ক্যাম্পাস ছেড়েছি অনেক দিন, তেমন নিয়মিত যোগাযোগ নেই ক্যাম্পাসের সাথে। হঠাৎ হঠাৎ অবসর থাকলে এক চক্কর দিয়ে আসি, এর বেশী ঘনিষ্ঠতা আদতে নেই আমার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেশ বড় একটা বিষয়, এখানকার ছাত্রদের রাজনৈতিক অসচেতনতা এবং অতিরিক্ত রাজনৈতিক সচেতনতা সবই দেখে এসেছি। এবং খুব কম সংখ্যাক রাজনীতিনিষ্ঠ মানুষ আমি দেখেছি আমার বিগত ১৫ বছরের ক্যাম্পাস জীবনে। হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ রাজনীতিকে মানবসেবার একটা পন্থা হিসেবে গ্রহন করেছে।
মূলত রাজনীতি সমাজবদলের হাতিয়ার নয়, বরং নিজস্ব পরিচিতি এবং নিজস্ব পরিচয় নির্মাণের একটা পদ্ধতি। যারা তথাকথিত বুর্জোয়া রাজনীতির চর্চা করে, মানে মৃদু বিপ্লবী এবং অতি বিপ্লবী বামদের ভাষ্যমতে যারা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির উপজাত এবং সেই রাজনীতির লোভ ক্যাম্পাসে ছড়ায়, তাদের মূল লক্ষ্য থাকে মূলত নিজের আর্থিক সুবিধা আদায়। এখানে রাজনীতি শুধুমাত্র উপার্জনের হাতিয়ার। তবে এর চেয়ে বড় কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির সবক নেওয়া রাজনীতিতে উচ্চাকাঙ্খী সকল মানুষের জন্য একটা বাড়তি সুবিধা , বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর গণ্যমান্য নেতাদের আবাস এখানে , সুতরাং তাদের সরাসরি সংস্পর্শ্ব পাওয়া এবং ক্ষমতাসীন থাকলে অপরাধ করে নিরাপত্তা পাওয়ার বিষয়ে একটু নিশ্চিত থাকা যায়।
বামপন্থী দলগুলো সমাজ বদলের রাজনীতি করে, তারা বিভিন্ন উপাংশে বিভক্ত, মূলত এইসব রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্মাণ হয় পাঠচক্রে, কিংবা মুক্ত আলোচনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গুটিকয় ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যাদের আমি সব সময়ই অতিবিপ্লবী বলতে চাই। বিপ্লব আসন্ন বিপ্লব হয়ে গেলো বিপ্লব এসে গেলো, এমন নেকড়ে বাঘ নেকড়ে বাঘের চিৎকার আমি তাদের কাছে গত ১০ বছরে অনেক বার শুনেছি। জনবিপ্লব, কিংবা গণবিপ্লব হয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে, সেই মুহূর্তে দল এবং আদর্শের অবস্থা বিবেচনা করে যারা সঠিক পথে থাকবে তারাই রাজনীতিতে বলিষ্ট ভুমিকা রাখবে। এবং এই অতি বিপ্লবীগণ সেই সঠিক রাজনীতি করে বলেই তাদের অনুমাণ।
বিপ্লবের অতিউৎসাহ কিংবা এড্রোলনল গ্রন্থির অতিরিক্ত নিঃসরণ, যেকোনো এক কারণে এরা জীবনে উত্তেজনা চায়, সম্ভবত এদের নৈতিকতাবোধ এদের নেশাসক্ত হতে বাধা দেয় কিংবা এদের নেশা করবার মতো সঙ্গতি নেই, তাই এদের নেশার দৌড় বড়জোর গাঁজা, তবে এরা বিপ্লবাসক্ত এবং এদের এই অতিরিক্ত বিপ্লবী প্রবনতায় এরা হঠকারী আচরণ করেই থাকে।
বস্তুবাদী দর্শণ এবং রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করছি না আমি, পার্টি পলিসি কিংবা থিসিস এন্টি থিসিস নিয়ে বিশাল বক্তৃতা দেওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। আমি সে লাইনের মানুষ না। আমার নিজস্ব পরিচিত অতিবিপ্লবীদের দেখে এটা আমার উপলব্ধি বলা যায়।
প্রতিটা বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহের ক্ষেত্র নির্মাণ করতে হয়, সমাজে চাহিদা তৈরি হয়, বৈষম্যের একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা সামাজিক মানুষ সহ্য করে, কিন্তু তাদের ভেতরে চাপা ক্ষোভ রয়েই যায়। রাজনৈতিক আন্দোলনের লক্ষ্য হলো এই চাপা ক্ষোভ, শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে মানুষের যে ঘৃণা সেটাকে উপলব্ধি করে জনসম্পৃক্ততার জায়গা তৈরি করা।
এবং পার্টি কিংবা সংগঠনের কাজটা আসলে একই সাথে এই ক্ষোভগুলোকে উপলব্ধি করা এবং সেই ক্ষোভ আর অসমতাগুলোকে আক্রান্ত মানুষদের জানানো। এবং তাদের পরিচালিত করা কিংবা তাদের প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদের একটা আকৃতি দেওয়া। তবে মূল বক্তব্য কিন্তু সেই জনসম্পৃক্ততা তৈরির জায়গা।
অতিবিপ্লবী বামদের সব থিসিস এবং এন্টিথিসিসে এই জনসম্পৃক্ততা তৈরীর জায়গা নেই, বরং হারে রে রে করেপেন্সিল হাতে তেড়ে গেলেই পট পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন দিবাস্বপ্নে বসবাস তাদের। তাদের উত্তেজনাহীনতা তাদের সবসময়ই এমন হঠকারী আচরণ করতে বাধ্য করে। এই হা রে রে রে রে রে করে তেড়ে যাওয়া অতিবিপ্লবীদের নিয়ে আমার সব সময়ই সংশয় আছে, তাদের বুদ্ধিমত্তা এবং বুঝবার ক্ষমতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে।
২০০৭ সালের অগাস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন সামরিক বাহিনীর সদস্য একজন ছাত্রকে থাপ্পড় মারবার ঘটনায় দেশ উত্তাল হলো, বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হলো, এবং সর্বপ্রথম একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধী জনআন্দোলন সংগঠিত হলো। এরই ফলশ্রুতিতে ক্যাম্পাস থেকে আর্মি ক্যাম্প সরানো হয়, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শিক্ষক আটক হয়।
এটা সম্ভবত ২৩শে আগস্টের ঘটনা। তখনও ঠিক নিশ্চিত নয় আর্মি ক্যাম্প সরবে কিনা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর থেকে, মধুর ক্যান্টিনের সামনে বসে আছি, বরং আন্্দোলনের আঁচ গায়ে মাখছি, পরিচিত কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সাথে আলোচনা করে বুঝতে চাইছি ঘটনা এবং বর্তমান পরিস্থিতি।
রাজনৈতিক কর্মসুচী নিষিদ্ধ থাকায় আন্দোলন হচ্ছিলো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যানারে-
হঠাৎ করেই একদল মিছিল শুরু করলো, তখনও আদতে তেমন আলোচনা সম্পূর্ণ হয় নি। দাবিদাওয়ার কোনটা কোনটা মানা হবে এটাও ঠিক করা হয় নি। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী কিংবা অন্য কোনো একটা ব্যানারে মিছিল শুরু হওয়া মাত্রই আন্দোলনটি দ্বিধাবিভক্ত হলো। এখানেও সেই কতিপয় অতিবিপ্লবী ভাইদের উত্তেজিত রক্ত। ২৫ মিনিট পরে সব শান্ত হলো। কিন্তু আন্দোলন ঠিক জমলো না। আমিও বিফল মনোরথে ক্যাম্পাস ছাড়লাম/ কথা হচ্ছিলো তখন ছাত্রদলের অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদকের সাথে, তার সাথে ছাত্র লীগের কোনো এক নেতা, যারা আদতে মারামারিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো-
তাদের বক্তব্য সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের কয়জন এখানে আছে, যারা আছে তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী। এবং এই যে মিছিল আর ব্যানার হাতে যে ১২জন মিছিল শুরু করলো শ্লোগান দিয়ে তারা যতটুকু করেছে আমরাও কি তার চেয়ে কম কিছু করেছি। আমাদের অন্তত সেই ক্রেডিট দিতে হবে। তা না দিয়ে আন্দোলন আত্মস্যাৎ করে নেওয়ার মানে হয় না।
সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ব্যনার বেশ শক্তিশালী এবং অরাজনৈতিক ব্যনার, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যানারের একটা আলাদা মূল্য আছে, সেই ব্যানার কিন্তু সবার উত্তরাধিকার, সেটা কতিপয় অবসাদে ভোগা উত্তেজনাখোর অতিবিপ্লবীর জন্য নির্ধারিত বিনোদন নয়।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আন্দোলন বিষয়ে এখনও জনগণের সংশয় কাটে নি। মূলত বিশেষজ্ঞ পর্যায়েও এই সংশয়। তারা সবাই নির্দ্বিধায় মেনে নিচ্ছেন তাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য নেই যার ভিত্তিতে তারা নিশ্চিত করে এর প্রভাব সম্পর্কে ভবিষ্যতবানী করতে পারেন। মূল সমস্যা আদতে তথ্যহীনতা। মনিপুরের একজন অধ্যাপক মনিপুরে টিপাইমুখের সাম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন, তবে সেটাও অনুমাণ, প্রকল্পের বিস্তারিত জানা নেই, তবে যদি তার অনুমিত ঘটনাগুলো ঘটে তবে সেটা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ে ডেকে আনবে।
আমিও একমত এ বিষয়ে যদি অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ হয় এবং যদি পানি সেচ প্রকল্পেরজ ন্য অপসারণ করা হয় তবে সেটা ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনবে। কিন্তু সেটা কি আদৌ ঘটবে?
কি আছে এই ১৫০০ কোটি টাকারও বেশী টাকা ব্যায়ে নির্মীতব্য প্রকল্পে? আমাদের সরকার বলছে তথ্য নেই, ভারতীয় সরকার বলছে তথ্য সব প্রদান করা হয়েছে। এবং সবগুলো প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত ভবিষ্যতবানী কিন্তু টেস্ট মডেলের উপর ভিত্তি করে, কোন মৌসুমে কতটুকু পানি থাকবে বাংলাদেশে কতটুকু পানি আসবে, এসবই আসলে মডেল থেকে মেপে নেওয়া, নিয়মিত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মেপে নিয়ে সেটাকে দিয়ে বিভিন্ন ঢালে কতটুকু পানি প্রবাহিত হয়, প্রকৃতির ক্ষুদ্র একটা নিস্প্রাণ মডেলে এসব তথ্য উপাত্ত দিয়ে একটা সাম্ভাব্য পরিণতির কথা আমাদের কাছে আসে।
ধোঁয়াশা কথাবার্তায় সাধারণ মানুষের এখনও তেমন পক্ষ গ্রহনের অবস্থা শুরু হয় নি। সাধারণ মানুষ কোনো নির্দিষ্ট একটি পক্ষকে সমর্থন করবে কি না এটাও এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে নি, সেখানে পর্যাপ্ত তথ্যের জন্য দাবী জানানো একটা আন্দোলনের সূচনা হতে পারতো। জনগণের এ বিষয়ে তথ্য জানবার অধিকার আছে, কিন্তু জনগণ তেমন ভাবে তথ্য পাচ্ছে না।
আন্দোলনের এই পর্যায় শুধুমাত্র জনসচেতনতা নির্মানের পর্যায়, এখানে এখনও তেমন অবস্থা আসে নি। সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে এখনও অন্ধকারে, তারা ফারাক্কার প্রভাব দেখে আশংকিত তবে এখনও তাদের কাছে পরিস্কার নয় এটা কি শুধুমাত্র পানিবিদ্যুত প্রকল্প না কি এটা কোনো সেচ প্রকল্প?
ল্যাম্পপোষ্ট নামক অতিবিপ্লবী কিছু মানুষের দল হঠাৎ করেই উপলব্ধি করলো তাদের কিছু বলা প্রয়োজন। মানুষের মত থাকবে, সেটা জানানোর চাহিদাও থাকবে, ব্লগে যারা আছে তারা ছাড়া এটা নিয়ে ওয়াকিবহাল কিংবা আপাতওয়াকিবহাল মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কম। ব্লগ লিখে অতিরিক্ত বিপ্লবী হয়ে উঠা কিংবা তথাকথিত বিপ্লবাসক্তি, কোনো এক অদ্ভুত কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিলো তারা জনসম্পৃক্ততা তৈরী না করেই ভারতীয় দুতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করবে।
প্রতিটা আন্দোলনের কয়েকটা পর্যায় আছে, এইসব পর্যায় ধারাবাহিক ভাবে চর্চিত হতে হয়, হঠকারিতা মাঝে মাঝে ভালো ফল বয়ে আনে হয়তো তবে অধিকাংশ সময়ই এটা ফ্লপ করে এবং বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে, সিপাহী বিপ্লব কিংবা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব এসবের ব্যর্থতা এখানেই, তারা উপযুক্ত সময়ে হাতুড়ির ঘা বসাতে পারে নি, বরং যখন জনগণের সমর্থন থাকতো ভারত যখন শত্রু রাষ্ট্র চিহ্নিত হয়েযেতো সে সময়ে এই আন্দোলনের বিপক্ষে যাওয়ার মতো পত্রিকা পাওয়া যেতো না ।
ল্যাম্পপোষ্ট সেটা না করে যা করলো সেটা হঠকারিতা, এবং এখানে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিলো না। রাষ্ট্র জনগণের প্রতিক্রিয়ায় বুঝেছে এই কতিপয় বিপ্লবাসক্ত যুবকের বিরুদ্দে শক্ত ব্যবস্থা নিলেও জনগণ সেটাকে প্রতিরোধ করবে না।
পুলিশ লাঠিপেটা করেছে, এবং এটাই স্বাভাবিক রীতি- যেকোনো দুতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করলে সাধারণত রাষ্ট্রীয় পুলিশ শক্ত হাতে বিক্ষোভ দমন করে, দুত অবধ্য এটা প্রায় সভ্যতার মতো প্রাচীন একটি রীতি, এখন আধুনিক রাষ্ট্রে দুতাবাসের নিরাপত্তাও তমনে অবশ্যপালনীয় একটি রীতি।
সেখানে কতিপয় বিপ্লবাসক্ত মানুষ গিয়ে হৈ হল্লা করলে রাষ্ট্রকে বাধ্য হয়েই কঠোর হতে হয়।
হঠাকারিতার ফলাফল সব সময় শুভ হয় না। এবং হঠকারী ব্যক্তি নিজেই নিজের হোগা মেরে বসে থাকে। ল্যাম্পপোষ্টের সদস্যদের অবস্থাও হয়েছে এমন।