ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে বলার অধিকার আমার আছে, আমার ভাষাবিষয়ক শুঁচিবাইকে প্রশ্ন করার অধিকারও আছে সবার। আলোচনা হতেই পারে, আমার অভিমত কিংবা বিশ্লেষন সর্বাংশে সঠিক এমন এঁড়ে দাবি আমি করছি না। এটা আমার নিজস্ব অভিমত। যদিও বানানসংক্রান্ত দূর্বলতা বিদ্যমান, আমি নিজেও সঠিক বাংলা ভাষার চর্চা করছি এমনও দৃঢ় ভাবে বলতে পারছি না।তবে আমি আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করি, সচেতন ভাবে চেষ্টা করি বাংলায় কথা বলতে।
বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে এখন বেশ একটা উন্নাসিক অবস্থা চলছে দেশে। আমি যখন দেশ ছাড়লাম 4 বছর আগে তখনও এতটা প্রকট ছিলো না এই বিষয়টা। তখনও দেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যাবস্থা প্রচলিত ছিলো। তখনও ধানমন্ডির আশে পাশে ইংরেজি উচ্চারণের বাংলা বলার প্রচলন ছিলো, এই জানিষ আমাড় গ্রেডটা খাড়াপ এসেষে, এই রকম বাংলা শুনলে আমার অন্ডকোষ থেকে শুরু করে সবকটা স্পর্শকাতর জায়গাই বিষম প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। সেইসব ছেলেদের সঙ্গমযোগ্যা মা, বোন সহ মহিলা সমপ্রদায়ের সাথে বিশেষ বিশেষ ভঙ্গিতে সঙ্গম বাসনাও জাগরুক হতো। এমন বকচ্ছপ জাতীয় একটা প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন ছিলো যেনো তারা বাংলাদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে গ্রহন করে, তারা শাররীক ভাবে বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে থেকে যখন মনে করে তারাহলিউডের কোনো চরিত্রে অভিনয় করছে কিংবা তাদের কোনো পরিজন যে মেরিকা, লন্ডন থাকে কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় থাকে তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির অন্ধ অনুকরন করছে তখন তাদের জন্য যে প্রাথমিক করুণার জন্ম হতো তা নষ্ট হয়ে স্পষ্ট বিরাগে রূপান্তরিত হতো।
আমার প্রায় সব বন্ধুই বাংলা মাধ্যমের ছাত্র, যদি সামাজিক স্তরবিন্যাসের কথা বলা হয় তাহলে তারা সবাই মধ্যবিত্ত এবং নিম্মমধ্যবিত্ত শ্রেনীর। এই একটা সমপ্রদায়ই আসলে বাংলা বই কিনে পড়ে। তা যেমনই হোক, সেবা প্রকাশনীর কিশোর ক্লাসিকস, তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল এইসব সহজপাচ্য সাহিত্যের ক্রেতা এরাই। এদের একটা অংশ পড়ে পাঠাভ্যাস বদলায়। আমাদের জোগা পাকনা কিছু নব্য আজিজে বা যেকোনো সাহিত্যসভানুগামী মানুষেরা কাফকা, লোরকা, বাতচেল্লি জাতীয় কথাবার্তা বলে, আর আমার মতো একটু আর্থিক অনটনে থাকা মানুষেরা তখনও দেশীর সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। এটাই পকেটের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব। আমার অর্থের তেমন জোর নেই, তাই 100 টাকার বেশী দাম দিয়ে বই কিনতে পারি না। নীলক্ষেতের ফটোকপি বই পড়ে আমার সাহিত্যতৃষা মেটাই।
হিন্দি ভাষা বুঝতে বা বলতে তেমন সমস্যা হয় না আমার। আমার বাসার অর্ধেক মানুষ উর্দুতে কথা বলতে আর লিখতে পারে। আমার প্রজন্মে এসে এই প্রথা অনেকটা লুপ্ত। আমরা যেহেতু অভিবাসী এখানে যদিও আমাদের 3 প্রজন্ম এখানে বাংলাদেশে কেটেছে তবে প্রথম প্রজন্মের মানুষেরা উর্দু আর ফার্সির চর্চা করার কারনে 2য় প্রজন্মকে এই 2 ভাষার শিক্ষা দিয়েছিলো। আমাদের প্রজন্মকেও এই পারিবারিক প্রথার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিলো কিছু দিন। আমি তেমন ভাবে আরবি হরফের উপর ভরসা করতে পারি নি বলেই উর্দু কিংবা ফার্সি শেখার বিষয়ে উদাসীন ছিলাম।
আমার কোনো ভাষা শিখতে ইচ্ছা করে না, কোনো আগ্রহ নাই। প্রথমত বাংলাদেশে আমি যে পরিবেশে থাকি তাতে এর কোনো উপযোগিতা নেই। আমি তেমন ভাবে প্রবল সাহিত্যানুরাগী নই। আমার নিজের স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ ভাষায় সাহিত্য পড়ারও আগ্রহ নেই। হিন্দি ভাষায় পড়তে পারি তবে এটার সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি করতে চাই না। আমি বাংলায় পড়তে চাই। তাই আমি সচেতন ভাবে কখনই বাজার থেকে ইংরেজী বা হিন্দি বা ফ্রেঞ্চ বা জাপানী কোনো ভিন্ন ভাষার বই কিনে পড়বো না। সাহিত্যের সামপ্রতিক ধারা সম্পর্কেও আমার আগ্রহ কম।
তারা যেভাবে লিখছে, যা লিখছে সেটাকে অনুকরন করার আগ্রহও আমার নেই, জেমস জয়েস পড়ার চেষ্টা করেছিলাম। বেশী দিন আগ্রহ টিকে নাই পড়ি নি। এর জন্য আমি বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত না।কাফকা কিংবা বালজাক পড়ার ইচ্ছা হয় নি, যদিও এগুলো সহজলভ্য। ইচ্ছা করলেই পড়া যেতো। তবে ইংরেজী বা ভিন্ন ভাষায় এই বইগুলো পড়তে হবে এই যন্ত্রনা করতে ইচ্ছা করে নি।
আমার অশিক্ষা কিংবা কুশিক্ষার প্রভাবেই হয়তো। যেহেতু আমি ভিন্ন ভাষা জানি না তাই আমার বাংলার প্রতি একটা টান আছে। আবার মনে হয় মাঝে মাঝে যেহেতু 2-4 লাইন সাহিত্য লিখি মাঝে মাঝে তাই নিজের প্রতি সৎ থাকাটা কর্তব্য। ভাষার চর্চা- বিনির্মান- ধারাবাহিকতা- পরিবর্তন সবই সাহিত্যিকরাই করে থাকে। তাদের হাতেই ভাষা প্রাণ পায়, তারাই ভাষার সংরক্ষক।
1993এর শেষের দিকে হঠাৎ করে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার চলে আসলো। এলাকা দখল করে লোকজন তার টেনে আকাশে উড়তে থাকা বিভিন্ন পরবাসী সংস্কৃতিকে টেনে আনলো বৈঠক খানায়। এরপর আমরা আধুনিক সমাজের অংশ হয়ে গেলাম, আমাদের ছেলেদের পাছায় উঠলো প্রায় খুলে পড়া জিন্স, মেয়েদের শরীরের কাপড়ের ছাঁটও বদলালো। এইসব বাহ্যিক পরিবর্তনের টানে, আরও একটু সাবলীলতার প্রয়োজনে তারা শুধু পোশাকই না সংস্কৃতিটাকেও আত্তিকৃত করলো। তাই হিন্দি নিম্ন মানের হাজার পর্বের নাটকও অবশ্যই দেখতে হবে এমন একটা চর্চাও শুরু হলো। আমার অবশ্য তেমন করে এই প্রবাহে গা ভাসাতে হয় নি। সারাদিনের আড্ডা শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত 12টা। তখনও তেমন করে টিভি দেখার আগ্রহও থাকতো না। এর পরে আরও ব্যাস্ততা বাড়লো। আরও অনেক সংযোগ হলো। মনস্তাতি্বক সংযোগ, প্রেম এসব বাহ্যিক বিষয়কে নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকার কারনে পরিবর্তনের ধারাটা বুঝলাম না। তখনও সেই 2 কুঁচি দেওয়া প্যান্ট আর চাইনিজ কাট শার্টই পরিধেয় হয়ে থাকলো। সংস্কৃতির চর্চা করতে গিয়ে ভেক ধরে পাঞ্জাবি গায়ে উঠানোর বিষয়টাকে সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে আসলে।
এরপরের সময়টাতে আরও বেশী মগ্ন থেকেছি বাংলায়। অনেক সাহিত্যিককে নতুন ভাবে আবিস্কার করলাম। যদিও প্রণব ভট্ট জাতীয় সাহিত্যিকে সাহিত্যাঙ্গন পচে গেছে, সমরেশের আদর্শবাদ কিংবা শীর্ষেন্দুর আধ্যাতিকতার সাথে হুমায়ুন আহমেদের মধ্যবিত্তের উচ্ছাস আর স্বপ্ন আর সাধের ফারাক আর সেই ফারাক পুরনের চেষ্টার সাহিত্য নিয়েও ক্লান্ত। সাহিত্যাঙ্গনের এইসব চর্চা ক্লিশে হয়ে যাওয়ার সাথেই আবার পরিবর্তন আনার বাসনাটা জাগরুক হলো। এইসব প্রচলিত ধারার বাইরে যেতে হলে এই সাহিত্যজনিত বাসনাকেও বুঝতে হবে। তাই দেশীয় সাহিত্য পড়েই সময় কাটলো যতটা অবসর ছিলো। তবে এই সম্পুর্ন বিষয়টার ভেতরে একটাই সমস্যা ছিলো বাংলায় এখনও পদার্থবিজ্ঞান পড়ার যোগ্যব্যাবস্থা হয় নি। আমাকে দিনের অনেকটা সময় ইংরেজি ভাষায় লিখিত পদার্থবিজ্ঞানের বই পড়তে হতো। নিছক জীবিকার টানে হয়তো এই যন্ত্রনাকে মেনে নিতে হয়েছে। অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক পরিভাষা তেমন ভাবে পোক্ত না বিধায় বাংলায় বিজ্ঞানের বই লেখা কষ্টকর। আর তেমন প্রচেষ্টাও ছিলো না। বাংলা একাডেমী কিছুদিন চেষ্টা করেছিলো, কয়েকখন্ড বাংলা বই বের করার পর সেসব বইয়ের কাটতি ছিলো না বাজারে তাই অর্থনৈতিক কারনেই এই প্রক্রিয়া একটা সময় থেমে গেছে।
তবে এর ভেতরে যা হলো আমার কথ্য ভাষায় ইংরেজির অনুপ্রবেশ ঘটলো। বাংলার ভেতরে ইংরেজী শব্দের মিশেল দিয়ে কথা বলতাম। সবাই বলছে বলেই এটা তেমন করে চোখে পড়ে নি। এর ভেতরেই লেখার সময় দেখতাম সমস্যা হচ্ছে, বাংলাশব্দের জন্য অভিধানের দারস্থ হতে হচ্ছে। নিয়ত চর্চা না থাকলে অনেক শব্দের ব্যাবহার কমে যায়। আমাদের আস্থা শব্দ কিংবা একাগ্রতা শব্দগুলোর বদলে ডিপেন্ডেন্সি ব্যাবহার করা, আমাদের অভিনিবেশের বদলে কনসেনট্রেট করা কিংবা এইসব শব্দ ব্যাবহারের জায়গাটা বদলে যাক। আমরা আস্থা- অনাস্থা। একাগ্রতা, মনোনিবেশ, এইসব শব্দকে কথ্য ভাষায় নিয়ে আসি। আমাদের ব্যাবহৃত অধিকাংশ ইংরেজি শব্দই আসলে বিশেষন, বাংলায় বিশেষনের অভাব নেই।বিশেষ্য থেকে বিশেষন করার রীতিটাও আমরা জানি, আমাদের যৌথ শব্দ তৈরির বিষয়টাতে বিভিন্ন রীতি আছে, শব্দ সংযোগ, বাক্য সংযোগ, অক্ষর সংযোগ রীতিও আছে। এবং এটা একটা নীতির উপর গঠিত। তবে বাংলা ব্যাকরণ পঠনে আমাদের অনাগ্রহ। আমাদের উন্নাসিকতার সুযোগে আমরা দেগা, করেগা, মারেগা খায়েগা ব্যাবহার করছি অনায়াসে। এই দীনতা আমাকে লজ্জা দেয়। আমরা ইংরেজী ব্যাবহার করছিলাম বিশেষনের সহজলভ্যতার জন্য, আমরা হিন্দি ব্যাবহার করছি আরও সাবলীল হয়ে উঠার জন্য। এটাই যদি সবার বোধগম্য ভাষা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে 21শে ফেব্রুয়ারী কেনো? কেনো প্রতি বছর একদিন অযথা খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি, ফুল দান জাতীয় নাটক করা। আমরা নিজেদের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা করবো না। আমরা ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা করবো সচেতন ভাবে আবার এমন ভান করবো যে আমাদের তুলনায় কেউ বেশী সংস্কৃতির ধারক বাহক নেই। আমরা প্রতিদিন চ্যানেল আই, এন টিভিতে অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংলিশে ডিজে ভিজেদের ভিজে ভিজে কথা বলতে শুনবো।এই হীনতা কিংবা দীনতার বিরুদ্ধে কথা বললে আমাদের মানসিক সুস্থতা প্রশ্নের সমুক্ষীন হবে, এই ধরনের অযথা প্রতিরোধ এখনও কেনো প্রচলিত থাকবে।
ইংরেজি আমাদের পেটের দায়। এইটা আরও বেশী নীচ করে দিচ্ছে আমাদের। আমাদের জাতীয়তাবাদী আলোচনার সংস্কৃতি নেই। আমাদের জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিতে সস্তা ভাঁড়ামি আছে, অনেক সাহিত্যিক নামক ভাঁড়ও এখানে লিখছে, অনেকেই ভান করছে, ভান করার অসুখও চলছে, এসবের বাইরে কোনো কথা বললে সেটা অভব্য অসভ্য অশোভন। এমন একটা নীতিমালাও ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। অন্ত্যজ জনের ভাষার আক্ষেপ, ইশ্বরপ্রেম সবই একটু আলাদা রকম ভাবে প্রকাশিত হয়।আমার ভাষা নিয়ে বেশ চিন্তিত সবাই। তারা ফাক ইউ- বাস্টার্ড এইসব শব্দ নিয়ে সচেতন না। মাদার ফাকার বললেও তাদের গায়ে লাগে না। তারা এইসব নিয়ে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে, করবেই না বা কেনো, হলিউডের ছবি অহরহ গালি দিচ্ছে, শরীর নির্ভর শব্দ ব্যাবহার করছে, হিন্দি ছবিতেও এখন বাস্তবতার নামে গালি ব্যাবহৃত হচ্ছে শুধু আমি কিছু বাংলায় শরীর নির্ভর কথা বললেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন কি এইসব বলে যখন বলছি আমাদের বাংলাভাষার চর্চা করা প্রয়োজন তখন সবাই আরও বেশী সচকিত হচ্ছে।
আমার একটা পরিচয় দাঁড়িয়েছে। আমি খারাপ কথা বলি। মানুষকে গালি দেই-তবে সমস্যা হলো আমি গালি দিচ্ছি বাংলায়,সেই সব তারা বুঝছেও। তবে তাদের শোধন হচ্ছে না। এক বন্ধুর একটা কথা মনে ধরেছিলো
বেকুবের হোগা দিয়া তালগাছ ঢুইক্যা গেলেও হের হুঁশ হয় না।
আমাদের সেইসব শালীন বোকচোদদের অবস্থাও এমনই। তারা নিজের সামনের শালীনতা বজায় রাখতে এমন সচেতন যে অসভ্য ভাবে সংস্কৃতি চর্চা করলেও তারা সভ্য।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১১ রাত ১১:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



