বুমকেশের ডায়েরী (পর্ব দুই)
বুমকেশের ডায়েরী (পর্ব এক)
ইহার কিছুদিন পরের ঘটনা। বুমকেশ তখন খুব হাঁটিত। সারাদিন ঘুরিয়া ফিরিয়া সন্ধ্যে নামিবার একটু আগে বাটিতে ফিরিত । কিন্তু কাহারও সহিত কোনো বাক্যালাপ করিত না। মনে চাহিলে দুএকটা কথা কহিত আর না চাহিলে নিশ্চুপ থাকিত। একদা প্রত্যূষে আমাদের বাটিতে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমায় ডাকিল। বুমকেশের গলা শুনিয়া কিছুটা সচকিত হইয়া আমি বাড়ির উঠোনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাদের বাড়ির উত্তরে তিনটে বেশ বড়সড় আমগাছ ছিল। ওইখানটায় দাঁড়িয়ে সোজা উত্তরে চাইলে অনেকদূর পর্যন্ত শুধু ধানক্ষেত দেখিতে পাওয়া যায়। ও সেই আমগাছ পার হইয়া ধানক্ষেতের আইল ধরিয়া আমাকে লইয়া ক্ষেতের মাঝে একখানা ছোট পুকুরের দিকে লইয়া চলিল। পুকুরটা অনেক পুরনো।একসময় ইহার বাধানো ঘাট ছিল। এখন উহা কালের বিবর্তনে লোপ পাইয়া যাহাতে পরিণত হইয়াছে তাহাকে ঘাট না বলিয়া ভাঙা ইটের স্তূপ বলাই শ্রেয়। ইটের স্তূপের উপর শ্যাওলা জমিয়াছে, আগাছা আর ঝোপজঙ্গলে ভর্তি। পুকুরের পানি অবশ্য পরিষ্কার। এতক্ষণ বুমকেশ কোন কথা কহিল না। পুকুরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে মুখ খুলিল,
"বলরামের শাহীমুকুন্দ বইখানা পড়েছিস?"
"না পড়িনি। কেন? কি লেখা আছে ওতে?"
"এমনি জিজ্ঞেস করলাম।"
"আচ্ছা তোর কি হয়েছে বলতো? কথাবার্তা কারও সাথে তেমন বলিস না। সারাদিন কই কই ঘুরে বেড়াস। তোর বাবা মা তো তোকে নিয়ে অনেক চিন্তা করেন। তুই তো আগে এমন ছিলি না?"
"হয়তোবা কোনো সত্যের সন্ধানে আমার এই প্রচেষ্টা। হয়তোবা ইহাই আমার আরাধ্য বস্তু।"
"কি খুঁজছিস তুই? যা পাবার জন্যে তুই ধীরে ধীরে সব ছেড়ে দিচ্ছিস?"
প্রশ্নটা করিবার পর বুঝিতে পারিলাম যে ওকে তখন এই প্রশ্নখানা করা উচিত ছিল না। বরং অন্যভাবে ওর কথাগুলা বুঝিবার চেষ্টা করার প্রয়োজন ছিল। যাহাই হোক, সে কোন উত্তর দিল না। বরং তাহার মুখের ভাব একটু বিবর্ণ হইল। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া কথা ঘুরাইবার উদ্দেশ্যে অন্য প্রসঙ্গ টানিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু কোনা পাত্তা পাইলাম না। সে এক হাত উচু করিয়া আমায় থামাইয়া দিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যে ও যেন কাহারও কথা খুব মনযোগ দিয়া শুনিতেছে। আমি চুপচাপ রহিলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে দু একখানা পাখির ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাইতেছিল না।
অতঃপর বুমকেশ কহিল তবে তাহা আমাকে নয় যেন অদৃষ্ট কোন সত্তাকে,
"চরণধুলা আমি তাহারই নিবো যে আমার মনের কথা বুঝে, আমার অব্যক্ত অনুভুতি যাহার কাছে স্পষ্ট বলিয়া প্রতীয়মান হয় আর দুটো সত্য বলে যে আমার তৃষিত হৃদয় তৃপ্ত করিতে পারে।"