একালের গনি মিয়া এবং শ্রাদ্ধ নামের কুসংস্কার......
"গনি মিয়া একজন কৃষক।
নিজের জমি নাই, অন্যের জমি চাষ করে। তাহাতে ধান হয়, পাট হয়। সে তাহার অর্ধেক ভাগ পায়। ছেলের বিবাহে সে অনেক ধুমধাম করিল। ইহাতে অনেক টাকা কর্জ হইল। সে কর্জ আর শোধ হইলোনা। এখন তাহার দু:খের সীমা নাই"- ছেলে বেলায় এই গল্প আমরা অনেকেই পড়েছি।
হিন্দু ধর্মালম্বীদের বাবা মারা গেলে শ্রাদ্ধ পালন করতে হয়, তেমনই মুসলমানদের মধ্যে পালন করা হয় জেয়াফৎ(জেয়াফৎ বাধ্যতামূলক নয়)। শ্রাদ্ধ এবং জেয়াফৎ অন্তঃমিল হচ্ছে মৃত ব্যক্তির সন্তানদের চৌদ্দপুরুষ ছাড়াও চেনাজানা অসংখ্য লোকদের দাওয়াত করে ভুরিভোজ করানো! এই শ্রাদ্ধ কিম্বা জেয়াফৎ খাওয়ানো অনেকের জন্যই গোদের উপর বিষফোড়ার চাইতেও বেশী কষ্টদায়ক।
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের বর্ণাশ্রম অনুযায়ী মৃত্যুর কতদিন পর শ্রাদ্ধের কাজ কর্ম, আত্মাকে পিণ্ডিদান ইত্যাদি হবে, তা ঠিক করা আছে। মৃতের শ্রাদ্ধের কাজ যে করবে (ছেলে থাকলে অবশ্যই ছেলে) তাকে আরও অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়। অশৌচ চলাকালীন সেলাইহীন এককাপড়ে থাকতে হয়। নিজে হাতে মাটির মালসায় ভাতে-ভাত রান্না করে খেতে হয়, যাকে বলা হয় হবিষ্যান্ন। জুতাে পরা চলবে না। রােদ-বৃষ্টি যাই হােক ছাতা নেওয়া চলবে না। চুল-দাড়ি-গোঁফ ছাঁটা চলবে না। গায়ে মাথায় তেল-দেওয়া বা সাবান দেওয়া অবশ্যই চলবে না। যৌনসঙ্গম নিষিদ্ধ। তারপর তাে রয়েছে আত্মার শ্রাদ্ধ-শান্তির নাম করে পুরােহিতকে মৃতব্যক্তির প্রিয় জিনিসপত্র দান, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়-বন্ধুদের ভূরিভােজে আপ্যায়ন ইত্যাদি।
শ্রাদ্ধের কাজ যিনি করবেন তিনি তেল, সাবানহীন রুক্ষ চুল ও এক মুখ অপরিচ্ছন্ন গোঁফ-দাড়ি নিয়ে, খালি গায়ে একটা নােংরা কাপড় পরে, খালি পায়ে এবং নিজের রান্না নিজে করে খাবে। আত্মার শান্তির নামে এই যে কুসংস্কার ও অর্থহীন খরচ যুগযুগ ধরে চলে আসছে আজও আমাদের সমাজ কিন্তু তার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছে না। পাছে লােকে কিছু বলে এই তাড়নায় এই কুসংস্কারের কাছে মাথা নােয়াচ্ছেন। যাঁরা এই সব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়ান, তাঁদের বিরুদ্ধে একদল লােক-কুবাক্য প্রয়ােগ করতে পারেন বটে, কিন্তু, একই সঙ্গে আর একদল লােকের চোখে শ্রদ্ধার আসনও পাতা হয়ে যায়। কারণ, কথায় ও কাজে যাঁরা এক, তাদের শ্রদ্ধা জানাবার মতাে লােক আজও আছেন।
এবার আসি আসল প্রসঙ্গে।
আমাদের গ্রাম প্রতিবেশী একটা হিন্দু পরিবার শীল সম্প্রদায়। পেশা চুল কাটা। অত্যন্ত দরিদ্র। ৮/১০ জন সদস্য পরিবারে অভাব নিত্যকার। চুল কেটে যা উপার্জন তাতে ওদের সংসার চলেনা। চুল কাটার বাইরে অন্যের জমিতে চাষাবাদ, পশুপালন করে। নিজেদের বসতবাড়ি ছাড়া অল্পকিছু কৃষি জমির মালিক হলেও সারা বছর কষ্টেশিষ্টে দিনাতিপাত করে।
বছর দশ আগে এই পরিবারের বড়ো ছেলে সঞ্জয়কে আমি ঢাকায় এনে একটা নামীদামি সেলুনে কাজ পাইয়ে দিতে সহায়তা করেছিলাম। ওর আর এক ভাই সুবলকেও দুই বছর আগে একটা প্রাইভেট অফিসের অফিস সহকারী হিসেবে লাগিয়ে দিয়েছি। দুই ভাই কষ্ট করে ঢাকায় থেকেখেয়ে বাকী টাকা বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোনদের জন্য পাঠিয়ে দেয়। পরিবার প্রাণ অত্যন্ত দ্বায়িত্ববান ছেলে। আমি ওদের খুব স্নেহ করি এবং ওরা আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো।
কিছুদিন আগে সঞ্জয়রে বাবা মারা গেছে। সঞ্জয়-সুবোধ ওদের ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে সচেতন হলেও আর্থিক কারণে কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। কিন্তু গ্রামের পুরোহিত/ব্রাহ্মণ্যরা সঞ্জয় পরিবারের উপর প্রেশার দিচ্ছে- বাবার শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন করতে। হিন্দু প্রধান এলাকায় আত্মীয় স্বজন ছাড়াও পাঁচ শতাধিক লোককে খাওয়াতে হবে.... শ্রাদ্ধকর্ম না করলে একঘরে হতে হবে!
অবশেষে "বাবার আত্মার শান্তির জন্য" সঞ্জয়-সুবোধ দুই ভাই বিভিন্ন জনের থেকে ধারকর্জ করে পঞ্চাশ হাজার টাকা যোগাড় করেছে। বসতবাড়ী ছাড়া কৃষি জমিটুকু এবং একটি গাভী গরু ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বাবার শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন করে এখন 'পূতপবিত্র হয়েছে'!
ছেলে বেলায় তৃতীয় শ্রেণির বইতে গনি মিয়ার গল্প যত বারই পড়েছি ততবারই হেসেছি। কিন্তু জীবন যুদ্ধে আমরা শেষ পর্যন্ত গনি মিয়া হয়ে যাই!
গনি মিয়ার সাথে নিজেকেও মিলিয়ে ফেলি।
নিজেকেও গনি মিয়া'ই মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




