অনেক রাজা-উজির মারা হলো, বাগাড়ম্বর হলো, তবে মূলত এক ইঞ্চিও অগ্রগতি হয় নি আলোচনার। সূচনা থেকেই বলা যাক, মূলত আন্দোলনের কৌশল হিসেবে আমার যে হঠকারিতা পছন্দ হয় নি সেটাকে অন্য সবাই মনে করেছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একমাত্র ঋজু উপায়। আমি এমন কোনো জনবিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার পক্ষপাতি নই।
টিপাইমুখ বাঁধ, ফুলতলি ব্যারেজ, কাচার সেচ প্রকল্প, উৎপাদিত বিদ্যুত এবং তার ব্যবহার, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লাভ-ক্ষতির খতিয়ান, সব কিছু নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত ছিলো। আমি ২ সপ্তাহ আগেও যা বলেছিলাম, এখনও আমার বক্তব্য তাই-
বাংলাদেশের সরকার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উদ্ভুত ভীতি থেকে টিপাইমুখ বাঁধ ও ভারতের প্রকল্পে নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করেছে প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া বিরোধী দল, এমন অবস্থান নিয়েছিলো হয়তো, তবে তেমন ভ্রান্তি কাটিয়ে উঠা প্রয়োজন।
আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক রকম নমনীয়তা আছে, এমন কি সরকার ইদানিং টিপাইমুখ এবং অন্যসব ঔদ্ধত্বের বিষয়গুলোকে যেভাবে সামাল দিয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ সরকারকে খুব বেশী সাহসী মনে হচ্ছে না, বরং তাদের এই প্রসঙ্গে কতটুকু নির্ভর করা যায়, এটা নিয়ে একটা সংশয় আমার আছে। কুটনৈতিক পর্যায়ে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় আওয়ামী লীগ কতটুকু সাফল্য অর্জন করবে সেটা নিয়ে সংশয় থাকলেও আমি নিজে মনে করি আমাদের অন্তত সরকারের কাছে দাবিটা পরিস্কার করে দেওয়া প্রয়োজন।
আমরা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, টিপাইমুখ প্রসঙ্গে সরকারকে কি অবস্থানে দেখতে চাই এবং সরকার যখন আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের কাছে এইসব বিষয়ে তথ্য চাইতে যাবে, তখন আমরা কি কি তথ্য দাবি করবো তাদের কাছে সেটাও পরিস্কার করে তুলে ধরা প্রয়োজন।
দাবিটা এখনও পর্যন্ত আমার সরকারের কাছেই, সরকারই এইসব আলোচনার উপযুক্ত ক্ষমতাধর সংস্থা। সে সংস্থায় আমাদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি রয়েছে, এবং আমরা প্রতিটা সংসদীয় আসন থেকে আমাদের নির্ধারিত দাবিগুলো তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারি-
যদি আমার কাছে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকতো তবে আমি কোনো দেশের দুতাবাসের সামনে গিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে না দাঁড়িয়ে বরং প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম আমাদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের জন্য হলেও নির্মাণ প্রকল্পের সবগুলো ডিটেইলড প্লান এবং ম্যাপিং এর বিষয়গুলো আমাদের কাছে নিয়ে আসতে।
সরকার তথ্য অধিকার আইন পাশ করেছে, এবং আমার দাবি হলো, আমরা সরকারকে বাধ্য করি( যদি সম্ভব হয়) ভারতের কাছে টিপাইমুখ এবং অন্যান্য যেসব নদী বাংলাদেশ-ভারত উভয় ভূখন্ডের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেসব নদী বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য আদায় করা, এবং টিপাইমুখ বাঁধের উচ্চতা, প্রস্থ, সংরক্ষণাগারের পানির ধারণ ক্ষমতা এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা না করে, তারা কিভাবে এটা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে এবং তাদের লক্ষ্য এবং অভিসন্ধি সম্পূর্ণ অবগত হয়ে সেটা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া।
আমাদের হাতে তথ্য থাকবে, উপাত্ত থাকবে, সরকার নিজের আগ্রহে একটা সংস্থাকে দিয়ে বাংলাদেশের সাম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতি ও লাভের পরিমাণ নিরূপন করতে পারে, কিন্তু আমাদের হাতে তথ্য থাকলে আমরাও বিশেষজ্ঞদের মতামত চাইতে পারবো এবং সরকারকে যেহেতু আমাদের নিঃশর্ত বিশ্বাস করবার কিছু নেই, সুতরাং আমরা নিজেরাই যাচাই করে দেখি এতে আমাদের লাভ কিংবা ক্ষতি কোনটা হবে।
আমাদের হাতে তথ্য না থাকলে আমরা যতই রাজনীতির মাঠ গরম করি তাতে কোনো ফায়দা হবে না, আমরা যদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারি টিপাইমুখ বাঁধে লাভের বদলে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ বেশী হবে, তাহলে সরকারী দপ্তরের ভাষ্য যাই হোক না কেনো, আমাদের কণ্ঠ আরও বলিষ্ঠ হবে।
আর যদি সরকার নিজস্ব বিশেষজ্ঞদের মতামত পেয়ে নিশ্চিত হয়ে যায় এটাতে বাংলাদেশের লাভের সম্ভবনা আছে তাহলে সরকার এই আন্দোলনকে কঠোর ভাবে দমন করবে। আশংকা এখানেই।
দমনের বিরোধিতা করতে গিয়ে রক্তক্ষয়ের আগে আমাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় যাচাই করে নেওয়ার জন্য হলেও আমাদের হাতে তথ্য প্রয়োজন, সেটা অন্য কোনো প্রকাশিত নিবন্ধের ভাষ্য নয়, বিজ্ঞান কিংবা মডেলিং সব পরীক্ষাগারেই একই রকম সমাধান দিবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের আবেগ নয় বরং নিরেট তথ্য এবং বৈজ্ঞানিক সমাধানের উপরেই নির্ভর করতে হবে। সেটাই নিরাবেগ সত্য।