শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসায় এক হিসেবে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। দু’বছর ধরে যে নিগৃহীত সরকার গদি দখল করে ছিল তারা কোনো অছিলায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা আমার কিছুতেই কাটতে চাইছিল না। এই দু’বছরে তারা গণতন্ত্রের অনুশাসনগুলো বিনষ্ট করে দিয়ে গেছে। তার ক্ষতিপূরণ আরো বহু বছরের ব্যাপার হবে।
আরেকটা কথা। শেষ পর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি লে. জে. এরশাদকে হাসিনা রাষ্ট্রপতির আসন কলঙ্কিত করতে দেননি, সে জন্য জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ। এরশাদ ১৯৮৩ সালের ১৫ নভেম্বর আমাকে তার ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে প্রাতঃরাশ খাইয়েছিলেন। আসলে সে দিন ভোরে ক্যাপ্টেন হায়দার আমাকে শেরাটন হোটেল থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সামরিক প্রেসিডেন্টের বাড়িতে। আমি রানীর সাথে সফরে গিয়েছিলাম। সে দিন প্রিন্স ফিলিপের সাথে আমার শ্রীমঙ্গল যাওয়ার কথা ছিল।
রাষ্ট্রপতির অনুরোধে আমি দুই নেত্রীর কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। তাদের কোনো একটা দল তাকে (এরশাদকে) রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন দিলে তিনি নতুন দল গঠন করবেন না। হাসিনা বলেছিলেন, এরশাদের শর্ত বিস্তারিত না জেনে তিনি জবাব দিতে পারেন না। খালেদা জিয়া এরশাদের নামোল্লেখে এমনই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন যে, প্রস্তাবের উল্লেখ করতে আমি সাহসই পাইনি।
তার পরও আরো সাত বছর এরশাদ সামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে গদিতে ছিলেন। তার মধ্যে তার অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনী মহাভারতের মতো বিশাল হবে। বহু গণতন্ত্রকামী তার পুলিশ ও ঘাতক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। শহীদ নূর হোসেন, শহীদ ড. মিলন তাদের মাত্র দু’জন ছিলেন। আমি তখন বিবিসিতে কাজ করতাম। এরশাদ একাত্তরের পাকিস্তানি ঘাতকদের মতো বিবিসি’র অনুষ্ঠান শোনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। বিবিসিকে খবর পাঠালে কিংবা অন্য কোনো ধরনের সহযোগিতা করলে দু’বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে বলে ঘোষণা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের মতো একটা ঐতিহ্যবাহী দল জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সেই এরশাদকে রাষ্ট্রপতির গদিতে বসাবে ভাবতে আমার রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল।
শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা কোনো না কোনো কারণে সবাইকেই বিস্মিত করবে। সমর্থকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী এমন ব্যক্তিদের মন্ত্রী নিয়োগ করেছেন যাদের গায়ে দুর্নীতির গ নেই। অবশ্য দু’জন ছাড়া। একজন হাসিনা নিজে। তার বিরুদ্ধে কতগুলো অভিযোগ তার নির্বাচনী বিজয়ের আগে ও পরে তুলে নেয়া হয়েছে। তবে একাধিক অভিযোগ এখনো বিচারাধীন আছে। দ্বিতীয়জন তার বৈবাহিক, তার কন্যা পুতুলের শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে কিছু কিছু দুর্নীতির কানাঘুষা শোনা গিয়েছিল।
ষড়যন্ত্র বনাম আনুগত্য
আরো দুটো ব্যাপার বিশেষ লক্ষণীয়। প্রথমত, ২০০৭ সালের মার্চ-এপ্রিলে আওয়ামী লীগের ক’জন সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য দলে সংস্কারের প্রস্তাব তুলেছিলেন। তাদের কেউ কেউ শেখ হাসিনাকে নেতৃত্ব থেকে বাদ দেয়ার প্রকাশ্য প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তাদের কেউ কেউ হাসিনার পিতার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন। শেখ হাসিনা তাদের কাউকে মন্ত্রিসভায় নেননি। অর্থাৎ দেড় বছর পরও নেত্রী তাদের ক্ষমা করতে পারেননি।
এমতাবস্থায় নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য হাসিনার পক্ষে যা যা করা স্বাভাবিক ছিল সেটা তিনি করেছেন। যাদের তিনি বিশ্বস্ত ও অনুগত মনে করেছেন, যারা প্রায় দিনরাত তার পাশে পাশে ছিলেন, এমন ব্যক্তিদেরই তিনি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদগুলোতে নিয়োগ করেছেন। আরেকটা ব্যাপার আমার ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে মনে হয়েছে। হাসিনার পিতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, শেখ হাসিনা তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র তানজিম আহমেদকে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করেছেন।
আমার পারিবারিক চিকিৎসকের অফিসে গত বুধবার (৭ জানুয়ারি) এক পরিচিত ভারতীয়ের সাথে দেখা। তিনি বললেন, ‘এটা কী রকম ব্যাপার হলো বলুন তো, মশাই? আপনাদের মৌলবাদী ইসলামিক রিপাবলিক বাংলাদেশে শুনেছি মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষিায় পিছিয়ে আছে। সে দেশে কী করে মেয়েরা এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব পেল?’ তাকে বলেছিলাম, ‘দাদা, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের যে প্রক্রিয়া শুরু করেন খালেদা জিয়া সে প্রক্রিয়াকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশের নারী এখন আর পিছিয়ে নেই।’ আরো বলেছিলাম, ‘পার্টিশনের আগে বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন, আর তো কখনো যাননি। একবার গিয়ে ঘুরে আসুন, বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক ধারণাই পাল্টে যাবে।’
আধুনিক রাষ্ট্রে তিনটি মন্ত্রী পদকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। অর্থ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র। শেখ হাসিনার সরকারে যারা এই তিনটি পদ পেয়েছেন তাদের মধ্যে আবুল মাল আব্দুল মুহিত ছাড়া আর কারো মন্ত্রিত্ব কিংবা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আছে বলে আমার জানা নেই। এ কথা অবশ্য ঠিক যে দায়িত্ব না পেলে অভিজ্ঞতা হবে কী করে? অন্য দিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অনভিজ্ঞ ব্যক্তির নিয়োগে বিপদের ঝুঁকি আছে।
একটা নমুনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ইতোমধ্যেই দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা ১১ জন বিএনপি নেতাকে হত্যা করেছে, অনেকে আহত হয়েছেন, কারো কারো সম্পত্তি জবরদখল করা হয়েছে। সাহারা খাতুনের মতে বিএনপি’র লোকেরাই নাকি একে অন্যকে খুন করছে। ১৯৯৬-২০০১ সরকারের আমলের আগ্রাসী সুরই কি শুনতে পাচ্ছি?
আবারো সশন্ত্র ক্যাডার?
মন্ত্রীর কথাটা ইসরাইলিদের মতো শোনাল। তারা ফিলিস্তিনিদের দেশ দখল করে রেখেছে, নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে, তার ওপর আবার সব দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। আসলে কিন্তু ’৯৬-০১ আমলের মতো সশস্ত্র ক্যাডাররা আবারো ‘একটির বদলে দশটি লাশের’ মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জয়নাল হাজারীর সমালোচনা করায় শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের তিরস্কার করেছিলেন। সাহারা খাতুন হয়তো সেখান থেকে সঙ্কেত নিতে চেয়েছেন। তিনি হয়তো আরো স্মরণ করেছিলেন যে তার পূর্বসূরি মোহাম্মদ নাসিম গজারি কাঠের লাঠির মিছিল নিয়ে বিচারপতিদের ভয় দেখিয়েছিলেন। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেকে সংযত না করলে এবং অধিকতর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে না পারলে নিজের, সরকারের ও বাংলাদেশের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবেন।
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি এক নম্বরেব ‘আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সে টাস্কফোর্সটা আসলে যে কী বস্তু, সে কথা তিনি বলছেন না। সন্ত্রাস দমনের নামে ভারতীয় কিংবা মার্কিন সৈন্যরা কী সমগ্র বাংলাদেশ চষে বেড়াবে? তাদের সাথে ইসরাইলি উপদেষ্টারাও আসবে বাংলাদেশে? এসব কথা জনসাধারণকে এখনি খুলে বলা দরকার। এ দিকে মিডিয়া এবং জনসাধারণ আতঙ্কিত। ভারত আর মিয়ানমার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার একটা বিরাট এলাকা দখল করে নিতে উদ্যত। দীপু মণি কী করছেন এ সম্পর্কে?
অবৈধ, অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অন্যায় কার্যকলাপ, তাদের জারি করা ১১৪টি বিতর্কিত অধ্যাদেশ বৈধ করার জন্য সরকার উঠে-পড়ে লেগেছে। এ সরকারের সব কাজকর্ম বৈধ করার প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ১৫ মার্চ আমেরিকা যাত্রার আগে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই দিয়ে গিয়েছিলেন। আরো সাম্প্রতিককালে একাধিকবার সে প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ব্যাপক সন্দেহ আছে যে, এ কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তাদের নিয়োজিত নির্বাচন কমিশন বরাবরই আওয়ামী লীগকে বিশেষ অনুগ্রহ ও আনুকূল্য দেখিয়েছে। সুতরাং বিস্ময়ের কিছু নেই যে আইনমন্ত্রী সংবিধান সংশোধন করে হলেও সেসব প্রতিশ্রুতি পালন করতে চান।
অর্থাৎ ভালো-মন্দ, হিতাহিত বিবেচনা ছাড়াই কলমের এক টানে সেনাসমর্থিত একটা নির্যাতক ও স্বৈরতন্ত্রী সরকার ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জানে, ভবিষ্যতে অভ্যুত্থান ঘটানোর কিংবা স্বৈরশাসন চালু করার অভিলাষ যাদের আছে, তারা এর থেকে উৎসাহ পাবে। তারা এই গদি আঁকড়ে থেকে দরকষাকষি করতে পারলে যেকোনো কারণে কোনো না কোনো দল তাদের বৈধতা দেবেই। এ লজ্জাকর অধ্যায় থেকে গা বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই যদি বিএনপি শপথ গ্রহণে বিলম্ব করে থাকে তাহলে তার প্রশংসা করতেই হবে।
প্রতিশ্রুতির কারচুপি
নির্বাচনে জয়ের পরই শেখ হাসিনা বিএনপি’র সহযোগিতা চেয়েছিলেন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার যদি তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো পালন করতে চায়, তাহলে বিএনপি তাদের সমর্থন দেবে। কিন্তু ইতোমধ্যেই প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়ে কারচুপি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা শুরু হয়েছে। নতুন অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত বলেছেন, ১০ টাকা কেজির চাল আর সারের ভতুêকির কথা দলের নির্বাচনী ইশতেহারে নেই।
জনাব মুহিতকে প্রশ্নঃ বাংলাদেশের ক’জন মানুষ ইশতেহার পড়ে ভোট দেয়? আর ইশতেহারের কত কপি ছেপেছে আওয়ামী লীগ সোয়া আট কোটি ভোটারের জন্য? নেতা-নেত্রীরা নির্বাচনী সভাগুলোতে যেসব কথা বলেন, যেসব প্রতিশ্রুতি দেন, তার ওপর ভরসা করেই বাংলাদেশের মানুষ ভোট দেয়। এখন আবার এলজিআরডি মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম তার স্বভাবসুলভ উদ্ধৃত আর দুর্বিনীত ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, শেখ হাসিনা আদৌ ১০ টাকা কেজির চাল আর সার ভতুêকির কথা বলেননি। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত মানুষ কি তাহলে স্বপ্নেই সেসব কথা শুনেছে হাসিনার মুখে? আশরাফুল ইসলামকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আসল গোয়েবলসের মিথ্যার মুখোশও একদিন খুলে গিয়েছিল।
একটা কথা কিন্তু ইশতেহারেও উল্লেখ আছে। বিএনপি থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগের প্রতিশ্রুতি হাসিনা এবং অন্যান্য নেতাও দিয়েছেন। এখন শোনা যাচ্ছে ইতি-উতি অজুহাত সৃষ্টি করে সে প্রতিশ্রুতি থেকেও পিঠটান দেয়ার চেষ্টা চলছে।
ইংরেজি প্রবাদ হচ্ছে, ‘মর্নিং শোজ দি ডে’ সকালের চেহারা দেখেই বোঝা যায় দিনটা কেমন হবে। নতুন আওয়ামী লীগ সরকারের বয়স এখন মাত্র এক সপ্তাহ। কিন্তু এরই মধ্যে যে আলামত তারা দেখাচ্ছে তা থেকে কি আপনাদের ভরসা হয়?

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




