somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

পাঠপ্রতিক্রিয়া..... বাঙ্গালা রুবাইয়াৎঃ এ টি এম মোস্তফা কামাল।

২৩ শে এপ্রিল, ২০২২ সকাল ১১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পাঠপ্রতিক্রিয়া.....
বাঙ্গালা রুবাইয়াৎঃ এ টি এম মোস্তফা কামাল।

আমরা জানি, ফারসি শব্দ ‘রুবাই’। শব্দটি ফারসি ভাষার এক বচন। ‘রুবাইয়াৎ’ হচ্ছে বহুবচন। রুবাই হচ্ছে মূলত চতুষ্পদী কবিতা, চার চরণের মধ্যে একটিমাত্র ভাবকে হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা। প্রেম, দ্রোহ, আনন্দ, বিষাদ, আধ্যাত্মিকতা, মানব হৃদয়ের আশা, আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের চিত্র অঙ্কিত হয় রুবাইয়াতের ছত্রে ছত্রে। আশাবাদ, নৈরাশ্যবাদ, সুফিবাদ, মরমিবাদ, দেহবাদ, নিয়তিবাদ এবং দর্শন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে রুবাইয়াতের চরণে। "রুবাইয়াতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ছত্রে থাকে অন্ত্যমিল আর তৃতীয় ছত্রে থাকে অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে অন্যান্য চরণের ব্যতিক্রম।"


রুবাইয়াতের সমার্থক কাব্য হচ্ছে- চীনা চতুষ্পদী কবিতা, জাপানি হাইকু। রুবাই ফারসি সাহিত্যকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি, পৃথিবীতে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা দিয়েছে। ফারসি সাহিত্য কাব্যকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথাঃ-
(১) কাচ্চিদা (রঙ্গ বা ব্যঙ্গ কাব্য),
(২) গজল (প্রেমগীত),
(৩) মসনবি (দীর্ঘ কাব্যগাথা),
(৪) রুবাই বা রুবাইয়াৎ।

রুবাইয়াৎ কাব্যের উত্থান ঘটেছে ইরানের বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামের হাত ধরে। ওমর খৈয়াম বুখারায় পড়াশোনার সময় একই সঙ্গে দুই তরুণীর সঙ্গে প্রেমে মজেছিলেন। একজন রুবাই আরেকজন রুবাইয়াৎ। দু’জনই জানতেন ওমর খৈয়াম দু’জনকে এক সঙ্গে ভালোবাসতেন। ওমর খৈয়ামের গজলে মুগ্ধ হয়ে রুবাই এবং রুবাইয়াৎ দু’জনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একত্রে তারা বিয়ে করবে। পরবর্তীতে ওমর খৈয়াম দুর্বিপাকে তুরস্কে চলে গেলে একজনকেও বিয়ে করা সম্ভব হয়নি। অন্য নারীকে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রুবাই এবং রুবাইয়াৎকে নিয়ে লিখেছেন অমর গাথা। কাজেই রুবাইয়াৎ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ওমর খৈয়াম হয়ে ওঠেন মূল প্রতিপাদ্য।

'বাংলা' বা 'বাঙ্গালা' শব্দটির সঠিক উৎপত্তিটি অজানা। সম্ভবত ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি এ অঞ্চলে বসবাসকারী দ্রাবিড় গোষ্ঠী 'বঙ' থেকে 'বঙ্গ' শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। অন্যান্য সূত্র থেকে ধারণা করা হয় যে অস্ট্রিক জাতির সূর্যদেবতা "বোঙ্গা" থেকে বঙ্গ কথাটির উদ্ভব হয়েছে।

এ টি এম মোস্তফা কামাল এর বাঙ্গালা রুবাইয়াৎ- র প্রথম প্রকাশ ২০০৯ সালের একুশের বই মেলায়। বইটি আমি তখনই মেলা থেকে কিনেছিলাম। চলতি বছর মেলায় এ টি এম মোস্তফা কামাল এর বই দেখেই সম্প্রতি অন লাইনে বইটি কিনে দেখি- এটা সেই আগের বইটিই! তবে আগের বই হলেও এবারে অনেক পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত। বাঙ্গালা রুবাইয়াৎ- এর পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণও বের হয়েছিল গত বছর একুশের বই মেলায়।


প্রিয় বন্ধু, আমার পরম সুহৃদ স্নেহভাজন এ টি এম মোস্তফা কামাল রুবাইয়াতের ব্যাকরণ-প্রকরণ ঠিক রেখে হৃদয়গ্রাহী ছন্দ, অন্ত্যমিলের দ্যোতনায়, কাব্যিক শব্দ বিন্যাসে অর্থবহ উপায়ে মস্তিস্ক নিংড়ানো ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন জুতসই বয়ানে। তিনি লিখেছেনঃ-
"ফজর নামাজ হয় না পড়া এমন গভীর ঘুম আমার!
আসর-এশাও ঘুমের শিকার, কাজের নামে জোহর পার!
ঘুম ও কাজের চাপ থাকেনা, বাদ পড়ে তাও মাগরিবও!
ঘুম জাগরণ এক কাতারে, হিসাব বড়োই চমৎকার!"


ব্লগ জীবনের শুরু থেকেই এ টি এম মোস্তফা কামাল শুধু আমার প্রিয় বন্ধুই নন, প্রিয় স্বজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর এবং এলএলবি ডিগ্রীধারী কামাল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরীরত থেকেও প্রবল সাহিত্যানুরাগী, প্রখর চিন্তাশীল, বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডার সম্পর্কে পঠন-পাঠনে ঋদ্ধ কাব্যের কারুকার্য সম্পর্কে যত্নশীল, নান্দনিকতার প্রজ্বলনে আলোকিত প্রাণ। কাজেই চিন্তা, চেতনা, ভাবের গভীরতা একটু গভীর হওয়াই স্বাভাবিক। কবিতার শৈল্পিক গুণ বিচারে সে নিজেই নিজের উদাহরণ। মানবিক মূল্যবোধ, সুফিবাদ ও মরমীয় সাধক তিনি।

তার রুবাই রচনায় কোথাও কবি চরম আশাবাদে উজ্জ্বল, আবার নৈরাশ্যবাদে বিবর্ণ। কখনো কবি অদৃষ্টবাদে উৎকণ্ঠিত আবার কখনো তিনি আজ্ঞেয়বাদে বিব্রত। মোস্তফা কামাল সুফিদের মরমিবাদ প্রচার করতে চেয়েছেন নাকি এপিকিউরিয়াম দর্শন অনুসারে দেহবাদের পক্ষে ওকালতি করেছেন তা তেমন বোঝা যায় না, তবে সুখ-দুঃখে নিরাসক্তি সবন্ধেই তার পক্ষপাতিত্ব তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
ছোট ছোট সহজ শব্দে, ছোট ছোট চার লাইনের বাক্যে প্রকাশ করেছেন এক একটা কাব্য কাহিনী- এ যেনো বিন্দু বিন্দু পানিতে গড়া মহাসিন্ধু! মোস্তফা কামালের একটি রুবাইয়াৎ ঠিক এ রকমঃ-
"চোখ ধাঁধানো হুরের রূপের হুজুর করেন বর্ণনা,
হৃদয় শোনে মন বাড়িয়ে, শোনার বাহন কর্ণ না।
তোমায় দেখে বুঝতে পারি হুরের রূপের মরতবা!
খোদার গড়া রুপই খাঁটি এরচে' খাঁটি স্বর্ণ না।"


আবার তিনি লিখেছেনঃ-
"সুরায় ভরা কুঁজোর গায়ে গোলাপ আভা ফুটলো কি?
দ্রাক্ষারসের ছদ্মবেশে ফুলের মধু জুটলো কি?
হঠাৎ মনে সন্দেহ হয়, গড়তে মাটির এই কুঁজো
কুমার বেটা আমার প্রিয়ার গোরের মাটি লুটলো কি?"


এটিএম মোস্তফা কামালের রুবাইয়াৎ পাঠ করে বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে ভিন্ন রকম মন্তব্য করা যেতে পারে কিন্তু অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সুরা ও সাকি রোমান্টিকতায় স্রষ্টার প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ছন্দ আর আধ্যাত্মিক কথা বার্তার মধ্য দিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে, প্রেম বিরহকে, সুরার সুধায় আনন্দে বিভোর হয়ে দিব্যজ্ঞান খুঁজে পেয়ে 'আমি এবং আমার আমিত্ব'কে অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ভাবে তুলে ধরেছেন। সব চাইতে বিস্ময়কর লাগে, যখন দেখি- তিনি রুবাইয়ের ফারসি ভাবধারার প্রতি সৎ নিষ্ঠ থেকে রচনা করেছেন অনবদ্য বাংলা রোমান্টিক রুবাই!

তার বাঙ্গালা রুবাইয়াৎ গ্রন্থে একশত পঞ্চাশটি রুবাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। প্রতিটি রুবাইয়ের অর্থ আলাদা ভাবের দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে, যা সুখপাঠ্য হিসেবে পাঠক আনন্দে উদ্বেলিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। কবি মোস্তফা কামালও ওমর খৈয়ামের রুবাইয়ের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বেশ কিছু রুবাই লিখেছেন, যার মধ্য থেকে একটি লেখা এ আলোচনায় পাঠকের উদ্দেশে তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে প্রতিভাত হচ্ছেঃ-
"খোদার ঘরে কাল ঢুকেছি ডাকতে খোদার নাম
পেছন থেকে সাকির সরাই ডাকছে অবিরাম।
অশেষ পাপের ভার কমাতে কাঁদতে লুটাই, হায়!
চমকে দেখি বিলাপ করে নিচ্ছি সুরার নাম!"


বাঙ্গালা রুবাইয়াৎ গ্রন্থের সাইজ রুবাইয়ের মতো ছোটো। বইয়ের প্রচ্ছদ বিমূর্ত সৌন্দর্য প্রকাশ করে। বইয়ে ভালো কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু বইয়ের বাঁধাই মানসম্মত নয়।

আমি বিশ্বাস করি- ভালো মানুষ না হলে, সুন্দর মনের মানুষ না হলে এমন সুন্দর সৃষ্টি সম্ভব না। একজন ভালো মানুষ, একজন সুন্দর মনের মানুষ এ টি এম মোস্তফা কামালের কাব্য দর্শন পাঠকের তৃষিত হৃদয়ে শীতল পরশ বইয়ে দেবে। নিঃসন্দেহে বলা যায় কাব্যবিচারে গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যকেই শুধু অলঙ্কৃত করবে না, আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করবে সেই প্রত্যাশা করছি।

(রুবাইয়া সম্পর্কে তথ্যউপাত্ত নিয়েছি গুগল থেকে)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:০৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তারেক ৩০০০ কোটী টাকার লোভেই দেশে ফিরেছে

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১০



তারেক এসেছে, বলেছে, I have a plan; তারেকের প্ল্যানটা কি? এই মহুর্তে তার প্ল্যান হতে পারে, নমিনেশন বাণিজ্য করে কমপক্ষে ৩০০০ কোটি টাকা আয়। ৩০০ সীটে গড়ে ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

বই : টক অব দ্য টাউন

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:০৮

বই : টক অব দ্য টাউন



একটি বই হঠাৎ করে এতটা আলোচনায় আসবে আমরা কি ভাবতে পেরেছি ?
বাংলাদেশের মানুষ অতি আবেগপ্রবন , বর্তমান রাজনৈতিক অস্হিরতার মধ্যে ও
বাঙালীর স্বভাবসুলভ অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাদ্রাসা শিক্ষা, বৈশ্বিক রাজনীতি, সহিংসতা ও জঙ্গিবাদ

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৫


লেখাটির শুরুতে একটি ভূমিকা দেওয়া যাক। সর্বশেষ দেশে গিয়ে কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। উত্তরবঙ্গে, নিতান্ত অনুন্নত আমাদের সেই গ্রামে এতগুলো কওমি মাদ্রাসা হয়েছে দেখে অবাক হয়েছিলাম। আগে গ্রামে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ কখনো এমন করে বলতে পেরেছে কি?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


ভারতে গরু ও গোমাংস নিয়ে হত্যা বা সহিংসতার নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন কারণ এটি রাজ্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং 'গরু রক্ষা' বাহিনী ইত্যাদীর কারণে একেক যায়গাতে একেক রকম। ভারত গোমাংস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×