ঐতিহ্যময় ঢাকা নিউ মার্কেটের সেকাল - একাল.....
কথায় আছে ঢাকার গৃহিণীরা চুলের ক্লিপ কিনতেও নিউমার্কেটে ছোটেন। কিন্তু সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মুখে চুনকালি দিচ্ছে ঢাকা কলেজের 'একশ্রেণীর ছাত্র নামধারী চাঁদাবাজ গুন্ডা'। 'রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এই ছাত্র নামধারী গুন্ডাদের' সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে নিউমার্কেট এলাকায় ক্রেতা সাধারন এখন জান-মালের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত!
আধুনিক নগর সভ্যতায় কেনাকাটার গুরুত্ব যেভাবে বেড়েছে সে হারে বেড়েছে মার্কেটের গুরুত্ব। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, রাজধানীর কেনাকাটার ক্ষেত্রে ক্রেতাদের একদা প্রথম পছন্দই ছিলো নিউমার্কেট এবং তৎসংলগ্ন গাউছিয়া মার্কেট। যদিও এখন ঢাকা শহর মানেই মার্কেটের শহর। পাড়া মহল্লা সর্বত্রই এখন বিশাল বিশাল শপিং কম্পলেক্স। এমনতরো অজস্র শপিং কম্পলেক্স থাকা সত্যেও ঢাকা নিউ মার্কেটের আবেদন এতোটুকু কমেনি!
এবার চলুন জেনে নেয়া যাক নিউমার্কেটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ ১৯৫২ সালে ৩৫ একর জায়গা নিয়ে এ মার্কেটের নির্মাণ কাজ শুরু করে শেষ হয় ১৯৫৪ সালে। বিকিকিনির জন্য নিউমার্কেটকে বলা যায় এ-ওয়ান। অবশ্য রাজধানীতে আয়েশী অবকাশ কাটাতে ঘুরে ঘুরে প্রশস্ত চত্বরে শপিং করার বেশ কিছু মার্কেট এবং এ সমস্ত শপিং মলে ক্রেতাসাধারণ আকর্ষণীয় সেবা পেলেও নিউমার্কেট তার আকর্ষণ ঠিকই বজায় রেখেছে। নিউমার্কেটের সরকারী ভাবে বরাদ্ধ ৪৪০টি দোকানে আপনি এমন কিছু নেই যা পাবেন না। অভিজাত বেনারসী শাড়ি থেকে শুরু করে শাটিং-স্যুটিং, অলংকার, লেদার আইটেম, বই-পুস্তক, ফটো স্টুডিও, রেস্টুরেন্ট- সবকিছুই পাচ্ছেন কেন্দ্রে অবস্থিত পার্কের চারপাশে। ৫০ এবং ৬০ এর দশকে ঢাকার নিউমার্কেট শপিং এবং চমৎকার সময় কাটাবার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল। ঢাকা রক্ষণশীল শহর হলেও উঠতি যুবকদের বান্ধবী নিয়ে ঘোরার জন্য নিউমার্কেট ছিল নিরাপদ স্থান। কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একে অপরকে কিছু গিফট করতে সান্ধ্য ভ্রমণটা নিউমার্কেটেই সেরে থাকে।
আশির দশকে নিউমার্কেটের উত্তর মুখে গড়ে ওঠে ক্রোকারিজ সামগ্রীর জন্য নিউ সুপার মার্কেট, কিচেন সামগ্রীর জন্য বনলতা মার্কেট, বিবিধ জিনিসের জন্য চন্দ্রিমা মার্কেট এবং ডি ব্লকে গ্রোসারিজ মার্কেট। মসজিদের পাশে নতুনভাবে বরাদ্ধ দেয়া ৬২টি দোকান দ্রব্যসামগ্রীর পসরা খুলে বসেছে। তবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের সহায়তায় গোটা নিউমার্কেট জুড়ে ফুটপাত হকারদের দখলে।
অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এর অনেক পরিবর্তন-বিবর্তন এবং অন্তর্ভুক্তি ঘটলেও নিউমার্কেট সকলের কাছে এখনোর “নিউ”। সময়ের প্রয়োজন মেটাতে নিউমার্কেট তার পরিধি বাড়িয়েছে, সাথে সাথে প্রাচ্য সভ্যতা ও ঐতিহ্যের ধারক নিউমার্কেট মানুষের চাহিদার কথাও ভোলেনি। গ্রোসারি থেকে শুরু করে বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন, জুয়েলারি, চশমা, লোকাল এবং ওয়েস্টার্ন ক্রোকারিজ এবং গৃহসজ্জার যাবতীয় সামগ্রী অর্থাৎ আপনার সম্ভাব্য সব প্রয়োজন মেটাতে নিউমার্কেট জুড়ি নেই। গৃহিণীরা অনেকেই জানে নিউমার্কেটের কোন দোকানে তার কাঙিক্ষত দ্রব্যটি মিলবে। ছাত্র থেকে শুরু করে পিতা-মাতারা তাদের প্রয়োজনীয় স্টেশনারী গুডসের সবটাই পেয়ে যায় নিউমার্কেটে।
প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ এবং সহনীয় দামের প্রশ্নেও নিউমার্কেট তার অবস্থান ধরে রেখেছিলো ২০০০ সন পর্যন্ত। ব্যতিক্রম নিউ সুপার মার্কেটের দোতলা-তিনতলার রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকানগুলো। উল্লেখ্য দুই ফ্লোরে কেনাকাটার নুন্যতম অনুকূল পরিবেশ নাই। ওখানে ২০০ টাকার জিনিস দাম হাকাবে ২০০০ টাকা। দোকানের মালিক এবং সেলসম্যান সবাই এক কথায় সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী এবং প্রতারক। কোনো পণ্যের দাম জিজ্ঞেস করলেও ধরা খেতে হয়। দাম পছন্দ না হলে ক্রেতা পণ্য কিনবেন না- এটাই স্বাভাবিক হলেও এই মার্কেটের দোকানীদের হাতে অপমান অপদস্ত এমনকি শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হবে। কাজেই ওই দুটি ফ্লোর এড়িয়ে চলুন।
তবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের সহায়তায় গোটা নিউমার্কেট জুড়ে ফুটপাত হকারদের দখলে। এহেন খারাবীর পরেও আজও নিউমার্কেট শহরের ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তার তোরণ এবং টাওয়ার ধ্রুপদী ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। নিউমার্কেটের ছোট ছোট কর্নারেও মিলবে আপনার প্রত্যাশিত সামগ্রী। ঢাকাবাসীরা নিউমার্কেটের জন্য রীতিমত গর্ববোধ করে।
দেশ বিদেশের লেটেস্ট ফ্যাশন যদি আপনি হাতের নাগালে পেতে চান তাহলে নিশ্চিতভাবে নিউমার্কেটে চলে আসতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোয়ালিটি পোশাক-পরিচ্ছদ সরবারাহ করছে আমাদের দেশীয় পোশাক শিল্প ফ্যাক্টরিগুলো। ঢাকা কলেজের বিপরীতে বা ওডিসিতেও এগুলো পেয়ে যাবেন। বাংলাদেশের প্রচুর সংখ্যক মানুষ বিশেষ করে পুরুষেরা পশ্চিমা স্টাইলের পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ক্রেতাদের চাহিদার কথা বিবেচনা করেই ওডিসি ফেয়ার প্রাইজ এই অভিরুচি পূরণ করছে। নিউমার্কেটের বিশাল ছাদের নিচে রয়েছে বাহারি পোশাকের বিপুল সমাহার। টি-শার্ট, ট্রাউজার, গরম কাপড়ের তো কথাই নেই। যিনি নিউমার্কেটে মার্কেটিং এর প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন তিনি বুঝতে পারবেন নিউমার্কেটের বিপুল সম্ভারের আভিজাত্য। বিশেষ করে বিপুল সম্ভারের বড় বড় স্টোরগুলোতে যদি কেনাকাটা করতে যান তাহলে ভীড়ের চাপ, কটাক্ষ বা দুই এক বার মৃদ্যু কনুইয়ের গুঁতো আপনাকে কবুল করে নিতে হবে।
পোশাক সম্ভার বিভাজনে এই মার্কেটের রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি পোশাক তা যে রং বা যে ডিজাইনের চান না কেন, তা ওখানে মিলবে। ছেলে এবং মেয়েদের জিন্স এবং টিশার্ট প্রাপ্তির মনোলোভা স্থান হচ্ছে ওডিসি। গ্যাবার্ডিন এবং ট্রাউজার প্রচুর বিক্রি হয় এখানে। প্যান্ট, শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার তো আছেই। খাঁচ কাটা, স্পষ্ট দাগ এবং বিচিত্র প্যাটার্নের টি শার্টের জুড়ি নেই। ওদের দ্রব্য সম্ভারের মূল্য যথেষ্ট নমনীয়, অধিক উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা ছাড়াও সহনীয় মূল্য মধ্যম আয়ের ব্যক্তিদেরও এর ক্রেতা সাধারণের অন্তর্ভূক্ত করেছে। শীত মৌসুমে ছেলে-মেয়েদের আকর্ষণীয় আইটেম হচ্ছে ডেনিম, জ্যাকেট, সোয়েটার এবং হাতাওয়ালা টি-শার্ট। শরীরের নানা ডিজাইনের বাহারি রংয়ের পোশাকের আকর্ষণীয় প্রাপ্তিস্থানের নাম হচ্ছে ওখানে। বিপুল সমাহার বড় কথা নয়, এর ফেয়ার প্রাইজই সাধারণ ক্রেতাদের টানছে। মোটামুটি মানসম্পন্ন একটা পোশাক ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় পেয়ে যাবেন।
নিউমার্কেট শুধু শপিং’র জন্যই নয়, ঢাকার গর্বের সাথে নিজেকে অংশীদার করারও একটা সুযোগ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




