চোখেল দেকা তব কিতু নয়
মনেল দেকা বাকি
ওও ......
লিদয় দিয়ে লেনা দেনাআআ......
“এই নচ্ছার পাজী মেয়ে ! তুই থামবি ? নাকি মাইর লাগাবো ধরে ? কখন থেকে ভুলভাল গান গাচ্ছিস ! আগে কথা বলা শিখ ভালোমত । তারপর গান গাস !”
“ইহ! আমাকে বলে আমি কতা পালি না ! কত্ত বল তাহস ! তুই নিজে একনো নেংতু হয়ে বাতলুমে যাস ; বিতানায় হিতু কলিস ! হিহিহিহিহিহিহিহি ......”
“কে বলে আমি বিছানায় হিসু করি ? থাপ্পড় লাগাবো ধরে !”
“আংকেল আমাকে তব বলেতে।”
“তোর সাথে কথা বন্ধ । আসিস আর আমার সাথে বর বউ খেলতে ! আর জীবনেও বর সাজবো না ! খেলিস তখন একা একা!”
“অলকো ( অর্ক ) ! আল বলবো না ! লাগ কলে না লক্কি তেলে ! আয় , তোকে একতা পাপ্পি দিয়ে দেই।”
আমার ছয় বছরের ছেলে অর্ক। তার একমাত্র খেলার সাথী পাশের বাসার তিন বছরের ফুটফুটে মেয়ে টুনটুনি। আজ ছুটির সকাল। তাই ওদের খেলার গতিটাও আজ খুব বেশি। আমি বারান্দায় বসে আছি আর ওদের দুষ্টুমি দেখছি। ওদের কথাবার্তা শুনে হেসে ফেলি আর ভাবি এত পাকনা কিভাবে হলো ওরা !
আমি ঠিক করে রেখেছি টুনটুনিদের পরিবারের সাথে সম্পর্কটা টিকে থাকলে ওকেই অর্কের বউ বানাবো। কিন্তু আমি যে কত পরে চিন্তা করি সেটা ওদিন বুঝলাম। অর্ক আমাকে সিরিয়াস মুখে বলে- “বাবাই , আমি কিন্তু টুনটুনি কে বিয়ে করবো ! ও স্কুলে ভর্তি হলে স্কুলে নিয়ে যাব।চোখে চোখে রাখব। ছেলেগুলো আজকাল বড্ড পাজী ! মেয়ে দেখলেই হলো ! সেদিন আমাদের ক্লাসের রবিনটা কি করলো জানো ? পাশের বেঞ্চের ঊর্মিকে জ্বালাতন শুরু করলো !.........”
আমি হেসেই অস্থির ! বলে কি ছেলে ! ক্লাস টু তে পড়েই এই অবস্থা ! হাল্কা করে কানটা মলে দেই ওর ।
অর্ককে আমি অনেক আদর , বেশিরভাগ স্বাধীনতা আর দরকারমতো শাসন করে গড়ে তুলছি। ও তাই আমার সাথে খোলামেলা এই ছোট থেকেই। ওর চিন্তাভাবনা যতটা বিস্তৃত করা যায় সেইমত দেখাশোনা করি। ও টুনটুনির অনেক বেশি খেয়াল রাখে । যেন এখনি ওর বউ হয়ে গেছে টুনটুনি! একদম আমার মতো হয়েছে ছেলেটা।
ওদের শিশুমনের ভালোবাসা দেখে আমিও কোন কোন দিন তলিয়ে যাই আগের স্মৃতিতে ......
দেখাটা ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন। বইমেলায়। আমি তখন সবে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। মাথায় বর্ণমালার পট্টি বেঁধে মেলা দাপিয়ে বেড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমি মামার সাথে মজা করছিলামঃ "১০০০ টাকায় কি হবে ! এই সেই ......। ”
এমন সময় মামার পরিচিত একবন্ধু এলেন তার ভাতিজী কে নিয়ে। দেখা হয়ে গেলো দুই বন্ধুর।ওনারা এখন আড্ডা দেবেন। আমাকে বলা হলো ঐ মেয়েকে নিয়ে মেলা ঘুরতে আর বই কিনতে। ভাল ছেলে হিসেবে আমার বরাবরই সুনাম । তাই এতটা বিশ্বাস।
আমি হাঁটছিলাম ওর সাথে জিন্সের পকেটে হাত গুজে । একটা আলাদা ভাব আসে। ও একটা সাদাকালো জামা পড়েছিল। গালদুটো সিঁদুরে লাল ! এতটা দ্যুতিময় ছিল ও ! হাল্কা কথা বলতে বলতে একসময় সব জড়তা কেটে গিয়ে আমরা কথার খই ফোটাই। আমার ওকে ভালো লেগে যায়। হয়তো ওরও একই অবস্থা । কিভাবে কিভাবে যেন ফোন নাম্বার নেয়া হয়ে যায় !
মাঝে মাঝে কথা হতো। ২ বছর এভাবেই যায়। শুধু দূর থেকে বন্ধুত্ব । এরপর একদিন ওদের এলাকায় যাওয়া হয় । ঐদিন আমিও কথা বলতে পারছিলামনা আর সে ও না !
দুজন দুজনার অবস্থা দেখে অবাক! প্রপোজ বলতে যা বোঝায় সেটা করিনি। সেদিনের দেখা হবার পরের অনুভূতিই যথেষ্ট ছিল যে আমরা দুজন দুজনকে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম।
তারপর ও কলেজে ভর্তি হলো। আমি যেন ওর অভিভাবক। কলেজের যাবতীয় তথ্য , ওকে পৌঁছে দিয়ে আসা- কাজগুলো আমিই করতাম। ও আমার ভালোবাসার মানুষ । কিন্তু আমি ওর যত্ন নিতাম ঠিক ছোট বোনের মত, নিজের মেয়ের মত।
ওর মা জানতো আমার সম্পর্কে। আমার সাথে ওর পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতেন। ওর বাসা থেকে তাই তেমন সমস্যা হয়নি। আমি আমার বাড়িতেও আমি সব বলে না দিলেও মা জানতো।
দিনগুলো ভালই কেটে যাচ্ছিল। নৌকায় দূরে কোথাও ভেসে যাওয়া। উল্টাপাল্টা কথা বলে হাসাহাসি। সাথে পড়াশোনাও চলছিল পুরোদমে। এমন সময় অনার্স শেষ না করেই আমি ওকে বিয়ে করে ফেলি। কেউ জানতো না। ঠিক হলো চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত ও নিজের বাড়িতেই থাকবে। আমার তখন যে কি যন্ত্রণা । ওকে ছাড়া থাকতে পারতামনা। অনেক কষ্টে দিন কাটতো। ফোনে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলতাম। কষ্ট সেও পেতো কিন্তু প্রকাশ করত না; আমি ঠিকই বুঝে ফেলতাম।
চাকরি পাবার পর আমাদের বিয়ের কথা প্রকাশ পেলো। “ওর” বাবা প্রথমে সমস্যা করিছেলেন। কিন্তু ওর মায়ের সমর্থন থাকাতে খুব সমস্যা হয়নি।
সংসার শুরু করার ১ বছরের মাথায় অর্কের জন্ম। অর্কের জন্মের পর সংসারের দায়িত্বভার একটু বাড়লো। ও বলল- চাকরী করবে। আমিও নিরুপায় হয়ে সায় দিলাম।
সরকারি চাকরী “ওর”। সারাদিনের ক্লান্তি মুছে যেত যখন আমরা তিনজন একসাথে হতাম।
সেদিন হরতাল ছিল। আমি বাসায় ছিলাম। ওকে অফিসে যেতেই হলো। ফিরেও এলো। তবে শাড়িটাতে রক্তের দাগ নিয়ে শুধু নিষ্প্রাণ দেহটা। পুলিশ-পিকেটারের সংঘর্ষে পড়েছিল ও। আড়াই বছরের অর্ক তখন ঘুমিয়ে ছিল। একবারের জন্য মনে হল – তিনজনের মৃত্যু একসাথে হলেই মনে হয় ভাল হত।পরে অর্কের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম। এসব কি ভাবছি ! ওর জন্য আমাকে বাঁচতে হবে।
কেটে গেছে সাড়ে তিন বছর। অর্ককে আমি একাই বড় করছি। “ওর” ভালোবাসা এখনও অনুভব করি। তাই হয়তো এখনো হেরে যাইনি। মনে হয় আমার সাথে সাথে অর্কর দেখাশোনা করছে অর্কর মাও ।
রাতে অর্ক ঘুম ভেঙে যখন দেখে আমি কাঁদছি, চুপচাপ আমাকে জড়িয়ে ধরে । অনেক কিছু বোঝে ছেলেটা। অনেক বড় হয়ে গেছে এই বয়সেই। আনন্দ হয় এটা ভেবে যে অর্ক তার বাবাইকে বুঝতে পারে।
দিনগুলো এখনও কেটে যায়। আমি আর অর্ক। আমাদের সাথে সেও আছে। মনের কোণে এখনও “ও”কে দেখতে পাই। তাইতো জীবনটা কেমন সহজ হয়ে গেছে।
স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। এক্ষুনি ছুটি হল। আমাকে দেখেই দৌড়ে এল অর্ক। দুহাতে কোমরে জড়িয়ে ধরল। - চল বাবাই।
মেঘ করেছে সকাল থেকেই। এখন বৃষ্টি নামব নামব করছে। আমার মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল। অর্ককে বললাম- বৃষ্টি ভিজবি ? ও সাথে সাথে রাজি !
আমরা বাপ- ব্যাটা রাস্তায় হাঁটছি আর বৃষ্টি ভিজছি। লোকজন পাগল ভাবছে বোধহয়। ভাবুক !
অর্ক বলল- বাবাই !
- কি ?
- টুনটুনি আমায় খুঁজেছিল সকালে ? ফোন দিয়েছিলে ওকে অফিস থেকে ?
- হ্যাঁ , খুঁজেছিল । বলল – আজ নাকি তোদের আবারো বিয়ে হবার কথা ?
- বাবাই, এমন বিয়ে বিয়ে খেলা ভাল্লাগে না। আমি সত্যি সত্যি বিয়ে করব ওকে।
- বিয়ে যে করবি , কাজ করিস ?
- করি তো ! এই যে পড়াশোনা করি !
- হাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহা ...।।
পাতাগুলো সবুজ আর প্রাণবন্ত হয়েছে বৃষ্টি ভিজে। মনে পড়ে বিয়ে পর “ওর” সাথে এমন বর্ষায় রাস্তায় হাঁটার কথা । “ওর” খোঁপায় কদমফুল গুঁজে দেয়ার দৃশ্য। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যাই।
বৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুত না ? !! একই সাথে সুখ আর কষ্টের প্রতীক । অন্তত আমার কাছে।
বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই । আমার চোখে জল আর মুখে হাসি। কোনটাই মিথ্যে নয়। চোখের জলটা “ওর” প্রতি আর হাসিটা অর্কের প্রতি। কোনটাই মিথ্যে নয়।