যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?
সব স্পন্দন কি শুধু মেটাফোরেই কথা বলে? মাঝে মাঝে মনে হয় না সমস্ত শিল্প-বিবৃতিইতো আসলে সূক্ষ্মতম অনুভূতির এক অক্ষম অনুবাদ?
ঐ যে নিভু নিভু সংবেদ! ওটাইতো ওর আসল শক্তি! লড়াই আর লড়াই! অনিবার্য এক চরম সত্যের বিরুদ্ধে। যদি বলি, হাতের তালুর পরম যত্নে নিশ্চিন্ত এক টুকরো কম্পমান অনিশ্চয়তা, তাহলে তার থেকে জীবনের অক্ষম অনুবাদ আর হয় না! অথবা ধরুন, পদ্মপাতায় জলফোঁটার ঐ টলটলে সংবেদ! অনিশ্চয়তার স্পর্শ ছুঁতে পেরেছে। কিন্তু আগ্রাসী অন্ধকারের বিরুদ্ধে ঐ তিরতিরে মোমশিখার অসম লড়াইটা? কে দেবে তার স্পর্শ?
নাহ!
সমস্ত কথনবিশ্বকেই বড্ড ঠুনকো আর একমাত্রিক লাগে যেন বিবৃতির সে প্রত্যক্ষতায়! তাই বহুমাত্রিক মেটাফোর চাই। একমাত্র তখনই অন্য শিল্প- মাধ্যমেও জীবনের স্পন্দন কবিতার মত বিশুদ্ধ সৃজন হয়ে উঠতে পারে।
ঐ এক টুকরো বাতির ভিশ্যুয়াল মেটাফোরটার কথা ভাবুন। তারকোভস্কির পেনাল্টিমেট ছবি Nostalghia(Nostalgia)। মূল প্রোটাগনিস্ট একজন রাশিয়ান লেখক- কবি! অভিনয় করবেন ইয়ানকোভস্কি। সত্যিকারের সৃজনশীল শিল্পীর কাছে সৃষ্টি তাঁর মাধ্যমের নিছকই নান্দনিক উচ্চারণ নয়! জীবনের প্রগাঢ় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস।
তারকোভস্কি ইয়ানকোভস্কিকে বললেন- শোনো, একটা দৃশ্যকল্পেই জীবনের সবচেয়ে সংবেদী পাঠকে ধরতে চাই। অথচ একটা শটও কাটব না! সম্পাদনার শল্যচিকিৎসা ছোঁবে না এ স্পন্দন! কেন? কারণ নিঃশ্বাস কে টুকরো করে ধরা যায় না। জীবনকে টুকরো করে জুড়লে প্রযুক্তির নন্দন হবে হয়তো। শিল্প হবে না। শিল্প হলেও তা জীবনকে ছুঁতে পারবে না। জীবনের ঐ তিরতিরে আর্তিটা এক শটেই চাই আমার। আমার জীবনের সেরা শট হোক সেটা!
বাকিটা অভিনেতার লড়াই। জীবনেরও। কোনও সজ্জিত পরিক্রমণ নয় ; সে এক সযত্ন আবর্তন।
Cinema Narrative এর প্রাসঙ্গিক অংশটা কী ছিল?
পরিত্যক্ত খাদানে বন্ধুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধায় দেশ থেকে দূরে, বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসিত এক কবির দীপযাত্রা! ক্লান্ত ও ধ্বস্ত পদক্ষেপ! মুখে উৎকন্ঠা আর মমত্বের আর্তি! হাতে জীবনের প্রতিভূ হয়ে একটুকরো ভরন্ত আকাঙ্ক্ষা। তিরতিরে! দেদীপ্যমান! কখনো তালুর পরম মমতার আড়ালে, কখনো বা পোশাকের! যাবতীয় অনিশ্চয়তার লড়াই তখন অন্ধকারের বিরুদ্ধে। আগ্রাসী হাওয়া-বাতাসের বিরুদ্ধেও! দীপযাত্রার অনিবার্য বৃত্তায়নের শেষে ভেঙে পড়বেন কবিও।
কিন্তু পরিচালক কোথায় তখন?
ঐ ভিস্যুয়াল মেটাফোর ততক্ষণে নির্বাক গ্রাস করে ফেলেছে তাঁর সমস্ত চেতনা! তিনি তখন ক্যামেরার পিছনে নান্দনিক অন্তর্ছন্দে নেই। দৃশ্যকল্পের কৌণিক অভিঘাত, মোটিফের অনুপুঙ্খ -- সেসব থেকে অনেক দূরে! শিল্পবোধের জারণে তাঁর চেতনার নির্মাণ- পুনর্নিমাণ-- সবকিছুই কখন যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে! বরং অভিনেতার শরীর, শৈলি, মনে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর হৃদস্পন্দনের রঙরেখ আর নিঃশ্বাসের সরগম! উঁহু, তার থেকেও হয়তো আরো গভীরের কিছু! প্রোটাগনিস্ট-কবির সত্তায় ঢুকে পড়েছেন ভূতগ্রস্তের মতো পরিচালক নিজেই! জীবনের প্রগাঢ় উপলব্ধি কখন যেন হারিয়ে দিয়েছে শিল্পের নন্দনকে!
আসলে অতগুলো ইন্দ্রিয়সংবেদ ছুঁয়ে মেটাফরিক নন্দনও নিছকই গৌণ তখন। বৃহত্তর সত্যটা হলো তারকোভ্স্কি ছুঁয়ে ফেলতে পেরেছিলেন জীবনকে।
ততক্ষণে এক হয়ে গেছেন কবিবন্ধু, প্রোটাগনিস্ট কবি, আর স্রষ্টা পরিচালক; এক অতীন্দ্রিয় সমাপতনে! অনিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তা! ঘাত- প্রতিঘাতে, স্বপ্ন- হতাশায়, লগ্ন-চ্যুতিতে, সে অনিশ্চয়তার অনিবার্য স্পর্শকাতর অভিযাত্রাই জীবন!
বিবৃতির প্রগলভতায় আর প্রতিভাসের অনুপুঙ্খে জীবন হয়তো বা আলাদা আলাদা! কিন্তু, শিল্পদৃষ্টির সে আপেক্ষিকতা ও নান্দনিক সমীকরণের মূল সূত্রকে তুচ্ছ করে অনিশ্চয়তার অমোঘ নির্যাসে জীবন আসলে একই। লালনের মমতাতেও।
হে জীবন, তোমার লড়াইটা তোমারই।
অন্ধকারের বিরুদ্ধে তোমার লড়াই অনির্বাণ শিখায় জ্বলতে থাকুক।
কে নিতে পারে সে যন্ত্রণার ভাগ?
তবুতো এক দীপ থেকে প্রজ্জ্বলিত হয় আরো দীপ।
আলোর ভাগ কমে না তাতে এতটুকু!
আর তাই আজ নিঃস্বার্থে নিজেদের বিপন্ন করেও অন্যের প্রাণের লড়াইয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন শয়ে শয়ে ঈশ্বর!
ধুলোমাটির পৃথিবীতে এই মনুষ্যত্বটুকুই একমাত্র ঐশী নিশ্চয়তা, তোমার অনিশ্চয়তা ছুঁয়ে থেকেও।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




