অল্পস্বল্প ব্লগিং ১
অল্পস্বল্প ব্লগিং ২
অল্পস্বল্প ব্লগিং ৩
অল্পস্বল্প ব্লগিং (শেষাংশ)
অনেক মানুষের কোলাহলে ঘুম ভাঙলেও চোখ মেলতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল মাথা থেকে আরম্ভ করে পায়ের তালু অবধি ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে করে থেঁতলে দিয়েছে কেউ। সামান্য নাড়াচাড়া করলেই খসে খসে পড়তে আরম্ভ করবে পুরো দেহের হাড়-মাংস। সর্বাঙ্গের ব্যথা সহ্য করতে যেয়ে অথবা অন্য কোনো ভাবে চোখ খুলে গেলে তীব্র আলোর ঝলকানিতে দৃষ্টিগোচর হয় না কিছুই। চোখের সামনে সফেদ কিছু যেন দেয়াল তুলে রেখেছে।
তবে টের পাই তীব্র কোলাহল কমতে কমতে সেটা গুঞ্জনে পরিণত হয়েছে। সফেদ দেয়ালের আশপাশে আবছা কালচে ছায়ারা নড়তে আরম্ভ করলে বৃষ্টির ছাঁট এসে নাকে-মুখে লাগে। আহা, কী আরামের একটি অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে চায় সারা দেহ জুড়ে। তুমুল বর্ষণে যদি পুরোপুরি সিক্ত হতে পারতাম। খানিক পরই যেন পূরণ হয়ে যায় অনুচ্চারিত প্রত্যাশা। নদীর জলে কি ভাসতে আরম্ভ করেছি ফের? আচ্ছা নদীটা পশু না মংলা ভুলে গেছি। যেখানে প্রথম ছুঁয়েছিলাম নাজমাকে। এভাবে যদি অনেকদিন ভেসে থাকা যেতো নদীর জলে। ভাসতে ভাসতে বিলীন হয়ে যেতাম নদী তরঙ্গে। আমার দেহে তখন সূর্য খেলা করতো অযুত নিযুত তারার ঝলকানি হয়ে। রুম্পার মতো কেউ দুঃস্বপ্নের মেঘ হয়ে হয়তো কখনো ঢেকে দিত আমাকে। কিন্তু চিরতরে ডুবিয়ে দিতে পারতো না গহন অন্ধকারের অতলে। খানিকটা হলেও মহাকাল ভুলে যেতো মুদিখানার হিসেব নিকেশ। আমি আড়াল হয়ে যেতে পারতাম আমার যাবতীয় বঞ্চনা থেকে। বেঁচে যেতাম প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নামের জাগতিক নিগ্রহ থেকে।
কিন্তু বাস্তবতা আমাকে প্রতিবার মনে করিয়ে দেয় যে, প্রত্যাশা করতে নেই। প্রত্যাশা থাকলেই শূন্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকবে ইচ্ছের মুক্তো দানা। আর তাই হয়তো দৃষ্টি মেলে আবিষ্কার করি পড়ে আছি অসংখ্য খুপরি ঘরে ঠাসা পল্লীটির প্রবেশ মুখে। লোকজন বা খদ্দের আমাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। হাসি-গল্পে কলকল করে আরো বেশ কটি রঙিন মেয়ে চলে গেল হয়তো নদীর দিকেই। নিজের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে পুরো দেহ কাদায় মাখামাখি। হায়, পকেটগুলো হাতড়িয়ে দেখি পুরোপুরি ফাঁকা। ফোন, ওয়ালেট, রুমালে বাঁধা চাবি, কিছুই নেই। হাতের ঘড়ি আংটি এমন কি পায়ের জুতো-মোজা পর্যন্ত নেই।
সর্বস্বান্ত হয়েও কেন যেন আমার ভেতরে কোনো আক্ষেপ বা হাহাকারের জন্ম হয় না। কেমন একটা পরিতৃপ্তির আলস্য ঘিরে রাখে আমাকে। নদীর দিকে চোখ পড়তেই দেখা যায় তীরের কাছে ভিড়িয়ে রাখা ট্রলারের সামনে মেয়েদের জটলা। যেখানে হয়তো আছে গত রাতের নাজমা অথবা নেই। হতে পারে আবারও দেখা হলে কেউ কাউকে চিনতে পারবো না। অন্ধকার বা আড়ালে আবডালে কত ঘটনাই তো ঘটে যায়, তার সবগুলো দিনের আলোতেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। জীবনের সবখানেই খানিকটা আড়াল থেকেই যায়, যার সবগুলো ভেদ করা সম্ভব হয় না কখনো।
আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াই। ময়লা আর কাদার মিশ্রণে নানা আকৃতির দাগ লেগে আছে পোশাকে, দেহের অনেক জায়গায়। দূরে দেখা যায় মংলা বন্দর। যেখান থেকে শুরু হয়েছে শহর। আর শহর হচ্ছে দাগ পরিষ্কার বা আড়াল করবার উত্তম জায়গা। আস্তে ধীরে সতর্ক হয়ে পা চালাই। যাতে পা হড়কে না পড়ে যাই। নদীর এবরো থেবড়ো পারের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লে হয়তো সত্যি সত্যিই হাড়-গোর দু একটা ভাঙবে।
(সমাপ্ত)