somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ গল্পের জাদুকর

১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বড়ভাই যখন ঢাকায় লেখাপড়া করতেন, আমরা থাকতাম বাড়িতে। কলেজ বন্ধ হলেই বড়ভাই বাড়ি চলে আসতেন, আমার জন্য নিয়ে আসতেন একগাদা বই। বইয়ের প্রতি নেশাটা এভাবেই বেড়ে গিয়েছিলো আমার। বড়ভাই একেকবার একেক রকম বই আনতেন। কোনোবার সত্যজিৎ, কোনোবার শীর্ষেন্দু, কোনোবার জাফর ইকবাল বা কোনোবার শরদিন্দু। সেরকমই, একবার আমার জন্য নিয়ে এলেন কিছু বই। তারমধ্যে, একটার নাম ছিলো "ময়ূরাক্ষী।" লেখক হুমায়ূন আহমেদ। এই লেখককে চিনিনা তাই বইটাও ফেলে রাখলাম। সুনীল, সমরেশ এদের বইয়ের দিকে হাত বাড়ালাম।

গ্রামে গল্পের বই পাওয়া যায়না। আর আমার বইপ্রাপ্তির অবলম্বন তখন বাবা আর বড়ভাই। বাবা ঢাকা গেলে বই নিয়ে আসতো আর বড়ভাই বন্ধের সময় এলে বই নিয়ে আসে, এ ছাড়া গল্পের বই পাওয়ার আর কোনো উৎস ছিলোনা।
কিছুদিনের মধ্যেই সমরেশ আর সুনীলের বই শেষ হয়ে গেলো। পড়ে রইলো হুমায়ূনের "ময়ূরাক্ষী।" হাতে আর কোনো বই নেই অথচ বইও পড়তে হবে।তাই, নিতান্ত বাধ্য হয়েই হাতে নিলাম "ময়ূরাক্ষী।" হিমু সিরিজের একটি বই ছিলো এটা। প্রথমবার পড়েই হিমুকে পছন্দ হয়ে গেলো। পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরিহিত মহাপুরুষ হিমালয়ের ভক্ত হতে বেশি দেরি হলোনা। সেই শুরু...

এরপর হুমায়ূন আহমেদের যে বইটা পড়েছিলাম, তার নাম "মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র।" চকচকে মলাটটার এককোণে ছেঁড়া ছিলো। ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো হলদেটে হয়ে গেলেও লেখাগুলো ছিলো ঝকমকে। অনীল বাগচীর একদিন, শ্যামল ছায়া, আগুনের পরশমণি...

এরপর, চলে এলাম ঢাকায়। ঘরের কাছে নীলক্ষেত। হিমু সমগ্র, মিসির আলী সমগ্র বগলদাবা করতে খুব বেশি সময় নিলাম না, গোগ্রাসে গিলতাম সেগুলো। বৃদ্ধ মিসির আলীরও বড় ভক্ত ছিলাম আমি।হিমু আর মিসির আলী, কী জীবন্তই না ছিলো চরিত্র দুটো।

ঈশ্বর দুহাত ভরে প্রতিভা দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর এলেবেলে, বহুব্রীহি পড়ে হাসতে হাসতে যেমন পেটে খিল ধরে যেতো, সেরকম "জোছনা ও জননীর গল্প" পড়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। মানুষকে হাসানো-কাঁদানোর বড় অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো মানুষটির। এমনি এমনি তো আর তিনি গল্পের জাদুকর হননি।

ভ্রমণকাহিনীও বড় সুন্দর লিখতে পারতেন তিনি।নিজের স্বকীয় ভঙ্গিতে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা দেওয়াতে সিদ্ধহস্ত তার মত আর কেউ ছিলো বলে তো মনে পড়েনা। রাবনের দেশে আমি ও আমরা, হোটেল গ্রেভার ইন, পায়ের তলায় খড়ম, যশোহা বৃক্ষের দেশে... বলতে গেলে কী আর শেষ হতে চায়?

শঙখনীল কারাগার, নন্দিত নরকে, কবি, মধ্যাহ্ন, তেঁতুল বনে জোছনা, গৌরীপুর জংশন, আমার আছে জল, দারুচিনি দ্বীপ... কোনটা রেখে কোনটাকে ভালো বলবো? সবগুলোতেই যে মিশে আছে জাদুকরের ছোঁয়া।

হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা চরিত্রও ছিলো ভীষণ পছন্দের। শুভ্র। এই চরিত্রটা নিয়ে মোট ৪টা কী ৫টা উপন্যাস হয়েছিলো। অথচ, তাতেই শুভ্র হয়ে উঠেছিলো আরেকটি জীবন্ত চরিত্র।

কবিতাও ভালো লিখতেন তিনি। "কবি" উপন্যাসে তাঁর লেখা কিছু কবিতাও ছিলো। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো তাঁর লেখা এই দুটি লাইনঃ
"দিতে পারো একশ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ, একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।"


আমি যখন ঢাকায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বিদেশে। বইমেলায় ঘুরতাম, যদি কোনোদিন স্যারের সাথে দেখা হয়ে যায়। জাফর ইকবাল স্যারের সাথে বইমেলাতেই দেখা হয়েছিলো। অটোগ্রাফও নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, গল্পের জাদুকরের সাথেও এভাবেই বইমেলাতেই দেখা হবে। "অন্যপ্রকাশ" এর স্টলের চারপাশে ঘুরঘুর করতাম। স্যারের বই উল্টেপাল্টে দেখতাম, স্যারের দেখা পেতাম না। বড় ইচ্ছে ছিলো, তাঁর লেখা বইতে তাঁরই একটা অটোগ্রাফ নেবো।

ঈশ্বর সবার সব ইচ্ছে পূরন করেন না। এখানেও তাই হলো, কিছুদিন পর খবর পেলাম, স্যার আর নেই। চলে গেছেন অনন্ত নক্ষত্রবিথীর ওপারে যেখানে কোথাও কেউ নেই।

বইমেলার আকর্ষণ এখন অনেকটাই ফিকে। বইমেলায় এখনো তাঁর বই "বেস্টসেলার" হয়, এখনো তাঁর হাসিমুখের ছবি স্টলে স্টলে দেখি, কিন্তু জীবন্ত হুমায়ূনকেই আর কোথাও দেখিনা, তাঁর অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য বিশাল লাইনও আর চোখে পড়েনা।

ভালো থাকবেন স্যার। হয়তো, ওপারের জগতে বসেই লেখালেখি করছেন, সেখানের বইমেলায় হয়তো আপনার বই-ই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। কে জানে? হতেও তো পারে। হিমু হওয়ার জন্য হয়তো ওপারের মানুষেরাও নগ্নপায়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে মধ্যরাতে হাঁটাহাঁটি করে। জ্যোৎস্নাশোভিত রাত তো আপনার খুব পছন্দ ছিলো। ওপারের জগতে কী জ্যোৎস্না আছে?

"আঙ্গুল কাটা জগলু" উপন্যাসের একটা লাইন দিয়েই শেষ করি, স্যার।
"একটা পাখি, চারটা পাখি, তিনটা পাখি"


সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×