১।
রুপা নীল শাড়ির সাথে মিল করে দু হাত ভর্তি করে নীল চুড়ি পড়ে টিএসসির মোড়ে দাঁড়িয়ে রিকশা খুজছে অনেকক্ষণ ধরে। শীতকাল আসি আসি করছে, কিন্তু তারপরেও রোদের তেজ কমেনি একটুও। রুপা হান্ডব্যাগ থেকে সানগ্লাসটা বের করে পড়ে নিল।
এই রিকশা এই?
খুব দ্রুত একটা রিকশা সামনে দিয়ে চলে গেল। একবারের জন্যে পিছনে ফিরেও তাকাল না। রুপা গত ১৭ মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার এখন ধানমন্ডি তিন নাম্বারে যাবার কথা। দুপুর বারোটার সময় দখিনা হাওয়া ভবনের নিচ থেকে একটা র্যালি বের হবে। হুমায়ুন স্যার এর জন্মদিন উপলক্ষে। এই ভরদুপুর বেলায় র্যালি করার বুদ্ধি হিমুর। কোন মানে হয়?
রুপা আবারো ঘড়ির দিকে তাকালো, এখন বাজে ১১টা বেজে ৩৫ মিনিট। এখান থেকে রিকশা করে ধানমন্ডী যেতে কম করে হলেও ৩০ মিনিট লাগার কথা। আর ইদানিং ঢাকা শহরে জ্যাম এর অবস্থা হয়েছে ভয়াবহ।
আরে রুপা না? কি করছ এখানে দাঁড়িয়ে?
ও বাকের ভাই? কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি, একটা রিকশাও পাচ্ছি না, এদিকে র্যালি তো শুরু হয়ে যাবে দেখছি।
যাবে না মানে, রিকশা যাবে রিকশাওালার বাবাও যাবে। দেখ না কেমন করে টিপে দিচ্ছি। বলেই বাকের ভাই রাস্তার মাঝখানে জেয়ে দাড়ালেন। আশ্চর্জের বিষয়, পলকের মধ্যেই বাকের ভাই একটা রিকশা ঠিক করে ফেললেন।
দেখলা রুপা, যেই রোগের যেই চিকিতসা, জ্বরের চিকিতসা প্যারাসিটামল, আর ক্যান্সারের চিকিতসা কেমথেরাপি। হা হা। নেও, উঠে পর, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আপনিও আসুন না আমার সাথে।
নাহ,আমার আবার একটু মোনার বাসার সামনে যেতে হবে, তুমি তো জানো, মোনা আবার রিকশা ঠিক করতে পারে না, তুমি চলে যাও, আমি মোনাকে নিয়ে চলে আসতেছি...!! বলেই বাকের ভাই শিস বাজাতে বাজাতে বদির বাইকের পিছনে জেয়ে উঠলেন।
২
এই ড্রাইভার, তোমাকে টাকা দিয়ে রেখেছি কি জ্যামে বসে থাকার জন্যে? ফাজিল কোথাকার?
মাজেদা খালা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, সাতাশ নাম্বারের সিগ্ন্যালে এসে তার গাড়ি আটকে গেছে, কোন ভিয়াইপি নাকি এই রাস্তা দিয়ে যাবে, তাই কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। ফুল স্পিডে এসি চলছে, তারপরেও মাজেদা খালার কপালে সুক্ষ ঘামের রেখা।
এই ড্রাইভার, তোমার কাছে পানি আছে?
জি না ম্যাডাম।
পানি নাই কেন? যাও পানি কিনে নিয়ে আসো। ফাজিল ছেলে।
ম্যাডাম রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থেকে নেমে জাওয়াটা মনে হয় ঠিক হবে না, সাইড করে তারপর যাই?
পানি রাখ না কেন গাড়িতে? এরপর থেকে গাড়ি নিয়ে বের হবার আগে গাড়িতে পানির বোতল কিনে রাখবে।
মাজেদা খালা তার নতুন কেনা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আর হটাত চমকে উঠলেন, আরে এটা শুভ্র না? এই ড্রাইভার, ডাকো, ডাকো, শুভ্র ছেলেটা কি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছি নাকি? রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এরকম করছে কেন?
এই শুভ্র, এই?
ড্রাইভার, যাও, শুভ্রকে ধরে নিয়ে আসো। দেখতে পাচ্ছ না, ছেলেটা কিছু দেখতে পাচ্ছে না?
খালা স্লামিলিকুম, ভালো আছেন?
হ্যা, ভালো আছি, তোমার একি অবস্থা? এখন কি কিছুই দেখতে পাওনা?
না খালা, আসলে ব্যাপারটা তা নয়, এখনও অল্প অল্প দেখতে পাই, কিন্তু ডাক্তার বলেছে আর সর্বোচ্চ মাস দুয়েক। তারপরে পুরোপুরি অন্ধ। তাই এখন থেকেই প্রাক্টিস করছিলাম একটু।
বলো কি?
জি খালা, মা তো এখন আর বাসা থেকেই বের হতে দেয়না, আজ হুমায়ুন স্যার এর জন্মদিন দেখে বের হতে দিয়েছে।
এসো, উঠে এসো গাড়িতে, আমিও তো সেখানেই জাচ্ছি। কি গরম পড়েছে দেখেছো? সব হিমু ফাজিলটার কাজ। এই গরমে দুপুর বেলায় কেউ র্যালি দেয়? বিকেলে দিলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত?
হিমু যখন বলেছে কিছু একটা সারপ্রাইজ নিসচয় আছে। হিমু তো এমনি এমনি কোন কিছু করেনা। গেলেই বোঝা যাবে।
৩।
চাচা মিয়া আপনার নাম কি?
জি, কিছু বললেন?
জি, বলছিলাম আপনার নাম কি?
জি আমার নাম মোখলেসুর রহমান।
ও আচ্ছা, গ্রামের বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনার নীলগঞ্জে।
এই যে এত বয়স হয়েছে এখনও রিকশা চালান, আপনাকে দেখার কেউ নেই?
কেউ থাকলে কি আর রিকশা চালাই? পোলা দুইডা হইছে হিরঞ্চি, নিশা কইরা পইরা থাহে, হেরারেই আমার দেখা লাগে, সবই আমার কপাল।
মিসির আলির চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে, এই বুঝি গড়িয়ে পরবে। আহারে, এই মানুষটার কত দুক্ষ। আচ্ছা, বাংলাদেশে যত ধনীরা আছেন তারা যদি এইরকম মখলেসুর রহমান দের দায়িত্ত নিয়ে নিত তাহলে দেশটা কত শুন্দর হয়ে যেত। এই বুড়ো বয়সে কোথায় তার নাতি নাত্নি নিয়ে আনন্দ করার কথা, আর সেখানে কি না তাকে রিকশা চালাতে হচ্ছে। জগতটা এত দুখের কেন?
মিসির আলি আকাশের দিকে তাকালেন। তার ভ্রু কুচকে গেল। প্রচন্ড রোদ উঠেছে। কিন্তু আকাশটা পরিস্কার নীল। কিছু সাদা পেজা তুলার মত মেঘ ছড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে।
সামনে কিসের যেন জটলা দেখা যাচ্ছে, রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে, রিকশার পাশ ঘেঁষে একটি গাড়ি এসে থামল। গাড়ির দুটি গ্লাসই কালো। ভিতরে কে আছে বোঝা যাচ্ছে না। মিসির আলি সময় কাটাবার জন্যে ভাবতে লাগলেন, গাড়ি দেখে কি অনুমান করা সম্ভব যে ভিতরে যিনি আছেন তার চারিত্রিক বিশিষ্ট কেমন হতে পারে? চেস্টা করে দেখা যেতে পারে।
গাড়ির রঙ লাল, লাল রঙের গাড়ি নিশ্চয় কোন লোকের হবার কথা না, খুব সম্ভবত গাড়ির মালিক একজন মহিলা। আচ্ছা, মহিলার বয়স কত হতে পারে?
হটাত করেই গাড়ির একটি গ্লাস খুলে গেল, ভিতর থেকে এক রূপবতী মেয়ে মাথা বের করে বলল স্যার স্লামালিকুম। স্যার ভালো আছেন?
মিসির আলি খুব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন, এভাবে কোন গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকাটা উচিত হয়নি। আর এই মেয়ে নিশ্চয় তার ছাত্রি হবে। কিন্তু তিনি ঠিক মনে করতে পারছেন না।
অলাইকুম সালাম।
স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন?
না ঠিক চিনতে পারছি না, বয়স হচ্ছে, এটা বয়স হবার লক্ষন, ইদানিং অনেক কেই চিনতে পারছি না। আমি খুবই লজ্জিত, মা, তুমি যেন কে?
স্যার, আমি মৃন্ময়ী। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে এসে হটাত করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর পরিক্ষা দেবো না, তখন স্যার আপনি এসে আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। আপনার কথামত পরিক্ষা দিয়েছিলাম বলেই সেবার পাস করে গিয়েছিলাম। মাস্টার্স করতে স্যার বাবা আমেরিকা পাঠিয়ে দিল। হুমায়ুন স্যার এর সাথে শেষ দেখা আমার সেখানেই হয়েছিল। দু বছর হল দেশে এসেছি। হিমু ফোন করে আজকের র্যালির কথা বলল। তাই অদিকেই জাচ্ছি। স্যার, আপনি কি অদিকেই জাচ্ছেন?
হ্যা, আমিও সেখানেই জাচ্ছি, হিমু আমার কাছেও এসেছিল, কিন্তু র্যালির কথা তো কিছু বলেনি আমাকে। আমি অবশ্য সন্দেহ করেছিলাম, ওর নিসচয় কোন পরিকল্পনা আছে।
স্যার, কিছু মনে না করলে গাড়িতে উঠে আসুন। বাইরে প্রচন্ড রোদ। প্লিজ স্যার।
আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে।
মখলেসুর রহমান কে ভাড়ার পুরো টাকা দিয়ে মিসির আলি মাঝপথে নেমে গিয়ে মৃণ্ময়ীর গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।
৪।
দখিন হাওয়া ভবনের একটু সামনে ধানমন্ডি লেক এর পাশের বেঞ্চিতে বসে হিমু সবেমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছে। হাতে ঘড়ি নেই দেখে বুঝতে পারছে না সময় কত হয়েছে। অনুমানে বুঝতে পারছে বারোটা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। অথচ এখনও কেউই এসে পৌঁছায়নি। সবাইকেই খবর দেয়া হয়েছে। যদিও সে নিজে খুব বেশিজনকে বলতে পারেনি। তিনদিন আগে বাদলকে বলেছিল আজকে সবাইকে হুমায়ূন স্যার এর বাসার সামনে চলে আসতে। বাদল এর সবাইকেই জানাবার কথা। আর যেই ভুল করুক, বাদল এই নির্দেশ অমান্য করবে সেটা হবার কথা নয়। নিশ্চয় সবাই চলে আসবে। হটাত করেই হিমুর খুব চায়ের তেস্টা পেয়ে গেল। আশেপাশে কোন চায়ের দোকান ও দেখা যাচ্ছে না। কালকে সারারাত খুব হাটাহাটি করা হয়েছে। এই মুহুর্তে পা ব্যাথা করা শুরু হয়ে গেছে। আজকে র্যালি তে যেতে পারলে হয়। নাহ, হিমুদের শরীরকে প্রাধান্য দিলে চলবে কেন, শরীর মোরে গেলে পচে যায়, মন পচে না, মন অমর। হিমু চায়ের উদ্দেশ্যে লেক ধরে হাটা ধরল।
এই চা গ্রম, এই চা গ্রম। আপনি হিমু না? স্যার আমাদের চিনেছেন? আমরা তিনজন, হুমায়ূন স্যার মারা যাবার পর কিছু করা হচ্ছে না, এখন তিনজন মিলে চা বিক্রি করতেছি। ভাইজান চা খাবেন, চা দিবো? এই মজনু হিমু ভাইজানরে চা দেও?
হিমু ভাইজান, কফি খাবেন, কফি, আমাদের কাছে কফিও আছে। বলেই বজলু কফি ঢেলে কাপ এগিয়ে দিল।
বাহ, ব্যবসা তো ভালোই চলছে মনে হচ্ছে।
কি যে কন হিমু ভাই, স্যার চইলা যাবার পর থেইকা কোন কাজে মন বসেনা। চা, কফি বিক্রি আসল উদ্দেশ্য না, ভাইজান, লেকের পারে বসে বিক্রি করি আর স্যর এর বাসার দিকে মাঝে মাঝে তাকাই, মনে হয় স্যার এখানেই আছে, কোন একদিন এসে বলবে, আর কত চা বিক্রি করবা, চল নতুন কিছু করি, সামনে ঈদ আসতেছে, নাটক বানাতে হবে তো।
মামা কাদছে, মজনুও কাদছে। তাদের কান্না দেখে হিমুর খুব ইচ্ছে করছে তাদের সাথে যোগ দিতে, কিন্তু সম্ভব না, হিমুরা চোখের জল ফেলে না, চোখের জল হল মায়া, হিমুদের থাকতে হবে সকল প্রকার মায়ার উর্ধে।
হিমু ভাইজান, আজকে নাকি র্যালি আছে, এই জন্যে এইখানে চইলা আসচি, র্যালিও করা হবে, আর তার মধ্যে কারো চা কফি খাইতে ইচ্চা করে আমাদের কাছ থেকে খাইতে পারবে। র্যালিতে যারা থাকবে তাদের জন্যে চা কফি ফ্রি।
কি বলেন, চা কফি ফ্রি? তাইলে রাইতে খাবো কি??
বজলু, তোমারে না বলছি কথা কম বলতে। হিমু ভাইজান কিছু মনে করবেন না, তার অধিক কথা বলার স্বভাবটা এখনও যায় নাই।
হিমু তার বিখ্যাত হাসি দিয়ে হাটা ধরল, সবাই আসার আগে কিছুক্ষন হেটে আসা যাক। লেক এর এই পাশটা অনেকটাই নির্জন। আর রোদও কম, পাশেই বড় বড় বিল্ডিং, সেই বিল্ডিং এর ছায়া পড়েছে আর একপাশে গাছ। হাটতে ভালই লাগছে। কিন্তু সমস্যা একটাই শরীর কুটকুট করছে, ঘামে ভেজা হলুদ পাঞ্জাবি গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। একটা গোসল দিতে পারলে ভালো হত। পাশেই লেক দেখে ইচ্ছে করছে লেকের শান্ত পানিতে নেমে যেতে। শুধু চোখ বন্ধ করে একবার ভাবতে হবে এটা কোন লেক নয়, এটা সেই ময়ূরাক্ষী নদী।
হিমু নাকি, নাইমা আসো, পানি অত্যাধিক শিতল। যেই গরম পরছে, তাতে পানিতে না নাইম্যা উপায় আছে? নাইমা আসো, তোমার সাথে গফ করি। তুমি আছো কেমন??
কে, দোতারা চাচা নাকি?? আপনি এখনও পানিতে থাকেন নাকি সবসময়?
জল চিকিৎসা নিতেছি, তাই থাকতে হয়। চিকিতসার মধ্যে বিরতি দেয়া তো ভালো না।
হুম, এইটা ঠিক বলেছেন, জল চিকিৎসার উপরে কোন চিকিৎসা নাই। আপনার তো দেখি প্রোমোশন হয়েছে, আগে থাকতেন পুকুরে, এখন থাকনে লেকে।
আরে নাহ, লেকে থাকবো কোন বিবেচনায়। আজকে কি র্যালি না কি যেন আছে তাই আসছিলাম, যেই গরম পরছে, মাথাটা আবার গরম হইয়া গেল, তাই ভাবলাম মাথাটা ঠাণ্ডা করা প্রয়োজন। মাথা খারাপ তো, এই মাথা খারাপ নিয়া র্যালিতে যাওয়া ঠিক হবে না। কি বল?
হুম, অতি উত্তম সিদ্ধান্ত।
নাইমা আসো, পানি অত্যাধিক শীতল, বিরাট আরাম পাইতেছি।
হিমু পানিতে নেমে গেল, এই মুহুর্তে তার জল চিকিৎসা দরকার না হলেও গোসল করাটা খুবই প্রয়োজন, দোতারা চাচাকে পেয়ে ভালই হল। পৃথিবীর অধিকাংশ কাজই একা করে কোন আরাম নাই, অথচ পৃথিবীতে আমাদের আসতেও হয় একা, যেতেও হয় একা। আর এই কারনেই হয়তো মাঝখানের সময়টুকু আমরা একা কাটাতে খুব ভয় পাই।
৫।
এই মেয়ে, তুমি কাধছো কেন? কে তুমি?
বড় চাচা, আমি নিলু, নিলুফার।
এই কোন নিলু বল তো? আমি ঠিক চিনতে পারছি না। হয়েছে কি জানো, নতুন একটা বিষয় নিয়ে গত দু দিন ধরে খুব চিন্তার মধ্যে আছি। দাড়াও, বিষয়টা তোমাকে একটু খুলেই বলি, তোমার আবার কান্নার ডিস্টার্ব করছি না তো, আমি দু মিনিটের মধ্যে বলে ফেলছি, তুমি দু মিনিট পড়ে না হয় আবার কান্না করতে পারবে, নো প্রবলেম। আমি ভাবছি, মানুষ মরে যায়, মরে গেলে তার দেহ পচে যায়, কিন্তু আত্মার কি হয়, আইনস্টাইন বলে গেছেন, শক্তি অবিনশ্বর, এর ধ্বংস নেই, এর রুপ পরিবর্তন হয় শুধু, আত্মা যদি শক্তি হয় তাহলে মানুষ মরে যাবার পর তার আত্মার পরিবর্তিত রূপটি কি??? তোমার কি এই বিষয়ে কিছু জানা আছে??
না বড় চাচা, আমার বুদ্ধি খুবই কম, আমি এই বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, তবে একজন পারবে, নিশু, তার অনেক বুদ্ধি।
আচ্ছা, নিশুটা যেন কে?
নিশু হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমতি মেয়েদের মধ্যে একজন। বিখ্যাত উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম এর ভালোবাসার মানুষ।
ও আচ্ছা, হ্যা মনে পড়েছে। ভালো কথা, আজকে কি নিশু এখানে আসবে? তাহলে ওর সাথে বসে ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষন আলোচনা করা যেত।
আমি জানিনা বড় চাচা, আমি কিছুই জানিনা।
বড় চাচা বিড়বিড় করতে করতে হাটা ধরলেন লেক এর পাশ ধরে। নিলুর খুব কান্না পাচ্ছে। সে দখিন হাওয়া ভবনের সামনে এই কান্নার ভয়েই যেতে চাচ্ছে না। সবাই নিশ্চয় তাকে খুব বোকা ভাববে। তাই লেক এর এই পাশটায় এসে বসেছিল। নিলু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাধছে। পরম করুনামায় কেন তাকে এত মায়া দিয়ে পাঠালো, কেন, কেন?
৬।
রুপা রিকশা থেমে নামলো। প্রচন্ড রোদে তার গাল গোলাপি আভা ধারন করেছে। দখিন হাওয়া ভবনের সামনে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু রুপা হিমুকে খুজছে। এইতো নদ্দিউ নতিম কে দেখা যাচ্ছে, ওকে কি জিজ্ঞেস করবো? সে কি জানবে হিমু কোথায়?
কবি সাহেব ভালো আছেন। আপনি কি একটা উপকার করতে পারবেন?
অবশ্যই পারবো, শুধু কিডনি দিতে পারবো না, কারন আমার কিডনি একটাই, সেটা দিয়ে দিলে আর চলতে পারবো না।
নাহ, কিডনি দিতে হবেনা, হিমু এসেছে কিনা এই খোঁজটুকু দিলেই আপাতত চলবে।
যাক, বাচা গেল, এই উপকারটুকু করতে পারবো, হিমু এসেছে, সে এখন আছে লেকের পানিতে, শুধু একাই না, তার সাথে দোতারা চাচা, বাদল, তারা তিনজন, তিতলি ভাইয়া, সবাই আছে। কিছুক্ষন আগে শুনলাম বড় চাচাও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে, সবাই মিলে ফিবনাচ্চি রাশিমালায় ডুব দিচ্ছে, আর এই রাশির হিসেব করছেন মহামান্য ফিহা।
বলেন কি? তাহলে আজকের র্যালির কি হবে?
বলতে পারছি না, হিমুর বুদ্ধি ছিল, হিমুই বলতে পারবে।
লেকের পাড়ে জেয়ে দৃশ্য দেখে রুপা হতভম্ব হয়ে গেল। দেখা গেল কম করে হলেও দুশো মানুষ লেকে নেমে গেছে। সবাই কিছুক্ষন পড়ে পড়ে ডুব দিচ্ছে। রুপা খুব কঠিন গলায় হিমুকে দু বার ডাকলো। কিন্তু এত মানুষের মাঝে সে ডাক হিমুর কান অবধি পৌছুলো না। রুপা হতাশ হয়ে দখিন হাওয়ার দিকে রওয়ানা দিল।
একি, নিলু না, তুমি কাধছো কেন?
আমি জানি না, আমি শুধু জানি আমার খুব কান্না পাচ্ছে, ভয়ংকর কান্না।
কেঁদো না বোকা মেয়ে, কাদার মত কিছু হয়নি। এসো আমার সাথে।
রুপা নিলুর হাত ধরে এগিয়ে যায় দখিন হাওয়ার দিকে।
৭।
একটা বড় গাড়ি এসে থামল দখিন হাওয়ার গেটে। গাড়ি থেকে নামলেন শুভ্রর বাবা ইয়াজউদ্দিন সাহেব। তিনি নেমে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে লিফট এর দিকে এগোলেন। বাসায় ঢুকে দেখেন দুনিয়ার মানুষ এসে বসে আছে। তিনি চারিদিকে একবার তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিলেন। সবাই চুপ হয়ে গেল, শুধু ধনু শেখ হুইল চেয়ারে বসে একটা কাশি দিলেন। ইয়াজউদ্দিন সাহেব তাতে গা না করে একবার শুধু ধনু শেখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
আজকে আমাদের মহান শ্রষ্ঠা হুমায়ূন স্যার এর জন্মদিন। আজকের দিনে সবাইকে এক যায়গায় পেয়ে খুব ভালো লাগলো। হিমু নাকি এজকে একটি র্যালি করতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ খবর পাওয়া পর্জন্ত সে নাকি দলবল নিয়ে লেকে ডুব দিচ্ছে। আমি আগেই বুঝেছিলাম হিমু কে দিয়ে কিছু হবেনা, তাই আমি একটা একশো পাউন্ডের কেক নিয়ে এসেছি। সেই কেক বাসায় উঠানো যাবে না, ভ্যান করে আসছে। আজকে সবাই মিলে দখিন হাওয়ার সামনে বসে আমরা দুই মিনিট স্যার এর জন্যে প্রার্থনা করবো, তারপর সবাই মিলে কেক কাটবো। কি বলেন সবাই?
সবাই একবাক্যে মেনে নিল, শুধু ধনু শেখ আরেকবার কাশি দিলেন।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব ধনু শেখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কোন আপত্তি আছে?
জি না, আমার আপত্তি দিয়া কি আসে যায়, আমি অতি নগন্য ব্যাক্তি।
তাহলে অকারনে কাশবেন না, আপনার তো আর যক্ষ্মা হয়নি, আর হলেও সমস্যা নেই, আপনার চিকিৎসার ব্যায়ভার আমি নিজ দায়িত্তে বহন করবো।
পরিশিষ্ট
দুপুর বারোটা বাজে।
সবাই দখিন হাওয়ার সামনে এসে জড় হয়েছে।
হিমু তার সঙ্গি সাথি সবাইকে নিয়ে চলে এসেছে, সবার গা থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ইয়াজুদ্দিন সাহেব হিমুর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। মাজেদা খালা বললেন, হিমু তুই দূরে সরে দারা, তোর গায়ের পানিতে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছিস তো।
সমস্যা নেই খালা, কিছুক্ষনের মধ্যে সবাইকেই ভিজতে হবে।
কেন, সবাই কি তোর মত মাথা খারাপ যে লেকের পানিতে জেয়ে গোসল করবে?
হিমু কিছু না বলে হাসলো।
মতি গান ধরেছে, ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওকি দয়াময়,
চাঁদনী পসর রাইতে যেন, আমার মরন হয়।
কথামত দুই মিনিট নিরবতা পালন চলছে। কোন এক আশ্চর্য কারনে সবাই কাদছে। সবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। এর মধ্যেই এক কোনায় দাঁড়ানো বুয়া হটাত করেই, ও স্যারগো বলে উচ্চস্বরে কেদে উঠলো। শুভ্রর চশমা বারবার ঝাপ্সা হয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি শুভর কাধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ থেকেও পানি পড়ছে ক্রমাগত। বড় চাচা, রুপা, নিশু, নদ্দিউ নতিম, মামা, মজনু, বজলু, বাকের ভাই আর তার পাশেই দাঁড়ানো মোনা সবাই কাধছে। এক নিস্তব্দতা ঘিরে ধরে আছে সবাইকে। সবাই আজ কাধছে। এই কান্না মহামানব হুমায়ূন আহমেদ এর জন্যে, তিনি না ফেরার জগতে চলে জাওয়ায় আজ সবাই অসহায় হয়ে গেছে, সব চরিত্ররা আছে, কিন্তু তাদের প্রান নেই, তাদের গল্প বলার কেউ নেই। মোনা আর বাকের ভাই এর বিয়ে হতে পারতো, তাদের একটা ফুটফুটে কন্যা হতে পারতো, কিন্তু কে লিখবে সেই গল্প? নিশু দাড়িয়ে আছে এক কোনায়। তার খুব ইচ্ছে করছে মতিন এর হাত ধরতে, কিন্তু সে ধরাবে সেই হাত? রুপা এখনও প্রতিদিন বাড়ান্দায় অপেক্ষা করে থাকে হিমুকে একবার দেখবে বলে, কিন্তু হিমু আসে না বরাবরের মতই, কিন্তু রুপা জানে, হিমু আর কোনদিন আসবে না, কোনদিন টেলিফন করে বলবে না, রুপা একটু বাড়ান্দায় এসে দাড়াও তো, নিল শাড়ি পড়ে দাড়িও। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কে লিখবে সেই গল্প??? কে তাদের মদ্ধে আবার প্রানের সঞ্চার করবে??
হটাত করেই আকাশ মেঘে ঢেকে যায়। আর হুট করে শুরু হয়ে যায় বৃষ্টি। এই কান্না কি আকাশের নাকি ওই দূর আকাশে বসে হুমায়ূন কাধছে, আর তার কান্না বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরছে? সবাই ভিঝছে, মাজেদা খালার দামি শাড়ি ভিজে যাচ্ছে, কিন্তু তিনিও আজ কোন কথা বলছেন না। তিনি শুধু একবার হিমুর দিকে তাকালেন। হিমু খালার দিকে তাকিয়ে হাসতে গিয়ে হাসল না। মিসির আলি এক দ্রিস্টিতে তাকিয়ে আছে হিমুর দিকে, তিনি বোঝার চেস্টা করছেন, মহাপুরুষ কি কাধছে?? কাদলে তো আর মহাপুরুষ হওয়া যাবে না। বৃষ্টির পানি এমনভাবে পড়ছে বোঝার উপায় নেই, কান্নার পানি নাকি বৃষ্টির??? হিমু ধীরে ধীরে ভিড় থেকে বের হয়ে পড়লো। বৃষ্টির মধ্যে হাটার মজা আলাদা। একবার শুধু আকাশের দিকে তাকালো, আর মনে মনে বলল, হুমায়ূন স্যার, আপনি ব্যার্থ হয়েছেন, আমাকে মহাপুরুষ বানাতে পারেননি। এই দেখুন আমিও কাধছি। কিন্তু আপনার চেস্টা ব্যার্থ হতে দেব না, চেস্তা করছি মহাপুরুষ হতে। হিমু হাটা ধরে, তার বিখ্যাত হাটা। একবার শুধু পিছন ফিরে দেখে, সবাই কেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সবাইকে আজ এক যায়গায় করা গেছে এই বা মন্দ কি...??? সবাই মিলে প্রার্থনা করলে যদি হুমায়ূন স্যার যদি আবার ফিরে আসেন তবে সেই বা মন্দ কি???? বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদুর। এই জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে, কি হবে শেষ একটা বারের মত কাকতালিয় কিছু ঘটে গেলে...??
বিঃ দ্রঃ মহামানব হুমায়ূন আহমেদ স্যার এর জন্মদিনে এক নাদান ভক্তের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি অনেক অনেক শুভেচ্ছা। বেচে থাকুক হুমায়ূন সবার মনের মধ্যে।