গরীবের ঘোড়া রোগ......
ক্যামেরার প্রতি আমার আগ্রহ বা দূর্বলতা সেই ছেলে বেলা থাকে- যা নিয়ে কয়েক বছর আগে ব্লগে লিখছিলাম... গরীব হলেও "শখের তোলা আশি টাকা"- আমি নিজেই সেই প্রবাদের উদাহরণ। জীবনে কতোগুলো ক্যামেরা কিনেছিলাম এবং আত্মীয় স্বজনরা গিফট দিয়েছেন- সে তালিকাও নেহায়েত কম নয়। ক্যামেরা প্রীতি, ফটোগ্রাফীর শখ আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়েছিলো আমার দুই চাচাদের মাধ্যমে। বয়স ১২ পেরুনোর আগেই আমি Shaheen, Dayna, Zenith, Xerox Band এর কমদামী ৪ টা ক্যামেরার মালিক হয়েছিলাম। তারপর এক এক করে Yashica, Mamiya, Canon, Sony, Panasonic, Olympus, Minolta, Asahi Pentax K1000 ক্যামেরার মালিক হই। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে- আমি ফটোগ্রাফীর আগ্রহ হারিয়ে ক্যামেরা সংগ্রহে মনোযোগী হলাম....... সে আর এক ইতিহাস।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে নিতান্তই শখের বশে ফটোগ্রাফির উপর দুটো ডিপ্লোমা কোর্স করেছিলাম- একটা 'বেগার্টস' এবং অন্যটা 'মোকাম্মেল ফটোগ্রাফী ইনস্টিটিউট' থেকে।
তানভীর মোকাম্মেল একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক।তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০১৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে।

তানভীর মোকাম্মেল ভাই সেন্ট জোসেফ্স স্কুলে আমার অনেক সিনিয়র ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মোকাম্মেল গ্রামীণ এলাকার ভূমিহীন কৃষকদের জন্য বামপন্থী সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ১৫ টি প্রামাণ্যচিত্র এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যাদের মধ্যে কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে।
তার নির্মিত চলচ্চিত্রগু হচ্ছে নদীর নাম মধুমতি, চিত্রা নদীর পারে, লালসালু, লালন, রাবেয়া, এবং জীবনঢুলী। তানভীর মোকাম্মেলের উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্র হলো দ্য গার্মেন্ট গার্ল অব বাংলাদেশ, দ্য আননোওন ব্যার্ড টিয়ারড্রপস অব কর্ণফুলী, রাইডার্স টু সুন্দরবনস, এ টেল অব দ্য যমুনা রিভার, 'দ্য প্রমিসড ল্যান্ড তাজউদ্দীন আহমেদ: অ্যান আনসাং হিরো, দ্য জাপানিজ ওয়াইফ, স্বপ্নভূমি এবং "১৯৭১। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউশন দ্বারা দর্শক ও সমালোচকদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে তার চলচ্চিত্র নদীর নাম মধুমতি এবং চিত্রা নদীর পাড়ে বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের মধ্যে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
মোকাম্মেল কবিতা, ছোটগল্প এবং চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিষয়ে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন। তানভীর মোকাম্মেলের লেখা বই হচ্ছে এ ব্রিফ হিস্টোরি অব ওয়ার্ল্ড সিনেমা, দ্য আর্ট অব সিনেমা, চার্লি চ্যাপলিন: কনকোয়েস্টস বাই এ ট্র্যাম্প, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সিসিফাস অ্যান্ড কোয়েস্ট অব ট্রেডিশন ইন নভেল (সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক একটি কাজ), গ্রান্ডভিগ অ্যান্ড ফোক এডুকেশন (বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার ধারণা বিষয়ক বই), এবং ম্যাক্সিম গোর্কির দ্য লোয়ার ডেফথস নাটকের অনুবাদ। মোকাম্মেল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র কেন্দ্র নামে একটি চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তানভীর মোকাম্মেল ভাই বর্তমান প্রজন্মের ফটোগ্রাফার এবং মিডিয়া জগতের সবার পরিচিত হলেও বেগার্টের মনজুর আলম বেগ স্যারের সাথে অনেকেই পরিচিত নন। মনজুর আলম বেগ হলেন বাংলাদেশে আলোকচিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ, যিনি এম এ বেগ বা বেগ স্যার এবং আলোকচিত্রাচার্য হিসাবেই বেশি পরিচিত। ততকালীন পূর্বপাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফটোগ্রাফি শিক্ষা কেন্দ্র “বেগ আর্ট ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফী” (১৯৬০) এবং “বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি”-র (১৯৭৬) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম বেগ। জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৭ সালে তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। আলোকচিত্রাচার্য মনজুর আলম ১৯৩১ সালে ১ অক্টোবর রাজশাহীর নবাবগঞ্জের শ্যামপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। এবং ২৬ জুলাই ১৯৯৮ সালে মৃত্যু বরণ করেন। বেগ স্যারের কাছে যখন ফটোগ্রাফী কোর্স করেছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন- "ফটোগ্রাফি হলো গরীবের হাতী পোষা শখ"!

মনজুর আলম ১৯৪৭ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৯ সালে এইচ.এস.সি. অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন । অতঃপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে আলোকচিত্র বিষয়ে ‘পাকিস্তান এয়ার ফোর্স টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে’ প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এর কিছুকাল পর, ১৯৫৭ সালে করাচীতে ইউনেস্কোর অধীনে মাইক্রোফিল্ম বিষয়ে প্রশিক্ষন লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৬৮ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত বৃত্তি লাভ করেন এবং তার সাহায্যে তিনি ইংল্যান্ডে “হ্যাটফিল্ড কলেজ অফ টেকনোলজীর ন্যাশনাল রিপোগ্রাফীক সেন্টার ফর ডকুমেন্টেশন”-এ রিপোগ্রাফী বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। একই সালে তিনি লন্ডনের কোডাক ফটোগ্রাফীক স্কুল থেকে রঙ্গিন ফটোগ্রাফী বিষয়ক ট্রেনিং লাভ করেন।
১৯৭৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডের “ব্রিটিশ ইন্সটিটিউট অফ ইনকরপোরেটেড ফটোগ্রাফারস” (IIP) থেকে ফটোগ্রাফী বিষয়ক কোর্সে ডিপ্লোমা করেন। ১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডের ইন্সটিটিউট অফ রিপোগ্রাফিক টেকনোলজীতে পেশাদারী যোগ্যতা ‘AMIRT’- এর জন্য আবেদনমূলক দরখাস্ত দেন তিনি; কিন্তু মনজুর আলমকে একধাপ উপরের ‘MIRT’ যোগ্যতাটি দেওয়া হয়।
মনজুর আলম বেগ ১৯৪৯- ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ফটোগ্রাফী বিষয়ে পাকিস্তান এয়ারফোর্সে চাকুরিরত ছিলেন; সেখানে তিনি স্থির, মুভী এবং এরিয়াল ফটোগ্রাফী বিষয় নিয়ে এয়ার ফোর্সের করাচি, লাহোর, পেশোয়ার, কোয়েটা ইত্যাদি বিভিন্ন স্টেশনে কাজ করেন। ১৯৫৫-১৯৫৭ সালে বেগ স্যার ঢাকা এবং ময়মনসিংহে ‘ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সারভিস’ (USIS) অফিসে মোশন পিকচার্স বিভাগে চাকুরি করেন। তিনি ১৯৫৭-১৯৬০ সাল পর্যন্ত করাচিতে CSIR এর অধীনে প্যান্সডকে চাকুরি করেন । কয়েক বছর পর ১৯৬৩ সালে ঢাকায় সায়েন্স ল্যাবরেটরীতে প্যান্সডকের শাখা অফিস খোলা হলে মনজুর আলম সিনিয়ার রিপোগ্রাফিক অফিসার পদে যোগ দেন। ১৯৮৮ সালে এম এ বেগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের অধীনস্থ ব্যান্সডক থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ছবির Nikon FE ক্যামেরা আমি কিনেছিলাম ১৯৮০ সনে। সেই সময় সেমি প্রফেশনাল ক্যামেরার মধ্যে এই ক্যামেরাটা বেশ বিলাসী এবং উন্নত মানের ছিলো। এই ক্যামেরাটি কিনে মঞ্জুর আলম বেগ স্যারকে দেখাতে নিয়ে যাই। ফটোগ্রাফীর জন্য তিনি এই ক্যামেরার উপযোগীতা সম্পর্কে অনেক পজেটিভ কথা বলেছিলেন। ফিল্ম ক্যামেরায় ছবি তোলায় ক্যামেরা এবং ছবি তোলার জন্য বেসিক কিছু জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। আবার ভালো মানসম্পন্ন সাদাকালো ছবি তোলার জন্য অনেক বেশী টেকনিক্যাল জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হয়। অটো এবং ডিজিটাল ক্যামেরায় রঙিন ছবির জন্য ততটা জ্ঞান দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অপরিহার্য নয়। ১৯৯৮ সনে ডিজিটাল ক্যামেরা কেনার পর ফিল্ম ক্যামেরা শোকেসে স্থান করে নেয়। ক্যামেরাটা এখনো ভালো আছে তবে বক্সটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারপরও বক্সের এক পাসে ক্যামেরা সম্পর্কে নিম্নোক্ত ডেসক্রিপশন লেখা উদ্ধার করতে পেরেছিঃ-



Nikon FE is an advanced semi-professional level, interchangeable lens, 35 mm film, single-lens reflex camera. It was manufactured by Nikon in Japan from 1978, and was available new from dealer stock until c..
Flash: ISO standard Hot shoe
Lens mount: Nikon F lens mount
Weight: 590 g (21 oz)
Dimensions: 142 × 57.5 × 89.5 mm
Film advance: manual
Released: 1978
Made in: Japan
আমার শখের ক্যামেরাগুলো উত্তোরাধিকার সূত্রে আমার ছোট ছেলে নিয়েছে। সেও একজন শৌখিন ফটোগ্রাফার....আমার কাছে যা ছিলো যক্ষেরধন, ছোট ছেলের কাছে তার কোনো গুরুত্ব আছে বলে আমার মনে হয়না! কারণ, আমার হাতে কখনো কোনো ক্যামেরা সাধারণ মেন্টেনেন্স এর বাইরে কিছুই করতে হয়নি, সেখানে ছেলের হাতে প্রায় সব ক্যামেরাই নষ্টের চুরান্ত হয়েছে!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



