আমি পড়ালেখা করেই ঈশ্বর তত্ত্ব সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দর্শন সম্পর্কিত বই ছিল আমাদের পারিবারিক পাঠাগারের সবচেয়ে আকর্শনীয় সংগ্রহ। সেখান থেকে স্কুল জীবনেই আমি নিৎস, স্পিনোজা এবং মার্কসের বইগুলো পড়েছি। এমন কি ইমাম গাজ্জালী এবং মওদুদীর বইও আমি আমাদের বাড়িতেই পড়তে পেরেছি। এক সময় মওদুদীর বইগুলো পড়ে মুগ্ধ হতাম বিশেষ করে তাঁর 'ইসলামী রেনেসার ধারণা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল এক সময়ে। যদিও এর সাথে আমার স্কুলের মৌলভি স্যারের অনুপ্রেরনা অনেকাংশে দায়ী ছিল।
ছোটবেলায় মহাভারত আমাকে ভিষণ আলোড়িত করে, এটা ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে রূপকথার গল্প হিসেবেই আমি বেশি দেখতাম। সেই সাথে কিশোর বয়সে 'এরিক ফন দানিকেন', রাহুল সাংকৃতায়ন আমাকে যে কোন পাঠের জন্য যে নির্মোহ দৃষ্টি তা তৈরী করে দিয়েছিল। হ্যাঁ, আরও একটা বই ছিল আমার খুব প্রিয়, সেটা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ''পৃথিবীর ইতিহাস: প্রাচীন যুগ''।
আমাদের পারিবারিক পাঠাগারটা ছিল আমার দেখা যে কোন পরিবারের তুলনায় বিশাল। দর্শন ও পদার্থ বিদ্যা ছাড়াও হিন্দু-খৃষ্টান-ইসলাম সকল ধর্মের বই সেখানে ছিল। সেটা হয়তো এজন্যে যে আমাদের পরিবারের প্রত্যেকেই উচ্চ শিক্ষিত ছিল বলে এবং সেই সাথে পরিবারের আভিজাত্য বাড়ানোর একটা বিশেষ তাড়নাও থাকতে পারে বলে আমার ধারণা।
স্কুলে হিন্দু শিক্ষক ছিলনা বলে ''ইসলাম শিক্ষা'' নিয়ে পড়তে হয়েছে। আমার স্কুলের মৌলভি স্যার এতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন। সম্ভবত তাঁর ধারণা হয়েছিল আমি মুসলমান হয়ে যাবো। এর কারন ছিল, ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় কাহিনীগুলি আমি প্রশ্ন করে করে শুনতে চাইতাম। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বাসায় নিয়ে গিয়ে এটা ওটা খাওয়াতেন। ঈদের বাজার থেকে আমার জন্য উপহার আনতেন। এ সময়ে কুরআনের বাংলা তর্জমা, শানে নুযুল এবং তাফসীর কিছু কিছু পড়েছি ও শুনেছি।
ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতে আসতো এক বৃদ্ধ, কাঁচা পাকা চুল। সবাই তাঁকে খুব সম্মান দিত। তিনি সবাইকে উপনিষদের জ্ঞান দিতো এবং তার ধারণা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন জ্ঞানী নাই। সেই সন্যাসীও একদিন ছোট কাকীর ঘরের আলমারি ভেঙ্গে দশ ভরি সোনার গহনা নিয়ে পালিয়ে গেল। আমি কিন্তু ব্যপারটায় অবাক হইনি, কিন্তু সবাই এতো অবাক হয়েছিল যে, তারা শেষ পর্যন্ত ধারণা করেছিল তিনি আবার ফিরে আসবেন।
আমার একটা প্রশ্ন ছিল সব সময়, সেটা ঈশ্বরের সৃষ্টি সম্পর্কিত। আমি বুঝেছিলাম এই প্রশ্নটিই ফয়সালা করার জন্য যথেষ্ট যে আমি তাঁকে বিশ্বাস করবো কি করবো না। কারণ ঈশ্বর যদি একা একাই সৃষ্টি হয় তবে সে নির্গুণ হতে বাধ্য; আর যদি আমার উপাসনা সে চায় তবে তাকে অসীম বলি কি করে?
ইন্টারমিডিয়েট পড়বার সময় 'আরজ আলী মাতুব্বর' আমাকে পরিণত করে তোলে। এ সময়ে খৃষ্টান মিশনারীদের সাথে চিঠিপত্র এবং তাদের প্রকাশিত বই পুস্তক আমি পড়তে থাকি। তারাও আমাকে অতি উৎসাহের সাথে বিনামূল্যে বই পুস্তক পাঠাতে থাকে। এভাবে প্রায় বছর খানেক চলার পর তারা খান্ত দেয়। সে সময়ে শেয়ার করার জন্য আমি আমার এক বড় ভাইয়ের (এলাকার) নিকট যেতে থাকি এবং বিতর্ক করি। তিনি আমাকে সংশোধন করতে যেয়ে নিজেই অজ্ঞেয়বাদী হয়ে পড়ে।
সবচেয়ে বড় ব্যপার বলে আমার কাছে মনে হয়, কুসংস্কার আর মিথ্যে বিশ্বাসকে প্রশ্ন করার জন্যই নাস্তিক জ্ঞান ধারণ করা একজন আধুনিক মানুষের জন্য প্রয়োজন। আজন্ম লালিত বিশ্বাস ও সামাজিক অটোসাজেশন গুলো আমাদের সমাজের নিস্পেষণের জন্য দায়ী। ব্যপারটা অনেকটা বন্দুকধারী সন্ত্রাসী আর সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে পার্থক্য পর্যায়ের। নাস্তিকের যুদ্ধটা তাই মূলত ভ্রান্ত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, যে বিশ্বাস জীবনকে শুধু মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে শেখায়, জীবনের গল্পই সেখানে অদ্ভুত মনে হয়।
সবাইকে ধন্যবাদ। মুক্তচিন্তার পথ আরও প্রসারিত হোক। এই কামনা করি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




