_______________________________(ছবি- গুগুল থেকে)
সমরেশ মজুমদার আমারও পছন্দের লেখকদের একজন। তাঁর লেখা আমাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করে। যেমন আগের কোনো একটি লেখায় লিখেছিলাম যে, সৈয়দ শামসুল হকের কোনো লেখা পেলেই পড়ে ফেলি। এমন কি তাঁর সম্পর্কিত কোনও লেখা পেলেও।
সমরেশ মজুমদারও আমার চোখে তেমনই একজন। তবে আমার কৌতূহল লেখকের লেখা নিয়েই। কোনো লেখকের ব্যক্তি জীবন নিয়ে ততটা আগ্রহ নেই। লেখক আর ব্যক্তি সম্পূর্ণ আলাদা সত্তা। লেখালেখির সঙ্গে এক আধটু সম্পর্কিত বলেই আমি জানি, ব্যক্তি চরিত্র আর ব্যক্তি জীবন দিয়ে লেখককে বিচার করতে হয় না। তারপরও কিছু কিছু ব্যাপার ঘটে যায়, দৃষ্টিকটু না হলেও যা মোটা দাগে চোখে লাগে। তেমনই একটা প্রসঙ্গে একটু লিখতে হচ্ছে। যদিও লেখকের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা নেই। তবু আশা করি লেখক সমরেশ মজুমদার তাঁর একজন পাঠক হিসেবে আমাকে শুরুতেই ক্ষমা করে দেবেন।
আমি মনে করি সব লেখকই তাঁর পরিচিত গণ্ডীর বাইরে গিয়ে কোনো এক সময় লিখতে চেষ্টা করেন। এমন কি তাঁর অচেনা কোনো পরিবেশ, সমাজ নিয়েও লিখতে উৎসাহ বোধ করে থাকতে পারেন। যেমন আমি কোলকাতা তো বটেই সে শহরটার আশপাশ সম্পর্কে বা সেখানকার জীবনাচার সম্পর্কেও আমার তেমন কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবু আমার ইচ্ছে হলো সেখানকার পরিবেশকে জড়িয়ে একটা গল্প লিখি। যে গল্পটির নাম প্রথমে দিয়েছিলাম ‘মুরগি।‘ পরে ‘বিশ্বাসের দহন ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থে গল্পটির শিরোনাম বদলে ‘মুঠি বদ্ধ অন্ধকার’ করে দিয়েছি। গল্পটিতে হিন্দু ধর্মের চরিত্র আছে। আছে সেখানকার ভাষার ব্যবহারও। কিন্তু গল্প হিসেবে কেমন হয়েছে সেটা পাঠকের মুখ থেকে তেমন বিস্তারিত জানা হয়নি। গ্রন্থটি অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত।
‘যুদ্ধ ও মানসাঙ্কের গল্প’তেও হিন্দু চরিত্র আছে। উত্তম পুরুষে লেখা এ গল্পটি কোনো মুসলিম লেখক লিখেছে না হিন্দু লেখক লিখেছে, পাঠক সেটা ধরতে পারেন না।
যাই হোক, এ লেখাটিকে যদি কেউ ভেবে থাকেন যে, আমার লেখার প্রচারণামূলক লেখা, তাতেও আমার আপত্তি থাকবে না।
সম্প্রতি ‘সোনার শেকল’ নামে সমরেশ মজুমদারের একটি উপন্যাস পড়লাম। শুরুটা হয়েছে বাংলাদেশের পটভূমিতে। প্রধান চরিত্র মতিন। যে একজন মুসলমান পরিবারের ছেলে। মুসলিম পরিবারের কারও সঙ্গে লেখকের সখ্য আছে কি না আমার জানা নেই। তবে পড়তে পড়তে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, লেখক আর কিছুটা সচেতনতার পরিচয় দিতে পারতেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবেই আমি জানি যে, বাংলাদেশের কোনো মুসলমান পরিবারে মাতামহ কে ঠাকু মা, পিতামহকে ঠাকুর্দা বলে না। লেখার ভেতর দিয়েই যদি লেখকের ধর্মপরিচয় ফুটে ওঠে, তাহলে বলব এটা লেখকের ব্যর্থতা। লেখার ভেতর দিয়ে কেন লেখকের ধর্ম পরিচয় ফুটে উঠবে? লেখক বিশেষ করে সাহিত্য সংশ্লিষ্ট লেখায় লেখকের ধর্ম পরিচয় অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। সাম্প্রদায়িকতাকে ছাপিয়েই একজন লেখক সবার লেখক হয়ে ওঠেন। তারপরও কেউ কেউ সাম্প্রদায়িকতাকে অতিক্রম করতে পারেন না। অথবা সচেতন ভাবেই তা করেন না।
অনেক হিন্দু লেখককে দেখেছি মুসলিম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে খানিকটা বিকৃত করে লিখতে। আমাদের পাশের গ্রামের এক হিন্দু ডাক্তার ছিল, যার নাম অবিনাশ। আজান শব্দটাকে সে উচ্চারণ করত ‘আজাম’ হিসেবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ‘নামাজ’ বা ‘নমাজ’ শব্দটিকে ‘নেমাজ’ লিখেছেন। বঙ্কিম বাবু যে মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন, লেখায় তা গোপন করতে চেষ্টা করেননি।
আরও অনেক হিন্দু লেখকের লেখাতেই প্রকট হয়ে উঠেছে যে তিনি হিন্দু। তাদের কি ধারণা যে, মুসলিম ধর্মীয় শব্দগুলো শুদ্ধ করে লিখলে বা উচ্চারণ করলে তাদের হিন্দুত্ব আক্রান্ত হবে বা কোনো অংশে খর্ব হবে? যেমন কাঠমোল্লারা বলে, হিন্দুর হাতের খাবার খেলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।
অবশ্য আমার ধারণা ছিল যে, সমরেশ মজুমদার ধর্মীয় দিক থেকে একজন উদার খ্রিস্টান। কিন্তু অবাক করা বিষয় যে, ‘সোনার শেকল’ পড়তে গিয়ে দেখি যে, তিনিও একজন কট্টরপন্থী হিন্দু। যে কারণেই হয়ত তিনি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বা ‘ওয়ালাইকুম সালাম’ লিখতে সংকোচ বোধ করেন। ‘সেলামালুকুম’ ‘আসলাম আলেকুম’ ‘আলেকুম আসলাম’ লিখে নিজের ‘ইমান’ ঠিক রাখলেন কি না সেটাও বুঝতে পারি না।
আনন্দ বাজার যেমন ‘এপি জে আবুদুল কালাম’ লিখে পত্রিকার হিন্দুত্বের ইমান ঠিক রাখে, বাংলাদেশে কোনো কোনো পত্রিকা বা হিন্দু লেখকের লেখায় এমন হীনতা দেখিনি বা থাকলেও আমার চোখে পড়েনি।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন জুলিয়ান সিদ্দিকী একটা সংকর নাম। তালি তাপ্পি মেরে বানানো নাম। অস্বীকার করবো না। কিন্তু এ নামে একক ধর্মের প্রকাশ নেই। কোনো মুসলিম লেখককে দেখিনি ‘নমস্কার’ শব্দটাকে ‘নমুস্কার’ বা ‘নমিস্কার’ লিখতে। ‘পূজা’ শব্দটাকে ‘পিজা বা পজা অথবা ‘পোজা’ লিখতে। মোটকথা কট্টরপন্থী মুসলিম লেখককেও দেখিনি বিকৃত করে হিন্দু ধর্মীয় কোনো শব্দ লিখতে। অথচ সেই উদারতা কলকাতার হিন্দু লেখকদের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না তেমন।
সুতরাং সমরেশ মজুমদার একজন হিন্দু লেখক। হয়ত বা তাঁকে উগ্রবাদী হিন্দুও বলা যেতে পারে। লেখক মলয় রায় চৌধুরী যেমন তাঁর বই না ছাপানোতে বাংলাদেশের প্রকাশকদের মৌলবাদী বলে গালি দিয়েছিলেন।
এখন আপনারাই বলুন, মৌলবাদের বীজ কে কোথায় কীভাবে বপন করে?
১০/১০/২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৪:১৭