somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(ছোটগল্প) চেইন

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় জীবন এখানে স্থবির হয়ে আছে। অথচ ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই কারও। গাড়িতে বসে উসখুস করছিল ক্যারল। খানিকটা বিরক্ত কণ্ঠে বলে, কেমন ট্রাফিক সিস্টেম তোমাদের? একটা গাড়ি একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে, সময়ের কি কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছে?
শাহেদ বলে, দেখতেই তো পাচ্ছ, সময়ের গুরুত্ব কেমন!
- এত লোক যাচ্ছে কোথায়? মনে হচ্ছে সবাই মুসলিম।
পাশ থেকে হঠাৎ আঙুল তুলে দেখায় ক্যারল।
শাহেদ বলল, হ্যাঁ, সবাই মুসলিম। সবাই চরমোনাইর পির সাহেবের অনুসারী। সম্মেলনে যাচ্ছে।
- ওদের হাতে কী ওসব? হাতপাখা?
- পির সাহেবের নির্বাচনী প্রতীক।
ভ্রু কুঁচকে ক্যারল শাহেদের দিকে তাকায়। বলে, পির সাহেব! হোয়াট ইজ পির সাহেব?
খানিকটা দ্বিধায় পড়ে যায় শাহেদ। কী বলবে এখন? ছোটবেলা থেকেই নানা রকম পির দেখে আসছে। তাদের সম্বন্ধে নানা রকম অদ্ভুত সব কাহিনী শুনে আসছে। কিন্তু ক্যারলের বলা হোয়াট ইজ পির? কথাটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে? তাকে কীভাবে বোঝাবে যে পির কী? পিরের মূল কাজটা কী। অনেকে এটাকে ব্যবসা বললেও বেশিরভাগ মানুষ মনে করে পির তাকে ধর্মের ছায়ায় পরকালের শান্তির পথ দেখায়। অনেকে নবী বা দরবেশের মতই যার যার পিরকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। কারও ভক্তি-শ্রদ্ধা অন্ধ বিশ্বাসের মতও হয়। যাদের ধারণা পির ইচ্ছে করলে সবই দিতে পারেন। এদের নিয়ে অনেক অবিশ্বাস্য কাহিনীও প্রচলিত আছে।
অনেক ভেবে কোনো দিশা না পেয়ে শাহেদ বলে, তুমি তো ভারতে গেছ। সেখানে সাধুবাবাদের তো দেখেছ। ভগবান রজনীশ সম্পর্কে কম বেশি তো জানই। যারা আধ্যাত্মিক সাধনা করে, শিষ্যদের সে সম্পর্কে এবং পরকাল সম্পর্কে নানা রকম জ্ঞান ও শিক্ষা দেয়। আমি অতটা ভাল জানি না। তবে, এ পির সাহেব বাংলাদেশে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চান। কুরআনের অন্ধ অনুসরণ করতে চান।
ক্যারল অবাক হয়ে বলল, তাহলে ইলেকশনের কী প্রয়োজন? লোকজনকে তো বুঝিয়ে শুনিয়েই কাজটা করতে পারতেন তিনি।
- তা পারতেন হয়তো। তবে, আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বুঝিয়ে শুনিয়ে তেমন কোনো কাজ হয় না। টাকা বা ক্ষমতার জোরে লোকজনকে যতটা বাধ্য করা যায় মিষ্টি কথায় তার কিছুই হয় না।
- তোমাদের কোনো এক্স প্রেসিডেন্ট তো তোমাদের দেশটাকে ইসলামী কান্ট্রি বলে ঘোষণা দিয়েছিল। সুফল কিছু পেয়েছিলে?
- আমি তেমন বুঝতে পারিনি। তবে, একাত্তরের ঘাতক আর দালালরা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। সে সঙ্গে আরব দেশ থেকে খেজুর আর দুম্বার গোস্ত আসত গরিবদের জন্য। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান আর মেম্বাররাই সেসব লুটপাট করে খেয়েছে। গরিবদের ভাগ্যে খুব সামান্যই জুটেছে। কোথাও কোথাও খোলা বাজারেও সেসব ত্রাণ সামগ্রী বিকিকিনি হয়েছে বলে শুনেছি।
সামনে থেকে গাড়ির জট ছুটলে আস্তে আস্তে সামনের দিকে গাড়ি বাড়ায় শাহেদ। হাফ ছাড়বার মত ক্যারল বলে, পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপচয় হল।
- এটা তো তুমি একদিন দেখেছ বলে তোমার কাছে খারাপ লাগছে। ব্যাপারটা প্রতিদিনই হয়। হয় মিছিল নয়তো অবরোধ। আবার কোনো দিন মন্ত্রী এমপিদের যাতায়াতের জন্য ঘটে। অন্যদিন হয়তো পরিবহণ শ্রমিকদের কোনো ব্যাপার।
বলতে বলতে একজন পথচারীকে চাপা দিতে দিতে কড়া ব্রেক করে গাড়ি থামায় শাহেদ। তারপর জানালা দিয়ে মুখ বের করে পথচারীর উদ্দেশ্যে বলে, ফুট ওভারব্রিজ চোখে দেখতে পাস না, কানাচোদা?
তারপর আবার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতে চালাতে শাহেদ বলে, তুমি যখন চলে এসেছ, থাকতে থাক। দেখতে দেখতে আমাদের মতো তোমারও সয়ে যাবে। দেখলে না লোকজন কেমন সরকার এমপি-মন্ত্রীদের গালি দিচ্ছিল? ওটাই আমাদের দৈনন্দিন সান্ত্বনা। তুমিও শিখে ফেলবে শীঘ্রই।
শাহেদের কথা শুনে কেমন শক্ত হয়ে বসে থাকে ক্যারল। পাশ ফিরে শাহেদের দিকে কয়েকবার তাকালেও কিছুই বলেনি। ভাঙেনি গম্ভীরতার মুখোশ। কিছু একটা বলতে যেয়ে খানিকটা দ্বিধায় ভুগলেও শেষ পর্যন্ত অস্বস্তি নিয়েই বলে ফেলে, তোমাদের দেশে করাপশনও কম না। প্রতিটা সরকারের সময়ই কম বেশি হয়। একবার তো তোমাদের দেশ করাপশনের দিক দিয়ে বিশ্ব প্রথম সারিতে ছিল।
শাহেদ হঠাৎ হেসে উঠে বলে, আসলে ব্যাপারটা হল কি জানো?
দৃষ্টিতে কৌতূহল ফুটিয়ে ক্যারল তাকিয়ে থাকে শাহেদের মুখের দিকে। বলে, যেমন?
- আমাদের দেশের আনাচে কানাচে, বাসে-ট্রেনে-লঞ্চে-স্টিমারে এমন কি হাট-বাজারেও মসজিদের জন্য টাকা তোলা হয়। নতুন নতুন মসজিদ যেমন তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন মুসুল্লিও। কিন্তু সৎ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে না। সরকারি বেসরকারি অফিসেও দুপুরে অনেকে মিলেই নামাজ আদায় করে একসঙ্গে। এভাবে ধার্মিক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নৈতিক-চরিত্র আরও উন্নত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার বদলে হচ্ছে উলটোটা। প্রতিটা সরকারী অফিসে, আধা-সরকারী অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। যারা ঘুষ খায়, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে। অনেকে আবার ইসলামি পোশাকে নিজেকে ঢেকে রাখে। নামাজ পড়তে পড়তে যাদের কপালে স্থায়ী কালো দাগ পড়ে গেছে। সাম্প্রতিক কয়েকটা নিউজে দেখেছি মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিনদের মাঝেও করাপশন মিশে গেছে। নৈতিক চরিত্রেরও স্খলন ঘটেছে। বাড়ছে যৌন অপরাধের মাত্রাও। অথচ তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আলাদা রকমের একটা শ্রদ্ধা, ভক্তি কাজ করতো। শুধু কি যৌন অপরাধ? তাদের কেউ কেউ মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছে। মসজিদে বসেই মাদক বিক্রির সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে বলে পত্রিকায় নিউজ এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে ধর্ম-কর্ম মানুষের নৈতিক মানদণ্ড বাড়াতে পারছে না।
- তাহলে কি এসব ধর্ম-কর্ম অর্থহীন?
ক্যারলের কণ্ঠে হতাশা ফুটে ওঠে।
আঁতকে উঠে শাহেদ বলে, চুপ চুপ!
ক্যারল অবাক হয়ে ফের তাকায় শাহেদের দিকে।
শাহেদ আবার বলে, প্রকাশ্যে এমন কথা কখনওই বলবে না। আমাদের দেশে দিনরাত যারা নেশা করে। শুওর মদ খেতে দ্বিধা করে না। বছরে এক আধবার মসজিদে যায় কি যায় না, তেমন মানুষও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু শুনতে চায় না। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। তুমি কি জানো হুমায়ূন আজাদের কথা বা অভিজিৎ রায়ের কথা? ইসলাম ধর্ম নিয়ে নানা যুক্তির কথা বললেও কেউ কানে তুলতে চায়নি। দুজনই আক্রান্ত হয়েছিলে বইমেলায়। ধর্মোন্মাদরা প্রকাশ্যে তাদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছিল। তেমন মানসিকতার লোকদের হাতে কবি শামসুর রাহমানও আক্রান্ত হয়েছিলেন। আরও অনেকেই খুন হয়েছেন। তাদের মাঝে লেখক, ব্লগার, কবিও আছে।
- হুম। কিছু কিছু আমিও জানি। মুসলিম ফ্যানাটিকদের ভয়ে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরিন দেশ ছেড়ে পরবাসে আছে দীর্ঘকাল।
- তাহলে তুমিই বল যে, ধর্মগ্রন্থে যা বলা হয়েছে তা কতটুকু তারা মানছে? নামাজ পড়ছে ঘুষও খাচ্ছে। মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে আবার ছাত্রীদের কাউকে রেইপও করছে। কোরআনে হাফেজ হয়েও মাদক ব্যবসা করছে কেউ। একবার এক সরকারী আমলার সঙ্গে কথায় কথায় জেনেছিলাম যে, ঘুষের টাকা দিয়ে তিনি একটি এতিমখানা আর মাদ্রাসা চালান।
- হাউ ফানি!
বলে, হা হা করে হেসে ওঠে ক্যারল। হাসি থামিয়ে বলে, তাহলে সেই ঘুষের মাদ্রাসা বা এতিমখানার ছেলেরাই নৈতিকতা শূন্য হয়ে বড় হচ্ছে। হয়তোবা তারাই বড় হয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, ড্রাগ ডিলার বা রেপিস্ট হচ্ছে।
শাহেদ হঠাৎ বলে ওঠে, ক্যারল, তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না?
- কেন এ কথা বলছ হঠাৎ?
হাসতে হাসতে শাহেদ বলে, সে কখন থেকে বকর বকর করছি। আমার খিদে পেয়ে গেছে।
- ওকে। কিছু খেলে মন্দ হয় না।
বলতে বলতে বাইরের দিকে একটা জমকালো ফুডকর্নার দেখিয়ে ক্যারল বলল, ওখানেও তো ভাল স্ন্যাকস পাওয়া যেতে পারে। অবশ্য তোমাদের দেশের লোকজন বাসী-পচা খাবারও ভাল বলে বেচে দেয়। লোকজন বুঝতে পারে না।
বলতে বলতে হেসে ওঠে ক্যারল। তারপর আবার বলে, মরা মুরগি ফ্রাই করে বেচে দেয়। কুকুরের গোস্তকে মাটন বলে চালিয়ে দেয়। এমন অদ্ভুত একটা দেশে তোমরা কীভাবে টিকে আছ বুঝতে পারি না। ইথিওপিয়ার লোকজনও তোমাদের চেয়ে ঢের ভাল আছে।
একটা টঙ দোকানের পাশে গাড়ি থামিয়ে শাহেদ বলল, তোমাদের কেএফসিও পচা বাসী খাওয়ায়। শুধু শুধু আমাদের দোষ দিও না। তবে, রাস্তায় যেসব খাবার বিক্রি হয়, সেসব কিছুটা নিম্নমানের হলেও টাটকা বলা যায়। খেয়ে দেখতে পার।
- না। ওসব না। কলকাতায় কদিন ছিলাম। আমার এক কলিগ মৈথিলী, রেস্টুরেন্টে হাত দিয়ে ভাত মাখিয়ে খেত। সঙ্গে কয়েক রকম সবজি, মাছ, মাংস। এমন কিছু খাওয়া যায় না?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, যাবে।
বলতে বলতে আরও খানিকটা এগিয়ে একটি টিনের ছাউনি দেয়া সস্তার রেস্টুরেন্টে ঢোকে শাহেদ।
ক্যারলকে দেখে লোকজন কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কোনের দিকে একটা টেবিল থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, মালটা দেখছস?
অন্য কেউ বলে, গেঞ্জিটা ফাইট্যা যাইবো লাগে।
ক্যারল বাংলা না বুঝলেও নারীসুলভ বোধ থেকে বুঝতে পারে যে, কথাগুলো তাকে কেন্দ্র করেই। শাহেদকে জিজ্ঞেস করে, লোক দুটো কী বলছে?
- কিছু না।
বলতে বলতে শাহেদ চেয়ারর টেনে বসে ক্যারলকেও বসতে বলে। তারপর একজন ওয়েটারের দিকে ফিরে বলে, হাত ধোওয়ার জন্য পানি বোল আর নতুন সাবান দাও। আর দুটো ভাত দাও!
দুজনেই হাত ধুয়ে তৈরি হয়ে বসতে বসতে ভাত নিয়ে আসে লোকটা। পানির বোল ফিরিয়ে নিতে নিতে বলে, তরকারি কী দিমু?
- সবজি, ভর্তা, গরুর গোশত আর ডাল দাও।
ভাত তরকারি সবজি আর ভর্তা দেখে চকচকে চোখে তাকায় ক্যারল। তারপর ভর্তা দেখিয়ে বলে, এগুলো ভর্তা? মৈথিলী বলেছিল।
- হুম।
বলেই, পাতে সবজি ঢেলে ভাত মাখায় শাহেদ। দেখাদেখি ক্যারলও সবজি দিয়ে ভাত মাখায়। কিন্তু শাহেদের মতো পাঁচ আঙুলে খেতে গিয়ে ঠিক মতো খাবার মুখে তুলতে পারে না। ব্যাপারটা দেখে হাসি এলেও শাহেদ গম্ভীরতা ধরে রাখে। বলে, আমাকে ফলো করো।
ওয়েটার ক্যারলের দুর্দশা দেখে একটা কাঁটা চামচ আর একটা টেবল চামচ নিয়ে আসে। কিন্তু ক্যারল তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলে, লেট মি ট্রাই। ফিংগার্স বেটার দেন স্পুন!
বাচ্চারা যেভাবে হাত মুখ ভরিয়ে প্লেটের চারপাশে খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে খায়, ক্যারলের অবস্থাও তেমন মনে হচ্ছিল। ব্যাপারটা দেখে লোকজন হাসাহাসি করলেও ক্যারল মোটেও বিচলিত হয় না। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যে, ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে সে।
ক্যারলের পেছনে সময় নষ্ট না করে নিজের খাওয়াটা মনোযোগ দিয়ে শেষ করে শাহেদ। এক সময় অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে, ক্যারলও ঠিক ঠিক অভ্যস্ত হাতেই খাচ্ছে। খুশি হয়ে সে বলল, বেশ শিখে ফেললে তো!
- হুম। আমাকে এইসব রান্নার রেসিপি কালেকশন করে দেবে।
- আচ্ছা।
ক্যারল খাওয়া শেষ করে সবাই যেখানে হাত ধোয় সেখানে গিয়েই হাত ধুয়ে নেয়। তারপর ওয়েটারের এগিয়ে দেওয়া টিস্যু দিয়ে হাত মুখ মুছে নিয়ে শাহেদকে বলে, চল যাই।
খাবারের দাম চুকিয়ে দিয়ে বাইরে বেরোতে বেরোতে শাহেদ বলে, ক্যারল, গাড়িতে উঠবার আগে একটা সিগারেট টানব, কিছু মনে করবে না তো?
- না না। বরং গাড়িতে বসেই কাজটা করা যাবে। আমার সঙ্গেও সিগারেট আছে।
শাহেদ খুশি হয়ে বলে, গুড! সময়টা অযথা নষ্ট হবে না।
হঠাৎ কোত্থেকে ছ-সাতজন ভিক্ষুক এসে ক্যারলকে ঘিরে ধরে বলতে লাগল, ম্যাডাম, ডলার প্লিজ! ম্যাডাম, ম্যাডাম, ডলার প্লিজ!
শাহেদ তাদের ধমক দিয়ে বলে, এই, সরো তোমরা! ম্যাডামের কাছে ডলার নাই।
সবচেয়ে বয়স্ক ভিক্ষুকটি বলল, তাইলে আপনে ট্যাকা দেন সাব!
ওয়ালেট থেকে একশ টাকার একটি নোট বের করে বয়স্ক লোকটির হাতে দিয়ে শাহেদ বলল, যাও ভাগো! সবাই সমান ভাগ করে নেবে।
বলতে বলতে ক্যারলকে তাড়া দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে শাহেদ।
দেখাদেখি ক্যারলও উঠে পড়ে দরজা লাগিয়ে দিতেই শাহেদ গাড়ি ছেড়ে দেয়। সেই ফাঁকে ক্যারল তার ব্যাগ থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে ধরায়। তারপর বলে, এসি অফ করে দিয়ে গ্লাস দুটো নামিয়ে দাও।
শাহেদ গ্লাস নামিয়ে দিয়ে ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি থামিয়ে নিজেও সিগারেট ধরায়। তখন একবার ঘড়িতে সময় দেখে ক্যারল জানতে চাইল, আর কতটা পথ আছে সামনে? সময় মতো পৌঁছুতে পারব তো?
- ও কোনো ব্যাপার না। তুমি সাদা চামড়ার দেশের লোক। তোমার জন্য সবাই ঘড়ি বন্ধ করে রাখবে।
বলে আবার হাহা করে হাসে শাহেদ। কিন্তু সে হাসি যেন ক্যারলকে স্পর্শ করে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পেরিয়ে ফার্মগেট ছেড়ে বাংলামটরে আরও বেশ খানিকটা অপেক্ষা করতে হয় তাদের। তারপর ফের শাহবাগে এসে বাধা পায়। গাড়ি নিয়ে সোজাসুজি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতে পারে না তারা। রাস্তা বন্ধ করে কয়েকজন ছেলেমেয়ে বসে আছে রাস্তায়। সামনে বড় করে হলুদ রঙ দিয়ে লিখে রেখেছে ত্রিশ পার্সেন্ট কোটা বহাল চাই।
এই প্রতিবন্ধকতা এড়াতে হলে তাদের বাঁইয়ে গিয়ে মৎসভবন পাশ কাটিয়ে হাইকোর্ট হয়ে ঘুরে আসতে হবে ভাষা ইন্সটিটিউটে।
হঠাৎ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিয়ে ক্যারল জানতে চাইল, রাস্তা বন্ধ করে কী করছে ওরা?
গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে শাহেদ বলল, ওরা আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি।
- ওরা কি ভিক্ষা করছে?
বলে, অবাক চোখে তাকায় ক্যারল।
- আরে নাহ! ভিক্ষা করবে কেন? ওরা দাবী আদায়ের আন্দোলন করছে।
- সংখ্যায় এত কম কেন? কিছুদিন আগে তোমাদের স্কুলের বাচ্চারা নিরাপদ সড়কের দাবীতে যেই আন্দোলন করেছিল ওটা তো অনেক বড় আন্দোলন ছিল। বিবিসি নিউজ করেছিল।
- হ্যাঁ। সে আন্দোলন আর এই আন্দোলন দুটো ভিন্ন ব্যাপার।
- বুঝিয়ে বল তো!
- মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলেমেয়ের জন্য আলাদা একটা কোটা ছিল। তা বাড়িয়ে তাদের নাতি-নাতিনদেরও কিছু সুবিধা দিচ্ছিল সরকার। কিন্তু সম্প্রতি সেই সুবিধা বাতিল করে দিয়েছেন আমাদের সরকার। সে সুবিধা আবার ফিরে পেতে চাচ্ছে তারা।
- তাহলে তো সেটার দাবীদার আরও বেশি হওয়ার কথা। এত কম কেন? সাকুল্যে পঞ্চাশ জনও তো হবে না!
- নাহ। এখন হয়নি। হয়তো দিনে দিনে আরও বাড়বে। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো এক নাতনি বলেছিল যে, বীরেরা সংখ্যায় কম হয়। জঙ্গলে যেমন শিয়াল-কুকুর বেশি থাকে, বাঘ বা সিংহ অল্প কয়েকটি থাকে।
- এরা তো বাঘ বা সিংহ নয়। বা বীর নয়। তারা নিজেরা কেউ যুদ্ধ করেনি। করেছে তাদের পূর্বপুরুষ। তারা কেন বাড়তি সুবিধা পাবে?
- কী করে তোমাকে বোঝাই। আচ্ছা চেষ্টা করছি। বলে, শাহেদ গিয়ার নামিয়ে দিয়ে ফের বলে, ধরো একজন মুক্তিযোদ্ধা ফ্রন্টে মারা গেলেন বা খুব খারাপ ভাবে আহত হলেন। ফলে, তাঁর পরিবারের আয় রোজগারের প্রধান মানুষটি থাকলো না বা আয় রোজগারের সামর্থ্য হারিয়ে ফেললেন। তাহলে সেই পরিবার চলবে কীভাবে? তাই সরকার তাদের কিছু সুবিধা দিলেন। তাদের সন্তানদের শিক্ষা বা চাকরি ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধা দিলেন যাতে পরিবারটি অভাবে অভাবে শেষ হয়ে না যায়। সেটারই একটা কোটা ঠিক করা ছিল।
- বুঝলাম কোটা পেয়ে আহত বা শহিদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ভালো শিক্ষা আর ভালো চাকরি পেল। পরিবার রক্ষা পেল। কিন্তু সুবিধা পাওয়া বা কোটার আওতায় চাকরি পাওয়া লোকটা তো ভালোভাবেই সংসার চালাতে পারছিল। তার ছোট ভাইবোনও সেই একই সুবিধা পেয়েছে বড় হয়ে। কিন্তু তাদের সন্তানরা আবার বাড়তি সুবিধা পাবে কোন যুক্তিতে?
- এটা নিয়েই দেশ আজ দু ভাগ হয়ে আছে।
ক্যারল হেসে বলে, তুমি কাদের সমর্থন করো?
- কোনোটাই না।
- কেন?
- আমার মতে কোটা সুবিধা পাবে প্রতিবন্ধীরা। বাকিরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে ভাগ্যকে জয় করে নিক। প্রতিবন্ধীরা এমনিতেই ভাগ্য বঞ্চিত। তাদের জন্যই কোটা পদ্ধতি থাকা উচিত যাতে তারা সমাজে কারও করুণার পাত্রপাত্রী হয়ে বেঁচে না থাকে।
- গুড থিংকিং!
বলল ক্যারল। তোমাদের জিডিপি বেড়েছে। দেশের উন্নতি হয়েছে। রাস্তাঘাট আর সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। লেখাপড়া করে তোমাদের চাকরিই কেন করতে হবে? ব্যবসা আছে, কৃষি আছে।
তারপর একটি সিগারেট ধরিয়ে ক্যারল আবার বলে, অবশ্য একজন বিদেশী হিসেবে তোমাদের বিষয়ে বলা আমাকে মানায় না। তুমি বলছিলে তাই কথা প্রসঙ্গে আমিও বলেছি। নেভার মাইন্ড!
শাহেদ বলে, জাতি হিসেবে এমনই আজব আমরা যে, চাকরিটাই আমরা পছন্দ করি। হয়তো খাটাখাটুনি কম করেও অনেক সময় ফাঁকি দিয়েও প্রায় সারাটা জীবন পার করে দেওয়া যায় বলে।
ভাষা ইন্সটিটিউটের সামনে আসতেই তারা দেখতে পায় অনেকেই ক্যারলকে বরণ করে নিতে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
খুশি হয়ে ক্যারল বলল, তোমার সঙ্গে আমার আগের পরিচয় আছে ব্যাপারটা বলে দাওনি তো?
- কেন নয়? বলেছি বলেই তো তোমাকে আনতে আমাকে পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে জানলেই তো ডিপার্টমেন্ট আমাকে আলাদা মূল্য দেবে। আমাদের এখানে ব্যক্তির যোগ্যতার চেয়ে তার বৈভব আর তার সম্পর্কের চেইনের মূল্যায়ন করা হয়। এ ছাড়া তেমন কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না।
ক্যারল মাথা ঘুরিয়ে কেমন অবাক চোখে তাকায় শাহেদের দিকে। তারপর শ্লথ পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে একবার মাথাটা ঝাঁকিয়ে যেন নিজেকেই বলে, ওও, চেইন ইজ ইম্পরট্যান্ট হিয়ার?

(সমাপ্ত)

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:৫৩
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×