ছোট্ট শিশু সৌম। নার্সারিতে পড়ে। বৌদির শত চেষ্টাতেও আজ দুপুরে বিছানায় যায়নি। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর সমস্ত কৌতুহল সে তার এই ছোটকার কাছে মেটাবে। আমি বাড়িতে আসা মাত্রই সে ছুটে এলো। ''ছোটকা তুমি এসেছ?''
''এই তো এসেছি বাবা, তুমি স্কুল থেকে কখন ফিরেছ ?'
''সে তো অনেক আগে।''
''তাহলে ঘুমাওনি যে?''
''এম্নি, ঘুম আসেনি যে''
''তাই বুঝি?''
''হু।''
একটু চুপ থাকে সে। আমাকে বাইরের পোশাক খুলতে সময় দেয়। তারপর বলে, ''আচ্ছা ছোটকা, আমাদের দেশ কোথায়?''
''কেন বাবা, এটাই তো আমাদের দেশ; বাংলাদেশ।''
''না, না। এটা তো মুসলমানদের দেশ। আমাদের দেশ কোথায়?''
ওর কথা শুনে আমি থ। কি বলবো ঐ শিশুকে?
প্রায় প্রতিদিন আমাদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। শুধু আমাদের শিশুদের কাছে নয়, এদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের কাছে, সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে এবং আমাদের নিজের অস্তিত্বের কাছে। আমরা যারা অমুসলিম প্রতিদিনই নিজেকে প্রশ্ন করি, আমাদের দেশ কোথায়? এদেশ নয়? আমরা কি বাংলাদেশী নই?
এদেশ আমার মা। এই মাতৃভূমি আগলে পড়ে ছিল আমার বাপ-ঠাকুরদা, তারা দেশ বিভাগ মেনে নিতে পারেনি, তারা ভারতে গিয়ে ঠাঁই নেয়নি কেবল ধর্মের কারনে। এদেশে সকল সম্পদ আর দেশের প্রতি ভালবাসা নিয়ে থেকে গেছে। পাকিস্তান আমলে শত সাম্প্রদায়িক ঝড়-ঝঞ্জাকে উপেক্ষা করেছে, মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে এদেশকে স্বাধীন করেছে। বাঙালি জাতির লাল-সবুজ পতাকার নিচেই স্বপ্ন দেখেছে। সাম্প্রদায়িকতা নয় সমতা। এদেশের আলো-মাটি-বায়ু আমাদের প্রাণেও তেমনি আনন্দ দেয় যেমনি দেয় অন্য ভাইকে। এখানে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু , কেউ বৌদ্ধ, কেউ খৃষ্টান অথবা অন্য যেকোন ধর্মের অনুসারি। কিন্তু আমরা সবাই এদেশের।
কিন্তু না। প্রতিদিন এদেশের অমুসলিম জনগন একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। প্রতিদিন হয়। আমি কি বাংলাদেশি নই?
গত দুদিন আগে বাংলাদেশের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে অর্থাৎ ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যা নিয়ে একটি পোষ্টের আলোচনা করতে গিয়ে জনৈক সুপ্রকাশ ভৌমিকের একটি কমেন্ট নিয়ে আমিও সোচ্চার হয়েছিলাম। একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে আমার কর্তব্য ছিল ভারতীয় এই নগ্ন হত্যার প্রতিবাদ জানানো এবং এবিষয়ের প্রতি যাদের পক্ষপাতিত্ব (যতদূর মনে হয় তারা সামুর ভারতীয় ব্লগার) রয়েছে তার প্রতিবাদ করা। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কিছু ব্লগার আমার পোষ্টের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে আমার ''হিন্দু পরিবারে জন্ম নেয়া'' এবং ''নাস্তিক হওয়া''কে টার্গেট করে বিভিন্ন ট্যাগিং করে যাচ্ছেন।
ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিষয়, দেশ আমাদের সকলের। ধর্ম নিজ বিশ্বাসের বিষয়, এই বিশ্বাস আপনি জোড় করে কিভাবে সৃষ্টি করবেন। আমিই বা আপনাকে জোড় করে কিভাবে নাস্তিক বানাবো বলুন?
আমি আমার মতকে প্রকাশ করতে পারি এবং আপনার মতে যে আমি বিশ্বাসী নই তা প্রকাশের সাথে যুক্তি তুলে ধরতে পারি। কিন্তু একটি সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বিশ্বাস আপনি কিভাবে চাপিয়ে দিতে পারেন তা বুঝতে আমি সত্যই অক্ষম। তা হলে আপনি হিন্দু কি মুসলিম অথবা আমার মতো নাস্তিক এই বোধটা সম্পুর্ণ আপনার। আর দেশ হচ্ছে আমাদের। এটা হচ্ছে একটি সংগঠন, আমার পরিচয়। আমি নাস্তিক তবু কি আমার পরিবার হিন্দু বলে অস্বীকার করতে পারবো? নাকি আমার পরিবার আইনগত ভাবে আমাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে আমার জন্মকে অস্বীকার করতে পারবে?
আমি আগে বাঙালি, তারপর হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান অথবা নাস্তিক। কিন্তু যারা প্রথমে ধর্মকে নিয়ে আসে তারাই এদেশে সাম্প্রদায়িক। বলতে শুনি আগে আমি হিন্দু অথবা আগে আমি মুসলমান তারপর বাঙালি। এখানেই দেশ, জাত যে পায়ের নিচে ভূলুন্ঠিত তা আর দেখতে হলো না। মুসলমান হয়ে তো পাকিস্তানী হতে পারলাম না, হিন্দু হয়ে তো হিন্দুস্থানি হতে পাররাম না। আর ধর্মের বেশ ধরে কি কেউ আরব হতে পারবে? কেউ কি আমেরিকান বা ইউরোপিয় হতে পারবে? এটাই হলো পরিচয়। এই পরিচয় বাঙালিত্বের পরিচয়। এ পরিচয় কে মুছে দিতে পারে? আছে কোন শক্তি?
তবু হায় সাম্পদায়িকতা, তবু হায় ধর্মের নামে হঠকারিতা। আর নিজ দেশে আমাদের পরিচয় সংকট। এ সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। আজ আমার সন্তান প্রথম স্কুলে যেয়েই সেই সংকটে পড়েছে, আমি আজ তাকে কোন পরিচয় দেই?
সেদিনের পোষ্ট-এ যাকে কটাক্ষ করে লিখেছিলাম, 'সুপ্রকাশ ভৌমিক' অথবা 'চয়ন কান্তি' যদি বাংলাদেশি হয়ে দেশ বিরোধী মন্তব্য করে তার দায় আমি কাকে দিবো?
৭১-এ আমরা দেখেছি কিছু মানুষ যারা ধর্ম দিয়ে নিজের মতামতকে বলি দেয় তারা দেশের স্বার্থকেও বলি দিয়েছিল। এখনও তারা বিভিন্ন নামের আড়ালে যারা সাম্প্রদায়িকতা লালন করছে তারাও তাই-ই করে যাচ্ছে। ভারতে রামের জন্মভূমির জিগির উঠছে, বাংলাদেশে রামপুরা নাম পাল্টে ইসলামপুর রাখা হচ্ছে। এগুলো তো আমাদের চোখের সামনে ঘটছে। আর আমরাও কিছু নিষ্কলুষ শান্তিময়-সাম্প্রদায়িকতার চশমা পড়ে তাই দেখে চলছি; প্রতিবাদ না করে।
আজ এই অবস্থা এসে দাড়িয়েছে আমরা প্রতিবাদ করি না বলে। আমরা কিছু ব্যক্তির উসকানি এবং জঙ্গি তৎপরতার কাছে জি্ম্মি হয়ে পড়েছি। যদিও তারা এদেশের বৃহৎ কোন অংশ নয়। তবু ধর্মীয় উসকানি তাদের প্রধান অস্ত্র।
আসুন তাদের প্রতিরোধ করি।
প্রগতির পথ প্রসারিত হোক।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১১ রাত ১০:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




