somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃদ্ধ বটের ছায়ায় এক বৃদ্ধা

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হনুফা আকতারের বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। দৃষ্টিশক্তির আর সামান্য অবশিষ্ট আছে। তার ছেলে তাকে যে চশমাটি এনে দিয়েছিলো সেটি পরা আর খালি চোখে দূরের জিনিস দূরেই দেখা একই কথা। তারপরও চশমাটি তিনি পরেন। বড় ছেলে কাশেম চশমাটি তাকে এনে দিয়েছিলো। হনুফা আকতার তার বড় ছেলেকে পছন্দ করেন খানিকটা বেশিই। তার দুই ছেলে। ছোট ছেলে জব্বার। দুই ছেলের বউ আর নাতি-নাতনি নিয়ে তার সংসার। অবশ্য এটিকে এখন আর তার সংসার বলা চলেনা। তার ভ’মিকা এখানে নগন্য। বলা যায়, অনেকটা পরগাছার মতো তিনি কোনোরকমে টিকে আছেন। শরীরে বাতের ব্যথা। হাঁটা-চলায় অনেক কষ্ট হয়। বাতের ব্যথায় সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকেন। আর এখন কাউকে ডাকার মতো শক্তিটুকুও পাননা। তার ছেলের বউরা তাকে কোন বেলা অথবা কয়বেলা তাকে খাবার দিয়ে যায় তাও তিনি ঠাহর করতে পারেন না। ছেলেরা তার কাছে আসে আরো কম। প্রায় মাস চার আগে কাশেমকে তিনি বাতের ব্যথার জন্য কবিরাজের কাছে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। এরপর থেকে তো ছেলেটার আর কোনো দেখাই নেই। জব্বারকে বলে দেখবেন কিনা- হনুফা আকতার তা ভাবলেন। জব্বার ছেলেটা খুব বদমেজাজি। এমনই যে কাশেম পর্যন্ত তাকে ভয় পায়। তবে তার মনে ক্ষীণ আশা- কাশেমই মনে করে তাকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাবে। ছেলের বউরা সংসারে শুধু অভাবের কথা বলে। অভাব অনটন নিয়ে সংসারে ঝগড়া মারামারি লেগেই আছে। কিন্তু তারপরও, বছরের পর বছর বিছানায় পরে থাকা একজনকে সামান্য ওষুধও কি কিনে দেয়া যায়না! জব্বার তো এসবে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে প্রায়ই বউকে পেটায়। বউ পেটানোতে সে সিদ্ধহস্ত। কাশেম বরং এই দিক থেকে ভাল্ ো। কিন্তু কাশেমের বউ আবার চরম হিংসুটে। তবে দুই বউয়ের মাঝে বেশ ভাব। তার ঘরের পিছনেই কলতলা। দুই বউয়ের ফুসুর ফাসুর তার কানে আসে। অনেক কিছুই বোঝেন আবার অনেক কিছুই তার শ্রাব্যতার সীমার বাইরে চলে যায়। যা কিছু বোঝেন সেসব শুনে কষ্ট পান।
হনুফা আকতারের ঘরটির অবস্থান গোয়ালঘরের সাথে। তিনি অবশ্য একদিক থেকে নিশ্চিন্তেই আছেন। তার ঘ্রানশক্তি হ্রাস পাওয়াতে দূগর্ন্ধ নাকে আসে না। বলা যায়, গোয়াল ঘরেই তিনি থাকছেন আজ প্রায় পনের বছর ধরে। কিন্তু তার অবস্থানটা এমন ছিলোনা। স্বামী মারা যাবার পর অনেককিছুই পরিবর্তন হয়ে যায়। স্বামী চলে গিয়েছে অন্ধকার কবর ঘরে আর তিনি চলে এসেছেন অন্ধকার গোয়ালঘরে। তবে এসব নিয়ে তিনি আর নতুন করে কষ্ট পাননা। ভেবে সান্তনা নেন- তাও তো তিনি সবার সাথে থাকতে পারছেন। একটা আশ্রয় তার আছে। তবে হনুফা আকতার খেয়াল করেন- ছেলেরা এবং ছেলের বউরা তার চাইতে বরং গোয়ালঘরের অন্য বাসিন্দাদের প্রতি যতœশীল। গাভীর অসুখ বিসুখে ওষুধের সরবরাহ দ্রুত ও পর্যাপ্ত। খাবারে যেন কোনো অনিয়ম না হয় সেদিকে সবার শ্যেন দৃষ্টি। এর কারণ হতে পারে- গাভীর দুধ দুইয়ে তাদের দু পয়সা রোজগার হচ্ছে। গ্রাম দেশে প্রচলিত একটা কথা তার মনে পড়ে যায়- দুধ দেয় যে গাভী তার লাথি খাওয়াও নাকি ভালো। তার ছেলের বউরা হর হামেশাই দুধ দুয়াতে গিয়ে গাভীর লাথি খাচ্ছে। তারা বরং সেই পা ধরেই গাভিকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
চিকার চিক চিক নাকি দরজার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ- হনুফা আকতার প্রথমে ঠাহর করতে পারেন না। তার চোখে কিছু আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারেন ঘরে দু’জোড়া পায়ের উপস্থিতি। জব্বার যেন হাক দিয়ে উঠে।
‘মা’ ।
হনুফা আকতার ভয় পেয়ে যান।
‘কিরে মা! ঘুমাইয়া আছসনি।’
‘নারে বাপ।’
‘বৈদ্যেরহাটে ভালা কবিরাজের খোঁজ পাইছি। কাইল দুই ভাই মিল্লা তোমারে লয়া যামু।’
কাশেমের কন্ঠ শুনে হনুফা আকতার প্রশান্ত হন। জব্বারের কথা বার্তা তার ভালো লাগেনা। তার মুখে কোনো লাগাম নেই। মাঝে সাঝেই তাকে গাল মন্দ করে। এমন কথাও বলে যে সে কেন মরছেনা।
‘লয়া যারে বাপ। বিষব্যথা আমি আর সইতে পারিনা।’
হনুফা আকতার বাড়ির বাইরে বের হননা বহুদিন। তার মনে আনন্দ- এই উপলক্ষ্যে সে নতুন নতুন এলাকার আলো বাতাস গায়ে মাখতে পারবে। সে হয়তো অচেনা কোনো পথ আবিস্কার করে ফেলবে। বুক ভরে তাজা নিশ্বাস, মাটির ঘ্রাণ নিবে। ঘরের এই বাতাস তার কাছে অসহ্য, দমবন্ধ মনে হয়। তার শ্বাসনালীও বায়ু পরিবর্তন চায়। ছেলেরা নিশ্চয়ই তার কষ্টের কথা বুঝতে পেরে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে তাকে কবিরাজের কাছে নিয়ে যাচ্ছে- তার ব্যথা উপশমের জন্য। এ ভেবে তিনি প্রফুল্ল বোধ করেন। ছেলেদের অভাব অনটন দূরীকরণের জন্য তিনি ¯্রষ্টার কাছে দোয়া করেন।

হনুফা আকতারের ছেলের বউরা আজকে তাকে খুব যতœ-আত্তি করছে। সকালে হালুয়া সুজি দিয়ে রুটি খেতে দিয়েছে। হালুয়া তার খুব প্রিয়। কতদিন তাদের কাছে খেতে চেয়েছেন! কিন্তু জোটেনি। উল্টো বউরা কটু কথা শুনিয়ে দিতো।
‘ কিরে মা, তোর এহনো অয় নাই!’ বাইরে থেকে জব্বারের কর্কশ কন্ঠ শোনা যায়।
তার বড় ছেলের বউ তার হাতে একটা ছোট পুটলি ধরিয়ে দেয়।
‘ পুটলিতে কি আছে গো বউ!’
‘ আপনের কয়েকটা কাপড় দিয়া দিছি।’
‘ কি কও! কবিরাজের কাছে কি কয়দিন থাকুন লাগবো নাকি।!’
‘ হ। কয়দিন থাকুন লাগবো। কবিরাজের বাড়ি ম্যালা দূর। যাইতেই লাগবো দুইদিন। আর আপনের যে জটিল ব্যারাম।’
হনুফা আকতার খেয়াল করেন ছোট বউ বড় বউকে কি যেন ইশারা করছে। তিনি আর দেরী করেন না। পুটলিটা হাতে নেন। অন্য হাতে লাঠি নিয়ে বের হয়ে আসেন। ছেলেদের হাত না ধরতে পেরে তিনি বরং লাঠিটি শক্ত হাতে ধরেন। যেন লাঠিটি শুধু তার শারীরিক ভার নয়। তার জীবনেরও ভার নিয়ে নিয়েছে।

বড় বউ আসলে ঠিকই বলেছে। যাত্রাপথ দূরেরই বৈকি। বেশ কয়েকবার যান পরিবর্তন করে হনুফা আকতার হাঁপিয়ে উঠেছেন। আর এখন তিনি লঞ্চে করে নদী পার হচ্ছেন। ঠান্ডা , তাজা বাতাসে তার ফুসফুস যেন আনকোরা হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে তার বেশ ভালো লাগছে। ছেলেদুটোর কোনো সাঁড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। চশমাটা খুলে তিনি চারপাশে তাকান। তিনি তো চশমা ছাড়াই ভালো দেখতে পাচ্ছেন। দু ছেলে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে নিচু স্বরে পরস্পরের সাথে কথা বলছে। ছেলেদুটোকে তিনি কাছে ডাকেন। তাদেরকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। বুকের ভিতর এক শূণ্যতা। সেখানে তাদের জন্য খুব মায়া অনুভব করছেন। তার কথা বলার কোনো মানুষ নেই। নাতি- নাতনিরাও তার কাছে ভিড়ে না। তার অব্যক্ত কথাগুলো কষ্ট হয়ে বুকের ভিতর জমাট হয়ে আছে। ঠিক যেন বরফের মত। একটু সহানুভ’তি, সম্মান তার এই জমাট বাধা বরফকে আর্দ্র করতে পারে। ছেলেরা তার কাছে আসার আগেই লঞ্চ ঘাটে ভিড়েছে। কাশেম জব্বার তাকে নিয়ে তাড়াহুড়া করে লঞ্চ থেকে নেমে পড়ে। ছেলেদুটোকে বুকে জড়িয়ে ধরার সময়টুক্ওু আর মেলেনি। তার মনের এ ইচ্ছাটি অপূর্ণই রয়ে গেলো।

হনুফা আকতারের যাত্রা আবার শুরু হয়েছে। তারা এখন অতিক্রম করছেন একটি বাজারের মধ্য দিয়ে। তার আর হাঁটতে ভালো লাগছেনা। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে তিনি আবার হাঁটার শক্তিটুকু ফিরে পাবেন। তার খুব ক্ষুধাও পেয়েছে। এখন পর্যন্ত পেটে কোনো দানা পানি পড়েনি। হনুফা আকতার কাশেমের কাছে আকুতি করেন।
‘কাশেম, বাপ এট্টু খাঁড়া।’
‘কেন কি অইছে।’
‘আর হাঁটতে পারতাছিনা। জিরাই লই।’
‘তাইলে আও, ঐ গাছতলে গিয়া বই। ঐ হানে ঠান্ডা লাগবো।’
‘কবিরাজের বাড়ি আর কদ্দূর!’
‘প্রায় আয়া পড়ছি।’
‘বাজান, এট্টু পানি খাওয়াইতে পারবি!’
‘তুমি তাইলে এইহানে বয়া থাকো। আমরা পানি লয়া আইতাছি।’
হনুফা আকতার আবছা দৃষ্টিতে ছেলেদের প্রস্থান দেখছেন। তিনি বসেছেন একটি বটগাছের নিচে। গাছটি অনেক পুরোনো। ডালপালা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। গাছতলায় বসে হনুফা আকতার বেশ আরামবোধ করছেন। তার কাছে মনে হলো তিনি মানুষ না হয়ে বটবৃক্ষ হলেও ভালো ছিলো। কারণ, বটগাছ বৃদ্ধ হলে সে বরং অন্যদের তার ছায়ায় আশ্রয় দিতে পারে। তাকে অন্যের আশ্রয়ে যেতে হয়না। কিন্তু মানুষকে হতে হয় ক্ষেত্র বিশেষে পরগাছা।

এরই মধ্যে অনেকটা সময় গড়িয়ে গিয়েছে। কেউ তার জন্য পানি নিয়ে আসেনি। হনুফা আকতার বেশ ভালোই বুঝতে পারছেন তার ছেলেরা আর ফিরবেনা। তিনি তার পুটলিটা হাতে নেন। আর লাঠিটি ধরে উঠে দাঁড়ান। তার সারা জীবনের অর্জন এবং অবলম্বন যথাক্রমে এ দুটিই।



তানিম যুবাযের
০৯/১২/২০১৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×