টোকাইয়রে কাম না করলে খাইতাম কেমনেঃ
দেশ জুড়ে দেখা যায় ৫ থেকে ১২ বছর বয়সী কিশোর কিশোরী রাস্তার পাশে পাপ্লাস্টিকের বোতল, পলিথিন ইত্যাদি কুড়ায়। লোকে বলে টোকাই। যেন জন্মটাই হয়েছে মানুষের উচ্ছিষ্ট আর অবহেলা কুড়িয়ে জীবন ধারণের জন্য। অথচ এবয়সে তাদের স্কুলে যাওয়ার কথা। দিন মজুর বাবা। কেউ ঠেলা চালক, মুটে, রিকশাচালক। মা'য়েরা প্রায় সবাই লোকের বাসায় বুয়ার কাজ করেন। আবার অনেক শিশুর মা-বাবারই কোন হদিস নেই!
আমাদের বয়স্কদের একটা গ্রুপ আছে- যারা সকাল বিকাল ধানমন্ডি লেকে হাটাহাটি করি, ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করি...। আমি কৌতূহলী মানুষ। খুচরা আলাপচারিতায় অনেক কিছু জানতে পারি। আমি প্রায়দিনই এই পথশিশুদের সাথে ওদের কারোর অবিভাবকদের পেলে তাদের সাথে কথা বলি। ওদের জীবনের কথা শুনি- জানি।
পলিথিনের বড়ো বস্তা নিয়ে ওরা বেরিয়ে পরে ধানমন্ডি, কলাবাগান, গ্রীণরোড, নিউ মার্কেট সহ সব এলাকাতেই। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ছেড়া কাগজ, ভাঙ্গা বোতল, লোহার টুকরো পরিত্যক্ত টিনের কৌটা, পানি ও সয়াবিন তেলের কনটেইনার ইত্যাদি কুড়িয়ে বেড়ানোর কাজ। এসব কুড়াতে কুড়াতেই ওরা তাকিয়ে দেখে পরিষ্কার পোশাক পরা তাদের সমবয়সীদের কেউ বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। কেউ যাচ্ছে খেলতে। কেউ বা বাবা-মায়ের সঙ্গে বাজারে। বা চকচকে গাড়িতে করেও যায় কেউ কেউ। তারা সযত্নে গা বাঁচিয়ে চলে। টোকাইদের নোংরা শরীরের সঙ্গে তাদের যেন ছোঁয়া না লাগে। প্রথম প্রথম মন খারাপ হলেও পরে সব সরে যায়। সারাদিন আবর্জনা ঘেঁটে যা পাওয়া যায় তা ওরা বিক্রি করে আশেপাশের "ভাংগারির দোকানে"। মিজান, জমির, টিটু, সোহেল, মতিয়া, পিন্টু, আব্বাসরা সবাই আসে এসব দোকানে।
ধানমন্ডি ৮ নম্বর রোডের তাকওয়া মসজিদের কাছে সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং ডাস্টবিনের কাছে ভাষমান ভাংগারির দোকানে ওদের প্রায়ই দেখা মেলে। সকাল-বিকাল হাটাহাটির সময় আমি ওদের সাথে কথা বলি। মতিন জানায়, ওরা ৩/৪ বন্ধু প্রতিদিনই টোকাইয়ের কাজ করে। বিকেলের দিকে বিক্রি করতে নিয়ে আসে কাছের যে কোনো দোকানে।
সুমিয়া আর সিলিকে দেখা গেল- কলাবাগান ১ম লেনের এক ভাংগারির দোকানে। আরো ক'জন সঙ্গীসহ কলাবাগান, লেক সার্কাস এলাকাতেই কাজ করছে ওরা। সুমিয়া জানায়, গত কয়েক মাস ধরে এ কাজ করছে সে। এর আগে বস্তির কাছের একটি মসজিদে আরবি পড়তো। এখন টোকাইয়ের কাজ করছে। সুমিয়া আর লিলি দু'জনই বলে, ইশকুলে যামু- টেহা পামু কই! হেই কাম না করলে খাইতাম কেমনে? নাদিয়া জানায়, স্কুলে যাওয়া তার ভারি ইচ্ছে। কিন্তু যেতে পারে না। সারাদিন টোকাইয়ের কাজ করে যে ৫০-৬০ টাকা আয় করে ওরা, তা তাদের সংসার চালানোর জন্য বড় দরকারি। তবে অনেক পথশিশুরাই চুরি চামারীতে হাত পাকানো! ওরা সুযোগ পেলেই গাড়ির সাইড মিরর, ফুয়েল ট্যাংকির ঢাকনা কিম্বা ইন্ডিকেটর লাইট, এমনকি হেড লাইট মুহুর্তেই খুলে নিয়ে পগারপার হয়ে যায়!
ভাংগারী ক্রেতা বউ বাজার বস্তির শাহাবুদ্দিন জানান, তিনি ২৮শ টাকা মাসিক ভাড়ায় এক রুমের কাঁচা ঘরে থাকেন বউ, ছেলে-মেয়ে নিয়ে। বউ লোকের বাসায় কাজ করে। সে রাতে ২/১ জনের খাবার নিয়ে আসে। নিজের দৈনিক ১৫০ টাকার বেশি রোজগার হয় না। ছেলে মেয়েরা টোকাইয়ের কাজ করে আরো ৫০-৬০ টাকা দেয়। সব মিলিয়ে কষ্টে-সৃষ্টে চলে সংসার। ভালো কিছু ছেলেমেয়েদের মুখে তুলে দেয়ার সাধ থাকলেও সাধ্যে কুলোয় না। লেখাপড়া করাবেন কি ভাবে। মোমেনা নামে এক বয়স্ক মহিলা টোকাই জানান, দিনমজুর স্বামী আর নিজের ঠোংগা বিক্রির রোজগারে ২ ছেলে মেয়েকে কলাবাগান ২য় লেনের ফ্রী-প্রাইমারী স্কুলে পড়াচ্ছেন। এক ছেলে আগামী বছর হাইস্কুলে যাবে। বড়ো দুটোকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। নিজে লেখাপড়া করেছেন দয়াগঞ্জের এক প্রাইমারী স্কুলে। যে কোনোভাবেই ছোট ২ ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে মোমেনার।
কলাবাগান ১ম লেনের কয়েকজন ভাংগারী ব্যবসায়ী জানান, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের বোর্ড মিলেই পাঠানো হয় এসব। খুবই সামান্য বিক্রি হয় স্থানীয় কয়েকটি বোর্ড ফ্যাক্টরিতে। রমিজ উদ্দীন নামে এক ভাংগারির দোকানদার জানান, তারা মূলতঃ খুবই কম পুঁজি নিয়েই ব্যবসা করছেন। বাড়তি পুঁজির প্রয়োজন তারা অনেক সময় তাদের মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রীম নেন। ক'জন টোকাই জানান, তাদের কোন নগদ পুঁজি নেই। পুঁজি বলতে পলিথিনের বস্তা ও সারাদিনের ঝড় বৃষ্টি, গরম উপেক্ষা করা শারীরিক শ্রম। ৪০/৫০ টাকা থেকে কেউ কেউ একশত টাকা পর্যন্ত আয় করছে ওরা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে বৃদ্ধিপায় আয়।
এদের শ্রমে-ঘামে সংগৃহীত উপকরণই রিসাইকিলিং-এর মাধ্যমে ব্যবহৃত হচ্ছে পুনঃ আয়না, বোর্ড, প্লাস্টিক সামগ্রীসহ রকমারি পণ্য। বোর্ড ও কাগজের মণ্ড তৈরির জন্যে বিবিধ প্রক্রিয়ায় এ সবই একটি পর্যায়ে নিয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে কাঁচামাল হিসেবে। কার্যতঃ কিছুই আজ আর ফেলনা নয়। রুজি-রোজগার, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে শিশু থেকে বয়স্ক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন এ পেশা।
প্রায় সব বস্তিতেই রয়েছে মা-বাবাদের মধ্যে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া করানোর ইচ্ছে। কিন্তু বাধা হয়ে আছে সামর্থ্য। কাজেই ছেলে-মেয়েরা টোকাই হয়েই আছে।
এক অভিভাবক জানালেন অনেক বস্তিতেই রয়েছে এনজিও স্কুল। কিন্তু এই এলাকায় বস্তি নেই বলে এখানে কোন এন জি ও কাজ করেনা- নেই কোন ফ্রি প্রাইমারী স্কুল। এখানে কাছাকাছি এন জি ও স্কুলের নাম "সুরভী"। কিন্তু ওই স্কুলে সবাইকে গণহারে ভর্তি করা হয়না। এরকম আরো স্কুল থাকলে এবং "সুরভী"র মত সুযোগ থাকলে আরো কিছু ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখতে পারতো। প্রাইমারি স্কুল যেগুলো আছে তার বেশিরভাগই বস্তি এলাকা থেকে বেশ দূরে। তাই যাদের "ইচ্ছে এবং সামর্থ্য" মোটামুটি কাছাকাছি, তারাও ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারছে না। বেশির ভাগ ছেলে-মেয়ে ৭/৮ বছর বয়স হওয়ার সাথে সাথে নেমে পড়ে পলিথিনের বস্তা নিয়ে টোকাইর কাজে। ছেড়া কাগজ আবর্জনা কুড়াতে কুড়াতেই ওরা বড় হয়.........
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


