মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়...........
সময়ের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাপন। নানা জটিলতার বেড়াজালে বন্দী আমাদের স্বাভাবিক জীবন আর আগের মতো সহজ সরল স্বাভাবিক থাকছে না। প্রাত্যহিক জীবনে নিত্য তাড়া করে ফিরছে বিচিত্র সঙ্কট। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির। ঘটছে অপ্রত্যাশিত ঘটনা, খবরগুলো এখন নিত্যকার চালচিত্র। এ ধরনের খবরগুলো যে কোন বিবেকবান মানুষকে খুব সহজেই আলোড়িত করে, বিচলিতও করে। আমাদের সমাজে এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে এখনকার চিত্র ভিন্ন। আগে কালেভদ্রে এ জতীয় ঘটনা ঘটলেও এখন এগুলো নিত্যকার চালচিত্র।
আমাদের চারপাশে প্রতিদিন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখে মনে প্রশ্ন জাগছে, আমরা কোন পথে এগোচ্ছি! আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কি লোপ পাচ্ছে, আমরা কি দিনে দিনে সভ্য সুশিক্ষিত আধুনিক মুক্ত চিন্তা-চেতনার দাবিদার হওয়ার বদলে অসভ্য, বর্বর মানবিক মূল্যবোধহীন হয়ে পড়ছি? শহরে নাগরিক জীবনযাপনে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতিক্রিয়ায় হয়ত পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন ও সম্পর্কে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে আটপৌরে সাধারণ জীবনে যান্ত্রিকতা বাসা বাঁধছে। পুরনো প্রচলিত মানবিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চেতনা, নৈতিক আদর্শিক ভাবধারা ক্রমেই মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। এখন হৃদয়বৃত্তিক আকর্ষণের বদলে সবাই বিত্তবৈভবে প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি অর্জনে অতিমাত্রায় আগ্রহী হয়ে উঠেছি। যে কোন উপায়ে সহজ সংক্ষিপ্ত উপায়ে ধনী হওয়ার নেশায় পেয়ে বসেছে সবাইকে। এজন্য নৈতিক অধঃপতন ঘটছে অনেকের। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোন উপায় অবলম্বন করতে বিব্রত হচ্ছে না তারা। দুর্নীতি, অসততা, অনিয়ম, প্রতরাণা, লোভ লালসার কাছে প্রতিনিয়ত আত্মসমর্পণ করতে দ্বিধা সঙ্কোচ করছে না- এক শ্রেণীর মানুষ। মনুষ্যত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে পশুত্বকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে তারা। এভাবেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি অবক্ষয়, অসততা, প্রতারণা, লাম্পট্য ব্যভিচার, অনিয়ম, লোভ আর নির্মমতা। যার ফলে প্রতিদিনই ঘটছে অসদাচরণের বিচিত্র সব ঘটনা। হতাশা, বঞ্চনা, ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে অনেকে ভুল পথে ধাবিত হচ্ছে। মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এভাবেই হাজার হাজার নারী-পুরুষ। মাদকাসক্তি আমাদের গোটা সমাজকে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে।ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইনের নেশায় বুঁদ হয়ে জগত সংসার, বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কত মানুষ তার হিসাব জানা নেই কারও।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন দিন আর বেশী দূরে নেই যখন মানুষের আত্মসম্মানবোধ, মানবিক মূল্যবোধ বলে কিছুই থাকবে না। যৌথ পরিবার ভেঙে এখন নিউক্লিয়ার পরিবার হচ্ছে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিও ভাঙতে ভাঙতে লিভ-ইন্; সিঙ্গল পেরেন্টহুডের দোর গোড়ায়।
আরও কিছু দিন পর মানুষ নিজের সাথেও নিজে থাকতে পারবে না। সহ্য করতে পারবে না নিজেকে। সুইসাইডাল দিন কাল। বোহেমিয়ান হবারও কিছু ডিসিপ্লিন থাকে। নিজের জন্য নিজে যখন হাতে বিষ তুলে নেয় কেউ, জীবন তখন আরও দুরূহ। আশেপাশে দোষ দেবারও কেউ থাকে না।
আমার অফিসের কাছেই দেশ সেরা এবং ঐতিহ্যবাহী একটা স্কুল কাম কলেজের ২০/২৫ জন ছাত্রছাত্রীদের গ্রুপভিত্তিক গাঁজার আসর বসে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। একদল চলে যায়, আর একদল আসে.... কয়েকশো মিটার এলাকা জুড়ে গাঁজার ধোঁয়া আর উৎকট গন্ধ! এরা সবাই না হলেও বেশীরভাগই ধনাঢ্য এবং অভিজাত পরিবারের সন্তান। ওদের মা-বাবা, অবিভাবকেরা হয়তো জানেনা তাদের উচ্ছন্নে যাওয়া সন্তানদের কথা.......
আমার বাড়ির পাশেই একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সকাল থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত সড়কে, ফুটপাতে, বারান্দায় ছাত্রছাত্রীদের বেলেল্লাপনা.... সন্ধ্যেবেলা কড়া ডোজের চোখ; কিছু টিনএজ ছেলে-মেয়েচোখে পড়ে....মায়া হয়, ওরা আমাদেরই সন্তান, ভাই-বোন.....কিভাবে উচ্ছন্নে যাচ্ছে! স্ট্রিট লাইটের নীলচে আলোয় ঝিমাচ্ছে। ওদের চোখের দিকে তাকানো যায়না। মোবাইল স্ক্রীনে চেয়ে থাকা অপলক রাত; চোখের নীচে ডার্ক সার্কল। ফাউন্ডেশন লাগিয়েও ঢাকা পড়েনা ক্লান্তি।
ইচ্ছে করে ওদের কোলে করে স্লিপিং ব্যাগে তুলে বাড়ি নিয়ে আসি। ঘুম পাড়াই...ঘুম ভাংগলে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলবো- 'তোমরা যা করছো তা প্রেম ভালোবাসা নয়। যৌনতারও একটা শৃঙ্খলা আছে, সৌন্দর্য আছে....তোমরা যা করছো তা প্রেমভালবাসা নয়, বিকৃত মানসিকতা। প্রেমকে কখনও জীবনের ওপরে রেখো না। সত্যিকারের প্রেম নিজেই একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন। কেনো, কিসের জন্য এভাবে নিজেদের ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিচ্ছো....'!
মনে অজানা ভয়....
বাড়ি ফিরে সন্তানদের দেখে আস্বস্ত হই.... আমার বাসার দক্ষিণের বারান্দা দিয়ে হাস্নুহেনার গন্ধ ভেসে আসে। ধ্বংসন্মুখ এই প্রজন্মের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই। ফজরের নামাজ আদায় করে ভোরের আকাশে দেখি আধ খাওয়া চাঁদ আর শুকতারা পাশাপাশি শুয়ে আছে- এই দৃশ্যের চাইতে সুন্দর কি আছে?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



