somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তাজউদ্দীন আহমদঃ শ্রদ্ধাঞ্জলি

২৫ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
(মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় নায়ক মহান নেতা তাজউদ্দীন আহমদএর ৯৫তম জন্মদিন ছিল ২৩ জুলাই। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।)


তিনি আসলেন, হাসলেন, আর জয় করে গেলেন। এমন ভাগ্য বিরল। স্বপ্ন দেখাও বাতুলতা। কিছু করতে হলে সততা আর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। প্রত্যেকটি মানুষকেই ভালো কিছু অর্জন করতে হলে, জয় করতে হলে প্রয়োজন একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়। এই গুনগুলো তাজউদ্দীন আহমদের গভীরে প্রোথিত ছিলো। সাথে ছিলো প্রচন্ড মেধা, বুকভরা সাহস আর গভীর সহমর্মিতা। এসেই হেসে জয় করায় তিনি কখনো বিশ্বাসী ছিলেন না। শৈশব থেকেই বাস্তবকে দেখেছেন নিবিড় ভাবে। মিশেছেন মানুষের সাথে। জীবনসংগ্রামকে খুব কাছে থেকে অনুধাবন করেছেন তিনি। ভেবেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য কিছু করার কথা। এই কিছু করার বীজ তাঁর অন্তরে রোপিত হয়েছিল মাত্র এগারো-বারো বছর বয়স থেকেই। ১৯৩৭ সাল। বৃটিশ বিরোধী তিনজন বিপ্লবী দেশপ্রেমিক নির্বাসিত হয়ে কাপাসিয়ায় আসেন। ঘটনাক্রমে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তাজউদ্দীনের সাথে দেখা হয় তাঁদের। কথায় কথায় তাঁরা প্রখর ধীশক্তির পরিচয় পান। তাঁর ভেতরে আগামী দিনের নেতৃত্ব পূর্বাভাস দেখেন। তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদকে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের কিছু বই পুস্তক পড়তে দেন। অল্প বয়সেই তিনি সেগুলো পড়ে সমূহ জ্ঞান আয়ত্ত করেন। মানবিক মূল্যবোধের পাশাপাশি বৈপ্লবিক চেতনাও জেগে ওঠে তাঁর অন্তরে।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের করাল ছোবলে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। অনাহারী মানুষের মুখ দেখে তাঁর হৃদয় কাঁপে। তাদের জন্য কিছু করার আকাঙ্খা তাঁকে তাড়িত করে। মানিকগঞ্জের তেওতার জমিদার পার্বতী শঙ্কর রায় চৌধুরী ধর্মগোলা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। সেই ধর্মগোলার পদ্ধতিতে ফসল তোলার মৌসুমে কৃষকদের নিকট থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হত। পরবর্তীতে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তা দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হত। তাজউদ্দীন আহমদ স্থানীয়দের সংগঠিত করে এ কাজ শুরু করেন। এলাকায় বসন্তের প্রাদুর্ভাব মহামারি আকারে দেখা দিলে তিনি নিজে স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে টিকাদানের ব্যবস্থা করেছেন। আশৈশব তিনি মানুষের সেবা করেছেন। অনেকের ঝগড়াঝাটির মীমাংসা তিনি করে দিয়েছেন। এমন মানবসেবার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে তাঁর। এই হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। যিনি সকল আড়ম্বর পরিহার করে সবসময় মানুষের পাশে থেকেছেন তাদের বিপদে আপদে। মানুষের জন্য কাজ করতে করতে মানবসেবার বৃহত্তম প্লাটফর্ম রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। লোক দেখানো এবং গলাবাজির রাজনীতির বিপরীতে থেকে নিরলসভাবে নিভৃতে কাজ করতেন এই মহান হৃদয়ের মানুষটি।
তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকরা তাদের শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে নগ্নভাবে ব্যবহার করেছে। তিনি এর তীব্র বিরোধী ছিলেন। নিজে কোরআনে হাফেজ ছিলেন। কোন কোন সময় নামাজে ইমামতিও করেছেন। খুতবাও দিয়েছেন জুমায়। ধর্মকে মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস ও ভক্তির দৃষ্টিতে সম্মান দিতেন। রাজনীতির বিষয় হিসেবে ধর্মের ব্যবহারের প্রবল বিরোধী ছিলেন তিনি। ধর্মের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে এমনটা করতেন না। বরং সকল ধর্মকে সমুন্নত রেখে অসাম্প্রদায়িক একটা দেশই ছিলো তাঁর স্বপ্ন। সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার চারটি মূলমন্ত্রের মধ্যে অন্যতম রেখেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে। এ ব্যাপারে তাঁর ভাষ্যঃ "ধর্মের উপর ভিত্তি করে দেশে কোন রাজনৈতিক দল থাকবে না। অর্থনৈতিক ও গঠনমূলক কর্মসূচির উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধু এখানে কাজ করার অনুমতি দেয়া হবে। বাংলাদেশ হবে একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্মের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্র কোন ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্মের নামে কাউকে শোষণ করতে দেয়া হবে না। ধর্মীয় ভিত্তিতে কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকবে না। দেশের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত দলই সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবে।"
বহুমাত্রিক তাজউদ্দীন আহমদকে তাঁর গুণাবলী ও কর্ম দিয়ে সংক্ষিপ্ত কলেবরে উপস্থাপন করা সুকঠিন। এখানে তাঁর আংশিক কিছু দিক আলোচিত হল মাত্র।
তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আত্মপ্রচার বিমুখ তাজউদ্দীন আহমদ বরাবরই নেপথ্যে থেকে কাজ করতে পছন্দ করতেন। তাই বরাবরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে, তাঁর সহচর হয়ে কর্মসম্পাদনেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে আটক করায় যে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হবার কথা ছিলো তা হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ দিশেহারা হননি। বরং বঙ্গবন্ধুর অমিত তেজকে চেতনায় ধারণ করে বহু কৌটিল্য, ষড়যন্ত্রের বাঁধাবিপত্তি অতিক্রম করে স্বকীয় দৃঢ়তায় মুক্তিযুদ্ধকে সম্মানজনক ও সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হল। মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরলেন। মোসাহেব আর চাটার দল তাঁকে ঘিরে রাখলো। ভেতরে ভেতরে শুরু হল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের বূহ্য ভেদ করে প্রিয় নেতার কাছে আগের দিনের সেই প্রিয়পাত্র হয়ে ফিরে যেতে পারেননি তাজউদ্দীন আহমদ। এখানেই ব্যার্থতা তাঁর। এমন একটি বিশাল যুদ্ধের মহানায়ক স্বাধীনতা পরবর্তী এই ষড়যন্ত্রের পঙ্কিলতা অতিক্রম করতে ব্যার্থ হবার পেছনে রয়েছে তাঁর উন্নত রুচিবোধ ও বরফ জমা অভিমান। বঙ্গবন্ধুও ষড়যন্ত্রকারীদের উষ্কানিতে স্বাধীনতাপূর্ব সুহৃদকে বুঝতে এবং সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে গ্রীক ট্র্যাজেডির সকল অধ্যায় ম্লান করে এর মূল্য দিতে হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে, বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদকে, আর বাংলাদেশের মুক্তিকামী আপামর জনগনকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৩:২৮
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×