সরকারি হাইস্কুল নেই এমন ৩০৬টি উপজেলায় সরকারি আর্থিক সহায়তায় একটি করে মডেল স্কুল স্থাপন প্রকল্পের নামে বরাদ্দের ৪৫০ কোটি টাকার শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহে বেপরোয়া লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের এমনকি শিক্ষকদের বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহারের জন্য একটি করে টেলিস্কোপ যন্ত্র বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) দুর্নীতিবাজ চক্রের সহায়তায় ঠিকাদাররা বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম টেলিস্কোপের পরিবর্তে বাচ্চাদের খেলনাসামগ্রী দূরবীন (বাইনোকুলার) সরবরাহ করে। তাও আবার একেবারে নিুমানের। গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে ব্যাগভর্তি করে খেলনাসামগ্রী কিনে ওইসব স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের ঢাকায় ডেকে এনে তাদের হাতে তা ধরিয়ে দেন ঠিকাদার। একইভাবে ওইসব স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, কম্পিউটার সরবরাহ, কম্পিউটারের প্রিন্টার ও টোনার সরবরাহ, ফটোস্ট্যাট মেশিন ও একটা করে অতিরিক্ত টোনার সরবরাহ, স্কুলের লাইব্রেরির জন্য বই ও আসবাবপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রেও চরম অনিয়ম করা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে শিক্ষা খাতে অভিনব দুর্নীতির এই চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন মডেল স্কুল প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণ ছাড়াও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ শিক্ষায় সহায়ক নানা সামগ্রী সরবরাহের জন্য দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেয়া হয়। স্কুলের জন্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ পান বনানীর ‘ল্যাক্সিকন’ নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর কর্ণধার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু স্কুলে স্কুলে বৈজ্ঞানিক যন্ত্র টেলিস্কোপ সরবরাহ না করে প্রধান শিক্ষকদের ঢাকায় তলব করে নিয়ে আসেন। এনে তার টঙ্গীর গোডাউন থেকে কাগজের ঠোঙ্গাবন্দি (কার্টন) অবস্থায় মালামালের একটি করে ব্যাগ তাদের হাতে তুলে দেন। দুদকের সিনিয়র উপপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, ঠিকাদার এই বৈজ্ঞানিক সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রেও ৫০ ভাগ কম সামগ্রী সরবরাহ করেন, যা সরবরাহ করেছেন তাও আবার খেলনাসামগ্রী, যা দিয়ে চাঁদ দেখা দূরের কথা ২০০ গজের মধ্যে কি আছে তাও ঠিকমতো দেখা সম্ভব নয়। তিনি জানান, ঠিকাদারের দেয়ার কথা ছিল ২৪ ইঞ্চি লম্বা স্ট্যান্ডবিশিষ্ট টেলিস্কোপ। কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি দূরবীন দিয়েছেন। তাও পরিমাণে কম। সব স্কুলে শিক্ষাসামগ্রী পৌঁছেও না।
‘৩০৬ উপজেলা সদরে নবনির্মিত বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে মডেল স্কুলে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পে প্রতি স্কুলে ১০টা করে কম্পিউটার সরবরাহের কথা থাকলেও কোনো স্কুলে ৯টি, কোনো স্কুলে ৮টি আবার কোনো স্কুলে কম্পিউটার সরবরাহই করা হয়নি, যা সরবরাহ করা হয়েছে তাতেও পর্যাপ্ত র্যাম, রোম ও সফটওয়্যার দেয়া হয়নি। ফলে কম্পিউটার খুলে কেবল কম্পোজ করা ছাড়া আর কোনো কাজ শিক্ষার্থীরা করতে পারছেন না। কম্পিউটারের সঙ্গে প্রিন্টার ও অতিরিক্ত টোনার দেয়ার কথা, তাও দেয়া হয়নি । ডেলটা সিস্টেম নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মডেল স্কুলে কম্পিউটার সরবরাহের কাজটি পায়।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ইসলামিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মকবুল হোসেন জানান, প্রকল্পের আওতায় কথামতো তার বিদ্যালয়ে কম্পিউটার পাওয়া যায়নি। শুধু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির নামে বাইনোকুলার পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে ফটোস্ট্যাট মেশিন সরবরাহের কাজ পায় অপর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রেও অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যে মানের মেশিন দেয়ার কথা তা দেয়া হয়নি।
সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ, মেরামত, সংস্কার ও আসবাবপত্র সরবরাহের দায়িত্ব শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের। জানা গেছে, বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হয়ে থাকে। আর এই কাজের আড়ালে চলছে লাগামহীন দুর্নীতি। যে কোনো উন্নয়ন কাজের দরপত্র প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে ঠিকাদারদের দিতে হয় মোটা অংকের ঘুষ। আর এর ভাগ প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। জানা গেছে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরে একজন প্রধান প্রকৌশলী, দু’জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, প্রধান কার্যালয়ে নয়জন এবং সারাদেশের ৩৮টি জোনে একজন করে নির্বাহী প্রকৌশলী রয়েছেন। এরাই হচ্ছেন বিভিন্ন কাজের মূল অভিভাবক। এদের হাতের মুঠোয় শত শত কোটি টাকার কাজ থাকে। এদের খুশি করলে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানও কার্যাদেশ পেয়ে যায়। আর এভাবে বিশেষ ক্ষমতা পেয়ে এরা একেকজন দুর্নীতির শিরোমণি হয়ে ওঠেন।
দুদক জানায়, ৩০৬টি মডেল স্কুলের কাজ নিয়ে শুরুতেই নানা কেলেংকারির তথ্য তারা পেয়েছেন। এমন ঘটনাও ঘটেছে এক ঠিকাদার সর্বনিু দরদাতা হয়েছেন। কিন্তু তাকে কাজ না দিয়ে দ্বিতীয় সর্বনিু দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে, যা সরাসরি দুর্নীতি। দুদকের অনুসন্ধান টিম জানায়, মডেল স্কুলের শিক্ষাসামগ্রীর বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের (ইইডি) প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তাজা অভিযোগ পেয়েছেন। মডেল স্কুলের অনুসন্ধান কাজ শেষ হলে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দুর্নীতির ফাইল খোলা হবে। অনুসন্ধান চলাকালে সন্দেহভাজন সব কর্মকর্তাকে দুদকে তলব করা হবে। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদেরও আয়-বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে যেসব ঠিকাদার এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থেকে কাজ করছেন, গত সাড়ে চার বছরে কে কত টাকার কাজ পেয়েছেন, কত টাকার কাজ করেছেন, তারও হিসাব নেয়া হবে। তৈরি করা হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের তালিকা। দুদকের কমিশনার (তদন্ত) এম সাহাবুদ্দিন চুপ্পু জানান, দুদকের টিম শিক্ষা খাতে দুর্নীতি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। একেকটি প্রতিষ্ঠান ধরে অনুসন্ধান করে জড়িতদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের বিনিময়ে অযোগ্য, অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুদক টিম সে বিষয়টি পৃথকভাবে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবে। - See more at: Click This Link