'ক্রাউসড এন্ড পাওয়ার'- এলিয়াস কানেত্তি
"অপরিচিত কোনো কিছুকে স্পর্শ করার চাইতে বেশী ভয় মানুষের কাছে আর কিছুই নেই। সে দেখতে চায় তার কাছে কি এসে পড়ল এবং সেটাকে সে চিনে উঠতে চায়, অন্তত মনের মধ্যে বিচার করতে চায়। যা কিছু অদ্ভুত ঠেকছে, মানুষ সবসময় তাকে স্পর্শের দিক থেকে এড়িয়ে চলতে চায়। অন্ধকার পরিস্থিতিতে অচেনা কোনো স্পর্শ আতঙ্কের সৃষ্টি করে উঠতে পারে। এমনকি আমাদের পোশাক পর্যন্ত তখন আমাদের যথেষ্ঠ নিরাপত্তা দিতে পারে না। এক্ষেত্রে নিজেকে একজন শিকার মনে হয় আর মনে হয় তার পোশাক ভেদ করে প্রতিরোধহীন শরীরের মাংসল স্পর্শ পাওয়াও অন্যের পক্ষে কতো সহজ।
মানুষ তার নিজেদের চারপাশে যে দূরত্ব সবসময় তৈরী করে রেখেছে তা এই ভীতির ফলে হয়েছে। সে এমন একটা ঘর তৈরী করতে চেয়েছে, যেখানে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না, যেখানে সে নিরাপদ। এটা শুধু কোনো দস্যুর দ্বারা লুণ্ঠিত হবার ব্যাপার নয়, এটা একটা অজানা জগৎ থেকে সহসা উৎপীড়নের ভয়।
স্পর্শ করার ব্যাপারে এই ভয় আমাদের মধ্যে রয়ে যায় বিশেষ করে আমরা যখন লোকজনদের সাথে চলাফেরা করে থাকি। আমরা যেভাবেই যাই; ব্যস্ত রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, বাসে বা ট্রেনে, এই ভয় আমাদের চালনা করে। এমনকি কারোর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও আমরা তাকে নিবিড় ভাবে লক্ষ্য ও পর্যবেক্ষণ করি এবং সম্ভব হলে তাকে স্পর্শ করা এড়িয়ে চলি। যদি এটা না ঘটে, তার অর্থ আমরা তাকে পছন্দ করি, তার প্রতি আকর্ষিত হই এবং আমরাই উপযাচক হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসি।
একমাত্র ভীড়ই হলো সেই জায়গা যেখানে মানুষ অন্যের দ্বারা স্পর্শ হবার ভয় থেকে মুক্তি পায়। এটা হলো একমাত্র সেই পরিস্থিতি যেখানে এর উল্টোটা ঘটে। সে চায় এক ঘন মানুষের ভীড়, যেখানে এক শরীর অন্যকে চাপ দেয়, সেই ভীড় এতই ঘন যে এই বলপ্রয়োগকে নির্দিষ্ট ভাবে চিনে নেওয়া সম্ভব নয়। যেই মূহুর্তে একজন সেই ভীড়ের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে, তখনই সে এই স্পর্শভীতি কাটিয়ে ওঠে। ওই আদর্শ পরিস্থিতিতে কোনো ভেদাভেদ কাজ করে না, সবাই সমান; নারী বা পুরুষ। তার বিরুদ্ধে যে, সে নিজেও তা। সে অন্যেকে এবং নিজেকে একইভাবে অনুভব করে। হঠাৎই মনে হয় সবকিছুই ঘটছে একটাই কোনো শরীরের ভেতর। ভীড় জনতার নিজেকে নিজে ঘন করে তোলার সম্ভবত এটিই কারণ, সে অন্য প্রত্যেক মানুষকে যথাসম্ভব স্পর্শ করে ধরে থেকে তার সেই স্পর্শভীতি কাটাতে চায়। তারা যতই একে ওপরের সাথে শারীরিক ভাবে সংশ্লিষ্ঠ হয়, ততই তারা একে অপরের দ্বারা স্পর্শীত হবার ভীতি কাটিয়ে ওঠে। ভীড়ের প্রকৃতির ভেতর এই স্পর্শভীতি উল্টোভাবে কাজ করে। যেখানে ভীড়ের ঘনত্ব সব চেয়ে বেশি সেখানে সর্বাধিক স্বস্তি অনুভূত হয়।"
জার্মানভাষী লেখক এলিয়াস কানেতির জন্ম বুলগেরিয়ায়। পরবর্তী সময় ব্রিটিশ নাগরিকত্বও পেয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় তিনি পার করেছেন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, ভিন্ন আবহে। কানেতি লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধ। তাঁর লেখার ‘সুপরিসর দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তা ও শৈল্পিক শক্তির প্রাচুর্যের’ কারণে তাঁকে ১৯৮১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
কসমোপলিটান লেখক এলিয়াস কানেতির ভৌগোলিক পরিচয় যেমন হোক না কেন, তাঁর মানসিক মাতৃভূমি ছিল জার্মান ভাষা। ধ্রুপদি জার্মান সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাঁর খাঁটি কথাসাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ‘ডাই ব্লেন্ডাং’ উপন্যাসের কথা। তাঁর এ উপন্যাসটি যখন লেখেন তখন তাঁর বয়স বিশের কোঠার মধ্যে। হিটলার-পূর্ব ভিয়েনার চিত্র তুলে আনা হয়েছে এখানে। ইতিহাসের কঠিন বিষয় নিয়ে লেখা এ বইটি কৌতুককর।
কানেতি মনে করতেন, লেখা খুব আগে আগে প্রকাশ করা হলে সত্যের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা খর্ব হয়ে যাবে। প্রবন্ধের বই ‘ক্রাউডস অ্যান্ড পাওয়ার’ লেখা একেবারে শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর একটি শব্দও প্রকাশ করবেন না বলে মনস্থির করেন। এ রকম সিদ্ধান্তের কারণে পাঠকদের কাছে তাঁর পরিচিতি সহজে ছড়ায়নি। তিনি চাইতেন তাঁর লেখা কালজয়ী হোক। বর্তমানকে দ্রুত জয় করতে না পারলেও পরবর্তীকালের কাছে তাঁর স্থায়িত্ব প্রত্যাশা ছিল বেশি। বয়স সত্তর পার হওয়ার পরে ধীরে ধীরে জার্মানভাষী ও ইংরেজভাষীদের কাছে তাঁর পরিচিতি ছড়াতে থাকে।
ইংল্যান্ডে থাকাকালে সাহিত্যিক মহলের যাঁদের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল তাঁদের কেউ ‘ডাই ব্লেন্ডাং’ প্রকাশ করার পরপরই পড়েননি। কানেতি ইংল্যান্ডকে মনে করতেন শেকসপিয়ার এবং ডিকেন্সের দেশ।
ইংরেজদের জীবন সম্পর্কে কানেতির অন্ধ ভক্তি ছিল। ইংরেজ নারীদের ভূমিকা নিয়ে নিজস্ব ধ্যান-ধারণাও ছিল: তিনি মনে করতেন সুদর্শনা ইংরেজ নারীরা ইংরেজ পুরুষদের পৌরুষ জাহির করার একটা মাধ্যম। একবার তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলকে একটা বক্তব্যের অনুষ্ঠান শেষে বের হয়ে যেতে দেখেন। হাস্যোজ্জ্বল বৃদ্ধ রাসেলের সঙ্গে ছিলেন বছর বিশেক বয়সের এক সুন্দরী নারী। কানেতির দৃষ্টিতে প্রশংসার দৃশ্য ছিল এটি।
কানেতি এলিয়টের কবিতা ও ব্যক্তিজীবন সম্পর্কিত অনেক কিছুই পছন্দ করতেন না। ইংল্যান্ডের ঐতিহ্য সম্পর্কে কানেতির সমীহ থাকলেও এলিয়টের দৃষ্টিতে ইংল্যান্ডের অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে মনে হতো। কানেতির মতে, ‘এলিয়ট হলেন হেগেলের অন্ধ অনুসারী। দান্তেকে তিনি হীন স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি আবেগহীন কঠিন হৃদয়ের মানুষ। নিজের সময়ের আগেই বার্ধক্যে জীর্ণ হয়ে গেছেন।’
লেখক কানেতির নিজের জীবন সম্পর্কে নিজস্ব বিশ্বাস ছিল। সে বিশ্বাসের কথা তিনি প্রকাশও করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কোনো কিছু সম্পর্কেই উদাসীন থাকব না, তবে ধৈর্য ধারণ করব ঠিকই। অন্য সবাই আমাকে কষ্ট দিলেও আমি কারো কষ্টের কারণ হবো না। নিজেকে সর্বগুণে অধিকতর গুণান্বিত করব। মনের দিক থেকে বিষণ্ন হলেও জীবনযাপন করাটা উপভোগ করব। আরো বেশি প্রশান্ত থাকব এবং অন্যের মাঝে সুখি হবো। সবখানে, সবার মাঝে বেড়ে উঠব, তবে অন্যের অধীন থাকব না মোটেও। সবচেয়ে কম আরাম নেবো, তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা বিলাবো। নিজেকে আর ঘৃণার চোখে দেখব না।’
নবীন লেখকদের প্রতি কানেতির পরামর্শ হলো, ‘নিজের জীবন সম্পর্কে লেখার সময় তোমার প্রতি পৃষ্ঠায় এমন কিছু থাকা চাই, যা এর আগে কেউ কোথাও শোনেনি, দেখেনি।’
সারমর্মঃ মানুষ সব সময় নিশ্চিত জীবন আশা করে কিন্তু এই পৃথিবীতে সবই অনিশ্চিত নিশ্চিত বলে কিছু হয় না। তাই মানুষ ভয় পায় এই বুঝি তার নিশ্চিত জীবনের উপর কেউ আঘাত করলো।
--- এলিয়াস কানেত্তি, ক্রাউডস অ্যান্ড পাওয়ার।