা হয় –যাতে প্রাণ ভরে পাপ করা যায় এবং বেহেশতও হাতছাড়া না হয়ে যায়। কোথাও বা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্ত করার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দেহ কেন্দ্রিক প্রেমের বাহানা করা হয় –যাতে করে মনের আগুনও নিভানো যায় এবং পবিত্রতাও অক্ষুণ্ণ থাকে। আবার কোথাও দুনিয়া বর্জনের বা বৈরাগ্যের পর্দার আড়ালে রাজা-বাদশাহ ও ধনিক-বণিকদের সাথে যোগসাজসে আধ্যাত্মিকতার জাল বিস্তার করা হয়। রোমের পোপ সম্প্রদায় ও প্রাচ্য জগতের গদিনশীনগণ এর জঘন্যতম দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। জাহেলিয়াত তার স্বগোত্রীয়দের সাথে এমন ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু নবীদের অনুসারীদের মধ্যে এ যাহেলিয়াত যখন অনুপ্রবেশ করে তখন অন্য এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দুনিয়াকে কর্মক্ষেত্র পরীক্ষাক্ষেত্র ও আখেলাতের কৃষিক্ষেত্র হিসেবে স্বীকার করার পরিবর্তে তাকে নির্যাতন গৃহ ও “মায়াজাল” রূপে পরিচিত করার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীনের ওপর সে প্রথম আঘাত হানে। দৃষ্টিভঙ্গীর এ পরিবর্তনের ফলে মানুষ এ বাস্তব সত্যকে ভুলে যায় যে, সে এ দুনিয়ায় আল্লাহর খলিফা হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত। সে ভাবতে আরম্ভ করে যে, সে এখানে কাজ করার জন্যে এবং দুনিয়ার নান রকমের দায়িত্ব পালন করার জন্যে আসেনি বরং তাকে অপবিত্র আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। তাই সে আবর্জনা ও অপবিত্রতা থেকে দূরে থাকা উচিত। এখানে অসহযোগী (Non co-operator) হয়ে থাকা ও দায়িত্ব এড়িয়ে চলাই তার যথার্থ কর্তব্য। এ ধারণার ফলে সে দুনিয়া ও তথাকার কাজ-কর্ম ও দায়-দায়িত্বের প্রতি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। সে খেলাফতের দায়িথ্ব গ্রহণ তো দূরের কথা, সামাজিক দায়িথ্ব গ্রহণ করতেও ভয় পায়। ফলে ইসলামী শরীয়াতের সমগ্র ব্যবস্থাই তার জন্যে অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইবাদাত ও খোদার আদেশ-নিষেধ পার্থিব জীবনের সংস্কার-সংশোধণ ও খেলাফতের দায়িথ্ব পালন করার জন্যে যে মানুষকে তৈরী করা হয়েছে এ মর্মকথা সে বুঝতে পারে না। বরং সে মনে করতে থাকে যে, ইবাদাত ও কিছু বিশিষ্ট ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তার পাপ জীবনের কাফফারা স্বরূপ। তাই এগুলোকে পূর্ণ মনোযোগের সাথে এবং যথাযথভাবে করে যাওয়া চাই, -যাতে করে পরকালে মুক্তি লাভ করা যায়।

এ মানসিকতা নবীবের উম্মতের একটি অংশকে মোরাকাবা (নিভৃতে ধ্যানমগ্ন থাকা) মোকাশাফা (অজানা রহস্য জানার চেষ্টা), চিল্লা দান, ওজিফা পাঠ, আহযাব ও আমলিয়াত (ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-তুমার প্রভৃতি), আধ্যাত্মিক জগতের স্থানসমূহ ভ্রমণ সায়রে মাকামাত) এবং হকিকতের দার্শনিক-[যথা সর্বেশ্বরবাদ।] ব্যাখ্যার গোলক ধাঁদার নিক্ষেপ করেছে। আর নফল ও মুস্তাহাবে ফরজ কাজ থেকে বেশী নিমগ্ন রেখে খেলাপতের দায়িত্ব থেকে উদাসীন করে রেখেছে। অথচ এ খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্যেই নবীদের আগমন হয়েছিল। এদের আর একটি দলের মধ্যে কৃত্রিম দৈন্য আমদানী, দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি, চুলচেরা বিচার ও নিষ্প্রয়োজন তত্ত্বানুসন্ধান, ছোট ছোট জিনিসের সূক্ষ্ম পরিমাণ ও খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে অতিমাত্রায় মাথা ঘামানোর ব্যধি সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন তাদের দৃষ্টিতে এমন এক ভঙ্গুর কাঁচপাত্রে পরিণত হয়েছে যা সামান্য ব্যয়িত হয় এ কাজে যে কোথাও কিছু উঁচু-নিচু হয়ে যায় কি না বা মাথার ওপরের সেই ভঙ্গুর কাঁচপাত্রটি ভেঙে চুরমার হয়ে না যায়। ধর্মে এত সূক্ষ্মতার পরে অনিবার্যরূপে দৃষ্টির সংকীর্ণনা, উদ্যমহীনতা ও স্থবিরতা জন্ম নেয়। এ ধরনের লোকদের মধ্যে জীবনের বড় বড় সমস্যার ওপর দূরদৃষ্টি নিক্ষেপ করার ও ইসলামের বিশ্বজনীন মূলনীতিগুলো উপলব্ধি করার যোগ্যতা কোথা থেকে আসবে? আর কি করেইবা তারা দ্বীনের বিশ্বজনীন মূলনীতি ও খুঁটিনাটি বিষয়ের জ্ঞান লাভ করবে এবং যুগের আবর্তনের ফলে তার নব নব পর্যায়ে দুনিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ ও পথ প্রদর্শনের জন্যে প্রস্তুত হবে?

৪. ইসলাম

অতি প্রাকৃত মতবাদ আল্লাহর নবীগণ পেশ করেছেন। তার সারমর্ম নিম্নরূপঃ

আমাদের চারপাশে পরিব্যপ্ত এ নিখিল বিশ্বজগত –স্বয়ং আমরা যার একটা অংশ মূলত এক সম্রাটের সাম্রাজ্য। তিনিই এর স্রষ্টা, মালিক এবং একমাত্র শাসক। এখানে তিনি ছাড়া আর কারও হুকুম শাসন চলে না এবং সকলেই তার অনুগত; সমস্ত ক্ষমতা ও এখতিয়ার পুরোপুরিবাবে একমাত্র সেই মালিক ও সর্বাধিনায়কের হাতে নিবদ্ধ। মানুষ এ সাম্রাজ্যের জন্মগত প্রজা। অর্থাৎ প্রজা হওয়া না হওয়া তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। বরং প্রজা হয়েই সে জন্মেছে এবং প্রজা হওয়া ছাড়া আর কিছু হওয়ার তার কোনো সম্ভাবনা নেই।

এ রাষ্ট্রব্যবস্থার মানুষের স্বেচ্ছাচারী দায়িত্বহীন হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। প্রকৃতিগতভাবেও তা হতে পারে না। সে একে তো জন্মগত প্রজা, তদুপরি এ সাম্রাজ্যের একটি অংশ। তাই সাম্রাজ্যের অন্য সকল অংশ যেমন সম্রাটের আদেশের আনুগত্য করে, তেমনি তারও সেই সম্রাটের আনুগত্য করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই। নিজের জীবনযাপন প্রণালী ও দায়িত্ব নিজেই ঠিক করে নেয়ার কোনো অধিকার তার নেই। সাম্রাজ্যের অধিপতি তাকে যে নির্দেশ দেন তাই মেনে চলাই তার একমাত্র কাজ। সে নির্দেশ আসে অহীর মাধ্যমে। আর যেসব মানুষের কাছে অহ আসে তাঁরা সবাই নবী।

কিন্তু মানুষের পরীক্ষার জন্যে মালিক প্রভু এক সূক্ষ্ম পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। তিনি নিজেও প্রচ্ছন্ন হয়ে গেছেন আর তাঁর সাম্রাজ্যের গোটা আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাও তিনি প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। এ রাষ্ট্রব্যবস্থা বাহ্যত এমনভাবে চলছে যে, এর কোনো শাসক দেখা যায় না, কর্মকর্তাও দৃষ্টিগোচর হয় না। মানুষ শুধু একটা কারখানা চলতে দেখে এবং তার ভেতরে নিজেকে উপস্থিত দেখতে পায়। বাহ্যিক ইন্দ্রীয় দ্বারা সে অনুভব করতে পারে না যে, সে কারও প্রজা এবং কার্ কাছে তার হিসেব দিতে হবে। সে এমন কোনো স্পষ্ট নিদর্শন চাক্ষুস দেখতে পায় না যা থেকে তার ওপর বিশ্ব স্রষ্টার নিরংকুশ কর্তৃত্ব এবং তার কাছে তার নিজের জবাবহি করার ও তার দ্বারা শাসিত হওয়ার ব্যাপারটা সন্দেহাতীতভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে –যার ফলে তা মেনে নেয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর থাকে না। নবীও এসেছেন কিন্তু এমনভাবে নয় যে, তার ওপর অহী আসতে স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছে এবং এমন কোনো নিদর্শনও তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়নি যা দেখলে তাঁর নবুয়াত মানতে বাধ্য হতে হয়। তাছাড়া মানুষ একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। অমান্য ও বিদ্রোহ করতে চাইরে যে ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়, প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণও তাকে সরবরাহ করা হয় এবং তাকে অত্যন্ত দীর্ঘ অবকাশ দেয়া হয়। এমনকি নাফরমানী ও অবাধ্যতার শেষ সীমায় পৌঁছা পর্যন্ত সে কোনো বাধার সম্মুখীন হয় না। সাম্রাজ্যের অধিপতি ছাড়া অন্য কারও আনুগত্য ও দাসত্ব করতে চাইলে তা থেকেওতাকে বলপূর্বক নিবৃত্ত করা হয় না্ তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয় যে, যার যার দাসত্ব ও আনুগত্য করতে চায় করুক। উভয় অবস্থায় অর্থাৎ অমান্য করলে ও অন্যের দাসত্ব করলেও অব্যাহতভাবে জীবিকা লাভ করতে থাকে, বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাজ-কর্মের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ এবং যাবতীয় ভোগের সামগ্রী মর্যাদা অনুসারে তাকে প্রচুর পরিমাণে দেয়া হয়। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তাকে এসব মুক্তহস্তে দেয়া হতে থাকে। কোনো খোদাদ্রোহী বা অন্যের আনুগত্যকারীকে কেবল খোদাদ্রোহী হওয়া বা অন্যের আনুগত্য করার অপরাধে পার্থিব জীবনের উপায়-উপকরণ সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে, এমন কখনো হয়নি। কেননা স্রষ্টা মানুষকে জ্ঞান-বুদ্ধি, ভালো-মন্দ চিনবার ক্ষমতা, কোনটা যুক্তিসঙ্গত ও কোনটা অযৌক্তিক তা বাছ বিচারের যোগ্যতা এবং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মসম্পাদনের ক্ষমতা দান করেছেন। নিজের অসংখ্য সৃষ্টির ওপর তাকে এক ধরনের আধিপত্য ও শাসকসুলভ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার ও সামর্থ দিয়েছেন। এসব দিয়ে তিনি তাকে পরীক্ষা করতে চান। এ পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন করার জন্যে তিনি তাঁর গোটা সাম্রাজ্যের বাস্তবতাকে ও স্বয়ং নিজের অস্তিত্বকে অদৃশ্যের পর্দায় ঢেকে রেখেছেন, যাতে করে তার বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা হয়। তাকে ভাল কিংবা মন্দ পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, যাতে সে সত্য ও ন্যায়কে জানারপর কোনো বলপ্রয়োগ ছাড়া স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে তার অনুসরণ করে, না প্রবৃত্তির দাসত্ব গ্রহণ করে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সেটা পরীক্ষা করা যায়। তাকে জীবনের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ না দিলে তার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার পরীক্ষা হতে পারে না।

দুনিয়ার এ জীবন পরীক্ষার অবকাশ মাত্র। তাই এখানে তার কাজের হিসেবও নেয়া হবে না, তাকে কর্মফলও দেয়া হবে না। পার্থিব জীবনে তাকে যা কিছু ভোগের সামগ্রী দেয়া হয় সেটা কোনো ভাল জাকের পুরস্কার নয় বরং তাও পরীক্ষার উপকরণ। আর সে যা কিছু দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ মুসিবদ ইত্যাদির সম্মুখীন হয় তাও কোনো খারাপ কাজের শাস্তি নয় বরং যে প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন বিশ্বজগত পরিচালিত হয় তারই অধীন স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রকাশিত ফলাফল।–[অবশ্য তার অর্থ এ নয় যে, দুনিয়ার জীবনে কর্মফল প্রদানের নিয়ম আদৌ চালু নেই। আমি যে কথা বলতে চাইছি তা হলো এই যে, দুনিয়ার কর্মফল সুনিশ্চিত ও সুনির্দিষ্ট নয় এবং তা স্পষ্টও নয়। দুনিয়ার যে কোন ব্যাপারে প্রতিদান ও প্রতিফলের চেয়ে পরীক্ষার উপাদানই বেশী। এ জন্যে এখানে যেসব কর্মফল প্রকাশিত হয় তাকে কারও সচ্চরিত্র বা দুশ্চরিত্র হওয়ার মাপকাঠি বলা যায় না।–(গ্রন্থকার)] কাজ-কর্মের আসল ও চূড়ান্ত হিসেব যাচাই-বাছাই ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পন্ন হবে এ পার্থিবজীবনের অবসানের পর। সেটাই এর নির্দিষ্ট সময় এবং তারই নাম আখেরাত। সুতরাং দুনিয়ার যে কর্মফল পাওয়া যায় তা দ্বারা কোনো জীবনপদ্ধতি বা কাজ শুদ্ধ না অশুদ্ধ, ভাল না মন্দ এবং গ্রহণীয় বা বর্জনীয়, তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। আসল মাপকাঠি হলো আখেরাতের প্রকাশিত ফলাফল। আর কোন জীবন পদ্ধতি এবং কোন কাজের ফল ভাল হবে এবং কিসের ফল খারাপ হবে, সেটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের ওপর নাযিল হওয়া অহীর মাধ্যমেই শুধু জানা সম্ভব। খুঁটিনাটি ও বিস্তারিত বিধি পরের কথা। আখেরাসের সাফল্য ও ব্যর্থতা যার ওপর নির্ভরশীল সেই মৌলিক ও চূড়ান্ত বিবেচ্য বিষয় হলো, মানুষ তার যুক্তি বিন্যাস ক্ষমতা ও চিন্তাশক্তির সঠিক ব্যবহার দ্বারা এ কথা বুঝতে পারে কি না যে, আল্লাহ তায়ালাই প্রকৃত বিধানদাতা ও শাসক এবং তাঁর পক্ষ থেকে যে বিদান এসেছে তা আল্লাহরই রচিত বিধান। আর এ কথা বুঝতে পারার পর স্বাধীন নির্বাচনী ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে আল্লাহর শাসন ও বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে কিনা।

নবীগণ শুরু থেকেই এ মতাদর্শ পেশ করে এসেছেন। এ মতাদর্শের ভিত্তিতে দুনিয়ার যাবতীয় ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। বিশ্ব প্রকৃতির সমস্ত নিদর্শনের পরিপূর্ণ তাৎপর্য উপলব্ধি করা সম্ভব। কোনো নতুন পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতা দ্বারা এ মতাদর্শের খণ্ডন হয় না। এ থেকে স্থায়ী ও আলাদা দর্শন প্রক্রিয়ার জন্ম হয় –যা সকল জাহেলী জীবন দর্শন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ দর্শন বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব সত্ত্বা সংক্রান্ত সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানকে নতুন পদ্ধতিতে বিন্যস্ত করে। এ বিন্যাস পদ্ধতি জাহেলী বিন্যাস পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সাহিত্য ও শিল্পকলার লালন ও বিকাশের জন্যে নবীদের মতাদর্শ জাহেলী সাহিত্য ও শিল্পকলার লালন ও বিকাশের পথের সম্পূর্ণ উল্টো ও ভিন্ন পথ রচনা করে দেয়। জীবনের সকল কর্মকাণ্ডে তা এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও এক বিশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে। সে লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে জাহেলী লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকৃতিগত ও উপাদানগত কোনো মিল নেই। নৈতিকতারও একটা আলাদা ব্যবস্থার উৎপত্তি হয় এ মতাদর্শ থেকে। জাহেলী নৈতিকতার সাথে তার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তারপর এ তাত্ত্বিক ও নৈতিক বুনিয়াদের ওপর যে সভ্যতার ইমারত গড়ে ওঠে, তা নির্ভেজাল জাহেলিয়াত থেকে উদ্ভুত সভ্যতাসমূহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। সেই সভ্যতা সংরক্ষণের জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজন –যার মূলনীতি আগাগোড়া জাহেলী শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধী। মোটকথা, এ সভ্যতার ধমনীতে ধমনীতে ও পরতে পরতে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর একক ও নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্ব, আখেরাতে বিশ্বাস এবং তার কাছে মানুষের দায়িত্ব সচেতনতা ও আনুগত্য বোধ সক্রিয় প্রেরণা ও প্রাণশক্তি হয়ে বিরাজ করে। কিন্তু নির্ভেজাল জাহেলী সভ্যতার সমগ্র কর্মকাণ্ড ও বিধি ব্যবস্থা মানুষের বল্গাহীন স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দায়িত্বহীনতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত। তাই নবীদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা থেকে যে ধাঁচের ও যে মানের মনুষ্যত্ব তৈরী হয়, তার রূপ কাঠামো ও বর্ণজৌলুস জাহেলী সভ্যতার তৈরী মনুষ্যত্ব থেকে সর্ভতোভাবে জুড়িহীন।

এরপর এ ভিত্তির ওপর যে বিস্তারিত সামাজিক ও তামাদ্দুনিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার কাঠামো দুনিয়ার অন্য সমসত্ কাঠামো থেকে পৃথক। পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য-বস্ত্র, জীবন-যাপন প্রণালী, চাল-চলন, ব্যক্তিগত চরিত্র, জীবিকা উপার্জন, সম্পদ ব্যয়, দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন, সামাজিক রীতি-পদ্ধতি, বৈঠকাদির পদ্ধতি, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বিভিন্ন রূপ, পারস্পরিক লেন-দেন, সম্পদ বণ্টন, রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকার গঠন, নেতার মর্যাদা, আইন সভা গঠন পদ্ধতি, বেসামরিক প্রশাসনিক সংগঠন আইন রচনার মূলনীতি থেকে খুঁটিনাটি বিধি প্রণয়ন, আদালত, পুলিশ, হিসাব নিরীক্ষণ পদ্ধতি, কর ব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, গণপূর্ত কার্যক্রম, শিল্প ও বাণিজ্য, তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ, শিক্ষা ব্যবস্থা ও অন্যান্য সকল বিভাগের নীতি নির্ধারণ, সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও সংগঠন যুদ্ধ ও সন্ধি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বৈদেশিক নীতি –এক কথায় জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপার থেকে শুরু করে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার পর্যন্ত এ তামাদ্দুনিক ব্যবস্থার নিয়ম-পদ্ধতি একটি শাশ্বত মহিমায় ভাস্বর। এর প্রতিটি অংশে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা তাকে অন্যান্য তামাদ্দুন থেকে পৃথক করে রাখে। এর প্রতিটি বিষয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, এক বিশেষ উদ্দেশ্য ও নৈতিক আচরণ কার্যকর থাকে, যার সম্পর্ক থাকে খোদার সার্বভৌম কর্তৃত্ব, মানুষের অধীনতা ও জবাবদিহির অনুভূতি এবং আখেরাতের লক্ষ্যের সাথে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×