ভ্রমন আমার মোটেও পছন্দ না, ভ্রমন শব্দটা শুনলেই আমার ভ্রমর ভ্রমর মনে হয়, ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ানো ধাঁচের সস্তা ফিচকেমি মনে হয়, সমস্যাটা আমার নিজস্ব সমস্যা বোধ হয়। কিংবা ভ্রমন সমন্ধে আমার ধারনাটা একটু আলাদা বিধায় এমন হতে পারে।
কেনো মানুষ ভ্রমন করে, দুরের দেশে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখা, প্রকৃতিপ্রেম। আমার বোধ হয় প্রকৃতিপ্রেম কম। কিংবা আমি অলস। এই যে লোকজন এত দুর দুর যায়, রাঙ্গামাটি বান্দারবান গিয়ে পাহাড়ের চিপায় চাপায় হেগে আসে, এত কষ্ট করে যাওয়ার কি দরকার, একবার ইচ্ছা হয়েছিলো এ শর্মার মাধবকুন্ডে যাবে, গিয়ে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক জলপ্রপাত দেখবে। তো এ শর্মা কোজ খবর নেওয়া শুরু করলো। আমার এক অভিজ্ঞ ভ্রামক বন্ধু এর আগেই ওখানে পাছা ঠেকিয়ে এসেছে সুতরাং তার শরনাপন্ন হওয়া। তার সাফ মন্তব্য অনেক উচু থেকে চিকন একটা পানির রেখা নীচে পড়ছে , জলপ্রপাত সম্পর্কে আমার যে ছবিটা মাথায় ছিলো সেটা একটু থমকে গেলো এহেন বর্ননায়। জলপ্রপাত শব্দটার একটা বলিষ্ঠতা আছে, আমার ভেতরে এমন বোধ হয়, অনেক উচু থেকে গর্জন করতে করতে পানি নীচে পড়ছে, চারপাশের পানির কনা উড়ছে, সেখানে দুপুরে রংধনু দেখা যাচ্ছে, অনেক অনেক ছবি একটানা চোখের সামনে আসে, সেখানে ফিতার মতো একটা পানির ধারা উপর থেকে নীচে পড়ছে ছবিটা মানানসই না, ট্যাপ থেকে পানি পড়ার মতো যদি জলপ্রপাত হয় তাহলে শালার এত দুর পয়সা খরচ করে যায় কোন বেকুব, ঘরে থেকেই পানির ট্যাপ ছাদে নিয়ে ছেড়ে সাধের জলপ্রপাত দেখে নিবো।
তবে চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে যাওয়া যায়। কিন্তু বন্ধুর পরের মন্তব্য আর পরিকল্পনা সামনে বাড়তে দিলো না, শালার উপর থেকে 4 জন মিলে মুতলে এর চেয়ে জোড়ে পানি পড়বে, বেফাঁস মন্তব্য শুনে আর যাওয়া হয় নি মাধবকুন্ড।
যেভাবেই হোক অনেক অনেক অপপরিকল্পনার পরেও বিভিন্ন জায়গায় পাছা দিয়ে চা সিগারেট খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে, বেশির ভাগই নিজের আগ্রহে নয় বরং বন্ধুসহচার্য পাওয়ার লোভে লোভে যাওয়া। আমার ভ্রমনগুলো আসলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে আড্ডা দেওয়া আর বিভিন্ন লোকেশনে গিয়ে চা সিগারেট খাওয়ার আনন্দ।
ভ্রমন আমাকে টানে না, টানে যাযাবর জীবন, একটা জায়গায় হুট করে যাওয়া, গিয়ে খানিক দ্্রষ্টব্য দেখে আসা, কারো সাথে কোনো যোগাযোগ হলো না, পরিবেশের সাথে একটু একান্ত আলাপন হলো না, উটকো অথিতির মতো গেলাম বসলাম, খেলাম, সম্ভাসনের পর ঠিক মতো পরিচয় না হতেই ফেরার তাড়া, এমনটাই মূলত আমাকে ভ্রমনবিমুখ করেছে। আমার মনে হয় কোথাও গিয়ে আগে এলাকর সাথে নিজে সম্পর্ক জোড়ালো করে নেই, একদন্ড দুই দন্ড বসে নিজেকে প্রকৃতির অংশ করে তার পর একটু একটু করে প্রকৃতির ভেতরে ঢুকে যাওয়া প্রকৃত ভ্রমন, অশীল ভাষায় আমার কাছে ভ্রমন অনেকটা সঙ্গম জাতীয়, একটু পুর্বরাগ অনুরাগ, একটু ন্যাকামির সুযোগ, একটু খুনসুটি, এসব করে করে নিজের মতো করে পাওয়া। নারীর ভিতরে যাওয়া আর প্রকৃতির ভিতরে যাওয়ার মধ্যে তফাত কম, তাই আমাকে বাউল টানে বেশী, ওরা আবার নারীর ভিতর দিয়ে পৃথিবী খুঁজে, চমৎকার ধারনাটা। শালার অভ্যাস খারাপ, একটু সুযোগ পেলেই সস্তা দার্শনিকতা শুরু করে দেই। ভ্রমনে ফিরে আসি এবার।
প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে হলে কষ্ট করার পক্ষপাতি আমি না, আমি ডিসকভারি আর জিওগ্রাফিকে দেখে নিবো পৃথিবীর রূপ বৈচিত্র। কল্পনার জোড় থাকলে আসলে 20 ইঞ্চি স্ক্রিনেও বিশাল ভাবে প্রকৃতিকে পাওয়া যায়, এর জন্য হিল্লি দিল্লি করতে হয় না, আর সময় আর পয়সা সাশ্রয় হয় এটা বলাই বাহুল্য। নিজেকে স্থাপন করে নেওয়ার বিদ্যাটা শিখলেই হলো।
আমার যদি কখনও এভারেষ্টের চুড়ায় চা সিগারেটখাওয়ার সাধ হয় আমি উঠবো না এভারেষ্টের চুড়ায় আমি ওখানে অবতরন করবো,একটা হেলিকপটার ভাড়া করে সোজা উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামবো, একটা চায়ের কাপ হাতে তারপর সিগারেট শেষ করে রওনা দিবো। লাভ কি হবে? এই যে সবাই কে বলতে পারবো পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জায়গায় পাছা ঠেকিয়ে একটা সিগারেট শেষ করলাম। এর জন্য এট কষ্ট করে হঁ্যাচরে পাঁচরে উঠবো কেনো আমি, আমি তও অলস মানুষ।
আমার কাছে নিজের লোকালয়ের বিভিন্ন জায়গায় মিশে যাওয়ার মতো ভ্রমন বেশী ভালো লাগে। প্রতিদিন চেনা পৃথিবীর ভিতরে নতুন নতুন রূপ আসে, সেটা দেখি, পায়ে হেটে ঘুরতে ভালোবাসি, চেনা চায়ের দোকানে বসে দোাকনির সুখ দুঃখের গল্প শুনি, আমার আন্তরিকতা ভালো লাগে, ভাষার ব্যাবধান নেই, তাড়া নেই, নিজের মতো তরিয়ে তরিয়ে উপভোগ করা। শালার আমি আসলেই কামুক হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। বয়সের দোষ।
এজন্যই ভ্রমন আমার পছন্দ না, পছন্দ যাযাবর জীবন। যাই হোক এবার কিছু গল্প শুনাই, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমার তাজমহলের রেলিংএ পা ঝুলিয়ে চা সিগারেট খাওয়া হয়েছে, রোটাংপাসের বরফে দাড়িয়ে চা সিগারেট টানা হয়েছে, টাইগার হিলের হু হু বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে কফি সিগারেট টেনেছি হাত অবশ হয়েছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার চুঁড়ায় আলোর পালাবদল দেখেছি, সবই সুন্দর তবে এসব দেখার জন্য এত কষ্ট না করলেও হতো, ডিসকভারিতে দেখে নিতাম, সাথে গরম চায়ের কাপ, হাতে সিগারেট আর সোফা বা বিছানায় নিজের মতো গড়িয়ে দেখার আনন্দ থাকতো বাড়তি পাওনা, অযথা বিরূপ প্রকৃতির যন্ত্রনা হজম করতে হতো না।
আমি এবার আমার নি জের ভ্রমনের গল্প বলি।
আমার বাসা দিনাজপুরতার পাশ দিয়ে গেছে পুর্নভবা নদ, বাংলাদেশের 2য় পুরুষ নদী, যদিও বেশীর ভাগ সময় ওখানের পানি থাকে এক হাঁটুর কম তবুও জায়গাটা আমার প্রিয়। নদীর বুকে চর পরেছে, সামনে খানিক আগালেই শ্মশান, সেখানে পুর্নিমা রাতে হেটে বেড়ানো একটা সময় নেশার মতো ছিলো। ধু ধু বালুচরের মধ্যে হেটে যাওয়া, চারদিকে উজ্জল চাঁদের আলো, মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ ডাকছে, এবং সাথে প্রিয় বন্ধু এবং সাইকেল, এবং ওয়াকম্যানে প্রেমের গান, বালুচরে প্রেমিকার নাম লেখা, যতটা বড় করে লেখা যায়, এবং অমবস্যার রাতে নদীতে নেমে যাওয়া কাপড় বিসর্জন দিয়ে, এটাকে আমি বলতাম প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া।
এমন এক দিনে এক বন্ধু পাড়ে রাখা কাপড় নিয়ে সোজা হাঁটা ধরলে অনেক কাকুতি মিনতি করে তার কাছ থেকে কাপড় ফেরত নিয়েছি। অন্তত 4 জন দামড়া ছেলে ল্যাংগোট পড়ে শহরের রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরছে এটা দেখলে পুলু বাবুরা রামপ্যাদানির বন্দোবস্ত করতোই। আর আমাদের সবাই মোটামুটি নামে ও চেহারায় চিনতো সুতরাং পরের দিন কলেজে যাওয়া যেতো না এমন কি শহর ছাড়া হওয়ারও সমুহ সম্ভবনা ছিলো।
এভাবেই একটা জায়গা আবিস্কৃত হয়, পুরোনো রেলব্রীজ। আমি এক বন্ধু র সামনে বেশ ভাব নিয়েছিলাম, ভাবটা এমন, বিকাল 5টা 15তে ওখানে একটা ট্রেন আসে, সে সময় আমরা ব্রিজে থাকবো এবং ট্রেন ভেতরে আসার পর আমর দৌড় দিয়ে ব্র ীজ পাড় হবো। অসুস্থ উত্তেজনা বলা যায় এটাকে, কিন্তু বন্ধুও বেশ সাহস দেখিয়ে ফেললো। সুতরাং আমাকে পরদিন যেতো হলো রেলব্র ীজে , বিকাল 5টা 15, অলস ভাবে ব্র ীজে উঠলাম, এর পর অপেক্ষার পালা। দুরে ট্রেনের আওয়াজ শুনলাম। ট্রেন যে মাথা দিয়ে আসবে সে মাথা দিয়ে উলটা দিকে হাটা শুরু করলাম, আমরা তখন ব্র ীজের মাঝ খানে ট্রেন ঢুকলো ব্র ীজে, সেখানে পথাচারিদের জন্য 2টা পকেট ছিলো, একটা আমরা অতিক্রম করেছি আগেই অন্যটা একটু সামনে। সাহস কিছুটা কমে গেলো কারন ট্রেনের বিশাল বপু দেখেই আঁতকে যাওয়া। দৌড়ানোর শখ উবে গিয়ে প্রান বাঁচানোর তাগিদ ভিতরে, তাই কাছের পকেটে শরণ নিবো এমন ভাবনা নিয়ে গেলাম, সেখানে একটা অসহায় রেলিং আছে শুধু, পাটাতন বলে কিছু নেই, গ্রামের লোকজন খুলে নিয়া জ্বালানি বানিয়েছে, ওদের গালমন্দ করার সুযোগ আসবে বেঁচে থাকলে এখন করি কি উপায়, আর আমাদের দেখে ট্রেনের হূইশেল, জোড় হূইশেল হসুনে সেদিন প্যান্ট নষ্ট করি নি এটা বিশাল সৌভাগ্য। কোনো উপায় না দেখে হিসাব কষলাম, উপর থকে যদি নদিতে ঝাপিয়ে পড়ি তাহলে বড়জোড় হাত পা ভাঙ্গবে, যদি তেমন হিসাব করে লাফ দেই তাহলে বালিতে পড়বো, ব্যাথ্যা লাগবে কম, নদীর পানিতে পড়লে মরে যাওয়ার সম্ভবনা কতটুকু, মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা যারা জানেন না তাদের জন্য বলি এসব ভাবতে আর হিসাব করতে সময় লাগে কয়েক সেকেন্ড, পরিশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া পাটাতনের উলটো পাশের ভিত্তিতে নামবো। সেই হিসেবে কয়েক পা সামনে গিয়ে ঝুলে ছোটো একটা লাফ, আমরা নিরাপদ। জায়গা মতো পৌছে প্রথম সমস্যা হলো বন্ধু নীচে নামবে না, ওকে পদঢতি বাতলে নিজে সটকে পড়বো এমন হওয়ার নয়, ওকে ঝুলতে বললাম, আমি নিজেও ব্র ীজের পাশের রেলিং ধরে ঝুললাম, ওকে বললাম আল্লার নাম নিয়ে রেলিং ছেড়ে দে, 5 ফুট বাই 5 ফুট জায়গা আছে, ওখানে ল্যান্ড করতে পারলেই হয়ে গেলো। বাঁচার তাগিদ আসলেও জোড়ালো, ঠিক মতো পড়লাম ওখানে, তারপর দেখলাম সার সার লোহার চাকা যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে, আওয়াজ আর দৃশ্যটার মধ্যে সম্মোহন আছে, কারন এর পরে আমরা অনেক বার সেখানে বসে সিগারেট টানতে টানতে ট্রেনের চাকা দেখেছি।
এর পরের গল্পও রেলব্র ীজের, তবে শীত কালের ঘটনা। রেল ব্র ীজের এক মাথায় জোড়া শিমুল গাছ। ঝাড়া 70 ফুট লম্ব দুইটাই। সেখানে এক শীতের রাতে 2টায় গিয়েছিলাম। সাথে 2 বন্ধু শমিক আর তমাল। শমিক একরাতের জন্য দিনাজপুর গিয়েছিল তার অনুরোধেই এমন নিশিরাইতে রাস্তায় নামা নচেত এই নৈশ্য অভিযানের নেশা আমি ছেড়েছিলাম বছর 2 আগে। সেখানে পৌছে আশ্চরত একটা দৃশ্য দেখা হয়ে গেলো। তখন চার পাশে কুয়াশার চাদর। শমিক নতুন সিগারেট খায় ওর তাগিদ একটু বেশী, আমি পুরানা পাপী তাই ওকে সিগারেট দিয়ে ব্র ীজের পকেটে দাড়িয়ে নিজের পুর্ব অভিযানের গল্প বলে আত্ম প্রসাদ নিচ্ছিলাম। একটা ট্রেন আসলো তখন, ট্রেনের আলোয় কুয়াশায় জোড়া শিমুল গাছের ছায়া, মনে হয় কেউ অলৌকিক যাদুতে শিমুল গাছ দুটো ছিড়ে শুন্য ভাসিয়ে দিয়েছে, ট্রেনের লাইন সোজা না তাই আলোর দিক পরিবর্তন হয় আর ছায়াও ঘুরতে থাকে। বড়ই মনোহর দৃশ্য, জোড়া শিমুলের ছায়া শুন্যে ভ্রমন করছে, ঘুরছে শুন্যে, ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় ট্রেন শিমুল গাছ অতিক্রম করলো, ছায়াও মিলিয়ে গেলো, আদ্ভুত এক বিবশতা নিয়ে আমরা নদীর পাশের রাস্তায় নামলাম হঁেটে হেঁটে বাসার পথ ধরলাম।
কেউ যদি আগ্রহী থাকে তাহলে দিনাজপুর রেল স্টেশনে নেমে সোজা পশ্চিমে ঝাড়া 20 মিনিটের মতো হাটলেই কাঞ্চন রেল ব্রীজ দেখতে পারবেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



