জুবায়ের আহমেদ
আমার শৈশবে মাছ ধরার নেশার ছিলো প্রচুর। বর্ষার শুরুতে, বর্ষায় কিংবা বর্ষা শেষে খাল ও ডোবা থেকে বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরা হতো। আমার নিজের বাড়ীতে আমি বন্ধুদের পাশাপাশি চাচাতো ভাইবোনদের সাথেও খালে জাল ও হাত দিয়ে মাছ ধরেছি। তখনকার সময়ে মেয়েরাও মাছ ধরতো বাড়ীর আশেপাশের খাল, ডোবা থেকে। মামার বাড়ীতে মামাতো ভাই, মামা ও নানার সাথে মাছ ধরতাম।
মইয়া জাল, কনুই জাল, পেলুন, কারেন্ট জাল, লাড়, বড়া, চল সহ বিভিন্ন উপায়ে মাছ ধরার মধ্যে পলো দিয়ে মাছ ধরাটা বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো। বর্ষা শুরুর সময়ে জোয়ারের পানি খালে আসার পর বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি মিলিয়ে জমিতে পানি উঠার পর সর পুটি, বোয়াল ও পুকুর-প্রজেক্ট থেকে ছুটে আসা মাছ জমিতে উঠতো। মাছের উপস্থিতি বুঝেই পলো ফেলতাম। এভাবে বেশ ভালো মাছ পাওয়া যেতো। অবশ্য পলো ছাড়াও চল দিয়েও মাছকে টার্গেট করে ছুড়ে মেরে মাছ ধরা হতো।
কনুই জাল বিশেষ উপায়ে হাতের কনুইয়ে নিয়ে পানিতে ছুড়ে মারতে হয়। মইয়া জালের দুই পাশে লম্বা কাঠের কিংবা বাঁশের চিড় দিয়ে বাঁধা থাকে। দুই পাশ থেকে দুইজন সামনের দিকে টেনে মাছ ধরতে হয়। পেলুন হলো ত্রিভুজ আকৃতির। কারেন্ট জালের সাথে সব অঞ্চলের মানুষই সম্ভব পরিচিত আছেন। লাড় হলো বর্ষা কালে খালি জমিতে সুবিধা মতো ২০-৩০ ফুট দূরত্বে দুটি খুটি গেড়ে, তারপর দুই খুটিতে শক্ত সূতা দিয়ে বেঁধে সেই সূতায় এক-দেড় ফুট দূরত্ব বজায় রেখে সূতোর এক মাথায় বড়শী (কুমিল্লায় আমরা বড়শীকে “ছিপ” বলি) ও অপর মাথা লম্বা শক্ত সূতায় বেঁধে রাখতে হয়। বড়া হলো ধইঞ্চা কিংবা কচুরিপানার শক্ত হাতার মাঝে এক হাত লম্বা সূতোর মধ্যে বড়শী লাগিয়ে ধইঞ্চার ক্ষেত কিংবা ধানি জমির পার্শ্বে ৩-৪ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে আদার (মাছের খাদ্য, শামুকের মাংসের টুকরো, কেচো (জির) দিয়ে ফেলে রাখতে হয়। লাড় কিংবা বড়া কয়েক ঘন্টা পর পর চেক করে মাছ লাগলে নিয়ে পুনরায় আদার দিতে হয়। সারা রাত জেগেও এভাবে আমরা মাছ ধরতাম। চল হলো চিকন মূলি বাঁশ/বোম বাঁশ এর এক পাশে লোহার চিকন রড বা ছাতাতে যে লোহাগুলো থাকে এগুলো নিয়ে ৮/১০ ইঞ্চি লম্বা করে ১৫-২০টি কাটি নিয়ে একপাশে ধার দিয়ে বাঁশের মধ্যে বিশেষ উপায়ে শক্ত করে বেঁধে চল তৈরী করা। এই চল দিয়ে দূরে থাকা মাছে ছুড়ে মারা হয়।
কনুই জাল দিয়ে নিজস্ব ডোবাতে মাছ ধরার আরেকটি বিশেষ উপায় আছে। ডোবাতে মূলত বর্ষাকালে কচুরিপানায় (কুমিল্লায় আমরা ফেনা বলি) ভরা থাকে। বর্ষা শেষে পানি যখন শুধু ডোবাতে থাকে, তখন কনুই জাল ফেনার নিচ দিয়ে জাল যতটুকু দৈর্ঘ্য প্রস্থ ততটুকু ফেনাকে ঘেরাও করা হয়। তারপর ফেনার ছুবড়াগুলো চেক করে করে ফেনাগুলো পুনরায় পানিতে কিংবা জমিতে ফেলা হয়। ফেনা ফেলা শেষ হলে শোল মাছ, টাকি, কৈ মাছ, চেদড়ি (মেনি মাছ), খৈয়া মাছ পাওয়া যেতো। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যেতো কৈ মাছ। এই মাছগুলো কচুরিপানার ছুবড়ার মধ্যে থাকতো, ফলে কচুরিপানার নিচ দিয়ে জালের মাধ্যমে ফেনাগুলোকে ঘেরাও করে ফেললে মাছগুলো আটকে যেতো।
বর্ষার শুরুতে খালে জোয়ারের পানিতে কনুই জাল দিয়ে মাছ ধরার আরেকটা রোমাঞ্চকর উপায় আছে। ছোট খালের মধ্যে জোয়ার ভাটা বুঝে কনুই জাল দিয়ে ফাঁদ তৈরী করা হতো খালজুড়ে। ছোট খাল হলে কনুই জাল খালের দুই পাশ পর্যন্ত চওড়া হতো। দুই পাশে বাঁশ দিয়ে জাল আটকের পাশাপাশি পেছনের দিকে আরেকটা বাঁশ দিয়ে জালটাকে উপরের দিকে তুলে রাখা হতো, আর সামনের দিকে জালটা খালের গভীর পর্যন্ত ফেলে রাখা হতো। কনুই জালের নিচের দিকে লোহা বাঁধা থাকতো বিধায় লোহার ভারে জাল মাটি পর্যন্ত লেগে থাকতো। এভাবে ফাঁদ তৈরী করে রেখে আমরা দুজন খালের দুই পাশে বশে থাকতাম। শোল, বোয়াল, সর পুটি, রুই কাতলা সহ বড় মাছগুলো যখন জোয়ারের পানিতে চলাচল করে সামনের দিকে এগুতে থাকে, ঠিক তখনই মাটি পর্যন্ত ফেলে রাখা জালে টাচ হওয়ার পর লাফ দিতে, আর লাফ দিলেই উপরে মাছ আটকের জন্য তৈরী করে রাখা ফাঁদে পড়তো, সাথে সাথে মাছটাকে আমরা হাত দিয়ে ধরে ডুলিতে কিংবা ডেকচিতে (ডেগ) রেখে দেই। এই ভাবে মাছ ধরাটা বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো।
বর্ষা শেষে ডোবা, খালে কিংবা গাংয়ে হাত দিয়ে মাছও বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো। প্রায় এলাকাতেই এভাবে মাছ ধরে। অনেক মানুষ মিলে দল বেঁধে মাছ ধরতে নামলে মাছ পাওয়া যায় বেশি। হাত দিয়ে মাছ ধরতে গেলে কৈ, টেংড়া, মাগুড় (জাগুড়) সিং মাছের কাটার আঘাতে রক্তাক্ত হতে হতো। বিশেষ করে টেংড়া ও সিং মাছের আঘাতের ব্যথা ভয়াবহ হতো।
বর্ষা শেষে জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি থাকাবস্থায় খালি জমিতে মাছ ধরার আরেকটা উপায় ছিলো। কলা গাছের ডাগ্গা কয়েকটা একসাথে জোড়া দিয়ে লম্বা কাছি বানানো হতো। একপাশে দুজন মইয়া জাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আরো দুজন কাছি দিয়ে পুরো জমিতে টানতে টানতে মইয়া জালের দুইপাশে এসে কাছি টানা শেষ করলে মইয়া জালের মধ্যে ছোট বড় অনেক মাছ উঠতো। দুই পাশ থেকে কাছি টানার ফলে মাছগুলো তাড়া খেতো, তাড়া খেয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকলে অবশেষে মইয়া জালে আটক হতো। এটাও বেশ রোমাঞ্চকর উপায় ছিলো মাছ ধরার।
আন্তা (আন্টা) এবং চাই দিয়েও মাছ ধরা হতো। আন্তা বড় আকৃতির ও চাই ছোট আকৃতির, দুটোর গঠনও একই। পেতে রাখলেই হয়। ছোট ছোট মাছগুলো বন্ধী হয় আন্তা ও চাইয়ে। বাড়ীর আনাচে কানাচের পানিতেই আন্তা-চাই পাতা হয় বেশি।
২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়েই এভাবে মাছ ধরে হয়েছে অসংখ্যবার। আমাদের কুমিল্লার উত্তরাঞ্চলে এখন ঠিকমতো পানি হয় না বর্ষায়। পানি হলেও বিলুপ্ত হতে চলছে বহু দেশী মাছ। আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না এখন। বইচা, দারখিলা, খৈয়া, কটকটি মাছ চোখে দেখি না বহু বছর হয়ে গেছে। বিশেষ করে কটকটি মাছ (মাগুরের মতো, তবে আকৃতিতে ছোট) দেখি না/খাইনি প্রায় ২০ বছর হবে।
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ছেলেরা ঘরকোনো হয়ে যাওয়ার ফলে নিজেরা হাত দিয়ে মাছ ধরা এখন তাদের সম্ভব হয় না, এছাড়া বহু অঞ্চলে বর্ষায় পর্যাপ্ত পানি না হওয়াও বড় কারন। তাছাড়া আমরা যারা নব্বই দশক কিংবা তারও আগে পরে শৈশব অতিক্রম করেছি, সেই সময়ে সামাজিক বন্ধন বেশ মজবুত ছিলো। পুরো পাড়া মহল্লার সকলেই একই পরিবারের মতো থাকতো। ফলে সবাই মিলেই উপভোগ করা হতো সবকিছু। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বর্ষা ও বর্ষা শেষে মাছ ধরার পরিবেশ থাকলেও আমাদের অঞ্চলে (উত্তর মুরাদনগর-কুমিল্লা) এখন আর সেই দিন নেই, নেই মানে একেবারেই নেই। মোবাইল বন্ধী হয়ে গেছে সবকিছু।