somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবা

১১ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
রফিকের হাতে একটা কুলফি আইসক্রিম, সে আইসক্রিম খাচ্ছে। আইসক্রিম কাঠি বেয়ে গড়িয়ে মাঝে মাঝে শার্টে লেগে যাচ্ছে, যদিও রফিকের এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার পূর্ণ মনোযোগ তখন কাঠিযুক্ত আইসক্রিমের দিকে। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে আইসক্রিম খেতে খেতে বাবার কাঁধে চেপে সে মেলা দেখতে যাচ্ছে। মেলা এখান থেকে তিনমাইল দূরে, বৈশাখী মেলা। বাবার হাতেও একটা আইসক্রিম, সেও আইসক্রিম খাচ্ছে। আজকের আবহাওয়া বেশ গুমোট, বাবা-ছেলে দরদর করে ঘামছে।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় তারা মেলার মাঠে পৌঁছে যায়। বিশাল জায়গা নিয়ে মেলা হচ্ছে, বহু লোকের ভীড়ে পুরো জায়গা সরগরম। বাবা-ছেলে মিলে ঘুরে ঘুরে দেখে মেলার খুঁটিনাটি।

সন্ধ্যাবেলায় মেলা থেকে ফিরে আসার পথে এক দোকানে রফিক ব্যাটারিচালিত ট্রেন দেখে কিনতে চাইলো। রফিকের বন্ধু সেলিমের এই ট্রেন আছে। এই ট্রেন আসল ট্রেনের মত শব্দ করে, ধোঁয়াও ছাড়ে।
বাবা দাম জিজ্ঞেস করলেন, "কত দাম ট্রেনের?"
-"৬০০ টাকা" দোকানদারের গম্ভীর উত্তর।

রফিকের বাবা খুব সাবধানে পকেট পরীক্ষা করে দেখলো সবমিলিয়ে সেখানে ২০০ টাকার মত আছে। রফিককে বললো, "পরে কিনে দেবো, বাবা।"
রফিকের বয়স তখন কত হবে, সাত কী আট। খেলনা ট্রেনের জন্য কান্না করার সেটাই উপযুক্ত বয়স, রফিকের চোখ টলমল করে উঠলো। ট্রেন না নিয়ে সে বাড়ি ফিরবেনা। বাবা পড়লেন উভয়সংকটে।
দোকানদারকে বললেন, "ভাই, আমার কাছে ২০০ টাকার মত আছে। টাকাটা এখন রাখেন, ট্রেনটা আমাকে দিন। বাকি টাকা আমি কিছুক্ষণ পরে এসে দিয়ে যাবো।"
যেখানে বিশ্বাস করে একজন মানুষ আরেকজনকে ৫ টাকা দিতে পারেনা, সেখানে ৪০০ টাকা বাকি রেখে ট্রেন দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা।
"যান যান, বাড়ি যান। দোকানের সামনে ভীড় বাড়াইয়েন না। টাকা নিয়া তখন আইসেন ট্রেন কিনতে। যত্তসব" দোকানদারের ঝাঁঝালো উত্তর।

ট্রেনের শোকে কাতর রফিককে কাঁধে নিয়ে বাবা বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করার পরে রফিক শান্ত হয়েছে। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে সে বলে, "ঐ ট্রেন ভালো না, ঠিক না, বাবা?"
বাবা হাসেন, কিছু বলেন না। বাচ্চা ছেলে ট্রেনকে খারাপ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে, বাবার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।

২.
কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যে হয়েছে। ঝিঁঝিঁপোকারা কোরাসে গান গাইছে রফিকদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে। টিমটিমে কুপির আলোয় রফিক পড়তে বসেছে। ক্লাস টু এর ছাত্র সে। স্লেটে চক দিয়ে সে লিখছে।
মা রান্না করছে রান্নাঘরে। বাবা গিয়েছে গঞ্জে। এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাবা এলে রফিক বাবার কাছে গল্প শুনতে বসবে। বাবা আসার আগে সে ক্লাসের লেখাপড়া সেরে রাখছে।

বাবার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, রফিক বুঝতে পারে বাবা এসে গেছে গঞ্জ থেকে। রফিক ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। বাবার গঞ্জ থেকে ফেরা মানেই রফিকের জন্য কিছু না কিছু আসা। পেন্সিলবক্স, জিলাপি বা লাটিম... যা হোক।

বাবা রফিকের হাতে একটা বড় বাক্স তুলে দেয়, বাবার মুখে মৃদু হাসি। বাক্স খুলে রফিক দেখে, ভেতরে সেই ট্রেন, যে ট্রেন সেলিমের আছে, যে ট্রেন ধোঁয়া ছাড়ে। রফিক খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।

রফিকের মা, রফিকের বাবার এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় রাগ হয়। এমনিতেই সংসারে টানাটানি চলছে, সেখানে অবুঝ ছেলের কথায় এত টাকা খরচ করে ট্রেন কেনা কেন?
রফিকের বাবা কিছু বলেনা, নীরবে সব শোনে। মাঝেমাঝে বামহাতের দিকেও তাকায়, গতকালও এ হাতে বহুবছরের সঙ্গী ঘড়িটা ছিলো। আজ হাত শূন্য, ঘড়ির বেল্টের কারনে চামড়ায় তৈরি হওয়া ফ্যাকাশে দাগটা নীরবে ঘড়িটার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়।

৩.
রফিকের বাবা কৃষক। বাড়ির পেছনে একচিলতে জমি তার সম্বল। সেই জমিতে ধান হয়, ঘরের সামনে অপরিসর কিছু জায়গায় সামান্য শাকসবজির চাষ হয়। কায়ক্লেশে কোনোমতে দিন কেটে যায়। এই অভাবের আঁচ যেন ছেলের গায়ে না লাগে সেজন্যে বাবা সবসময়েই সতর্ক থাকে। ছেলেকে ভালো জামাকাপড় কিনে দেয়, স্বামী-স্ত্রী অনাহারে, আধপেটা খেয়ে থাকলেও ছেলে যাতে পেটভরে তিনবেলাই খেতে পারে, সে চেষ্টা অব্যাহত থাকে প্রতিদিন।

এভাবেই দিন কাটে, রাত কাটে, আবার দিন আসে, রাত আসে, মাস পেরিয়ে বছর আসে। রফিক ফার্স্ট হয়ে ক্লাস থ্রিতে ওঠে। রফিক প্রথম হওয়াতে বাবা তাকে একটা সুন্দর নীল জামা কিনে দেয়। সেই জামা গায়ে দিয়ে রফিক নিয়মিত স্কুলে যায়।
এরকমই একদিন নীল জামা গায়ে ক্লাস করছিলো রফিক, হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যায় সে।

রফিকের বাবাকে খবর দেয়া হয়। সে তখন ক্ষেতে ধানের চারা লাগাচ্ছিলো, পাগলের মত ছুটে আসে সে স্কুলে। এম্বুলেন্স ডাকা হয়। এম্বুলেন্স আসে, অজ্ঞান রফিককে কোলে নিয়ে তার বাবা এম্বুলেন্সে ওঠে। এম্বুলেন্স মেঠোরাস্তার ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলে সদর হাসপাতালের দিকে।

৪.
ডাক্তাররা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন রফিককে। জানা যায়, রফিকের দুটো কিডনিই ড্যামেজড। তাকে বাঁচাতে হলে দুটো কিডনি লাগবে, যত দ্রুত সম্ভব। কিডনি পাওয়াও যায়না সহজে, পেলেও অনেক টাকার ব্যাপার। ডাক্তারের মুখে সব শুনে রফিকের বাবা জড়পদার্থের মত হাসপাতালের মেঝেতে বসে পড়ে, শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের দিকে। মগজে শুধু একটা শব্দই প্রতিধ্বনিত হয়, "কিডনী।"

ক্ষণকাল অতিবাহিত হয়, হঠাৎ করে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, বিচিত্র সে হাসি।

পরিশিষ্টঃ শীত শুরু হয়েছে। গাছগুলো তাদের পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। জায়গাটা ভরে যাচ্ছে ঝরাপাতায়। রফিক সাহেব কোটটা ভালো করে গায়ের সাথে জড়িয়ে নিলেন। আস্তে আস্তে হেঁটে রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা গাড়িতে বসেন। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ড্যাশবোর্ডের দিকে ধীরেধীরে তাকান। বাবার সাদাকালো ছবি সেখানে।

হাত দিয়ে বাবার ছবিটাকে একটু স্পর্শ করলেন রফিক সাহেব, বাবার ছবিটা কী আরেকটু উজ্জ্বল হলো ছেলের স্পর্শে?

গাড়ি চলতে শুরু করেছে, বাবার সমাধিকে পেছনে রেখে। কিছু ঝরাপাতা দমকা বাতাসে এলোপাথাড়ি উড়ছে...
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৩
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×