ফিলিপাইনের স্বাধীনতাকামী নির্যাতিত মুসলিমদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির নামে সমঝোতা করেছে দেশটির সরকার। ১৭ বছর ধরে চলা আলোচনার ফল এ চুক্তির মাধ্যমে দেশটির দশকের পর দশক ধরে উগ্রবাদী বৌদ্ধ সরকার আর শান্তিকামি নির্যাতিত মুসলিম নিপীড়নের অবসান ঘটলো। গতকাল ইয়াওমুল খামিস (বৃহস্পতিবার) রাজধানী ম্যানিলায় নিজ বাসভবনে সরকারের পক্ষে শান্তি চুক্তিতে সই করে প্রেসিডেন্ট বেনিগনো আকুইনো। মুসলমানদের পক্ষে চুক্তি সই করে মরো ইসলামিক লিবারেশন ফ্রন্ট (এমআইএলএফ)।
চুক্তিতে মুসলিম অধ্যুষিত বাংসামোরোকে স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে ঘোষণা করেছে ফিলিপাইন সরকার। বাংসামোরোকে নিজের বাজেট ও পুলিশ গঠন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
চুক্তির শর্ত মতে এমআইএলএফ তার ১০ থেকে ১৫ হাজার সৈন্যের অস্ত্র সমর্পণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
চুক্তিমতে, বাংসামোরোর সরকার সংগৃহীত করের ৭৫ শতাংশ নেবে, ধাতব খনিজ পদার্থ থেকে আয়ের ৭৫ শতাংশ পাবে এবং মৎস্য অঞ্চলের কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করবে।
২০১৬ সালের স্থানীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাংসামোরোর শাসন ক্ষমতায় থাকবে অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ ।
মিন্দানোয় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের সাথে লড়াই করে আসছিল মুসলমানরা। এছাড়াও দেশটি তাদের জন্মভূমি। সরকারের মদদপুষ্ট উগ্রবাদী বৌদ্ধ সামরিক ও বেসামরিক হামলায়, সহিংসতা, ও গণহত্যায় ফিলিপাইনে কয়েক লক্ষ মুসলমান শহীদ হয়েছে।
‘মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষু হায়েনারাই মুসলিম গণহত্যা চালায়’:
উল্লেখ্য, মিয়ানমারে ইসলামবিদ্বেষী ও হিংগ্রতাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বেই মুসলিম গণহত্যা চালানো হয় বলে এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স। ২০১১ সালে দীর্ঘ ৪৯ বছরের সেনাশাসন অবসানের দাবি করার পরপরই মূলত আরো হিংগ্র ও বর্বর কায়দায় মুসলমানদের উপর নির্যাতন শুরু করে হিংস্রতাবাদী বৌদ্ধরা। নির্যাতনের পরিধি বাড়তে বাড়তে তা শেষ পর্যন্ত গণহত্যায় পৌঁছেছে বলে জানায় রয়টার্স।
অহিংসার দাবির আড়ালে হিংস্র হায়েনারূপী বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রিত দেশ মিয়ানমারের ঝলমলে প্যাগোডার জন্য ‘স্বর্ণভূমি’ নামে পরিচিত। কিন্তু বৌদ্ধদের সেই স্বর্ণভূমিতেই অহিংসার দাবিদার ভিক্ষুদের নেতৃত্বে ‘৯৬৯’ তত্ত্ব দিয়ে মিয়ানমারের অধিবাসী মুসলমানদেরকে হত্যা এবং নির্যাতন করছে বর্বর যালিম বৌদ্ধরা। ‘৯৬৯’ এমন একটি তত্ত্ব যার মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন গুণবাচক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়। চলতি ২০১৩ সালের মার্চ মাসের শেষ নাগাদ মেইকটিলা শহরে হামলায় চারদিনে শতাধিক নিরীহ মুসলমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে হিং¯্র বৌদ্ধরা। মুসলমানদের পবিত্র মসজিদ-মাদরাসাসহ হাজার হাজার বাড়িঘর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের উস্কে দিতে দেয়ালে ‘চিকামারা’ লিখেছে ‘মুসলমানদের হত্যা করো’।
প্রায় ৩০ জন প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য অনুযায়ী, বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই এই গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়। আর এসব হিং¯্র ভিক্ষুদেরই গণতান্ত্রিক মিয়ানমারের প্রতীক হিসেবে দাবি করা হয়।
গত ২১ মার্চ ২০১৩ ঈ. তারিখ মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ২৫ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। হামলাকারী বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা মুসলমান নিহতদের রক্তাক্ত দেহগুলো পাশের এক পাহাড়ে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। কয়েকটি লাশ কেটে টুকরো করে জঙ্গলাকীর্ণ ডোবায় ফেলে দেয়। দশ বছরের কম বয়সী দুইটি মুসলিম শিশুর পোড়া লাশও দেখা গেছে সেখানে।
এর আগে প্রায় একশ মুসলমানকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা। সেই সময় তারা এক মুসলিম যুবতীকে আটকে রাখে। ওই যুবতীর ঘাড়ে ধারালো অস্ত্র রেখে তারা পুলিশের উদ্দেশ্যে বলে, “যদি তোমরা আমাদের পিছু নাও তবে আমি একে হত্যা করবো।” ম্যাশেটিসহ বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত বৌদ্ধ হায়েনারা সেই সময় হামলা চালিয়ে দোকান এবং ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
মধ্যাঞ্চল ছাড়াও দেশের প্রধান শহর ও বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের কাছাকাছি এলাকায়ও দাঙ্গা ছড়িয়ে দিয়েছে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা। এখানে পুলিশের সামনেই সংঘবদ্ধ দাঙ্গাবাজ বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা নিরীহ মুসলমানদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ২১ মার্চের (২০১৩ ঈ.) পরে এই ঘটনা ঘটলেও স্থানীয় রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তিনদিন ধরে চলা এই দাঙ্গা প্রতিরোধে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সে কার্যত শহরের উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে মুসলিম গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে। হিংস্র ভিক্ষু হায়েনারা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে না দিয়ে, উদ্ধারকারীদের বাধা দিয়ে এবং ধ্বংস কাজে নেতৃত্ব দিয়ে কয়েকটি মুসলিম এলাকা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।
এসব দাঙ্গার ঘটনা প্রতিরোধে দেশটির বিরোধীদলীয় নেত্রী কথিত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি কোনো ভূমিকা রাখেনি। এই বিষয়ে রয়টার্সের সঙ্গে সে কথা বলতেও রাজি হয়নি। এতে কথিত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচিকে ইসলামবিদ্বেষী এবং মুসলিম গণহত্যায় তার পরোক্ষ সম্মতি রয়েছে বলে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন মন্তব্য করে। অবশেষে অহিংস দাবিদার হিং¯্রতাবাদী বৌদ্ধরা মুসলিম নির্যাতনের অবসান করবে প্রত্যয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয় মুসলিমদের সাথে।
চুক্তিতে সইয়ের আগে আকুইনো বলেছে, অতীতের কুসংস্কারকে দূরে ঠেলে আসুন আশার পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখি।
চুক্তি সইয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন এমআইএলএফ চেয়ারম্যান ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। বিদ্রোহীদের সঙ্গে ফিলিপাইন সরকারের শান্তি আলোচনা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছে মালয়েশিয়া।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এমআইএলএফ-এর পাঁচ শতাধিক সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বলেন, অনেক বছরের দ্বন্দ্ব ও অনেক জীবন হানির পরও এটি সাহসিকতার গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। অতীতের সমস্যার দিকে না তাকিয়ে দুই পক্ষই ভবিষ্যতের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে চুক্তিতে অংশ নেয়নি মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও বাংসামোরো ইসলামিক ফ্রিডম ফাইটারস। মোরো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ১৯৯৬ সালে সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল।
চুক্তিতে সইকারীদের একজন এমআইএলএফ-এর এক জ্যেষ্ঠ সদস্য আবহৌদ সাঈদ এম লিঙ্গা। তিনি বলেছেন, চুক্তিতে ছোট ছোট কিছু গোষ্ঠী খুশি নয়, কিন্তু বাংসামোরোর জনগণ খুশি। বাংসামোরোর দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটবে।
তিনি আরও বলেন, এখনই যে সবাই যোগ দেবে, এটা আমরা আশা করছি না। কেননা তাদের মনে শঙ্কা, চুক্তি বাস্তবায়ন হবে কিনা।
চুক্তি বাস্তবায়িত হলে এর সুফল জনগণ ভোগ করবে বলে জানান তিনি।
এমআইএলএফ-এর সিনিয়র ফিল্ড কমান্ডার ও গোষ্ঠীর মুখপাত্র ভন আল-হক ১৯৭২ সাল থেকে সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেছেন, যুদ্ধের ময়দানে থাকা তরুণ যোদ্ধারা পুরো জীবনেই যুদ্ধ দেখেছেন। তারা তাদের পরিবারের কোলে ফিরে যেতে চায়, স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চায়।