কোথায় হারিয়ে গেছে মধ্যবিত্তরা......
১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সাল- ২৪ বছর পেরিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে একটা সময়ে এমনও গেছে যে- অনেক মানুষ না খেয়ে মারা গেছে এবং কোটি লোক না খেয়ে মরার উপক্রম হয়েছিল। একই সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা কর্মী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী শতভাগ অসৎপথে অঢেল স্থাবর অস্থাবর সম্পদের মালিক বনে গিয়েছিল। আমেরিকা থেকে আসা মাইলো নামে এক প্রকার ঘাসের বীজের মত দেখতে শস্যের খিচুড়ি আর ঘোড়ার খাদ্য ভুট্টার তৈরী ছাতু' খেয়ে জীবন রক্ষা করতে প্রাণন্তকর চেষ্টা করেছে। বাজারে চিনি পাওয়া যেত না, লবণ পাওয়া যেতোনা কিন্তু সেই ক্ষমতাবানদের গুদামঘরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ ছিলো। একজন গ্রাজুয়েট স্কুল শিক্ষকের বেতন ছিল মাসে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। শিক্ষিত যুব সমাজের সামনে চাকরির বাজার মোটেও ভাল ছিল না। তার উপর প্রতিটি পরিবারের সন্তান সংখ্যা ছিল ৫-৬ কিম্বা ততোধিক।
শহরের রাস্তাগুলিতে সন্ধ্যার পরে দূরে দূরে একটা করে ১০০ ওয়াটের বাল্ব টিম টিম করে জ্বলত। তাই সন্ধ্যার পরে শহরটা কেমন ভূতুরে হয়ে প'ড়ত। বেশির ভাগ মেয়েরাই স্কুলে যাতায়াতের সময়টুকু ছাড়া বাইরে থাকতো না নিরাপত্তার অভাবে। তারা স্কুলের গন্ডি পার করে ১৫/১৬ বছর বয়স হলেই শাড়ি পরা শুরু করে দিয়ে গৃহমধ্যে আবদ্ধ হয়ে যেতো। যারা কলেজে পড়াশোনা করতো তারাও সন্ধ্যা হলেই গৃহবন্দী, কারণ তখনও টিউশন পড়ার জন্য কোচিংএ যাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়নি। তাই প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও ছেলে-মেয়েরা প্রেম করার সুযোগ পেত না।
পাড়ার কোন ছেলে আর মেয়েকে আলাদা ভাবে কথা বলতে দেখলে, সেটা পুরো এলাকায় একটা খবর হিসেবে ঢিঢি পড়ে যেত। তবে বিকেলের দিকে ছেলেরা একটু বেশি সময় বাইরে থাকার অনুমতি পেত। কোন বাড়িতে বোনেরা স্কুল ছুটির পর সোজা বাড়ি না ফিরলে হৈ চৈ পড়ে যেত। ছেলেরা স্কুল করে বাড়ি ফিরে আবার বেরোতে পারতো, তবে ৬টা সাড়ে ৬টার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে পিঠে একটা হ্যাঙ্গার কিম্বা হাত পাখার ডাটি ভাঙ্গা বরাদ্দ থাকত।
তখন ছোটদের, সে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক- বাড়ি ফিরে তাকে সংসারের টুকটাক কাজ করতে হ'ত। যেমন হ্যারিকেন মুছে তেল ভরে সেগুলো জ্বালানো, বিছানা পাতা, ছোট ভাইবোনকে কোলে নেওয়া- এইধরনের সব কাজ! মায়েরা সারাজীবন নীরবে সংসারের জন্য খেটে যেতেন। চুলায় কাঠ জ্বেলে ধোঁয়ায় নাস্তানাবুদ হয়ে ৮/১০ জন লোকের রান্না, বাড়ির সবার জামা কাপড় কাচা, ছেলে মেয়েদের ছেড়া জামা-প্যান্ট সেলাই করা এইসব। নিম্নবিত্ত পরিবারের বাচ্চাদের জ্বরজারি জন্য কবিরাজ, হোমিওপ্যাথিই ছিলো ভরসা। পথ্য বলতে সাগুদানা কিম্বা পালো নামক এক ধরনের খাদ্য। বিত্তবানদের জন্য হরলিক্স, স্যুপ.....
মায়েদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু ছিল না। তবে দশ বারো বছর বয়স থেকে মেয়েরা এসব কাজে মাকে সর্বদা সাহায্য করতো। একই সংসারে ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে বিভেদ খুব প্রকট ছিল। সবচেয়ে দুঃখের কথা বাড়ির মায়েরা নিজে একজন মেয়ে হয়েও এই ব্যাপারে মুখ্য ভুমিকা নিতেন। সব সময়ে মেয়েদেরকে মনে করিয়ে দিতেন, "তুমি মেয়ে হয়ে জন্মেছো, ভাইর মত তোমার কিরকেট খেলা, বল খেলা শোভা পায় না।" মেয়েরা বড়োজোর বাড়ির আংগিনায় কুতকুত খেলতো কিম্বা লুডু।
প্রতি বছরই আমরা আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতাম। আমাদের গ্রাম হিন্দুঅধ্যুষিত এলাকা। হিন্দু গৃহবধূররা সাধারণত বছরে দু'একবার স্বামীর পিছনে পিছনে পায়ে হেঁটে পাড়ার পুজো দেখতে যাওয়া আর দুমাসে তিন মাসে একবার স্বামীর সঙ্গে রিক্সায় চড়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া, ব্যাস এই ছিল মা-দের জীবনের একমাত্র বিনোদন। আমার এখনো মনে আছে- হিন্দু গৃহবধূরা তাদের স্বামীর সাথে যখন বাপের বাড়ি যেতেন তখন তাদের কোলে ছোট বাচ্চা ছাড়াও টিনের তৈরী ফুল আঁকা বাক্সটাও হাতে নিতেন আর জামাই বাবাজী ধূতির একটা অংশ হাতে নিয়ে স্ত্রী সন্তান এবং লাগেজ স্ত্রীও হাতে দিয়ে সামনে আয়েসি ভংগিতে হেঁটে যেতেন।
অন্যদিকে খোদ ঢাকা শহরেও মুসলিম পরিবারের স্ত্রীরা রিকশায় শাড়ি পেচিয়ে ঢেকে বেড়াতে যেতেন। তবে সিনেমা দেখার সৌভাগ্য খুব একটা পেতেন না। সেইযুগে সব সংসারে বাবা-রা ছিলেন সর্বেসর্বা। একে পুরুষ মানুষ, তার উপর সংসারের একমাত্র উপার্জনশীল মাথা বলে কথা, তাই পান থেকে চুন খসলেই হুলুস্থুল কান্ড বাধাতেন। তখন বেশিরভাগ বাড়ির কর্তারা হাসি বা রং তামাসা কাকে বলে জানতেন না এবং অনেকটা হিটলারী কায়দায় সংসার চালাতেন।
অফিস থেকে ফিরে আসেপাশের চার পাঁচটা বাড়ির বাবা/চাচারা তাদের সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বা তাস খেলতে বসতেন পাড়ার কোন একটা ঘরে। বেশিরভাগ সময়ে ওদের আলোচনার বিষয় থাকত ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিম্বা বাজার দর.....
তবে একটা জিনিস তখন একদম পাওয়া যেত না, সেটা হচ্ছে মোটর বাইক, গোটা পাড়াতে দু একজনের মোটর বাইক পাওয়া যেত। তবে তখন সাইকেলের প্রচলন ছিল ঘরে ঘরে। গোটা পাড়ার সবার বাড়িতে টেলিভিশন ও টেলিফোন ছিলনা। একমাত্র কোন বড় ডাক্তার, উচ্চপদস্থ অফিসারের বাড়ি এবং দু একজন ব্যবসায়ীর বাড়িতে টেলিফোন থাকতো। পাড়ায় কোন বিখ্যাত ডাক্তার বা বড় ব্যবসায়ীর বাড়িতে ভক্সওয়াগন, মরিস মাইনর কিম্বা ফিয়াট গাড়ি থাকতো। তখন সাদা আর কালো রং এর গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো রঙের গাড়ি খুব একটা দেখতে পাওয়া যেত না। পাড়ার এলএমএফ ডাক্তার বাবু সাইকেলে চেপে রোগী দেখতে বেরোতেন, সব পাড়ায় এমবিবিএস ডাক্তার পাওয়া যেত না।
সে যাই হোক- দিন বদলে গিয়েছে। এখন ঢাকার একটা কানা গলিতেও ১০/১২ তলা অত্যাধুনিক ৩/৪ বেডের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট বাড়ি। ৫/৬ সন্তানের যায়গায় ১/২ সন্তান (তারাও আবার প্রবাসী), বাবার মাসে ১৫০ টাকা আয় থেকে নিজের মাসে লাখ লাখ টাকার ফিক্সড ইনকাম। একটা ভাঙ্গা রেডিও-র যায়গায় দুটো ৪২"/৫৬" এলইডি টি ভি, একটা ভাঙ্গা সাইকেলের জায়গায় টয়োটা প্রিমিউ বা পাজেরো জিপ। তবু সেই সরু গলির ঝরঝরে বাড়ির একজনকে কবে যে কোথায় সবাই হারিয়ে ফেলেছে সবাই, অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই তাকে কেউ খুজে পাচ্ছে না, তার নাম ছিল 'শান্তি'!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:১৫