somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

জুল ভার্ন
এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

পৈত্রিক ভিটায় এক সপ্তাহ......

১৭ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৈত্রিক ভিটায় এক সপ্তাহ......

কিছুদিন আগে বরিশাল আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে উত্তরাধিকার সূত্রে আমার কিছু সম্পত্তি আছে- যদিও তা বহুলাংশেই বেদখল হয়ে গিয়েছে। দখলদার সবাই নিজ আত্মীয় জ্ঞাতি স্বজন এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন লুটেরা বাহিনী। যারা রক্ষক, তারাই ভক্ষক- আমিই অবাঞ্চিত! এ যেনো- নিজ গৃহে বনবাস!

তবুও দু একজন শুভাকাংখি আছেন বলেই- পৈত্রিক ভিটায় কালেভাদ্রে আসতে পারি। গ্রামে গেলে দখলদার থেকে সম্পদের হিস্যা না পেলেও কয়েকজন দখলদার সম্মান করে, ভালোবেসে খাতিরযত্ন করতে কার্পণ্য করেনা- এটাও কম প্রাপ্তি নয়! এবার বাড়িতে গিয়েছিলাম পরিবারের সবাইকে নিয়ে। যাওয়ার পরপরই কেয়ার টেকার জেলেদের দিয়ে পুকুর থেকে কৈ, শিং, মাগুর মাছ ধরেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের কেউ গরুর দুধ নিয়ে এসেছেন, কেউ পিঠাপুলির আয়োজন করেছেন। চাচাতো ভাই(অন্যতম দখলদার) রান্নায় বিখ্যাত কালো তুলসী ভোগ চাল রান্না করেছে। চারিদিক ম ম করছে সুগন্ধে- যা আমি বেশ দূর থেকেই টের পাচ্ছি।

ছোটবেলায় ছুটিতে গ্রামে যাওয়ার, ফেলে আসা সেই সুগন্ধ দিনের স্মৃতিতে মনে পড়ছে- কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের লেখা ’ধান ও মাঠের কবিতা’-
ধানের বুকের দুধে হাত দাও।
মনে হবে, নারী।
আমি সেই নারীকে জপাতে
সারারাত উবু হয়ে বসে থাকি হেমন্তের মাঠে---
যার নাম বাসমতী,
যার নাম পদ্মা, কামিনী।
মাঝখানে সরু আল। দু-ধারে লুঠেরা, ঠগি, খুনি।
হেটো-চাষা হয়ে বসি সেইখানে,
এমন আনাড়ি,
ধানের বুকের দুধে হাত দিই।
কেঁপে ওঠে নারী।

আমাদের এই এলাকা শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যেই অপূর্ব নয়, অসাধারণ তার সম্ভারেও। চলুন আগে দেখি এই এলাকার প্রসিদ্ধ চাল।

আউশধান/চাল চিনেন? দানা মোটা, লালচে মিঠে চালের নাম আউশ চাল। একেবারে মাঠে-ঘাটে নিম্নবিত্তদের খাওয়ার চাল। সেই চাল থেকে রান্না করা হয় "বিচকি" নামের একপ্রকার খাদ্য। আপনারা কেউ "বিচকি" খেয়েছেন? বিচকি বৃহত্তর বরিশাল জেলায় ব্যাপক প্রচলিত একধরনের সুস্বাদু খাদ্য।

"বিচকি" রান্নার পদ্ধতি হচ্ছে- চাল ভেজে কয়েক ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেই ভেজা চাল ফুলেফেঁপে বড়ো হয়। তারপর রান্না করা হয়- সদ্য তৈরী গুড়, নারিকেল কোড়া, কারি পাতা, দারুচিনি, এলাচ, ঘি এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে। এই বিচকি গ্রাম বাংলার মানুষের অত্যন্ত বিলাসী এবং পছন্দের খাবার, যা দিয়ে অতিথি আত্মীয় স্বজনদের আপ্যায়িত করা হয়।

এবার বলবো- কালো ’তুলসি ভোগ’ চালের কথা। নির্দ্ধিধায় চাল সাম্রাজ্যের ’যুবরাজ’ বলা যায় তুলসী ভোগ চালকে। ছোট দানার চাল অথচ এই রকম মনমাতানো সুবাস আর স্বাদ দ্বিতীয়টি পাবেন না। এই চালের আদি নিবাস কুচবিহার। তবে কুচবিহার অঞ্চলের লোকেরা তুলসী ভোগ চালকে বলে- নুনিয়া চাল।

বাংলাদেশে এই চাল(ধান) চাষ শুরু হয়েছিলো শেরপুর/জামালপুর জেলায়। তারপর দিনাজপুরে। এখন দেশের প্রায় সর্বত্রই এই ধানের চাষ হলেও কৃষকেরা এই ধান চাষে উতসাহি নয়। কারণ, এর ফলন অত্যন্ত কম। তাই চাষ করে মূলধন লস হয়। তারপরও কেউ কেউ নিজের জমিতে শখ করে অল্প পরিমানে এই ধানের চাষ করেন। আরও একটা বেশ সম্মানীয় চাল আছে- যার নাম চিনি শক্করখানা । শক্করখানা খুব ছোটছোট দানার চাল। স্বাদে-গন্ধে ফিরনীর জন্য অদ্বিতীয়। চিনি শক্করখানা দিয়ে ফিরনী রান্না করে আপনাকে জানাতে হবে না, মৌ মৌ সুবাসে চিনি শক্করখানাই জানান দেবে তার পরিচয়। একেবারে আতরের খুশবু। স্যর উইলিয়াম হান্টারের লেখা 'The Annals Of Rural Bengal' লেখাতে এই চালের কথা উল্লেখ আছে। তুলসী ভোগ এবং চিনি শক্করখানা ধান চাষে কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে গুণগত মান বজায় থাকেনা। এই ধান শতভাগ জৈব সার ব্যবহার করতে হয়। সংগত কারণেই উল্লেখিত দুই জাতের ধানের মতো বাসমতী, কালিজিরা, চিনিগুড়া, বিরুই, বিন্নি ছাড়াও অনেক উন্নত জাতের চালই এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গিয়েছে। আমি আমাদের কয়েকজন বর্গা চাষীকে তুলসী ভোগ, শক্কর খানা, চিনিগুড়া, বাসমতি ধানের বীজ দিয়েছিলাম- যা ফলন হবে তার অর্ধেক আমাকে দেওয়ার শর্তে। আমি অর্ধেক দুরের কথা- বছর শেষে এক পঞ্চমাংশও পাইনা। কেউ যদি বরিশাল থেকে আমার জন্য ৫/১০ কেজি চাল, ২/৪টা নারিকেল নিয়ে আসেন- তারা আমার বাসায় ৪/৫ দিন বেড়াবে, আমার কাছ থেকেই টাকা নিয়ে চিড়িয়াখানা, এয়ারপোর্ট, হাতিরঝিল সহ ঢাকা শহর ঘুরে দেখবে এবং বরিশাল ফিরে যাবার ৩/৪ গুণ বেশী ভাড়া ছাড়াও নানাবিধ উপহার সামগ্রী চেয়ে নেয়! সেই টাকা দিয়ে আমাদের পরিবারের বাতসরিক প্রয়োজনীয় চাল কেনা যায়!


এবার একটু মাছের কথা বলা যাক। বিষখালী নদীর ইলিশ মাছ স্বাদে গন্ধে দেশ খ্যাত। আর সোনালী বোয়াল, আইড়/আড়, পাংগাশ নাকি 'দেবতাভোগ্য' উল্লেখ আছে মহাভারতে। কালোবোয়াল, সোনালী বোয়াল আর আইড় মাছের তীর্থস্থল হল বিষখালী। যে জীবনে বিষখালীর ইলিশ, বোয়াল কিংবা আইড় মাছ খায়নি তার মানবজীবন বৃথা। বিষখালী নদীতে আরও পাওয়া যায় পোয়া, তাপসী আর পেল্লায় সাইজের বাছা/শিলং ট্যাংরা মাছ। বিষখালী নদীর সাথে সংযোগ আছে সুন্দরবন অঞ্চলের বলেশ্বর, কচা, সন্ধ্যা, সুগন্ধ্যা নদীর। আবার দক্ষিনের বংগপোসাগরের মোহনা থেকে কালাবদর, আন্ধার মানিক খালের সুস্বাদু পানির। একই সাথে এতদ অঞ্চলের খাল-বিল-পুকুরেও দেশজ প্রাকৃতিক মাছের সম্ভার। এই এলাকায় এখনো হাইব্রিড মাছের চাষ তেমন একটা নাই বললেই চলে। এখনো এই অঞ্চলে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেনি বলেই খাল বিল নদীর পানি দুষিত হয়নি বলেই প্রাকৃতিক মাছের প্রজজন ভালো এবং স্বাদে অতুলনীয়। এবার গ্রামে যাওয়ার পর একজন জেলে পেল্লায় সাইজের দুটি আইড় মাছ নিয়ে এসেছে এবং অনেকটা জোরজবরি করে ঢাকার বাজার মূল্য থেকে ডাবল দামে গছিয়ে দিয়েছে! গ্রামের লোকদের ধারণা, ঢাকার লোকদের কাছে বেশুমার টাকা..... যাই হোক, চক্ষু লজ্জায় মাছ দুটো কিনে আমার জমি দখলদারদের নিয়ে খেয়েছি।


গ্রামের আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের সাথে কথা বলতে খাওয়া দাওয়া শেষে কল্পনার রাত বেশ বেড়ে উঠেছে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা ভেংগে আমাদের বাপ-বেটাদের নিয়েই গ্রামের মানুষজনে সামনের বারান্দাটি কোলাহল মুখরিত। যতদূর চোখ যায় জোছনা প্লাবিত রাতে ধানক্ষেতের নিস্তব্ধ হাতছানি। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। ভাংগা ভাংগা মেঘ। মনে হয় যেন ভেসে যাই এই অপার্থিব উদ্ভাসিত জ্যোৎস্নায়। শিশিরের অশ্রু ঝরে পড়ছে টিনের চালে। নিশুতি রাত, চন্দ্রাহত নদী, ঘন সবুজ বন। বহুদূরে কে যেন দরাজ গলায় গাইছে-

সুধাই তোরে রাখাল বন্ধু বইসা নদীর ধারে...দিবানিশি বাঁজাও বাশী খুইজা বেড়াও তারে....

আমি খুঁজতে থাকি, এই অশ্রুনদীর সুদূর পারের ঘাট.....আমার দাদা, বাবা-চাচাদের শৈশব......
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৯
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=হিংসা যে পুষো মনে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৮


হাদী হাদী করে সবাই- ভালোবাসে হাদীরে,
হিংসায় পুড়ো - কোন গাধা গাধিরে,
জ্বলে পুড়ে ছাই হও, বল হাদী কেডা রে,
হাদী ছিল যোদ্ধা, সাহসী বেডা রে।

কত কও বদনাম, হাদী নাকি জঙ্গি,
ভেংচিয়ে রাগ মুখে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমাধ্যম আক্রমণ: হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন নূরুল কবীর ও নাহিদ ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:০৫


জুলাই গণঅভ্যুত্থানের রক্তস্নাত পথ পেরিয়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, সাম্প্রতিক মব ভায়োলেন্স এবং গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ সেই স্বপ্নকে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নিউ এজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×