বাস বেনাপোল পৌছানোর পর সবাই কুয়াশা ঢাকা সীমান্ত দেখে উত্তেজিত, আর কয়েক শত গজের পরই ভিন্ন দেশ, ভাষা একই রকম কিন্তু জাতীয়তা ভিন্ন। এ পাশে বিডি আর চেক পোষ্ট ও দিকে বি এস এফ পোষ্ট।সারি সারি ট্রাক আছে, মানুষ গিজগিজ করছে এবং আমরা অপেক্ষা করছি, সিস্টেম করতে হবে।
সীমান্ত এলাকায় দূর্ণিতি খুবই সাধারন একটা বিষয়, আমাদের বি ডি আর ভাইয়েরাও টাকা খেতে পছন্দ করে। বি ডি আর বিগ্রেডিয়ার কিংবা এমন একজন কেউ এসে পরিচয় জানতে চাইলো। ঢকাবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার সুবিধা আছে কিছু, এখনও ভারে কাটে খানিকটা। তাদের সাথে দেনদরবার করছে ট্রাভেল এজিন্সির মালিক এবং ওখানে আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে আছে তমাল। এই প্রথম খুব অভাব বোধ হচ্ছে শনকের জন্য। বেচারা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য আসতে পারে নি, এসেছিলো বিদায় জানাতে, সবাই জড়িয়ে ধরে বেশ আবেগঘন একটা বিদায়মুহূর্তও তৈরি করেছিলো। এখন এখানে সম্পুর্ন দায়িত=ব তমালের একার, তমাল নিসঙ্গ শেরপার মতো একটা সেতু তৈরি করে আছে, ট্রাভেল এজেন্সির মানুষদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং এখানের 2 যুযুধান পক্ষের সাথেও তাল মিলিয়ে চলা। রাজনীতির সবক যাকে বলে।
অবেশেষে সবুজ সংকেত পাওয়া গেলো। আমরা লটবহর নিয়ে ধিরে ধীরে নো ম্যানস ল্যান্ড অতিক্রাম করছি, ক্রিকেটের পিচের মতো সামান্য এক টুকরো ভূখন্ড যেখানে কোনো দেশের নাম নেই। ওখানে মারা গেলে কে লাশ দাবি করবে কে জানে? বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা ভালো, কোনো একটা লাশ পড়লে বি এন পি আওয়ামি লীগ দুজনেই নিজের কর্মি বলে দাবি করে, এই নো ম্যানস ল্যান্ডে লাশ পরলে কি দুই দেশ নিজেদের নাগরিক বলে দাবি করে? এসব ফিচকে প্রশ্ন দিয়েই কথোপকথন সাজানো হচ্ছে। রাতজাগার ক্লান্তি কিংবা রাতে ঘুম না হওয়ার ক্লান্তি সবার চেহারায়। লিটু ভাই উৎসাহী মানুষ, চিয়ার আপ বয়েস বলে স্কাউট লীডারের মতো উদ্দিপ্ত করার চেষ্টা করলেও খুব একটা হালে পানি পাচ্ছে না এই উদ্যোগ, সবাই কোথাও নিজের শরীরটা এলিয়ে দিয়ে খানিক বিশ্রমাের স্বপ্ন দেখছে, 52 ব্যাগ এবং হ্যান্ড ব্যাগ এবং প্রতিটা মেয়ের তৃতীয় ব্যাগ,( এটা আমার কাছে আরও একটা রহস্য, মেয়েরা কোথাও গেলে 3টার কম ব্যাগ নিয়ে নামতে পারে না, সেটা 12 ঘন্টার ভ্রামন হোক আর 1200 ঘন্টা তাদের নু্যনতম 3টা ব্যাগ সাথে থাকবেই, এবং সেগুলো পাথরের মতো ভারি, মনে হয় ওরা সবাই ব্যাগে পাথর ভরে ঘুরে। ) এবং কিছু মেয়ে ন্যাকা সুরে আব্দার করছে তোরা পুরুষ হইছোস কি কামে একটুহেল্প কর, কেউ কেউ সাহায্যকরতে উন্মুখ আমি এসব ভাবালুতাকে পাত্তা দেই না। তোমরা শখ কইরা পাথর ব্যাগে ভইরা রাস্তায় নামবা আর আমাগোরে কুলি বানাইবা এইটা কি ধরনের কাম? আমরা কি সবাই অমিতাভ বচ্চন নাকি।
এর পরও একজনের দুরাবস্থা দেখে সাহায্যের হাত বাড়াতে হলো। বেচারা কোনো এক কারনে বমি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। এই বমি করা নিয়েও রসিকতা চলছে, কাকে দায়ি করা যায় এই জন্য? তোমরা তো মানুষ ভালো না, এক রাত বাইরে কাটাইলা আর সকালে বেলা উঠেই বমি করো, কাহিনী কি? আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে রসবোধ সম্পন্ন ছেলে লুকুর রসিকতার মা বাপ নাই, ও যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো বেফাঁস কথা বলে ফেলতে পারে। আমাদের এক বান্ধবিকে একবার ভরা আড্ডায় বলছিলো দেখ যদি গ্যাস বেশী হয় তাহলে পায়ে পাথর বাইন্ধা রাহিস, পরে দেখবি গয়াস বেলুনের মতো উইড়া গেছোস আকাশে, আমরা নীচে দৌড়াইতে দৌড়াইতে তোরে ধরার ট্রাই দিতাছি। বুঝস না নিউটন'স থার্ড ল, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
উত্তরে বিব্রত বান্ধবি বলেছিলো লুকু তোরে আমি খুন করে ফেলবো। আর একটা কথাও বলবি না।
লুকু সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আর বিভিন্ন ঘটনা বয়ান করছে। রাতজাগার ক্লান্তি মুছে দেওয়ার জন্য এসব হাস্যরসের কোনো বিকল্প নেই। সবাই নোম্যানস ল্যান্ডের 40 গজ এলাকা পেরুতে গিয়ে হয়রান। অবশেষে বি এস এফের তল্লাশীখানায় ঠাঁই হলো আমাদের। ওদের শকুনের চোখ, অভিজ্ঞ তাই বেছে বেছে আমাকেই ধরলো, এসে বললো আচ্ছা তোমার কাছে ডলার আছে? অনেকেই পাসপোর্টে যত এনডোর্স করা আছেতার 2 গুন ডলার নিয়ে এসেছে, কেউ কেউ আরও বেশী, সবাই এক বছরে সওদা করে নিয়ে যাবে এপার থেকে,কারো কারো বিদেশি জিনিষের প্রতি চরম ভক্তি থাকে, তারা পারলে বিদেশি পটল বিদেশি আলু কিনে খায়, অবশ্য বাংলাদেশের বাজারে দেশি আর ভারতীয় পেয়াজের দাম আলাদা, ছোটো বেলায় যখন হল্যান্ডের আলু খেতে হতো, সেই সব আজদাহা সাইজের আলু দেখে একটা ধারনাই জন্মেছিলো মনে বিদেশের সব কিছুই বুঝি প্রকান্ড হয়। ভারতীয় পেয়াজের সাইজও বেশ বড়, ভারতীয় রসুন তাও আমাদের দেশি রসুনের দ্্বিগুন সাইজের। চাইনিজ শিম বলে একটা সব্জির কথা মনে পড়ছে, সেটা চলতি শিমের মতো না তার অনেক শাখা প্রশাখা। এসব বিদেশী ভক্ত মানুষেরা পিন্ধনের কাপড় থেকে শুরু করে প্রসাধনী সবই বিদেশি ব্যাবহার করে। আমার এক বন্ধু ছিলো, সে আবার ফ্যাশনদুরস্ত। পোশাকে ফিটফাট মানুষ আমার দুচোখের বিষ, এই সাজুগুজু গুডুগুডু বয়দের আমি হজম করতে পারি না। পোশাক পড়ে স্বাচ্ছন্দ বোধ না করলে পোশাক পড়ে থাকা কেনো? তার আবার ব্রান্ডের আইটেম ছাড়া অন্য কিছু পছন্দ না, ইটালির কোনো এক প্রতইষ্ঠানের শার্ট পয়ান্ট বেলট, জুতাব্যাবহার করে সে। তার সুট পিন বা কোট পিন ওটাও সেই কোম্পানির। এক দিন লাইব্রেরির সামনের জামতলায় ওর সাথে দেখা, তার এইসব কথা শুনে আমি বললাম আচ্ছা খোঁজ নিয়ে দেখছো তো ওরা কনডম বানায় কিনা? ঐটাও তো পড়তে হয়। বেচারা আমার উপর রাজ করছিলো ভীষন রকম।
আমার চারপাশে এমন অনেক মানুষই আজ দাঁড়িয়ে, যারা পুরো ব্যাগভর্তি লিস্টি এনেছে, এখান থেকে কি কি কিনে নিয়ে যাবে দেশে। আমার পরের প্রশ্ন করা হলো লিটু ভাইকে। তুমি লিখেছো তোমার পেশা ছাত্র, তুমি কি আসলে ছাত্র? লিটু ভাই কেমব্রিজে যাওয়ার কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক জটিলতায় যেতে পারছে না, বেচারা রাজনীতি করে না এটাই তার কাল হয়েছে, 2 বার এডমিশন বাতিল করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা সামনে ঝুলানো হয়েছে, নু্যনতম 1 বছর কিংবা 2 বছর চাকরি না করলে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমন করতে পারিবে না।
লিটু ভাই আইনানুগ মানুষ, ভর্তি বাতিল করে এখানে আমাদের পড়ানোর চেষ্টা করছে। তিনিও গম্ভির মুখে বললেন হ্যা আমি ছাত্র। সব কিছু ভালোয় ভালোয় শেষ হলো, সামান্য কিছু উৎকোচ সব সময়ই সাবলীলতা বাড়ায়, গতীশীলতা বাড়ানোর জন্য অনন্য অর্থ, সেই ফ্লোতে আমরাও বি এস এফের চেকিং শেষ করে বাসের অপেক্ষা করছি।
ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুর মার্কা একটা বাস হাজির হলো সামনে, সবাই ক্ষিপ্ত হলো তমালের উপর, ট্রাভেল এজেন্সির মানুষের উপর ক্ষিপ্ত হওয়ার যথেষ্ট কারন আছে, এটা আমাদের দেশের মুড়ির টিনের তুলনায় খারাপ। সীট ফাটা, কোথাও ভেতরের নাড়কোল ছোবরা বাইরে বের হয়ে আছে, 100 উপদেশবানী অলংকৃত অভ্যন্তরের শিকগুলো মরচে ধরা। খুব ভালো একটা ইমপ্রেশন তৈরি করতে পারে নি, আগে দর্শনধারী পরে গুনবিচারী, এই বাসটাই গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে আমাদের নিয়ে কোলকাতা পেঁৗছালো, সম্ভবত 2 ঘন্টা কিংবা আড়াই ঘন্টার মামলা, ঠাঁই হলো নিউ মার্কেটের আশে পাশের কোনো এক হোটেলে। সেখানে বাংলাদেশিরা উঠে নিশ্চিত ভাবেই, 6 বিছানার কক্ষ, 2 বিছানার কক্ষ, 3 বিছানার কক্ষ, 4 বিছানার কক্ষ, অনেক রকম কক্ষ আছে, শিক্ষকেরা মহান তারা 2 বিছানার কক্ষ পেয়ে ঢুকে গেলেন। তমাল ছিলো ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে, সে হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে সবার হাতে চাবি তুলে দিচ্ছে, শিক্ষকদের হাতে চাবি তুলে দেওয়ার পর তারা দৃষ=টির সামনে থেকে সরে গেলো। গোল বাঁধলো তখনই, বাকি সবাই চাবি চাইছে এবং সঙ্গি হিসাবে নিজেদের পছন্দের মানুষ চাইছে, হলবাসী বন্ধুরা এতে দূর্নিতির গন্ধ খুঁজে পেয়েছে, তাদের দাবি তমাল কোনো একটা আপোষ রফা করেছে ওদের সাথে। আমাদের পেটে ছুঁচোর ডন, সারারাত ভ্রমনের ক্লান্তি, এবং এখানের এসব রংবাজি দেখে বিরক্ত হলেও আমি নিশ্চিত ঝামেলায় জড়াতে যাচ্ছি না। কে শালার সামনে গিয়া বলবে ওদের ওরা যা করতেছে এইটা ঠিক না। সবাইকে যে সিঙ্গেল বেডরূম দেওয়া হবে না এটা আমরা সবাই জানি, একটু মানিয়ে চলতে হবে। যাই হোক শিক্ষকদের পর মেয়েদের পালা, ওদের চাবি বুঝিয়ে দেওয়ার পর হলবাসী ভাইদের দাবি মেনে ওদের চাবি তুলে দেওয়ার পর ঢাকাবাসীরা কক্ষ বাছাইয়ের সুযোগ পেলো। তমাল ক্ষিপ্ত। লিটু ভাইয়ের জন্য 2 বিছানার কক্ষ পাওয়া যায় নি, তার জন্য একটা 3 বিছানার কক্ষ নেওয়া হয়েছে, লিটু ভাই ছাড়া আর কে থাকবে সেখানে, আশফাক আর তানভীর সেই কক্ষে যাওয়ার পর আমরা বাকীরা পেলাম 6 বিছানার 2টা কক্ষ, অবশ্য এতে আমরা যার পর নাই উল্লসিত। যত বেশী জোট বেঁধে থাকা যায় ততই আনন্দ।
এর পরই আসা শুরু করলো একের পর এক অভিযোগ।
বাথরুমে বদনা নেই- তমাল ছুটলো অভ্যর্থনায়, ও সমস্যার সমাধান দেওয়া হলো, শাওয়ার দিয়ে গরম পানি পড়ছে না, আবারও অভ্যর্থনায় যাও। ফ্ল্যাশ কাজ করছে না, ভয়াবহ খরব, আবারও অভ্যর্থনায়। আমার বিছানা পছন্দ হয় নি, আমি রুম বদল করবো। ওদের যতই বোঝানো হয় কেউই ঠিক সপ্তম স্বর্গে নেই, সবাই একই রকমের সমস্যা অনুভব করছে কিন্তু সেই এক বুধবারে তারা মেনে নিয়েছিলো ঢাকাবাসীরাই দায়িত্বে থাকবে ম্যানেেেমন্টের এখন অব্যাবস্থাপনা কেনো?
আমি হোটেল রুমে ঢুকার পর দেখি কোথাও জায়গা নাই, শেষে অভ্যর্থনার সামনের টয়লেটের ফ্রেশ হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাই আর কাজকারবার দেখি, আমাদের ঢাকাবাসীর পক্ষ থেকে তমালকে সাহাজ্য করার জন্য এসেছে রুবেল আর বাবু। ওরা তিন জন অভিযোগ নিস্পত্তির ব্যাবস্থা করছে। শমিক ব্যাস্ত ক্যামেরা নিয়ে, ও 25টা রিল নিয়ে এসেছে, আরও প্রয়োজনে কেনা হতে পারে, সবাই ক্যামেরা এনেছে হয়তো তবে শমিকের ভরসায় আছি আমার মতো অভাজনরা, বলদ তানভীর বাথরুমে গিয়েছে আর বের হওয়ার নাম নেই, ওকে সমানে গালি দেওয়া হচ্ছে , শালা ঘুমাস নাকি ভিতরে গিয়া, মাথায় আলু উঠবো ফ্ল্যাশের চেইন ধইরা ঘুমা, পইড়া গেলে কি হইবো?
দুপুর বাজছে 1টা। বেনাপোলের হোটেলের পরটা ভাজির কার্যক্ষমতা অনেক আগেই শেষ, এখনও রিফুয়েলিং করতে হবে। অথচ সবাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের না হলে খাইতে যাওয়া যাবে না।
এদিকে অভিযোগের পর অভিযোগ আসছে। সব নিস্পত্তি হলো না, তমাল এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বললো তোমরা যদি মনে করো তোমরা এর চেয়ে ভালো ভাবে ম্যানেজ করতে পারবা গো এহেড, টেক দিস রেসপন্সিবিলিটি। আমার আপত্তি নাই, আই হ্যাভ এনাফ।
হলবাসীরা সমস্বরে বললো তুমি দায়িত্বে আছো তুমি সব দেখবা, আমাদের উপর চাপাইতে চাও কেন?
এটার নিস্পত্তি হবে খাওয়ার পর, এমন আশ্বাস দিয়ে আমরা বাথরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকি, খোল খোলো দ্্বার রাখিও না বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে-
আমরা আশার নয়ন মেলে রাখি, অপেক্ষা করি ফ্রেশ হয়ে খেতে যাবো কখন?
( আল্লার কসম চলবেই চলবে)

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


