একদিনের রাজা রানী.........
ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে যেগুলি সম্পর্কে কথা বলা প্রথাগত নয়, বা সেগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে চুপ করে দেওয়া হয় এবং কেবলমাত্র তুচ্ছ এবং যৌক্তিকভাবে সম্পর্কহীন ঘটনাগুলি পৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়। ইতিহাসের এই মুহুর্তগুলির মধ্যে একটি হল জোসেফ গোয়েবলস এবং ম্যাগডা গোয়েবলস ঘটনা।
রানীঃ

ইনি ছিলেন তাঁর বাবা মা এর বিবাহবহির্ভূত সন্তান। মা অগ্যাস্টি, বাবা অস্কারের বাড়িতে কাজ করতেন...অনৈতিক সন্তান আসায় তারা দ্রুত বিয়ে করলেন। বাবা তার কন্যার প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবন ছিলেন। তিন বছর পর মা বাবাকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করলেন ফ্রিডল্যান্ডারকে। এই দ্বিতীয় বাবাও কন্যাটির প্রতি স্নেহপ্রবন ছিলেন। এটিও মায়ের ঈর্ষার কারন হল। বিবাহবহির্ভূত সন্তান বলেই মায়ের কাছে কন্যা সর্বদাই বিরক্তির কারন ছিল। এইসব বুঝে, দ্বিতীয় বাবা তার পদবী দিয়ে কন্যাকে ভর্তি করেদিলেন ব্রাসেলস এর এক বোর্ডিং স্কুলে। নাম হল ম্যাগডা ফ্রিডল্যান্ডার।
স্কুলের কড়া নিয়ম, অস্থির শৈশব বাল্যকাল ম্যাগডার জীবন দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। উঁচু সমাজ, ক্ষমতাবান পুরুষের প্রতি হয়ত এর থেকেই এক নেগেটিভ আকর্ষন জন্মায়। ১৯২১ সালে ম্যাগডা ধনী গুন্থার কোয়ান্ডকে বিয়ে করলেন। তার আগে ম্যাগডাকে তার জিউইশ পদবী ফ্রিডল্যান্ডার ত্যাগ করতে হল, কারন গুন্থার জিউশদের ঘৃণা করতেন। বিয়ের একবছরের মাথায় প্রথম সন্তান। গুন্থার বহুগামিতায় অভ্যস্ত ছিলেন এবং ম্যাগডাকেও সন্দেহ করতেন। ম্যাগডা ও সন্তানকে উপেক্ষা করে নিজে ভোগের জীবন কাটাতেন। অবশেষে ১৯২৯ তাদের ডিভোর্স।
সমাজের অভিজাত মহলে ম্যাগডার যোগাযোগ থাকার সুবাদে, একদিন এক নাজি মিটিংএ এক রোগা,খুঁড়িয়ে চলা মানুষের বক্তৃতা শুনলেন। অসম্ভব ভাল কথা বলেন মানুষটি। এক নতুন জার্মানীর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ম্যাগডা হাঁ করে শুনতেন- ঐ খোঁড়া মানুষটির বক্তব্য নয়, তার চুম্বকের মত আকর্ষনীয় ব্যাক্তিত্বে ম্যাগডা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অতঃপর প্রেম এবং পরিণয় ১৯৩০ সনে। ‘খোঁড়া শয়তানে’র সঙ্গে।
রাজাঃ

ছোট থেকেই রাজা রুগ্ন। বাঁ পায়ে ক্লাব ফুট (পোলিও) থাকার জন্য খুঁড়িয়ে হাঁটে। স্কুলের সহপাঠীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ তাকে ‘খোঁড়া শয়তান’ বলে অভিহিত করা, এই সব কিছু তাঁর মধ্যে এক প্রতিশোধের বাসনা তৈরী করে।ববড় হয়ে এর উত্তর দিতে হবে। গায়ের জোরে পারবে না, জবাব দিতে হবে মেধা দিয়ে। কথায়, বক্তব্যে ভাষনে মানুষকে প্রভাবিত করতে হবে। পড়াশোনায় কখনওই খারাপ ছিলেন না। জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন। ডক্টরেট করতে করতেই ততদিনে বিখ্যাত বক্তা হয়ে গেছেন। তুখোড় জাতীয়তাবাদী বক্তা।
হিটলারের নজরে পরলেন। ১৯২৬ সালে তাঁকে বার্লিনের (NSDAP; National Socialist German Workers’ Party) লিডার করলেন। তার সঙ্গে সকল প্রচার যন্ত্রের প্রধান।
এটাই চাইছিলেন রাজা। তাঁর নিজের ক্ষেত্র। সত্য মিথ্যা অর্ধসত্য নাজিজম সম্পর্কে তৈরীমিথ এই সব ক্রমাগত প্রচার সফল প্রচার করতে করতে এক বিরাট সংখ্যক জার্মানীর মানুষকে হিটলার ও তাঁর বিশ্বাসের অনুরাগী করে ফেললেন। ১৯৩৩ সালে তিনি হলেন হিটলারের কাছের মানুষ, তথ্য প্রচার মন্ত্রী গোয়েবেলস্...জোসেফ গোয়েবেলস্।
রাজা-রানী.....
বিয়ের পর ক্রমাগত ছয়টি সন্তানের জন্ম দিলেন ম্যাগডা। তাঁদের ছয়টি সন্তান হয়েছিল। তবে ম্যাগডার এই বিবাহিত জীবন আরও অসহ্য হয়ে উঠেছিল। কারন..
গোয়েবেলস এর অত্যধিক নারী লিপ্সা। ক্রমাগত একের পর এক নারীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তেন গোয়েবেলস। যেদিন নিজেদের বিছানায় গোয়েবেলসকে অন্য নারীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত দেখলেন, ম্যাগডা সোজা হিটলারের কাছে গিয়ে সব বললেন। হিটলার সব শুনে বললেন ‘থার্ড রাইখের অসম্মান হবে এসব বাইরে প্রকাশ পেলে। তোমরা অন্তত সমাজে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে থাক’
ম্যাগডা মাথা নিচু করে বললেন, "Er ist der größte Schurke, der jemals das deutsche Volk in den Bann gezogen hat.“ (‘He is biggest scoundrel who has ever held the German people in thrall.)’ হিটলারের কিছু বলার ছিল না!
গোয়েবেলস জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার মিথ্যাচার চালিয়েছেন। নিজেও বিশ্বাস করতেন নিজেরই মিথ্যা কথা। নইলে আফ্রিকায় মার্শাল রোমেলের হার এবং স্টালিনগ্রাড হাতছাড়া হলেও বলতে পারেন ‘এটা জার্মানীর হার নয়। ট্যাক্ট ফুল রিট্রিট। জার্মানীর হাতে গোপন অস্ত্র আছে। পৃথিবী জানে না এর বিধ্বংসী ক্ষমতা!’
কিছুই হল না।

১৯৪৫ এর এপ্রিলে জার্মানীর পতন আসন্ন বুঝে গোয়েবেলস ও ম্যাগডা তাঁদের ছয় সন্তান নিয়ে হিটলারের বাঙ্কারে আশ্রয় নিলেন। ৩০শে এপ্রিল গোয়েবেলসকে ‘জার্মানীর চ্যান্সেলার’ ঘোষনা করলেন হিটলার। তারপর ইভা ব্রাউনকে নিয়ে সুইসাইড করলেন।
পরেরদিন ১লা মে, ১৯৪৫ ম্যাগডা তাঁর ছয়সন্তানকে সাদা ড্রেস পরালেন। ডাক্তারকে বলে সবাইকে মরফিন ইঞ্জেকশন দিলেন। এরপর সবার মুখে সায়ানাইড ঢেলে দিলেন....
বাইরে বেরিয়ে এলেন গোয়েবেলস-ম্যাগডা। ম্যাগডা সায়ানাইড ক্যাপসুল মুখে দিয়ে ঢলে পড়লেন। গোয়েবেলস নিজেকে গুলি করার আগে গার্ডকে বললেন 'আমি নিজেকে সুট করার পর তুমিও আমায় সুট করবে"!
একদিনের রাজা-রানীর ইতিহাস এখানেই শেষ!
(1) "I was Hitler's Maid"- by Paulin Kohler
(ভাষান্তর নয়, ভাবানুবাদ আমার)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১১:২৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




